সংখ্যার সৌন্দর্য আলোচনা করতে গেলে আমাকে এমন আরো হাজারখানেক লেখা তোমাদের সামনে তুলে ধরতে হবে যা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে, সৌন্দর্য উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে আজকে তোমাকে একটু ধারনা দিবো। জটিল সংখ্যা নিয়ে সজ্জিত সংখ্যাতত্ত্বের মোটামুটি আমাদের জানা পরিপার্শ্বের সকল কিছু নিয়েই আমার একটা লেখা আগামী কিছুদিনের মধ্যেই তোমরা প্রথম আলো গণিত ইশকুলে পেয়ে যাবে যাতে। সেখান থেকেই আজকের লেখাটা।
সংখ্যা জগতের নিমিখ পানে বিচরণ করে অমূলদ সংখ্যা। তারই উদাহরণ দিতে গেলে তোমার সামনে $\sqrt{2}, \sqrt{3}, \sqrt{5}, \pi(3.1415…), e(2.7182818…)$ চলে আসবে। আজকে আমাদের আলোচনার মূলত অমূলদ সংখ্যা $e$-কে নিয়েই। দশমিকের পরে 50 ঘর পর্যন্ত $e$ এর মান, $e=2.71821812845904523536028747135266249775724709369995…$।
1618 সালে জন নেপিয়ার সাহেব যখন লগারিদম নিয়ে মত্ত, সে সময় তার প্রকাশিত কিছু ফাংশনের তালিকায় প্রথম দেখা মেলে $e$-এর। একে সেই হিসাবে নেপিয়ার’স কনস্ট্যান্ট বলাও চলে। তবে, $e$-কে ধ্রুবক হিসাবে প্রথম আবিষ্কার করেন জ্যাকব বার্নোলি। তিনি চক্রবৃদ্ধি মুনাফা নিয়ে কাজ করতে যেয়ে $e$-কে ধ্রুবক হিসাবে নিয়ে সূত্র প্রদান করেন। চক্রবৃদ্ধি মুনাফার সূত্রে $e$-এর ব্যবহার নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে। বিষয়টা একটু বিস্তারিত বলি। 1683 সালে জ্যাকব বার্নোলি একটা সমস্যা সমাধান করতে যেয়ে এই ধ্রুবক আবিষ্কার করেন। সমস্যাটি হলো,
An account starts with \$1.00 and pays 100 percent interest per year. If the interest is credited once, at the end of the year, the value of the account at year-end will be \$2.00. What happens if the interest is computed and credited more frequently during the year?
একটা চিন্তা করো। কোনো ব্যাংকে বার্ষিক মুনাফার হার 100% এবং তুমি আসল হিসাবে 100 টাকা জমা দিলে। তাহলে বছর শেষে তোমার ব্যাংকে থাকবে 200 টাকা। এগুলো আমরা অনেক ছোট বেলায় পড়েছি। জ্যাকব বার্নোলি চিন্তা করেছিলেন যদি মুনাফার হার বার্ষিক না হয়ে অর্ধবার্ষিক হতো কিংবা ত্রৈমাসিক হিসাবে মুনাফা প্রদান করতো তাহলে বিশেষ কোনো সুবিধা হতো কিনা সেটা নিয়েই। একটা জিনিস মাথায় রেখো। বছর ঘুরে 100% মুনাফা দেবার বদলে অর্ধবার্ষিক হলে মুনাফার হার 50% হবে কিংবা ত্রৈমাসিক হলে মুনাফার হার হবে 25%। এটা খুব স্বাভাবিক চিন্তা। সরল মুনাফার ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আসবে না কেননা আসল একই রেখে মুনাফার হার এবং সময় উভয়ই সমানুপাতিক হারে একই রাখা হয়েছে। কিন্তু তুমি যদি একটু বুদ্ধিমান হয়ে থাকো, তাহলে তুমি ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে আসবা না। এবার একটু চিন্তা করো। বছরের শুরুতে 100 টাকা দিয়ে খোলা তোমার স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্টে ত্রৈমাসিক 25% হারে মুনাফা যুক্ত হচ্ছে।
ঠিক 3 মাস পরে তুমি পাচ্ছো $100+(100+25\%) =125$ টাকা, 6 মাসের মাথায় তা হবে $125+(125+25\%) =156.25$ টাকা, 9 মাসের শেষে তুমি $156.25+(156.25+25\%) =195.3125$ টাকার মালিক। আবার বছর শেষে তুমি হবে $195.3125+(195.3125+25\%) =44.140625$ টাকার মালিক। সাধারণ হিসাবে তো তোমার 200 টাকা থাকার কথা। কিন্তু একটু বুদ্ধি খাটায় তুমি 44.140625 টাকা বেশি পেয়ে গিয়েছ। এখানে একটা কথা মনে করিয়ে দেই। সরল মুনাফা আমরা আসল সবসময় ধ্রুবক ধরে নিই। অর্থাৎ মুনাফ পাবার সাথে সাথে তুমি কার্ড সোয়াইপ করে শপিং করে ফেলছো প্রাপ্ত মুনাফার টাকায়। এদিকে চক্রবৃদ্ধি মুনাফায় আমাদের প্রাপ্ত মুনাফাও পরের সাইকেলে আসলের সাথে যুক্ত হয়ে আসল বৃদ্ধি করছে ক্রমান্বয়ে। সেজন্য তুমি বেশি মুনাফা পাবা। এবার যদি ত্রৈমাসিক না হয়ে ধরো ব্যাংক মাসিক মুনাফা দিচ্ছে তোমাকে। তাহলে আরো আরো বেশি টাকা পাবা তুমি। অর্থাৎ, সাইকেল যত ফ্রিকুয়েন্টলি হবে, তোমার মুনাফাও তত বাড়বে। একই সাথে মুনাফার হার কমতে থাকবে কেননা বছর ঘুরে আমাদের প্রাপ্ত মোট মুনাফার হার কিন্তু অপরিবর্তিত রাখতেই হবে। এতসব বিবেচনা করে একটা সূত্র আমরা আনতে পারি।
মনে করো, বছর ঘুরে ব্যাংক তোমাকে মোট 100% মুনাফা দিবে। যদি বার্ষিক মুনাফা হিসাব করো তবে 100% পাবে, যদি অর্ধবার্ষিক হিসাব করো তবে প্রতিবার 50% পাবে, এভাবে। যদি এভাবে চিন্তা করো যে বছরে তোমার n-বার মুনাফা চাই, তবে প্রতিবার আসলের উপরে মুনাফার হার হবে $\frac{100}{n}%$ এটুকু যদি তুমি বুঝে থাকো, তাহলে আমাদের আলোচনা একটু প্রসারিত করার সময় এসেছে।
চক্রবৃদ্ধি মুনাফার একটা সূত্র আমরা ষষ্ঠ/সপ্তম শ্রেণীতে জেনেছিলাম। চক্রবৃদ্ধি মুনাফা সহ আসল, $C=(1+r)^n$। এখানে, $C$=মুনাফা সহ আসল, $P$=মুনাফা যে আসলের উপরে দেওয়া হবে তার পরিমাণ, $r$=শতকরা মুনাফার হার, $n$=এক বছর সময়ে চক্রের পরিমাণ বা সময়। তুমি যদি এই সূত্রটা বুঝতে চাও, খুব সেটা বুঝে ফেলতে পারো। যদি, $n=1$ হয়, তাহলে $C=P(1+r)=P+(P\times r)$ । এখানে, $P$ হলো ব্যাংকে জমা রাখা টাকা এবং $P\times r$ হলো ব্যাংক কতৃক তোমাকে প্রদত্ত মুনাফা। প্রথম মুনাফা পাবার পরে তোমার আসল দাড়াবে $P(1+ r)$, দ্বিতীয় চক্রে মুনাফার হার $r\%$ হলে, দ্বিতীয় চক্র শেষে তোমার ব্যাংকে থাকবে
\begin{align} P’+(P’\times r) &= P(1+r)+P\times r\times (1+r) \\ &= P(1+r) \times (1+r) \\ &= P(1+r)^2 \end{align}
এভাবে বাৎসরিক $n$ বার মুনাফা দেওয়া হলে বছর ঘুরে তোমার মুনাফা সহ আসলের পরিমাণ দাঁড়াবে $C=P(1+r)^n$ টাকা। ধরো তোমাকে সরাসরি মুনাফার পরিমাণ দেওয়া নেই, বলা হয়েছে বাৎসরিক মোট মুনাফার হার $100\%$, তাহলে বলা যায়, $r\% = \frac{100}{n}\%$, এখানে বছরে $n$ বার মুনাফা নিবো বিধায় $n$ দিয়ে ভাগ করা হয়েছে। তাহলে একটু আগে দেওয়া মুনাফা সহ আসলের সূত্রকে লেখা যায়, $C=P(1+100/n)^n$ টাকা। যদি $n$-নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করি অর্থাৎ $n$-কে অসীম বিবেচনা করি, তাহলে লিমিটের সহায়তা প্রয়োজন হবে আমাদের। $n \to \infty$দিয়ে বুঝায়, খুবই ক্ষুদ্র সময়ের ব্যবধানে ব্যাংক আমাদের মুনাফা দিবে কেননা এক বছরকালীন সময়কে আমরা অসীম ভাগে ভাগ করে এক চক্রের সময়কাল ধরে নিয়েছি। একে লেখা যায়, $\displaystyle e=\lim_{x \to \infty} (1+1/n)^\infty$। ক্যালকুলাস নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলে প্রথমেই এই লিমিট নিয়ে তোমাকে বিশদ জানতে হবে। সেখানে, উপরের লিমিট ফাংশনের মান যে $e$, এটা তোমার অনেক জায়গায় প্রয়োগ করতে হবে।
টেইলর সিরিজের সাহায্যে $e^x$ বা $e$-ভিত্তিক ফাংশন (Exponential Function with Base $e$)-কে প্রকাশ করা হয়,
\begin{align}
e^x = \sum_{n=0}^\infty \frac{x^n}{n!} &=
\frac{x^0}{0!} + \frac{x^1}{1!} + \frac{x^2}{2!} + \frac{x^3}{3!} + \cdots \\
&= 1+x+ \frac{x^2}{2!} + \frac{x^3}{3!} + \cdots
\end{align}
এখানে, ধরে নিলে $e$-এর মান সম্বলিত একটা অসীম সিরিজ পেয়ে যাবে। সিরিজটা হলো,
\begin{align}
e = \sum_{n=0}^\infty \frac{1}{n!} &=
\frac{1}{0!} + \frac{1}{1!} + \frac{1}{2!} + \frac{1}{3!} + \cdots \\
&= 1 + \frac{1}{1} + \frac{1}{2\cdot 1} + \frac{1}{3 \cdot 2\cdot 1} + \cdots
\end{align}
$e$-নিয়ে আরো মজার মজার কিছু তথ্য তোমাদের জানিয়ে রাখি এই ফাঁকে। অন্তরীকরণ এবং যোগজীকরণ করার সময় $e$ ভিত্তিক সুচকীয় ফাংশনের কিছু বিশেষ আচরণ লক্ষ করবে। যেমন:
- $\frac{d}{dt}e^t = e^t$
- $\frac{d}{dt}\log_e t = \frac{1}{t}$
- $\displaystyle \int_1^e \frac{1}{t} dt = 1$
এছাড়াও $e$ হলো একমাত্র বাস্তব সংখ্যা যার জন্য, $(1+1/n)^n < e < (1+1/n)^{n+1}$ এবং $e^x \ge x+1$ অসমতাগুলো সংজ্ঞায়িত হয়।
গণিতে $0, 1, \pi, i$ এর ন্যায় $e$ এর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে এবং এই বিশেষ 5 টা প্রতীক একসাথে ইউলারের বিখ্যাত সূত্রে দেখা যায় যাকে Euler’s Identity বলা হয়। আগেই বলেছি $e$ হলো একটা অমূলদ সংখ্যা, ফলে এর মনের কোনো শেষ নেই। মজার বিষয় হলো, এরপরে থেকে e-ভিত্তিক ফাংশনগুলো আরো বিস্তৃতি লাভ করে জটিল সংখ্যা দাড়াও সংজ্ঞায়িত হয়। $\sin(x)$ এবং $\cos(x)$ এর জন্য টেইলর সিরিজের আলোকে অয়লারের সূত্রটা নির্ণয় করাও সহজ হয়ে যায়। অর্থাৎ, $e^{i\pi} = \cos(x) + i \sin(x)$।
$x = \pi$ লেখা হলেই আমরা পাই , অয়লারের আইডেন্টিটি ইকুয়েশন বলা হয় যা বিশ্বের সবথেকে সুন্দর সূত্রের খেতাবে ভূষিত হয়েছে। কারণ এতে একই সাথে 0, 1, $\pi$, $i$ এবং $e$ এর মধ্যে একটা সম্পর্ক ডিফাইন করা হয়েছে। এখানে যদি আমরা হালকা একটু লগারিদম এপ্লাই করি তবে পাওয়া যাবে, $$\ln(e^{i\pi}) = \ln(-1) \implies i\pi = \ln(-1)$$
$e^{i\pi} = \cos{x} + i \sin{x}$ থেকে আমরা আরেকটা জিনিস বলতে পারি, $(\cos{x} + i \sin{x})^n = (e^{i\pi})^n = e^{inx}$
আবার $\sin{x} = \frac{e^{ix} – e^{-ix}}{2i}$ এবং $\cos{x} = \frac{e^{ix} + e^{-ix}}{2}$ ।
এখনো কিন্তু $e$-কে ‘$e$’ বলা হয়নি, একটা মোটামুটি বিশেষ সংখ্যা হিসেবে বিরাজমান $e$-নিয়ে কাজ করা শেষ হলে 1690 এবং 1691 সালের দিকে গটফ্রিড লিবনিজ এবং ক্রিশ্চিয়ান হাইজেনসের চিঠিপত্রে এই ধ্রুবককে ‘$b$’ অক্ষরের মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীতে 1731 সালের 25 নভেম্বর গোল্ডবাখকে লেখা ইউলারের একটি চিঠিতে প্রাকৃতিক লগারিদমের ভিত্তি হিসাবে ‘$e$’ এর ব্যবহার করতে দেখা যায়। 1727 অথবা 1728 সালের দিকে ইউলার তার একটি অপ্রকাশিত পেপারে এর ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে 1736 সালের দিকে ইউলার তার মেকানিকা-তে আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘$e$’ ব্যবহার করেন। যদিও পরবর্তী বছরগুলোতে এই ধ্রুবককে কিছু গবেষক ‘$c$’ দিয়েই প্রকাশ করেন, তবে অবশেষে ‘e’-কেই নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।
কন্টিনিউড ফ্রাকশনের সাহায্যে $e$-কে লেখা যায়,
সহজ আরেকটা কন্টিনিউড ফ্রাকশন হলো
$e$-কে অমূলদ প্রমান করতে অয়লার সাহেব এই কন্টিনিউড ফ্রাকশনগুলো নিয়ে আসেন। এছাড়াও আরো অনেক এমন অসীম ধারা, ফ্রাকশন, অসীম গুণফল আছে, যেগুলো থেকে $e$-এর মান ডিফাইন করা হয়েছে। লিন্ডেম্যান-ওয়েয়ারস্ট্রাস থিওরেমের আলোকে দেখানো হয়েছে এটা তুরীয় অমূলদ সংখ্যা, একে কোনো বহুপদী সমীকরণের মূল হিসাবে প্রকাশ করা যায়না। 1873 সালে চার্লস হার্মাইট কর্তৃক প্রদত্ত একটি প্রমাণের আলোকে বলা যায়, লিউভিল সংখ্যার (লিউভিল সংখ্যা হলো একটি বাস্তব সংখ্যা $x$, যা $0 < |x – p/q| < 1/q^n$, এখানে $q>1$ এবং এতে এক জোড়া পূর্ণসংখ্যা বিদ্যমান থাকবে) সাথে তুলনা করলে বলা যায়, e-হলো এমন প্রথম তুরীয় সংখ্যা, যা কিনা কোনো বিশেষ কারণে গঠিত হয়নি।
আলোচনা তবে এখানেই রাখছি। গণিতের উৎসবের মৌসুমে তোমাদের সকলের জন্য থাকলো অনেক অনেক শুভকামনা।
[ বি. দ্র. লেখাটি পূর্বে প্রথম আলোর গণিত ইশকুলে প্রকাশিত হয়েছে। ]
তথ্যসূত্রঃ
Leave a Reply