বিন্দুর শরীর অপ্রকৃতস্থের মতো কাঁপছে, তাকে বদ্ধ উন্মাদের মতো দেখাচ্ছে। সে এক রহস্যের জালে আটকে গেছে। দুই পাশের দেয়াল আস্তে আস্তে তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। বিন্দু বুঝতে পারছে সে সময়ের প্রান্তে এসে গেছে। তার আর সময় নেই, সে মারা যাচ্ছে! কিন্তু সে বাঁচতে চায়। তার স্বপ্ন আর জীবনটাকে আরও ভালো করে অনুভব করতে চায়। দেয়ালগুলো ক্রমেই এগিয়ে আসছে, হঠাৎ দেয়ালগুলোর গতি বেড়ে গেল। তারা কী বিন্দুর ভাবনা বুঝতে পারছে?
দেয়ালগুলো বিন্দুর চোখের সামনে এসে গেছে। বিন্দুর চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। কিন্তু সেই অশ্রু পরিপূর্ণভাবে নিজের বিষাদ প্রকাশ করতে পারল না। বিন্দু ব্যাকুল হয়ে চিৎকার করছে, আর দেয়ালগুলো নিঃমিষেই তাকে শেষ করে দিল!
২.
উপরের ঘটনার মতো দৃশ্য প্রায়ই রহস্যময় গল্প কিংবা সিনেমায় দেখা যায়। বিভিন্ন মানুষকে চারপাশের দেয়াল চাপ দিয়ে মেরে ফেলে। এই মৃত্যু ঘটে যার কারণে সেটা হলো “চাপ”। এই চাপ থেকেই জন্ম সম্ভব সুন্দর, কখনো বিভৎস কিছু আবিষ্কারের! যার একটি হলো “হাইড্রোলিক প্রেস” !
পদার্থবিজ্ঞান চাপকে একটু ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করে। উপরের উদাহরণ থেকে আমরা ধারণা নিতে পারি। দেয়ালগুলো বিন্দুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার কারণে একসময় একদম তার গায়ে গায়ে মিশে যায়। কিন্তু দেয়াল থেমে যায় নি, সেগুলো এগিয়ে গিয়েছে। যার কারণে বিন্দুর শরীরে একটা তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব হয়। পরে সেগুলো আরও এগিয়ে আসে, যার পরিণতি কি সেটা ভালো করেই বুঝা যায়! এই যে দেয়ালগুলো এগিয়ে এসে তার শরীরে ব্যথা দিচ্ছে এর কারণ হলো দেয়াল তার শরীরে “বল” প্রয়োগ করছে।
এখানে তার শরীরে বল প্রয়োগ করার কারণে একটা ❝চাপ” তৈরি হয়েছে। তাহলে চাপ হলো একটা এরিয়া বা সুন্দর করে বললে ক্ষেত্রফলে বল প্রয়োগ করার কারণে চাপ তৈরি হয়। কিন্তু চাপ বেশি না কম সেটা মাপার জন্য একক ক্ষেত্রফলে কতটুকু বল অনুভব হচ্ছে সেটা বের করতে হবে।
চাপ যেহেতু আমরা পরিমাপ করব, তাই চাপ হলো –
❝একক ক্ষেত্রফলে যতটুকু বল প্রয়োগ করা হয়েছে❞
যদি ক্ষেত্রফল A (area) হয় আর সেখানে F বল প্রয়োগ করা হয়।
তাহলে চাপ হলো,
একক ক্ষেত্রে পাওয়া বল = F/A
এটা হলো চাপের গাণিতিক রূপ বা ভৌতিক ভাষায় “সূত্র”। এই চাপের একককে বলা হয় প্যাসকেল।
৩.
এখন ফিরত যাই সেই ভৌতিক ঘরে, যেখানে আটকে পড়েছিল বিন্দু। চিন্তা কর, সেখানে বিন্দুর জায়গায় যদি কোনো তরল বা বায়বীয় পদার্থ থাকত তাহলে কি হতো? মানে কোনো আবদ্ধ জায়গায় তরল বা বায়বীয় পদার্থকে চাপ দিলে কি হয়? চিন্তা করো একটা কাচের পাত্র আমি পানি রেখেছি, তারপর পিস্টন দিয়ে বল প্রয়োগ করছি। যার কারণে পানিগুলো চাপ অনুভব করবে। এভাবে চাপ দিতে দিতে একসময় দেখব কাচের পাত্রটাই ভেঙ্গে গেছে! কি অদ-ভূত! চাপ দিলাম পানিতে ভেঙে গেল পাত্র?
এই বিষয়টা সম্পর্কে প্রথম ধারণা করেন ব্লেইস প্যাসকেল। আর তার এই ধারণাটাই Pascal’s Law নামে পরিচিত। তার মতামতের শাব্দিক প্রয়োগে না গিয়ে ধারণাটা বলি।
তিনি বলেছেন একটা আবদ্ধ পাত্রে তরল বা গ্যাসীয় পদার্থকে চাপ দিলে চাপটা সব জায়গায় সমানভাবে অনুভূত হবে এবং সেই পদার্থ পাত্রের গায়ে লম্বভাবে কাজ করবে বা লম্বভাবে চাপ দিবে।
এই জন্য কাচের পাত্রে পানি নিয়ে চাপ দিলে সেটা কাচের পাত্রে অনুভব হয় এবং পাত্রটি ভেঙে যায়! তাই চাপ ঐ পদার্থকে দিলেও তার প্রভাব পাত্রের উপর পড়ে।
এই যে প্যাসকেলের এই কথাটা, একটা আবদ্ধপাত্রে তরল বা বায়বীয় পদার্থে বাহিরে থেকে চাপ দিলে তা সমানভাবে সঞ্চালিত হয়ে পাত্রের সংলগ্ন গায়ে লম্বভাবে কাজ করে। এটা ব্যবহার করেই হাইড্রলিক প্রেস বুঝা যায়।
৪.
এতোদিন আমরা বিভিন্ন গণিত, থিওরি দেখে এসেছি হাইড্রোলিক প্রেসে সেই সব অনুভব করাও যায়!
হাইড্রোলিক প্রেসের সিস্টেমটা একটু বুঝা যাক, একটা ত্রিমাত্রিক কোণকের ভূমি থাকে গোল আর মাথাটা থাকে তীক্ষ্ণ বা চোখা। এখন যদি কোণকে মাথার দিক থেকে কেটে ফেলি তাহলে মাথার দিকে থাকবে ছোট বৃত্ত আর ভূমিতে থাকবে বড় বৃত্ত। এখন ভূমির বৃত্তটাকে একটা কিছুদিয়ে ঢেকে দিলে হয়ে যাবে আমাদের আবদ্ধ পাত্র। আগেই বলেছি, এই ব্যবস্থা কাজ করে প্যাসকেলের দেয়া সূত্র মেনে। তাই আমাদের একটা আবদ্ধ পাত্র লাগবে যার একপ্রান্তের ক্ষেত্রফল বড়, অপরপ্রান্তে ছোট!
আমরা সাধারণত হাইড্রোলিক প্রেসের সাথে পরিচিত। আমাদের বইয়ে একটা দৃশ্য আছে, দুইটা সিলিন্ডার আকৃতির পাত্র নল দিয়ে যুক্ত। একটা বাচ্চা ছোট সিলিন্ডারে চাপ দিয়ে বড় সিলিন্ডারের মুখে বসে থাকা একটা স্বাস্থ্যবান লোককে উঠিয়ে ফেলেছে। এখানেও মূলত ঐ সিস্টেমটা খেটেছে। সিলিন্ডার দুইটা পানিপূর্ণ আর ছোটটার ক্ষেত্রফল, বড়টার ক্ষেত্রফলের চেয়ে ছোট।
আমরা আমাদের ঐ কোণকের ফ্রাস্টাম মানে মাথা কাটা কোণকের সিস্টেমে ফেরত আসি। মনে করো, আমি ঐ পাত্রটাকে পানি দিয়ে পূর্ণ করলাম। তারপর ছোট ক্ষেত্রফলের মাথায় চাপ দিলাম। কি হবে বলো তো?
প্যাসকেল বলেছেন, আবদ্ধপাত্রে চাপ দিলে চাপ সমানভাবে ছড়াবে! তাই ছোট ক্ষেত্রফলে বলপ্রয়োগ করলে যে চাপ পাওয়া যাবে পাত্রে সবজায়গায়ও একই চাপ পাওয়া যাবে! কিন্তু সেটা তো কখনোই সম্ভব নয়! কারণ আমরা জানি চাপ হলো “বল/ক্ষেত্রফল”।
তাহলে আমি যেই বল দিচ্ছি তার জন্য কিভাবে সবজায়গায় সমান চাপ হবে? পাত্রে ক্ষেত্রফল তো ধীরে ধীরে বাড়ছে। যেহেতু বলকে ক্ষেত্রফল দিয়ে ভাগ তাই একই বল (মনে করো যদি আমি ছোট ক্ষেত্রে বল দেই F,) থাকলে এরিয়া বাড়লে তো চাপ কম হওয়ার কথা কারণ
চাপ = বল ÷ ক্ষেত্র।
যদি আমি শুরুতে বল দেই ৫ একক আর এরিয়া হয় ১ একক তাহলে শুরুতে চাপ হবে ৫ একক। আর ফ্রাস্টামের মাঝামাঝি ক্ষেত্রে তো শুরু থেকে ক্ষেত্রফল বেশি। যদি মাঝে ক্ষেত্রফল হয় ২ তাহলে চাপ হবে ২.৫ একক। কারণ আমি তো আর বল প্রয়োগ করি নি। কিন্তু প্যাসকেলের কথা আর আমার ধারণায় মিলছে না! তাহলে কে ঠিক আমি না প্যাসকেল?
আসলে এখানে প্যাসকেলই ঠিক! তরল পদার্থকে (প্রবাহী পদার্থকে) চাপ দিলে এমন অদ্ভুত জিনিস পাওয়া যায়। তাদের আবদ্ধ পাত্রে চাপ দিলে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ফ্রাস্টামে চাপ দিলে ক্ষেত্রফল বাড়ার সাথে সাথে বলটাও বেড়ে যাচ্ছে! তাই চাপ সমান হয়।
যেমন, যদি শুরুতে বল দেই ৫ একক, ক্ষেত্র থাকে ১ একক, তাহলে চাপও ৫ একক। আর শেষে ক্ষেত্র থাকে ৫ একক, তাহলে চাপও থাকবে ৫ একক। মানে শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বল বেড়ে যাবে ২০ একক। দেখ, আমি কিন্তু বল প্রয়োগ করেছি, ৫ একক। আর শেষে তা কিনা হল ২৫ একক! কি অদ্ভুত কাণ্ড!
কিন্তু এই বল কেন বাড়ে? তার কারণ অনুপাত, বল আর ক্ষেত্রফলের অনুপাত। এখান থেকে গণিতকেও ফিল করা যায়! সেটা তো বুঝলাম যে, অনুপাতের মাহত্ম্য এখানে রয়েছে, কিন্তু বল বাড়ছে কিভাবে? এই প্রশ্ন পাঠকের ভাবনার কাছেই থাক! একটা ক্লু দেই, এখানে পরমাণুদের ইতস্তত গতির ব্যাপার আছে!
এভাবে “হাইড্রোলিক প্রেস” ব্যবহার করে শুধু মোটাতাজা মানুষকে উপরে তোলা না, আরও অনেক সুন্দর কাজ করা যায়!
তথ্যসূত্র:
- নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যবই
- https://youtube.com/playlist?list=PLxSt9YDBipm6kLNUHS6UYtfvFLpOS_gq9
Leave a Reply