নিঝুম রাতে কানে ভেসে আসে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ। রাত যত বেশি গভীর হয়, আওয়াজ ততটা প্রকট শোনায়। তবে ঝিঁঝিঁ পোকার একটি খুবই অদ্ভুতরকমের বৈশিষ্ট্য আছে। এই বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে এদের আওয়াজ শুনেই পরিবেশের তাপমাত্রা কত তা বলে ফেলা যায়।
ডলবেয়ারের সূত্র
আমোস এমারসন ডলবেয়ার নামে একজন মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক ছিলেন। তিনি একদিন খুব মন দিয়ে ঝিঁঝিঁ পোঁকার আওয়াজ শুনছিলেন। আপনাদের কাছে ঝিঁঝিঁ পোঁকার আওয়াজ শোনার ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগলেও ডলবেয়ারের কাছে তা অদ্ভুত কিছু ছিল না। তিনি আসলে খুব সুক্ষ্ম একটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন 15 সেকেন্ডে ঝিঁঝিঁ পোকা যতবার ডাক দিচ্ছে তার সাথে 7.52 যোগ করে, যোগফলকে 1.94 দিয়ে ভাগ করলেই ঐ সময়ে পরিবেশের তাপমাত্রা কত তা বের হয়ে যাচ্ছে। বেশ আজব এই সূত্র আবিষ্কার করে ফেললেন ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক পর্যবেক্ষণ করে। তার নামানুসারে এই সূত্রকে ডলবেয়ারের সূত্র বলে।
তিনি দেখলেন গ্রীষ্মকাল আসছে। গ্রীষ্মকাল আসার সাথে সাথে দিনদিন আশেপাশের পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়ছে। পরিবেশের তাপমাত্রা যত বাড়ছে ঝিঁঝিঁ পোকাদের এই আওয়াজ দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। যেমন ধরুন বসন্তকালে তাপমাত্রা কম ছিল। তখন এরা প্রতি 15 সেকেন্ডে যদি 20টি ডাক দিত তাহলে গ্রীষ্মকালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রতি ১৫ সেকেন্ডে ৩০টির মত। ডলবেয়ার ধারণা করলেন তাহলে তাপমাত্রা হ্রাস-বৃদ্ধির সাথে নিশ্চয়ই এই ঝিঁঝিঁ পোঁকার ডাকের সংখ্যার কোনো একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। এর আগেও ইংরেজ কবি জন কিটস (1795 AD – 1821 AD) তার কবিতায় তাপমাত্রা ও ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের এই পর্যবেক্ষণটির ব্যাপারে লিখে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন,
On a lone winter evening, when the frost
Has wrought a silence, from the stove there shrills
The Cricket’s song, in warmth increasing ever,
-by John Keats in On the Grasshopper and Cricket
তাপমাত্রার সাথে পোকার ডাকের সম্পর্ক আদৌ আছে কি না তা জানতে তিনি প্রতি ১৫ সেকেন্ডে একটি ঝিঁঝিঁ পোঁকা কতবার ডাক দেয় সেই তথ্য ও ঐ সময়ে আশেপাশের পরিবেশের তাপমাত্রা কত সেই তথ্য তার নোটবুকে লিখে রাখলেন। তার পর্যবেক্ষণ করা ঝিঁঝিঁ পোকাগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Oecanthus fultoni। এরপর গ্রাফ পেপারের $x$ অক্ষ বরাবর পরিবেশের তাপমাত্রা ($T_c$) এবং $y$ অক্ষ বরাবর প্রতি ১৫ সেকেন্ডে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের পরিমাণ ($N_{15}$) বসিয়ে দিলেন। বিন্দুগুলো যোগ করলে একটি সরলরেখার মতন পেলেন বিজ্ঞানী ডলবেয়ার। এই সরলরেখাটিই বলে দিচ্ছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের সাথে তাপমাত্রার সম্পর্ক।
আপনারা যারা সরলরেখার সমীকরণের ধারণার সাথে পরিচিত তারা খুব সহজেই এই সরলরেখার সমীকরণ বের করতে পারবেন। সরলরেখার সমীকরণ বের করার জন্য সরলরেখার উপরস্থ দুটি বিন্দু লাগে। সরলরেখার উপরস্থ দুটি বিন্দু যদি $(x_1, y_1)$ ও $(x_2, y_2)$ হয় এবং যদি সরলরেখাটি $y$ অক্ষকে $(0,c)$ বিন্দুতে ছেদ করে তাহলে সরলরেখার সমীকরণ হবে
$$y=\frac{y_2-y_1}{x_2-x_2}x+c$$
এখানে আমাদের সরলরেখার উপরের দুইটি এমন বিন্দু হচ্ছে $(15, 21.58)$ ও $(20, 31.28)$। এছাড়াও আমরা দেখতে পাচ্ছি সরলরেখাটি $y$ অক্ষকে $(0, -7.52)$ বিন্দুতে ছেদ করেছে। তাহলে সরলরেখাটির সমীকরণ হবে
$$N_{15} = \left( \frac{31.28-21.58}{20-15} \right ) \times T_c -7.52 $$
$$\Rightarrow N_{15} = 1.94 T_c -7.52$$
$$ \Rightarrow T_c = \frac {N_{15}+7.52}{1.94} $$
ধরুন আপনি কান পেতে বসে বসে শুনলেন যে একটি ঝিঁঝিঁপোকা ১৫ সেকেন্ডে ২৫ বার ডাক দিয়েছে। তাহলে ঐ সময়ের তাপমাত্রা হবে $ \frac{25+7.52}{1.94} = 16.76 ^\circ C $। এভাবে আপনি উপরের সমীকরণ ব্যবহার করে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনে সহজেই আশেপাশের পরিবেশের তাপমাত্রা কত তা বের করে ফেলতে পারেন। বিজ্ঞানী ডলবেয়ার তার সূত্রটি Oecanthus fultoni প্রজাতির ঝিঁঝিঁ পোকার জন্য আবিষ্কার করলেও সাধারণ ঝিঁঝিঁ পোকার ক্ষেত্রেও এই সূত্রটি অনেকাংশেই কার্যকর।
তাপমাত্রাই কি মূল কারণ?
বিজ্ঞানী ডলবেয়ার তার সূত্রে দুইটি চলক ব্যবহার করেছেন। চলক দুইটি হচ্ছে পরিবেশের তাপমাত্রা $(T_c)$ এবং ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের সংখ্যা $(N_{15})$। একটি চলককে বসানো হয়েছে ছক কাগজের এক অক্ষ বরাবর। অন্যচলককে আঁকা হয়েছে ঐ অক্ষের লম্ব অক্ষ বরাবর। প্রশ্ন হচ্ছে এই দুই চলকের মাঝে আসলেই কোনো সম্পর্ক আছে কি না! অন্যভাবে বলতে গেলে পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি আসলেই ঝিঁঝিঁ ডাকের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ কি না তা গাণিতকভাবে জানা প্রয়োজন।
যখন দুইটি চলক পরষ্পর সম্পর্কিত (Correlated) কি না তা জানার প্রয়োজন পড়ে, তখন বিজ্ঞানীরা ঐ দুই সহগের মাঝের পিয়ারসন কোরিলেশন গুণাঙ্ক (Pearson Correlation Coefficient: $r$) নামে একটি রাশির মান বের করে। এই রাশির মান সবসময় ০ থেকে বড় হয় এবং ১ থেকে ছোট বা সমান হয়। এর মান যত বেশি হয় তত বেশি একটি চলকের পরিবর্তন অপর চলককে প্রভাবিত করে বলে ধরে নেওয়া হয়। আমরা যদি উপরের ছক কাগজে আঁকা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের সংখ্যা ও ঐ সময়ের তাপমাত্রার মাঝের পিয়ারসন কোরিলেশন গুণাঙ্ক বের করি তাহলে এর মান দেখা যায় $0.98$। অর্থাৎ এর মান প্রায় ১ এর কাছাকাছি। যেহেতু তাপমাত্রা ও ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের সংখ্যা, এই দুটি চলকের মাঝের পিয়ারসন কোরিলেশন গুণাঙ্কের মান ১ এর অনেক কাছাকাছি, তাই গাণিতিকভাবে বলা যায় আসলেই তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারনে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক পরিবর্তিত হচ্ছে।
ঝিঁঝিঁ ডাকের মূল রহস্য
এর আগের অংশে আমরা পিয়ারসন কোরিলেশন গুণাঙ্ক-এর সাহায্যে দেখেছি যে তাপমাত্রা পরবর্তনের কারণেই মূলত ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের সংখ্যাও পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু পিয়ারসন কোরিলেশন গুণাঙ্ক-এর একটি সমস্যা আছে। যেমন ধরুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি শহরের কিছু তথ্য আমাদের কাছে আছে। ঐ শহরের আইসক্রিমের দোকানে প্রতিদিন কী পরিমাণ আইসক্রিম বিক্রি থেকে আয় আসে তার তথ্য আমাদের কাছে আছে। আবার প্রতিদিন কী পরিমাণ অপরাধ সংঘটিত হয় তার তথ্যও আমাদের কাছে আছে। এখন আমরা যদি ছক কাগজের এক অক্ষ বরাবর কোনো একদিনে আইসক্রিম থেকে পাওয়া মুনাফা আর অন্য অক্ষে ঐ দিনেই সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা গ্রাফ পেপারে বসাই তাহলে নিচের মতো একটি চিত্র পাব। আমরা যদি এই দুই চলক (আইস্ক্রিম থেকে আয় ও সংঘটিত অপরাধ সংখ্যা)-এর মাঝে পিয়ারসন কোরিলেশন গুণাঙ্ক বের করি তাহলে দেখব এর মান $0.23$। অর্থাৎ এদের মাঝে কিছু একটা সম্পর্ক অবশ্যই আছে।
গাণিতিকভাবে বুঝাতে চাইলে বলতে হবে, আইস্ক্রিম যদি বেশি বিক্রি হয় তাহলে অপরাধের সংখ্যা বেড়ে যায়। কিন্তু আপনি নিজেই ভাবুন, এই জিনিসটি কি কোনোভাবে লজিক্যাল? আসলে তা নয়। এখানে তৃতীয় আরেকটি চলকের উপর এই দুইটি বিষয়ই নির্ভর করে। এখান থেকে আমরা একটি জিনিস শিখে রাখব – পিয়ারসন কোরিলেশন গুণাঙ্ক দিয়ে গাণিতিকভাবে দুইটি চলক সম্পর্কিত কি না তা বুঝা যায়! তবে একটি চলকের পরিবর্তনের কারণে আসলেই অন্যটি প্রভাবিত হয় কি না তা বুঝা যায় না। আসলেই কোন চলক কোনটিকে প্রভাবিত করে তা আমাদেরকে বুদ্ধি খাটিয়ে বের করতে হবে।
ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের সাথে তাপমাত্রার একটি গাণিতিক সম্পর্ক আছে তা পিয়ারসন কোরিলেশন গুণাঙ্ক দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবে আমরা মাত্রই দেখলাম বাস্তবেই এই সম্পর্ক থাকে কি না তা সম্পূর্ণরূপে পিয়ারসন কোরিলেশন গুণাঙ্ক দিয়ে যাচাই করা যায় না। তাই এখন আমাদেরকে আরেকটি ফিজিক্যাল ব্যাখ্যা দাঁড় করানো প্রয়োজন।
ঝিঁঝিঁ পোকা একটি শীতল রক্তের প্রাণী। অন্য বহু শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রানীর মতো ঝিঁঝিঁ পোকাও ‘আরহেনিয়াস -এর সমীকরণ’ নামে একটি বিশেষ সমীকরণ অনুসরণ করে। এই সমীকরণটিই নির্ধারণ করে দেয় প্রতি ১৫ সেকেন্ডে কতবার ঝিঁঝিঁ পোকা ডাক দিবে বা একটি পিঁপড়া কত দ্রুত চলাচল করবে ইত্যাদি। এদের এই ডাক তৈরিতে একপ্রকার রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হবে। এই রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে ঝিঁঝিঁ পোকার পেশি সংকুচিত-প্রসারিত হবে এছাড়াও নির্দিষ্ট কোণে বেঁকে যাবে। ঝিঁঝিঁ পোকার পাখার উপরের অংশ বিক্রিয়ার কারণে কাছাকাছি চলে আসে এবং এদের মাঝে আপেক্ষিক ঘর্ষণের সৃষ্টি হয়। এই ঘর্ষণের ফলে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ তৈরি হয়। দেহের দুইটি অঙ্গে ঘর্ষণের মাধ্যমে আওয়াজ তৈরির এ প্রক্রিয়াকে স্ট্রিডুলেশন (Stridulation) বলে। সর্বনিম্ন কী পরিমাণ $(E_a)$ শক্তি ঝিঁঝিঁ পোকার থাকলে এই স্ট্রিডুলেশন কাজ করবে তা নির্ধারণ করে দেয় আরহেনিয়াসের সমীকরণ।
$$k = Ae^{\frac{E_a}{RT}}$$
এখানে $ E_a $হচ্ছে সর্বনিম্ন কী পরিমাণ শক্তি থাকলে বিক্রিয়াটি সংঘটিত হবে। আর $T$ হচ্ছে পরিবেশের তাপমাত্রা। আরহেনিয়াসের সমীকরণ থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি এই সর্বনিম্ন প্রয়োজনীয় শক্তি এবং পরিবেশের তাপমাত্রার মাঝে একটি আপাত সম্পর্ক রয়েছে। আর $E_a$-ই যেহেতু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক তৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে তাই বলা যায় ‘ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের পরিবর্তনের জন্য পরিবেশের তাপমাত্রার পরিবর্তনই দায়ী’।
আরো যা যা দেখতে পারেন
- ঝিঁঝিঁ পোকার ডাটা ও কো-রিলেশন বিষয়ক ডাটার অ্যানালাইসিসের জুপিটার নোটবুকটি পাবেন এখানে
- বিভিন্ন তাপমাত্রার ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের ভিন্নতা শুনতে এই অডিওফাইলগুলো দেখতে পারেন এখানে
- ঝিঁঝিঁ পোকা কীভাবে তার আওয়াজ তৈরি করে তা দেখতে এই ভিডিওটি দেখুন
তথ্যসূত্র
- Dolbear, A. E. (1897). The cricket as a thermometer. The American Naturalist, 31(371), 970-971.
- Science Buddies Staff. (2020, November 20). Ask a Cricket, ‘What is The Temperature?’.
Leave a Reply