প্রতি বছরই শীতের শুরুতে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, কক্সবাজারের সোনাদিয়া কিংবা নিঝুম দ্বীপে অতিথি পাখিদের আনাগোনা শুরু হয়। ঢাকার কাছাকাছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জলাশয়েও অতিথি পাখিদের মেলা উপভোগ করতে দর্শনার্থীদের ভিড় জমে। এসব পাখিদের বেশির ভাগই আসে উত্তর মঙ্গোলিয়া, তিব্বতের একটি অংশ, চীনের কিছু অঞ্চল, রাশিয়া ও সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে। শুধু মাত্র আমাদের দেশেই যে পরিযায়ী পাখিদের দেখা মেলে তা না। পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, ভারতে কিংবা ইউরোপেও ওদের দেখা যায়। যেমন গত সেপ্টেম্বর এ একটি ইউরোপিয়ান ব্ল্যাকবার্ড ১৫৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বেলারুস থেকে আলবেনিয়ায় যায়।
পাখিদের এই পরিযাণ সত্যিই অবাক করার মতন। কিন্তু পাখিরা ঠিক কি কারণে এত দূর পথ পাড়ি দেয়? পথিমধ্যে তাদের শারীরিক কি ধরণের পরিবর্তন ঘটে? কেনই বা কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলের পাখিরাই পরিযায়ী হয়? কিংবা তারা তাদের গন্তব্যই বা নির্ধারণ করে কি করে? শুধু পাখিই নয় অন্যান প্রাণীদের বিচিত্র সব আচরণ নিয়েই বা আমরা কতটা জানি? যেমন ইউরোপিয়ান বান মাছেরা প্রজননের উদ্দেশ্যে কোথায় যায়? কিংবা কেনই বা ইউরোপিয়ান সারসের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে?
প্রাণীদের নিয়ে এইসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতেই “ইকারুস” ( ICARUS- International Cooperation For Animal Research Using Space ) নামের একটি মিশন শুরু করা হয়। মিশনের উদ্দেশ্য নানান রকমের প্রাণীদের একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করা। যাতে বিজ্ঞানীরা ওদের বিচিত্র সব আচরণ সম্বন্ধে গবেষণা করতে পারেন। আইডিয়াটার সূত্রপাত হয়েছিল দুই দশক আগে। জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট অব অ্যানিম্যাল বেহেভিউর এর পরিচালক মার্টিন উইকেলস্কি’র মাথায়। তার ভাবনা ছিল- লাখ খানেক প্রাণীর শরীরে খুবই হালকা একটা ট্রান্সমিটার যুক্ত করে দেয়া যা প্রতিনিয়ত তাদের সম্পর্কে নানান রকম তথ্য প্রেরণ করবে। বিষয়টাকে তিনি নাম দিয়েছেন “অ্যানিমেলস ইন্টারনেট” বা “প্রাণীদের অন্তর্জাল”।
ইকারুস মিশনের উদ্দেশ্য এইরকম একটা অ্যানিমেলস ইন্টারনেট তৈরি করা। বিজ্ঞানীরা খুবই হালকা ওজনের ( ৫ গ্রাম ) একটি ট্রান্সমিটার তৈরি করেন। এই পর্যন্ত প্রায় একশটি প্রাণীর শরীরে যুক্ত করা হয় এই ট্রান্সমিটার। এদের মধ্যে আছে নানান রকম পাখি, বাদুড়, গণ্ডার, কচ্ছপ, ছাগল এবং আরও অনেক। প্রতিনিয়তই ট্রান্সমিটারটি এদের শরীর থেকে নানান রকম তথ্য- তাদের অবস্থান, আচরণ এবং শরীর সম্বন্ধীয়- প্রেরণ করছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ( ISS ) থাকা গ্রাহকে।
ইকারুস মিশন কেন গুরুত্বপূর্ণ?
বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী সংরক্ষণে
ইউরোপিয়ান সারসের সংখ্যা আগের তুলনায় প্রায় সত্তর শতাংশ কমে এসেছে। তাছাড়া কমে এসেছে গান পাখিদের ( সং বার্ড ) সংখ্যাও। ইউরোপে সংখ্যাটা ৬০০ মিলিয়নের নিচে। আমরা সবাই-ই কোন না কোন বাস্তুতন্ত্রে বসবাস করি। একটা বাস্তুতন্ত্রের প্রতিটি সদস্যই গুরুত্বপূর্ণ। কোন একটি সদস্য হারিয়ে গেলে তার প্রভাব প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ঐ পুরো বাস্তুতন্ত্রেই পড়ে। উইকেলস্কি বলেন, তারা পনেরো হাজার সারসের শরীরে ট্যাগ যুক্ত করে দিবেন। উদ্দেশ্য এদের বিলুপ্তির পেছনে কারণ জানা। প্রাণীদের বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার ক্ষেত্রেও ইকারুস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে বদ শিকারিরা বন্য গণ্ডারদের শিকার করে। ইকারুসের গবেষকরা বন্য জিরাফ, সিংহ কিংবা বন্য কুকুরদের ট্যাগ করার কথা ভাবছেন। যাতে করে বন্য প্রাণীরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা বদ মানুষদের খপ্পরে পড়লে বিজ্ঞানীরা সেটা জানতে পারেন।
ইকারুসের বিজ্ঞানীরা ট্যাগ ব্যবহার করে ব্ল্যাকবার্ডদের হৃদস্পন্দন মাপছেন। এভাবে তারা ব্ল্যাকবার্ডদের দেহের শক্তি খরচ এবং স্ট্রেস সম্পর্কে ধারণা পান। বিজ্ঞানীরা বোঝতে চান পরিযাণ তাদের জন্যে কতটা ব্যয়বহুল। বিষয়টা ব্ল্যাকবার্ডদের জন্যে এতটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও বিপন্ন প্রজাতি যেমন শোরবার্ড, সামুদ্রিক কচ্ছপ কিংবা আফ্রিকান বড় ফ্রুট ব্যাট ( ফল খাওয়া বাদুড় )-দের জন্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রাণীদের বাসযোগ্য বাসস্থান কেমন হওয়া উচিত তা বোঝতেও সহায়ক হবে বিষয়টি। এভাবে ইকারুসের মাধ্যমে মানুষ এবং প্রাণীদের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া গড়ে তোলা সম্ভব।
প্রাণীদের বিচিত্র আচরণ নিয়ে জানতে
আমাদের চারপাশের বিচিত্র সব প্রাণিরা প্রতিনিয়ত বিচিত্র সব কাণ্ড করে যাচ্ছে। সেসব খবর সাধারণ মানুষেরা রাখে না। যেমন সাদা সারসেরা সাহারা মরুভূমির উপর দিয়ে প্রতি মৌসুমে পাঁচবার উড়ে যায়, কোকিল পাখিরা রাশিয়ার কামচাটকা থেকে ভারত হয়ে অ্যাঙ্গোলায় যায়। পাখিদের এই দীর্ঘপথ পাড়ি দেয়া কালে তাদের শরীরের শক্তি খরচ, ডানার কম্পন কিংবা অনুসন্ধানি আচরণ- এ সব কিছুই পর্যবেক্ষণ করেন ইকারুস মিশনের গবেষকরা। শুধু পাখি নয় অন্যান্য প্রাণীদের বিচিত্র আচরণও পর্যবেক্ষণ করা হয়। তাদের দেহের তাপমাত্রা, আদ্রতা, তাদের গতি প্রভৃতির রেকর্ড রাখা হয়।
আরেকটা আশ্চর্যজনক তথ্য হচ্ছে, প্রতিনিয়তই প্রাণিরা একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করে। উইকেলস্কি বিষয়টাকে ইন্টারনেট বা অন্তর্জাল বলেন। কিংবা বলা যায় টেরেস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অব থিংস ( Terrestrial Internet of Things- IoT )। তারা স্থলজ আইওটি এর সাথে মহাকাশে থাকা আইওটি’র সমন্বয় করছেন। যদি কোন প্রাণী সাহারা মরুতে কিংবা রেইনফরেস্ট এর কোন উপত্যকায় মারা যায়, স্যাটেলাইট আইওটি’র মাধ্যমে সেই তথ্যটি জানা যাবে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে
প্রাণীদের রয়েছে প্রকৃতিকে বোঝার মতন ইন্দ্রিয় ব্যবস্থা। যেমন তারা আসন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত সম্বন্ধে আগাম ধারণা করতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রাণীদের ষষ্ঠেন্দ্রিয় অর্জন করার পেছনে তাদের এই সামষ্টিক আচরণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গবেষকরা আবহাওয়া পূর্বাভাস
দেয়ার ক্ষেত্রে প্রাণীদের এই ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর কথা ভাবছেন। যেমন ম্যাক্সিকান গ্যানেট এবং শোরবার্ডরা বসন্তকালে বোঝতে পারে আগামী শরতে অ্যানশভিস এবং অন্যান্য মাছদের উৎপাদন কেমন হবে। কিংবা ইন্দো প্যাসিফিক এর ববিস পাখিরা আগামী এল নিনো ( El Niño ) কতটা শক্তিশালী হবে সে ব্যাপারে আপনাকে নিশ্চিত হতে সাহায্য করতে পারে। বলে রাখা ভালো যে, এল নিনো এবং লা নিনা দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের জলবায়ুর প্যাটার্নকে বোঝানো হয়। ববিস পাখিরা এল নিনো শক্তিশালী হবার আভাস পেলে হয় প্রচুর পরিমাণে ডিম দেয় কিংবা একেবারেই ডিম দেয় না।
মহামারীর পূর্বাভাস দিতে
উইকেলস্কি জানান, ইকারুসের মাধ্যমে আগত কোন মহামারী সম্বন্ধেও আগাম ধারণা পাওয়া যেতে পারে বলে। যেমন চীনের কিছু হাঁসকে ট্যাগ করা হয়েছে যা তাদের শরীরের তাপমাত্রা রেকর্ড করছে। বিজ্ঞানীরা এদের শরীরের তাপমাত্রা থেকে ধারণা করতে পারেন সামনে অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়িয়ে পড়বার সম্ভাবনা কতটুকু। কিংবা আফ্রিকান বাদুড়দের রক্ত পরীক্ষা করে জানা যাবে ইবুলা ভাইরাস এর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বার সম্ভাবনা নিয়ে।
ইকারুসের বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতে পর্তুগাল ম্যান-ও-ওয়ার ( man-o-war- এক ধরণের বিষাক্ত জেলিফিশ )- দের ট্র্যাক করতে চান। তারা ৫০০ মিলিগ্রাম ওজনের আরও ছোট ট্যাগ তৈরি করেছেন। উদ্দেশ্য জমির ফসল খেয়ে উজাড় করে ফেলা পঙ্গপালদের ট্যাগ করা। নিঃসন্দেহে ইকারুস চমৎকার একটা মিশন। মজার ব্যাপার হল, লোকজন এখন ইকারুস কে অনুরুধ জনায় এই বলে যে, তারা তাদের আশ পাশের প্রাণীদেরকেও ট্যাগ করতে চান। বিষয়টা অনেকটা আকাশের তারা পর্যবেক্ষণ করার জন্যে লোকের হাতে দূরবীক্ষণ দেবার মতন।
তথ্যসূত্রঃ নিউ সায়ন্টিস্টি
বি দ্রঃ লেখাটি পূর্বে দৈনিক বাংলার ইউরেকা পাতায় ছাপা হয়েছে।
Leave a Reply