আমরা জানি সাপ মূলত ভূকম্পন অনুভব করে “শুনতে” পায়, তাদের কার্যকরী কোন কান নেই বলে বায়ুবাহিত শব্দ শুনতে পারে না। কিন্তু আসলেকি কি তাই? সাপের কি কান নেই? সাপ কি আসলেই শুনতে পারে না? সম্প্রতি এ বিষয়ে চাঞ্চল্যকর কিছু গবেষণা হয়েছে। চলুন জানা যাক তার খবরা-খবর।
“আজ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ড. ক্রিস্টিনা এন. জেডেনেকের থেকে একটি ইন্টারভিউর মাধ্যমে জানার চেষ্টা করবো। আমরা এখন কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছি যেখানে ড. জেডেনেক Venom Evolution Lab এর রিসার্চার হিসেবে কাজ করছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য আমরা ড. জেডেনেকের ল্যাবে পৌঁছে যাবো।”
গাড়ির মধ্যে থেকেই জেনিসা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বলে তার ইন্টারভিউ ভ্লগ শুরু করলো। আমি ক্যামেরাম্যান হিসেবে জেনিসার সাথে যাচ্ছি। জেনিসাকে বেশ উদ্দীপিত লাগছে।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2023/06/snack-2.jpg?resize=1024%2C1024&ssl=1)
দু’য়েক মিনিট পরেই আমরা কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে এসে পরলাম। জেনিসা গাড়ি থেকে নেমেই ল্যাবের দিকে যা“সাপ কি মানুষ কিংবা অন্য প্রাণীর করা আওয়াজ অথবা যেকোনো ধরণের শব্দ শুনতে পারে না? সাপ কি শুধু মাটির কম্পন অনুভব করেই সাড়া প্রদান করে? সাপের কি কান নেই?ওয়া শুরু করলো, আমি ইন্টারভিউ শ্যুট করার সকল যন্ত্রপাতি নিয়ে জেনিসার পিছু পিছু গেলাম।
জেনিসা আর আমি ল্যাবের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দরজায় কড়া নাড়তেই একজন স্টাফ দরজা খুলে দিলো। জেনিসা আর আমি ভিতরে ঢুকলাম। ভিতরে ঢুকেই দেখতে পেলাম মাইক্রোস্কোপে একজন ত্রিশোর্ধ নারী খুব মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে।
আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে পিছন ফিরে আমাদের দিকে তাকালো।বেশ হাসি হাসি মুখ করে আমাদের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলো “তোমরাই The Canberra Times এর রিপোর্টার এবং শ্যুটার, যারা কর্ডাটা (Chordata) পর্বের ভার্টিব্রাটা (Vertebrata) উপপর্বের রেপটিলিয়া (Reptilia) শ্রেণীর স্কোয়ামাটা( Squamata) বর্গের সার্পেন্টেস (Serpentes) উপবর্গের প্রাণীটি সম্পর্কে জানতে এসেছো?
জেনিসা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। এই নারী গবেষকের এমন কথা বলার ধরণ বেশ অদ্ভুত লাগলো।হয়তো এমন ভাবেই কথা বলে ওনারা। যাইহোক আমি ইন্টারভিউ শ্যুট করার জন্য রুমের কর্ণারে রাখা সোফা বরাবর ক্যামেরা সেটআপ করতে লাগলাম। ওইদিকে জেনিসা ড. জেডেনেকের সাথে কুশলাদি বিনিময়ে ব্যস্ত।
কিছুক্ষণ পর সেই স্টাফ আমার জন্য একটি সুইভেল চেয়ার নিয়ে এসে আমাকে বসার অনুরোধ করলো। এর মধ্যে ড. ক্রিস্টিনা হাতমুখ ধুয়ে হয়ে ল্যাবকোট খুলে চলে এসেছেন। তিনি এখন ইন্টারভিউয়ের জন্য প্রস্তুত।
ইন্টারভিউ শুরু হয়ে গেছে, ক্যামেরায় তা শ্যুট করা শুরু করে দিয়েছি, জেনিসা দ্বিতীয়বার ক্যামেরা সামনে গবেষকের কুশলাদি জিজ্ঞেস করলো। এবার মূলপর্ব অর্থ্যাৎ প্রশ্নপর্ব শুরু হচ্ছে।
জেনিসা জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা ম্যাম শুনেছি সম্প্রতি সাপের শব্দ নিয়ে গবেষণায় নতুন কিছু তথ্য উঠে এসেছে। সেই সম্পর্কে আমরা জানতে চাই।“
গবেষক বলতে শুরু করলেন, “হ্যাঁ তুমি ঠিক শুনেছো। আমরা এতদিন জানতাম যে সাপ শুধু মাটির মাধ্যমে যাওয়া শব্দ কম্পন অর্থাৎ টেকটাইল সেন্সিং অনুভব করতে পারে। কিন্তু আমাদের সম্প্রতি করা গবেষণায় দেখেছি যে সাপ বায়ু মাধ্যমের শব্দেও বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখায় যা আমাদের এতদিনের ভুল ধারণা ভেঙে দেয়। আমাদের এই গবেষণায় ৭টি প্রজাতির ১৯টি ভিন্ন সাপ অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং একই বায়ুবাহিত শব্দে ভিন্ন প্রজাতির সাপ ভিন্ন ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিলো।“
“আচ্ছা ম্যাম, “সাপের কি কান আছে?” জেনিসা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বললো।
“হ্যাঁ আছে তো। সাপের অন্তঃকর্ণ আছে। আমাদের মতো বহিঃকর্ণ ও মধ্যকর্ণ নেই। সাপের অন্তঃকর্ণ বেশ সুগঠিত। চোখের পেছনে দুই চোয়ালের সংযোগস্থলের কাছে অবস্থিত।অন্তঃকর্ণের সাথে একটি সূক্ষ্ম হাড়ও সংযুক্ত থাকে।” ড. ক্রিস্টিনাও উত্তর দিয়ে কফির কাপে চুমুক দেয়ার জন্য হাতে নিলো।
কফির কাপে চুমুক দেয়ার আগেই জেনিসা প্রশ্ন করলো, “আমরা মাঝে মধ্যে শুনে থাকি সাপ নাকি জিহ্বা দিয়ে শুনে, কথাটি কতটুটু সত্য?“
এবার গবেষক একটু হেসে ফেললো। কফির কাপটা টেবিলের উপর রেখে বললো, জিহ্বার কাজ শ্রবণ করা নয় তাহলে জিহ্বা দিয়ে কিভাবে শুনবে। সাপ বায়ু কিংবা স্থল অথবা জল মাধ্যমে আগত শব্দ তরঙ্গ সাপের চোয়ালের মাধ্যমে অন্তঃকর্ণ সংলগ্ন সূক্ষ্ম হাড়ে পৌঁছায়। এরপর শব্দ তরঙ্গ অন্তঃকর্ণে প্রেরিত হয় এবং সেখান থেকে অডিটরি স্নায়ুর মাধ্যমে তা সাপের মস্তিষ্কে পৌঁছায়। এটাই মূলত সাপের শ্রবণ প্রক্রিয়া।“
“আপনাদের গবেষণা আর কী কী জানতে পেরেছেন? গবেষণা প্রক্রিয়াটাও একটু জানতে চাই।” জেনিসা খানিকটা কৌতুহলী হয়ে বললো কথাগুলো।
“আমাদের গবেষণা বিষয়ে জানানোর আগে বলে নিতে চাই সাপের চারপাশের পরিবেশকে বোঝার জন্য তার শ্রবণ শক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিকারী আক্রমণ কিংবা যেকোনো ধরণের আঘাত থেকে সাপের দেহকে বাঁচতে সাপের শ্রবণশক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।” এতটুকু বলে গবেষক আবার কফিতে চুমুক দিলেন।
এবার ক্যামেরার লেন্স বরাবর তাকিয়ে জেনিসা দ্বিতীয় কৌতুহল মেটানো জন্য বলতে শুরু করলেন,”আমরা আমাদের গবেষণা জন্য একটি সাউন্ডপ্রুফ ঘরে একবারে একটি সাপকে বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তরঙ্গ প্রেরণ করে পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। আমরা কক্ষকে পুরোপুরি সাইলেন্ট করে 1-150Hz, 150-300Hz এবং 300-400Hz এর মধ্যে যেকোনো একটি ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তরঙ্গ ঐ কক্ষে প্রেরণ করেছিলাম। এই ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তরঙ্গ ভিন্ন প্রজাতির সাপ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সাড়া ও ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিলো। আমরা অ্যাক্সিলেরোমিটার সাহায্যে এটাও পরীক্ষা করে দেখেছি যে কক্ষে প্রেরণ করা শব্দ তরঙ্গগুলো স্থল কম্পন সৃষ্টি করছে কি না। এতে আমরা জানতে পেরেছি কক্ষে কোনো ধরণের স্থল কম্পন সৃষ্টি হয়নি অর্থাৎ কক্ষে প্রেরণ করা শব্দ তরঙ্গ শুধু বায়ু মাধ্যমেই সাপের অন্তঃকর্ণে প্রবেশ করেছে এবং সাপগুলো এতে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে সাপ বায়ুবাহিত শব্দও শুনতে পায়।”
এতটুকু প্রায় এক নিশ্বাসে বলে ড. জেডেনেক একটু থামলেন। মনে হলো খানিকটা হাঁপিয়ে উঠেছেন তিনি।
জেনিসা নিজের হাতের স্মার্ট ওয়াচের দিকে তাকিয়ে আবার ড. জেডেনেককে প্রশ্ন করলেন যে, “সাপ কি তাহলে আমাদের কথা শুনতে পায়?”
গবেষক আবার শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো,”আমাদের এই গবেষণা সাপ শুনতে পায়না এই গুজবকে খন্ডন করেছে অর্থ্যাৎ সাপ শুনতে পায় তবে সেটা আমার-আপনার মতো নয়। তবে সাপ সম্ভবত আমাদের করা আওয়াজ কিছুটা বিকৃত ভাবে শুনতে পায়।” ড. জেডেনেক পুনরায় কফির কাপে চুমুক দিলেন।
কফির কাপটা টেবিলে রেখে বলতে লাগলেন, “লিঙ্গভেদে মানুষের কণ্ঠস্বরের ফ্রিকোয়েন্সি 100-250Hz পর্যন্ত হয়। আমাদের গবেষণায় এই ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তরঙ্গও অন্তর্ভুক্ত ছিলো। যা ঐ কক্ষে ৮৫ ডেসিবেলে সাপ থেকে ১.২ মিটার দূরত্বে উৎপন্ন করা হয়েছিলো এবং সাপ তাতে সাড়া প্রদান করেছে যদিও এটি তুলনামূলক উচ্চ শব্দ কম্পন ছিলো। তাই আমরা এটি বলতেই পারি যে সাপ মানুষের উচ্চ স্বর কথা বলা কিংবা চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পারে। তবে এর মানে এই নয় যে সাপ মানুষের স্বাভাবিক কথোপকথনের শব্দ শুনতে পায় না। আমরা এখনো সেই শব্দস্তর সাপের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করিনি।”
ড.জেডেনেক আবারো থেমে শ্বাস নিয়ে পরবর্তী প্রশ্নের জন্য উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালেন জেনিসার দিকে তাকালেন।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2023/06/image-6.png?resize=770%2C549&ssl=1)
জেনিসা বেশ মনযোগ দিয়ে ড. জেডেনেকের কথাগুলো শুনেছে। জেনিসা বললো,”আচ্ছা ম্যাম আর বেশিক্ষণ আপনার সময় নষ্ট করবো না শেষ একটি জিজ্ঞাসা হলো, শব্দ শুনে সাপগুলো কি ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে সেই বিষয়ে জানতে চাই। সাপগুলো কি শব্দ শুনতে পেয়ে শব্দের উৎসের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেছে নাকি সেখান থেকে দূরে যাওয়ার প্রবণতা দেখিয়েছে?”
“আচ্ছা বেশ আমি দুয়েকটা প্রতিক্রিয়া নিয়ে বলছি, ওমা পাইথন নিয়েই বলা যাক তাহলে। অস্ট্রেলিয়ার শুষ্ক অঞ্চলের একটি বিষহীন সাপ। এই সাপ শব্দ শুনতে পেরে উৎসের কাছে পৌঁছানোর প্রবণতা দেখিয়েছে এবং পেরিস্কোপিং নামক আকর্ষণীয় আচরণ করে শব্দের উৎস খোঁজার কৌতুহল প্রদর্শন করেছে। পেরিস্কোপিং হলো শরীরের সামনের এক তৃতীয়াংশ উঁচু করা।” ড.জেডেনেক একটু থেমে আবার শ্বাস নিচ্ছে। জেনিসা কফির কাপে চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলের উপর রাখলো।
ড. জেডেনেক আবার বলতে শুরু করেছেন,”এরপর ডেথ অ্যাডার, তাইপন ও ব্রাউন স্নেকের কথা বলা যায় যাদের মধ্যে ওমা পাইথনের বিপরীত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেছে। এরা শব্দ শুনতে পেয়ে শব্দের উৎস থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। শব্দ শুনে ডেথ অ্যাডার লেজের মাধ্যমে শব্দ করে সতর্কবার্তা প্রদান করে। তাইপান ও ব্রাউন স্নেকও শব্দ শুনে আত্মরক্ষা ও সতর্কতামূলক প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে।”
জেনিসা এবার বেশ হাসিখুশি ভাবে ড. জেডেনেককে ধন্যবাদ জানিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ইন্টারভিউর পরিশেষ বাক্যগুলো বলে আজকের মতো ইতি টানলো। যদিও গবেষকের নিজের সাক্ষাৎকার তবুও জেনিসা ল্যাব থেকে বেরিয়ে আসার সময় ড. জেডেনেকের থেকে সোর্স হিসেবে গবেষণাপত্রটি নিয়ে এসেছে। এই যে সেটি:
Snakes Can Hear You Scream, New Research Reveals – Scientific American
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এখানে বর্ণিত বৈজ্ঞানিক গবেষণার তথ্য মূল গবেষণাপত্র ও সায়েন্টিফিক আমেরিকানসহ অন্যান্য নির্ভরযোগ্য মাধ্যম থেকে নেয়া হয়েছে ও কাল্পনিক সাক্ষাতকারের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে।
Leave a Reply