বিকেল বেলা ব্যালকনির গ্রিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দুই হাত দূরে ছোটভাই যশো গ্রিল ধরে ঝুলার চেষ্টা করছে। আকাশ বেশ মেঘলা, শীতল বাতাসে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর গ্রিল ছেড়ে দিয়ে যশো বললো, “আচ্ছা দাদা, আমাদের লোম দাঁড়িয়ে যায় কেন? এর কারণ কী?“
বুঝতে পারলাম আমার মতো যশোরও লোম দাঁড়িয়ে গেছে। আমি বললাম, বলবো তার আগে বলতো, এই যে আমাদের লোম দাঁড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা এটাকে ইংরেজিতে কি বলে?”
যশো সহজ সরল ভঙ্গিতে বললো, “গুজবাম্পস (Goosebumps)“
“এটার আরো কিছু নাম আছে সেগুলো জানিস?”
“সেগুলো তো জানি না। তুমিই বলো?” আগের ভঙ্গিতেই বললো যশো।
“সাধারণত লোম দাঁড়িয়ে যাওয়াকে গুজবাম্পস (Goosebumps) বলে। তবে এর আরো নাম আছে যেমন গুজ পিম্পল (Goose Pimples), গুজ ফ্লেশ (Goose Flesh) এবং গুজ বাম্পলস (Goose Bumples)। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই গুজবাম্পসকে Cutis anserine বলা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়ও গুজবাম্পসের আরো কিছু নাম আছে যেমন হরিপিলেশন(Horripilation), পাইলোরেকশন (Piloerection)। এছাড়া পাইলোমোটর রিফ্লেক্সও (Pilomotor reflex) বলা হয়। সুন্দর না নাম গুলি?”এই বলে ব্যালকনিতে বসে পরলাম।
যশোও আমার মুখোমুখি বসে বলতে লাগলো, “গুজবাম্পস-ই বেটার। আচ্ছা এই লোম দাঁড়ানোকে গুজবাম্পস বলার কী কারণ? হাঁসের সাথে এর কি সম্পর্ক?“
“হাঁসের পালক ছাড়ানোর পরে দেখবি ত্বকের উপর ছোট ছোট খোঁচা খোঁচা অংশ দেখা যায়। আমাদের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেলেও এমন দেখায় তাই এই অবস্থার নাম গুজবাম্পস। যাকে শুদ্ধ বাংলায় বলে হংসীত্বক। বুঝলি?”
“হ্যাঁ বুঝেছি। আচ্ছা তাহলে…” যশো আর কিছু বলে উঠার আগেই আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলতে লাগলাম,
“তোকে আর একটা ইনফরমেশন দেই, একটু আগে যে Cutis anserine নামটা বললাম সেটার Cutis শব্দের অর্থ ত্বক এবং anser শব্দের অর্থ হাঁস/হংস। এবার কী বলতে চাইছিলি বল।”
“গুজবাম্পসের সংজ্ঞাটা বলতে পারবে?” যশো বেশ অনুরোধের সুরে বললো কথাটা।
আমি বলতে শুরু করলাম, “এক কথায় বললে বাহ্যিক ক্রিয়ার ফলে প্রাণী দেহের অভ্যন্তরে অনৈচ্ছিক প্রতিক্রিয়ায় ত্বকের নিচের পেশীতে স্নায়ু সংকেত প্রবাহের ফলে লোমকূপ গুলো কিছুটা উপরে উঠে যায়। এ অবস্থাকেই গুজবাম্পস বলে।”
“সংজ্ঞাটা একটু ব্যাখ্যা করো?” যশো কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
আমি শ্বাস নিয়ে বলতে লাগলাম, আচ্ছা শোন, মূলত অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে অ্যাড্রিনালিন হরমোন নিঃসরণের ফলে গুজবাম্পস হয়। আমরা যখন কোনো গান শুনি, মুভি দেখি, গন্ধ নিই, স্বাদ গ্রহণ করি, যৌন উত্তেজনায়, রোমান্টিক মুহূর্তে, শীতল অনুভবে, শারীরিক পরিশ্রম কিংবা মলত্যাগ করা, দুঃখ, ভয় কিংবা আনন্দদায়ক ঘটনা শুনি, পড়ি অথবা বাস্তবে সেগুলোর সম্মুখীন হওয়ার ফলে সৃষ্ট মানসিক চাপ ইত্যাদি বাহ্যিক ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ার হিসেবে আমাদের দেহে কখনো কখনো অ্যাড্রেনালিন হরমোন নিঃসৃত হয়। যাতে আমরা সেই আবেগপ্রবণ বিষয় গুলো থেকে বের হয় পুনরায় স্বাভাবিক হতে পারি। এবার এই হরমোন নিঃসরণের ফলে ত্বকের নিচের প্রতিটি লোমকূপের সাথে সংযুক্ত ইরেক্টোরেস পিলোরাম (Erectores pilorum) নামক পেশী তন্তুতে স্নায়ু সংকেত প্রবাহিত হলে লোমের গোড়ার দিক সংকোচিত হয় এবং এতে লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। যাকে খাঁটি বাংলায় বলি শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠা। তবে কখনো কখনো গুজবাম্পস কোনো কারণ ছাড়াই হতে পারে।” এক নিঃশ্বাসে বলে যশো-র দিকে তাকিয়ে আছি।
“এই গুজবাম্পস কি শুধু আমাদেরই হয় নাকি অন্য প্রাণীর মধ্যেও দেখা যায়?আর এটা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ অথবা এর কি উপকারিতা কিংবা অপকারিতা কিছু আছে?” যশো জিজ্ঞেস করলো।
দেয়ালে হেলান দিয়ে বলতে লাগলাম,”হ্যাঁ সংজ্ঞাতেই প্রাণীদেহের কথা উল্লেখ করেছিলাম। মানুষ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যেও গুজবাম্পস দেখা যায়। এর মধ্যে কুকুর, বিড়াল, সজারু, বিভিন্ন ধরনের পাখি ইত্যাদি প্রাণী উল্লেখযোগ্য। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে সাধারণত প্রতিদ্বন্দ্বীকে আক্রমণ করা থেকে সতর্ক করতে, নিজের শরীরকে উষ্ণ রাখতে এবং বিপরীত লিঙ্গকে যৌন মিলনে আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে গুজবাম্পস দেখা যায়।” এইটুকু বলে থামলাম।
শ্বাস নিয়ে আবার বলতে লাগলাম,”গুজবাম্পস বিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের পূর্ব প্রজাতি থেকে পাওয়া একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। তবে আমাদের শরীরের লোম স্তর পাতলা হওয়ার কারণে আমাদের শরীরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রভাব ফেলে না। তবে অন্যান্য লোমশ প্রাণীদের ক্ষেত্রে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা নিজেদের শীতের সময় শরীরে তাপ ধরে রাখতে এবং গরমে শরীরকে শীতল রাখে গুজবাম্পসের মাধ্যমে। আর আগে তো বললামই প্রতিপক্ষকে সতর্ক ও বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষিত করতেও গুজবাম্পস ব্যবহার করে। ও হ্যাঁ এই ব্যাপরে তোকে একটা মজার তথ্য দেই।”
“কী তথ্য?” গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
“সম্প্রতি ইঁদুর নিয়ে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে ইঁদুরের চুল/লোম গজানোর সাথে গুজবাম্পসের সম্পর্ক রয়েছে। গুজবাম্পসের ফলে ত্বকের নিচের পেশী সংকুচিত হলে লোমকূপের স্টেম সেলগুলি সক্রিয় হয় যা যার ফলে চুল/লোম বৃদ্ধি পায়। গবেষকরা ধারণা করছে অন্যান্য লোমশ প্রাণীর লোম বৃদ্ধির কারণও গুজবাম্পস। মানুষের টাক মাথায় চুল গজানোর জন্য এই গুজবাম্পসকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে গবেষণা চলছে।” এইটুকু বলে হাতের কাছে থাকা পানির বোতল থেকে পানি পান করছি।
যশো বেশ অধৈর্য স্বরে বললো”আর গুজবাম্পসের কি কোনো খারাপ দিক আছে নাকি?“
“যদিও গুজবাম্পস খুবই সাধারণ ও সাময়িক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। তবে দীর্ঘস্থায়ী গুজবাম্পস বিরল কিছু রোগের লক্ষণ।যেমন: কেরাটোসিস পিলারিস (Keratosis pilaris) এটি একধরণের চর্মরোগ এবং এতে আক্রান্ত হলে ত্বকে দীর্ঘসময় ধরে গুজবাম্পস থাকে। এরপরে অটোনোমিক ডিজ্রেফ্লেক্সিয়া-র (Autonomic dysreflexia) কথা বলা যায়। মেরুদণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত হলে স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা কিছুটা ব্যাহত ফলে এই রোগ দেখা দেয় যার বাহ্যিক লক্ষণ হলো গুজবাম্পস। এছাড়াও গুজবাম্পসের লক্ষণ যুক্ত আরেকটি ব্যাধি হলো টেম্পোরাল লোব এপিলেপসি (Temporal Lobe Epilepsy)। যা একটি স্নায়ুবিক ব্যাধি। সবশেষে সর্দি জ্বরের ক্ষেত্রেও শরীরে দীর্ঘ সময় ধরে গুজবাম্পস দেখা যায়। বুঝতে পেরেছিস?
“হ্যাঁ বুঝলাম, আচ্ছা এবার আমি যাই। আর এগুলোর সোর্স লিংক দিও আমাকে।” যশো হাসি হাসি মুখ করে বললো।
“এই যে দেখ সোর্স” এই বলে ওর হাতে ফোন দিয়ে ব্যালকনি থেকে রুমে চলে আসলাম।
Harvard Health Publishing: Wondering about goosebumps? Of course you are
Leave a Reply