চিন্তার চাষঃ কীভাবে প্রস্তুতি নিবে?

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

দশম শ্রেণিতে থাকতে আমি চিন্তার চাষের ক্ষুদে গবেষণা কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলাম। একটা সিরিয়াস প্রজেক্টে কাজ করে বিজয়ীও হয়েছিলাম। সেই সুবাদে অনুজদের পক্ষ থেকে এই প্রতিযোগিতার ব্যাপারে লেখার অনুরোধ পেয়েছি। আর তাই লিখতে বসে গেলাম।

“চিন্তার চাষ” একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। আমাদের দেশের কিশোর-কিশোরীরাও যেন গবেষণা কার্যক্রমের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়, সেই উদ্দেশ্যেই এখন প্রতিবছর সংগঠনটি শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করছে। মূলত নির্দিষ্ট অঞ্চলভিত্তিক ক্যাম্পেইনের সংগঠনটি বিভিন্ন স্কুলের দলভিত্তিক শিক্ষার্থীদেরকে “গবেষণা” বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করে।

একাধিক সেশনে এই ক্যাম্পেইনটি সম্পন্ন হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদেরকে নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর গবেষণা করতে বলা হয় এবং সকল প্রক্রিয়া-পদ্ধতি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এরপর দীর্ঘ কয়েক মাস সময় নিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের কাজ ও গবেষণা শেষ করে গবেষণাপত্র জমা দেয়। সেখান থেকে বাছাইকৃত কয়েকজনকে নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে প্রেজেন্টেশন ভিত্তিক সেমিনানের আয়োজন করা হয় এবং এখানে বাছাইকৃত শিক্ষার্থীরা তাদের পোস্টার বা রিসার্চ পেপার নিয়ে আলোচনা পেশ করে। তারপর স্বনামধন্য প্রফেসর ও বিশেষজ্ঞদের মার্কিং এর উপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত বিজয়ী নির্ধারিত হয়।

এখন প্রশ্ন হলো, এই প্রোগ্রামের জন্য গবেষণা করব কীভাবে? পুরো জার্নিটা কেমন হবে? গবেষণাপত্রটাই বা কেমনে লিখব? তো, চলো, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা যাক।

বিষয়বস্তু নির্ধারণ ও আউটলাইন তৈরি

তোমেক প্রথমেই একটি সুস্পষ্ট কাঠামো দাঁড় করাতে হবে। তুমি কী নিয়ে কাজ করতে চাও, সেটা ঠিক করতে হবে। তবে তার আগে তোমাকে অবশ্যই মন খুলে ভাবতে হবে। কারণ গবেষণা সবসময় করতে হয় নতুন কিছুকে সামনে আনার উদ্দেশ্যে। আর এর জন্য প্রয়োজন গন্ডির বাইরে গিয়ে চিন্তা করা।

যাহোক, তুমি গবেষণার জন্য একটি টপিক বেছে নিলে। আমি “বিজ্ঞানচর্চায় বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে?” এই বিষয়ের উপরে গবেষণাটা করেছিলাম। তুমিওএরকম কোনো ইউনিক বা অনন্য বিষয় নিয়ে চিন্তা করে টপিক নির্ধারণ করতে পারো। ধরো, তুমি বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ দরিদ্রদের মাঝে বেশি নাকি উচ্চবিত্তদের মাঝেও এর যথেষ্ট প্রকোপ রয়েছে, সেটা নিয়ে গবেষণা করতে পারো।

এরপর তোমাকে একটি আউটলাইন তৈরি করতে হবে। তুমি কোন রাস্তা দিয়ে তোমার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবা, কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করবা এবং কীভাবে গবেষণার শেষ বিন্দুতে পৌঁছাবা, সেটা আগে নির্ধারণ করে নিতে হবে। মনে রেখো, এই কাজটা কিন্তু দলগত; একই শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মিলে এই কার্যক্রমে অংশ নিতে হয়। তাই সবার আইডিয়ার উপর ভিত্তি করেই একটি সুন্দর ও গোছানো আউটলাইন তৈরি হবে।

উপকরণ সংগ্রহ

গবেষণা করতে গেলে অবশ্যই উপকরণ বা যন্ত্রপাতির প্রয়োজন। একদম ব্যবহারিক গবেষণা হলে তো কিছু ল্যাব ইন্সট্রুমেন্টের দরকার পড়ে। আর যদি গবেষণাটি তাত্ত্বিক পর্যায়ের হয়, তবুও কিছু উপকরণের প্রয়োজন। যেমনঃ বই, নিউজপেপার, আর্টিকেল, রিপোর্ট, সমজাতীয় গবেষণাপত্র ইত্যাদি। তাছাড়াও তুমি যদি তোমার গবেষণার জন্য জরিপ করতে চাও, তাহলে তোমার ফর্ম, কাগজ ইত্যাদি প্রয়োজন। আর কাজটা যদি ভার্চুয়ালি করতে চাও (আমি করেছিলাম), তাও তোমার ডিভাইস, ইন্টারনেট ইত্যাদি প্রয়োজন। এসব কিছু তোমার হাতের কাছে রাখতেই হবে, যাতে দ্রুতই এগুলো ব্যবহার করে গবেষণা চালিয়ে যেতে পারো। কিছু ক্ষেত্রে উপকরণ বাবদ অনেক বেশি অর্থের প্রয়োজন হতে পারে, যেটা ম্যানেজ করাটাও জরুরি।

মাঠে নামো

সবকিছু মোটামুটি হাতের কাছেই আছে। এবার কাজে নেমে যাও। প্রথমেই তোমার দলের অন্যান্য সদস্যদের সাথে আলোচনা করে নেও। তারপর কাজ ভাগ করে নিয়ে ম্যারাথন শুরু করো। একটা কাজের পেছনে কখনো সবাই মিলে শ্রম দিবা না, ক্ষেত্রভিত্তিক কাজ করলে পুরো গবেষণাটার আউটপুট হিসেবে ভালো কিছু পাওয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি।

কাজ অনেক ধরণের আছে। যেমনঃ পড়া, অনুসন্ধান বা জরিপ করা, তথ্যভান্ডার তৈরি ইত্যাদি। এখন একে একে এসব নিয়ে কথা বলব। ধৈর্য ধরে বিষয়গুলো খেয়াল করো।

প্রথমেই পড়ার কথা বলি। যেকোনো গবেষণায় এতা সবচেয়ে বেশি জরুরি। ধরো, তুমি ডেঙ্গুর প্রকোপের সাথে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করছো, সেক্ষেত্রে এ বিষয়ে কোনো বই আছে কিনা, পূর্বে কোনো গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে কিনা, ইন্টারনেটে কোন ব্লগপোস্ট বা তথ্যসূত্র আছে কিনা সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে। এরপর সেগুলো পড়তে হবে।

বইয়ের ব্যাপারটা খোঁজা খুবই সহজ। বিভিন্ন দেশী-বিদেশী বইয়ের অনলাইন প্ল্যাটফর্মে গিয়ে তুমি ডেঙ্গু ও রোগ বিষয়ে কী কী বই আছে এবং বইগুলো তোমার গবেষণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা সেটা খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় বই সংগ্রহ করতে পারবে। আর গবেষণাপত্র খুঁজে পেতে ResearchGate বা Google Scholar এর মতো ওয়েবসাইটের সাহায্য নিতে পারো। আর ব্লগপোস্ট, আর্টিকেল বা অন্য কোনো রেফারেন্সের জন্য এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, রয়টার্স, সায়েন্স ম্যাগাজিন, ফরেন অ্যাফেয়ার্স, ফোর্বস ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে পারো।

এরপর আসি জরিপ-অনুসন্ধান বা মতামত ও বাস্তব তথ্য নিজে থেকে সংগ্রহের ব্যাপারে। এখন তুমি তোমার ডেঙ্গু বিষয়ক গবেষণার জন্য জরিপ করতে চাচ্ছো যে কোন শ্রেণির মানুষেরা কত বেশি ডেঙ্গুর শিকার হচ্ছে। এক্ষেত্রে তুমি বিভিন্ন স্থানে গিয়ে জরিপ করেও এই হার নির্ণয় করতে পারবা, আবার ভার্চুয়ালি পুরো দেশব্যপী তথ্য ও মতামত সংগ্রহের জন্য গুগল ফর্মের মাধ্যমেও পরিসংখ্যান তৈরি করতে পারবা।

এরপর ঐ পরিসংখ্যানগুলো থেকে তথ্য বিশ্লেষণ করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে। আর পূর্বে বিভিন্ন বই, ব্লগপোস্ট এবং গবেষণাপত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যও রেফারেন্স সহ একত্রিত করো। তোমার জরিপ বা অনুসন্ধান এবং পঠিত বিষয় থেকে প্রাপ্ত সকল পরিসংখ্যান ও উপাত্তকে মিলিয়ে একটা তথ্যভান্ডার তৈরি করো। আর যদি তুমি হাতে-কলমে কোনো পরীক্ষা করে থাকো, তাহলে সেই পরীক্ষণের ফলাফল লিপিবদ্ধ করো। এরপর তোমার তথ্যভান্ডার বা লিপিবদ্ধ ফলাফলের উপর ভিত্তি করে একটি খসড়া তৈরি করে ফেলো।

গবেষণাপত্র লেখা

খসড়ার আলোকে এবার গবেষণাপত্র লিখে ফেলো। একটা বিষয় খেয়াল রাখবে, গবেষণাপত্র অবশ্যই Formal হবে, কোনো অতিরিক্ত কথা বা রূপক, কবিতা বা অপ্রয়োজনীয় বিষয় উল্লেখ করা যাবে না।  একটি আদর্শ গবেষণাপত্রে নিম্নোক্ত পয়েন্টগুলো থাকবেঃ

১. সারসংক্ষেপ (Abstract)
২. ভূমিকা (Introduction)
৩. কার্যপদ্ধতি (Methods)
৪. ফলাফল (Result)
৫. উপসংহার (Conclusion)
৬. তথ্যসূত্র (Reference)

সারসংক্ষেপে পুরো গবেষণার একদম সারাংশটা লিখতে হবে অল্প কথায়। এরপর ভূমিকাতে গবেষণার আইডিয়া কীভাবে পেলে, কীভাবে শুরুটা করলে ও এগিয়ে গেলে, হাইপোথিসিস কী ছিল এবং প্রাথমিক ফলাফল কী সেটা নিয়ে সংক্ষেপে অনধিক ২টি প্যারায় সংক্ষিপ্ত বর্ণনা লিখতে হবে। কার্যপদ্ধতিতে গবেষণার কাজ আর ফলাফলে সেই কাজ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বা সিদ্ধান্ত উল্লেখ করতে হবে।

তোমার গবেষণাটির সূত্র ধরে ভবিষ্যতে আর কেউ গবেষণা করতে পারবে কিনা কিংবা তোমার গবেষণাটি নিয়ে সংক্ষিপ্ত মত থাকলে সেগুলো উপসংহারে লিখতে হবে। এছাড়াও তোমার গবেষণাটিতে বাইরের কেউ সহযোগিতা করেছে কিনা সেটারও কৃতজ্ঞতা এখানে প্রকাশ করতে পারো। আর গবেষণা করতে গিয়ে বাইরের কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলে এবং সেটা গবেষণাপত্রে উল্লেখ করলে সেই “তথ্যসূত্র” বা “রেফারেন্স” পয়েন্টে একে একে লিখতে হবে।

ব্যাস, শেষ!

প্রেজেন্টেশন

যদি তুমি জাতীয় পর্যায়ের জন্য নির্বাচিত হও, তাহলে তোমাকে ডিজিটাল স্লাইড তৈরি করে তোমার গবেষণার উপর ১০ মিনিটের প্রেজেন্টেশন দিতে হবে, যেটা মারাত্মক জরুরি। তোমরা দলের সদস্যরা ভাগ করে নিবে কে কতক্ষণ কোন পয়েন্টে কথা বলবা, কে স্লাইড নিয়ন্ত্রণ করবা ইত্যাদি।

তো, এই ছিল চিন্তার চাষের গবেষণাভিত্তিক ক্যাম্পেইনের প্রস্তুতি নিয়ে একটি বিস্তারিত ব্লগপোস্ট। আশা করি, তুমি লেখাটি পড়ে যথেষ্ট আইডিয়া এবং হিন্ট পেয়েছো। এখন তোমার সহকর্মীদেরকেও এটা পড়তে দেও এবং কাজে লেগে যাও। শুভ কামনা রইল!

লেখাটি 261-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 897 other subscribers