খরগোশ ল্যাগোমর্ফা বর্গের লেপোরিডি গোত্রের একটা তৃণভোজী প্রাণী। এদের দুটো ভাগ আছে- হেয়ার (Hare) এবং র্যাবিট (Rabbit)। আমরা অনেকেই প্রায়শই এই দুই দলকে এক করে ফেলি। কিন্তু তাদের মধ্যে আছে বিস্তর ফারাক। র্যাবিটদের দেহের গড়ন অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের হয়। কান জোড়াও হেয়ার’দের তুলনায় ছোট ছোট। জন্মলগ্নে র্যাবিট শাবক’দের দেহে কোনরকম পশম থাকে না। চোখ জোড়া বন্ধ অবস্থায় থাকে। এরা গাছপালা আর ঝোপঝাড়ে ভরতি এলাকায় মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বসবাস করে। অন্যদিকে হেয়ার’দের দেহ বড় আকারের হয়, কান জোড়াও বেশ লম্বা। জন্মলগ্ন থেকেই এদের গা ভরতি পশম থাকে। চোখ খোলা অবস্থাতেই হেয়ার শাবকের জন্ম হয়। বাসস্থান নির্বাচনেও এদের র্যাবিট’দের সাথে পার্থক্য আছে। এরা সাধারণত খোলামেলা জায়গায় বাসা বানিয়ে থাকতে পছন্দ করে। হেয়ারদের সবাই-ই লেপাস গণের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু র্যাবিট’দের দশটা গণে ভাগ করা গেছে- ব্র্যাকিলাগাস, বুনোলাগাস, ক্যাপ্রোলাগাস, নেসোলাগাস, অরিক্টোলাগাস, পেন্টালাগাস, পোয়েলাগাস, প্রোনোলাগাস, রোমেরোলগাস এবং সিলভিলাগাস।
জীবাশ্ম রেকর্ড বলে ল্যাগোমর্ফা বর্গ বিবর্তিত হয়েছিল এশিয়ায়, আজ থেকে চল্লিশ মিলিয়ন বছর আগে ইওসিন পিরিয়ডে। মহাদেশগুলোর স্থানান্তরের দরুন সারা বিশ্বে (অস্ট্রেলিয়া বাদে) র্যাবিট এবং হেয়ারদের নানান প্রজাতি ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে ইউরোপ এবং আমেরিকায় ষাট’টিরও বেশী র্যাবিট প্রজাতি আছে। এরা সবাই-ই ইউরোপিয়ান র্যাবিট অরিক্টোলাগাস কুনিকুলাস (Oryctolagus cuniculus) এর উত্তরসূরি। এরা বিবর্তিত হয়েছে প্রায় অর্ধ মিলিয়ন বছর আগে। রোমান’দের হাত ধরে এরা পুরো ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। দুই শ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে সর্বপ্রথম রোমানরা মাংস এবং পশমের লাভের আশায় খরগোশ (র্যাবিট) পুষতে লাগল, যা কিউনিকালচার নামে পরিচিত। কারো কারো মতে রোমানরাই ব্রিটেনে খরগোশদের (র্যাবিট) পুনঃপ্রবর্তিত করে। ১৮৫৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় এবং ১৮৬০ সালে নিউজিল্যান্ডে র্যাবিটসদের বিস্তৃতি ঘটে ব্রিটিশদের হাত ধরে। পুরো বিশ্বে ইউরোপিয়ান র্যাবিটদের সংখ্যায়ই সবচাইতে বেশী। বাংলাদেশে সাধারণত র্যাবিটদের সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে হেয়ার আছে।
র্যাবিটদের সমাজ বেশ জটিল। এরা দল গঠন করে বাস করে। প্রতিটা দলে বিশ জনের মত সদস্য থাকে। নিজেদের এলাকা রক্ষা করতে এরা দল বেধে শত্রুর মোকাবেলা করে। আবার নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করার জন্যে নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দে জড়ায়। তাদের মধ্যে আবার আলফা নারী এবং আলফা পুরুষ খরগোশ আছে। আলফা নারীরা নিজ দলের প্রজনন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে। আলফা পুরুষরা তাদের কাজের পুরষ্কার স্বরুপ নারী খরগোশের সাথে মিলনের সুযোগ পায়। পুরুষ ছানারা একবার মায়ের দুধ ছেড়ে অন্য খাবারে অভ্যস্ত হয়ে গেলে, তার জন্মস্থান ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে বন্য জই খোঁজার জন্যে। নারী ছানারা নিজ এলাকায় থেকে যায়। মা, বোন, কন্যা, দাদী, চাচীরা মিলে একটা মাতৃতান্ত্রিক পরিবার গঠন করে। এই পরিবারে প্রধান থাকে একটা প্রভাবশালী নারী খরগোশ। খুবই কঠোর নিয়মে দল শাসন করে সে। প্রায়শই নিজের অধীনস্থদের সন্তানকে হত্যার উদ্দেশ্যে শিকারিদের সামনে টেনে আনে। র্যাবিট’দের গড় আয়ুষ্কাল চার বছর। কিন্তু বুনো র্যাবিট’রা ন’ বছর অবধি বাঁচতে পারে।
পৃথিবী জুড়ে র্যাবিটদের এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণ হল এদের ভালো প্রজনন ক্ষমতা। মেয়ে খরগোশ (র্যাবিট) তিন থেকে চার মাস বয়সেই প্রজননক্ষম হয়ে উঠে, একসাথে ছ’টা ছানার জন্ম দিতে পারে। একটা খরগোশ দম্পতি বছরে চল্লিশটা শাবকের জন্ম দিতে পারে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, গবাদিপশুর জন্যে শীতকালীন ফসল চাষ বেড়ে গিয়েছিল। সেই সাথে বেড়ে গিয়েছিল প্রাকৃতিক শিকারি প্রাণী হত্যার পরিমাণ। আর তাতে খরগোশের (র্যাবিট) সংখ্যা বেড়ে যায় প্রচুর পরিমাণে। জমির ফসল খেয়ে সাভার করে দিতে থাকল খরগোশের দল। এরা হয়ে উঠল ফসল চাষের বড় শত্রু। খরগোশের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ তখন জরুরি ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। শটগান, ফেরেট, ফাঁদ পাতা কিংবা বিষ- কোনোকিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। কেননা গর্তবাসী খরগোশের দল সহজেই এসবকে ফাঁকি দিতে থাকল। উপায়ন্তর না দেখে খরগোশ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হল মাইক্সোমা নামের এক ধরণের পক্সভাইরাস। এই ভাইরাস র্যাবিটদের দেহে মাইক্সোমাটোসিস নামক মারণঘাতী রোগ সৃষ্টি করে। ১৯৩০ সালে, অস্ট্রেলিয়ান সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নেয় র্যাবিট নিয়ন্ত্রণে এই ভাইরাস ব্যাবহার করার ব্যাপারে। এই আইডিয়া দারুণ কাজে দেয়। প্রথমে অস্ট্রেলিয়া এবং পরে ইউরোপে র্যাবিট প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছিল বলা যায়।
কিন্তু গণহারে খরগোশ হত্যা প্রকৃতিতে বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। পুরো পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রে র্যাবিট বেশ গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এদেরকে ডাকা হয় ইকোসিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার। সমগ্র বাস্তুতন্ত্রের সংবেদনশীল খাদ্যজাল আর বাসস্থান এর ভারসাম্য রক্ষায় এরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যুক্তরাজ্যের স্কোখলম দ্বীপে, মাইক্সোমাটোসিস এর শুরুর দিকে খরগোশ এর গর্ত গুলোয় পাফিন এবং শিয়ারওয়াটার নামের পাখিরা বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল। আকাশ আর স্থলের অনেক শিকারিরা র্যাবিটদের উপর খাদ্যের জন্যে নির্ভরশীল। খরগোশদের নিরলস ভাবে ঘাস খাওয়া এবং গর্ত তৈরি, সেমি-ওপেন মোজাইক আবাসস্থল টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখে। এই ধরণের আবাসস্থল বন্যজীবনে বেশ প্রতুল। একটা উদাহরণ হচ্ছে পূর্ব অ্যাঙ্গলিয়ার ব্রেকল্যান্ড। এটি একটি বিশেষ ভাবে সংরক্ষিত জায়গা (SAC- Special Area of Conservation)। এই জায়গাটা দেশটির একমাত্র সক্রিয়, ক্রমাগত ভাবে চলমান বালিয়াড়ি হিসেবে পরিচিত। বিরল বন্যজীবের আবাসস্থল হিসেবেও এলাকাটা বিশেষ ভাবে খ্যাত। শায়িত বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ নাউএল (knawel) এর সন্ধান মেলে এই বালিয়াড়িতে। বিশ্বের আর কোথাও এর সন্ধান পাওয়া যায় না।
খরগোশদের বিলুপ্তিতে কৃষকরা খুশি হয়েছিল বটে। তবে উদ্ভিদদের মধ্যে বৈচিত্র্যতা কমে গিয়েছিল। বাজপাখি, বেজি আর অতিথি পাখিরা মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যুক্তরাজ্যের মনোরম নীল প্রজাপতির শুঁয়োপোকাদের খাবার হচ্ছে লাল পিঁপড়া। খরগোশদের চারণ করা তৃণভূমিতে এক সময় প্রচুর পরিমাণে লাল পিঁপড়া পাওয়া যেত। র্যাবিট এর সংখ্যা কমার সাথে সাথে লাল পিঁপড়াদের পরিমাণও কমে এসেছিল। ফলে খাদ্যাভাবে বিলুপ্ত হতে থাকে নীল প্রজাপতিরা। অস্ট্রেলিয়ায়ও অনেক পাখি আর মারসুপিয়াল প্রজাতি হারিয়ে গেছিল র্যাবিট নিশ্চিহ্ন হবার ফলে। ১৯৮৪ সালের দিকে খরগোশদের জন্যে এক নতুন হুমকির আগমন ঘটে চীনে। এটিও একটি ভাইরাস। এর নাম র্যাবিট হেমোরেজিক ডিজিজ ভাইরাস (RHDV)। এই ভাইরাস সংক্রমণে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ র্যাবিটই মারা যায়। আক্রান্ত র্যাবিটের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে, খিঁচুনি শুরু হয়, এবং সবশেষে কোমায় গিয়ে মারা যায়। এই রোগ প্রথমে বেশ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপে। ‘৮৮ সালে স্পেনে প্রথম এই রোগে আক্রান্ত র্যাবিট শনাক্ত হয়। আইবেরিয়ায় ষাট শতাংশ র্যাবিট মারা পড়ে। এর প্রভাব পড়ে র্যাবিট শিকারিদের উপরেও। লিংকস নামের আইবেরিয়ান বনবিড়াল আর স্প্যানিশ ঈগল প্রায় বিলুপ্তই হয়ে গেছিল।
২০১০ সালে RHDV2 নামে একই রকম আরেকটা রোগ ছড়িয়ে পড়ে খরগোশদের মধ্যে। এইবারও ব্যাপক ভাবে কমে যায় খরগোশের সংখ্যা। ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের ভেতর, স্পেনের আন্দালুসিয়ায় ডোনানা জাতীয় উদ্যানে আশি শতাংশ খরগোশ মারা পড়ে। আইবেরিয়ায় ষাট থেকে সত্তর শতাংশ খরগোশ (র্যাবিট) বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং এরই ধারাবাহিকতায় লিংকস আর ঈগলও বিলুপ্ত হয়ে যায়। যুক্তরাজ্য ব্রিডিং বার্ড সার্ভে এর জরিপ অনুসারে, ১৯৯৬ থকে ২০১৮ সালে অবধি ৬৪ শতাংশ বন্য র্যাবিট হারিয়ে যায়। RHDV ভাইরাসের উৎপত্তির বিষয়টা এখনো অজানাই রয়ে গেছে। মাইক্সোমাটোসিস এর মতন এরাও হয়ত এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে ছড়িয়ে পড়ে, কিংবা দুইটা ভাইরাসের জিনোমের মিশ্রণের মাধ্যমেও এদের উদ্ভব হতে পারে। উৎপত্তি যেভাবেই হোক, র্যাবিটদের উপর এই ভাইরাসের প্রভাব মারাত্মক ছিল। এতটাই প্রকট ছিল যে স্পেনে ইউরোপিয়ান র্যাবিটদের বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। র্যাবিট সংরক্ষণের উদ্যোগ ব্যর্থ হবার একটা কারণ লোকজন এখনো এদের কৃষির শত্রু মনে করে। এক বছরে প্রায় ছ’ মিলিয়ন র্যাবিট শিকার করা হয়েছে। কিন্তু এখন এমন কি হল যে এদের সংরক্ষণ করায় উঠে পড়ে লাগতে হল? বিলুপ্তি ঠেকাতে স্পেন এবং ফ্রান্সে প্রতি বছর পাঁচ লাখ র্যাবিট উৎপাদন করা হয়। কিন্তু এদের মধ্যে নব্বই শতাংশই মারা যায় শিকার, রোগ বালাই এবং স্ট্রেস এর কারণে।
তবে এখনো কিছুটা আশার আলো আছে। স্পেনের কিছু কিছু এলাকায় ষাট শতাংশ র্যাবিট এর শরীরে RHDV2 ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি আছে। আইবেরিয়ার সব র্যাবিটকেই টিকে থাকার জন্যে লড়াই করতে হচ্ছে না। অরিক্টোলাগাস কুনিকুলাস কুনিকুলাস (Oryctolagus cuniculus cuniculus) এবং অরিক্টোলাগাস কুনিকুলাস আলগিরাস (O. c. algirus) নামে দুইটা উপপ্রজাতি আছে। আইবেরিয়ান উপদ্বীপের উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হওয়া ডায়াগোনাল লাইনটা একে দুই ভাগে ভাগ করেছে। এর একটা ভাগে বাস করে O. c. cuniculus আর অন্যটায় O. c. algirus। এরা কখনো নিজেদের মধ্যে প্রজননে অংশ নেয় না। কারো কারো মতে এদেরকে আলাদা দুইটা প্রজাতি হিসেবে গণ্য করা উচিত। দক্ষিনে বাস করা O. c. algirus-দের মধ্যে বিলুপ্তির হার বেশী হলেও উত্তরে বাস করা O. c. cuniculus-দের সংখ্যা বরং বাড়তির দিকে। এর পেছনে সঠিক কারণটা এখনো দর্শানো যায় নি। তবে O. c. algirus-দের সংরক্ষণে এই কারণটা জানা জরুরি। একটা উপায় হতে পারে, এদের কলোনির আকার বাড়িয়ে বেশী করে ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়া, যাতে করে এদের ভেতর ঐ ভাইরাসের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি তৈরি হয়।
খরগোশদের আবাসস্থল থেকে চল্লিশ মিটার দূরে কিছু কাঠ গাছের গাদা কৌশলে রেখে দিলে, এরা এই গাদার ভেতর মাটিতে গর্ত খুঁড়া শুরু করে দেয়। গবেষকরা এইরকম ভাবে দুই বছর পরীক্ষা করে দেখেছেন। চল্লিশ শতাংশ কাঠ গাছের গাদার ভেতরেই খরগোশরা গর্ত করে বসবাস শুরু করেছিল। আর নব্বই শতাংশেরও বেশী গাদায় খরগোশদের বিচরণ ছিল। এই প্রক্রিয়া বেশ সরল, প্রযুক্তিগত তেমন কিছুই নেই। কিন্তু বেশ ভালো কাজে দেয়। খরগোশদের সংরক্ষণে এই ধরণের পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। অন্যান্য পদ্ধতি গুলো আরও সাধারণ হতে হবে, যদিও এ ব্যাপারে অর্থায়ন তেমন নেই। সেই সাথে গৃহপালিত খরগোশ গুলোকে বন্য খরগোশ থেকে দূরে রাখতে হবে। অন্যথায়, পুরো ব্যাপারটা বিবর্তনের উপর ছেড়ে দেয়া ছাড়া উপায় নেই। র্যাবিটরা সত্যিকার অর্থেই বেশ দুঃসময় পার করছে। কিন্তু গবেষকরা আশাবাদী যে, র্যাবিট পৃথিবী থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে না।
তথ্যসূত্রঃ নিউ সায়ন্টিস্ট ম্যাগাজিন এর “Save Our Bunnies” প্রবন্ধ আলোকে লেখা।
Leave a Reply