কোন নতুন শহরে জীবনে প্রথমবার গেলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে খাবি খেতে হয়। নতুন কোন পাড়ায় গেলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছাতে আমাদের বারবার গুগল ম্যাপ দেখতে হয়, বা স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে হয়, “ভাই এই জায়গাটা কোন দিকে?”। গন্তব্যস্থানে পৌঁছানোর বদলে কয়েকবার পথ হারানোর দশা! অথচ মস্তিষ্ক ঠিকই সক্রিয়ভাবে জায়গাটা চিনে নিচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ পরেই ওই জায়গাটা আপনার সুপরিচিত হয়ে উঠবে। হয়তো আপনি স্থানীয়দের মতো কিছু শর্টকাট রাস্তাও শিখে নেবেন, আর নতুন বেড়াতে আসা কোন বন্ধুকে অবলীলায় জায়গাটা ঘুরিয়ে দেখাবেন।
শহরটি একটা অচেনা গোলকধাঁধা থেকে হাতের উল্টোপিঠের মতো চেনা রাস্তায় রূপান্তরের কারণ হলো আপনার মস্তিষ্ক একটা কগনিটিভ ম্যাপ তৈরি করে ফেলেছে। এই ম্যাপটা হলো বাইরের জায়গাটার একটা মানসিক প্রতিরূপ, যেটা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে কোন রাস্তা নিতে হবে সে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
মস্তিষ্ক ঠিক কিভাবে এই নতুন জায়গাটার মানসিক ম্যাপ তৈরি করে?
চলুন পরিচিত হওয়া যাক হিপ্পোক্যাম্পাসের সাথে। মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস নামক অংশটা আমাদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে সাহায্য করে। “হিপ্পোক্যাম্পাস” শব্দটা শুনলে আমার কেন যেন মনে হয়, যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যে একটা হিপোপটেম্যাস বা জলহস্তি হেটে বেড়াচ্ছে! আসলে এই শব্দটা গ্রীক যার অর্থ সি-হর্স। মস্তিষ্কের মোটামুটি কেন্দ্রে থাকা এই অংশটা দেখতে সি-হর্সের মতো। গত শতাব্দীর পুরোটা জুড়ে গবেষকদের আগ্রহের কেন্দ্র ছিলো হিপ্পোক্যাম্পাস। তবে হিপ্পোক্যাম্পাসের কাজ ঠিক কি তা দীর্ঘদিন ধরে অজানাই ছিলো। এখন আমরা জানি যে মস্তিষ্কের এই অংশটি স্মৃতি, পথ খুঁজে বের করা, ও ভবিষ্যত পরিকল্পনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এই লেখাতে হিপ্পোক্যাম্পাসের একটা বিশেষ কাজ সম্পর্কে আমরা জানবো – তা হলো অবস্থান নির্ধারণ প্রক্রিয়া।
১৯৭০-এর দশকে ইঁদুরের হিপ্পোক্যাম্পাসে ইলেকট্রোড নিয়ে স্পাইক বা স্নায়ু-উত্তেজিত হওয়ার সংকেত রেকর্ড করছিলেন দুইজন গবেষক – জন ও’ক্যাফে এবং জোনাথন জাস্ট্রাভস্কি। তারা খেয়াল করলেন, ইঁদুরটি স্থানের ঠিক কোন বিন্দুতে আছে, তার সাথে কিছু স্নায়ুর সক্রিয় হওয়ার স্পাইক-সংকেত মিলে যায়।
চলুন মনে মনে ওই পরীক্ষাটা কল্পনা করি। আমরা একটা ছোট্ট চারকোনা জায়গায় ইঁদুরটিকে ছেড়ে দিলাম। ইঁদুরটির মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাসের কিছু নির্দিষ্ট স্নায়ুতে ইলেকট্রিক সংকেত রেকর্ড করা শুরু করলাম।
যখন ওই স্নায়ু থেকে একটা স্পাইক পাওয়া যাবে, তার মানে ওই স্নায়ুটি তখন সক্রিয়ভাবে এর আগের বা পরের স্নায়ুর সাথে সংকেত বিনিময় করছে। এ স্পাইক মূলত কিছুই নয়, তড়িৎ-রাসায়নিক বিভব পরিবর্তনের একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম। দুইটি স্নায়ুর মধ্যে যোগাযোগের একটি মৌলিক একক হলো এই স্পাইক।
তো, যখন ওই ইঁদুরটির মাথায় রাখা প্রোবে স্পাইক তৈরি হয়, তখন আমরা ইঁদুরটি চারকোনা ঘরের ঠিক কোথায় আছে সেটার স্থানাঙ্ক লিপিবদ্ধ করে রাখবো।
ইঁদুরটি ঘরের মধ্যে বেশ কয়েকবার ঘুরে বেড়ানোর পর আমরা দেখতে পারবো যে, এই স্নায়ুটি ঘরের একটা নির্দিষ্ট একটা বিন্দুর বিশাল ভক্ত! কারণ যখনই ইঁদুরটি ওই বিন্দুতে বা এর আশেপাশে যায়, তখনই ওই স্নায়ুটি তড়িৎ-রাসায়নিকভাবে উত্তেজিত হয়ে স্পাইক তৈরি করা শুরু করে।
এই গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে এই স্নায়ুগুলো নাম দেয়া যাক স্থান-কোষ (Place cell) এবং ঘরের মধ্যে যেখানে ওই স্থান-কোষ সক্রিয় হয় তার নাম দেয়া যাক স্থান-ক্ষেত্র (Place field)। স্থান-ক্ষেত্র হলো বহির্বিশ্বের একটা অংশ যেখানে ইঁদুরটি ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর স্থান-কোষ মস্তিষ্কে হিপ্পোক্যাম্পাসেরর ভেতরে। আমরা কিন্তু বলতে পারবো না যে স্থান-স্নায়ুকোষের সাথে স্থান-ক্ষেত্রের আকার সম্পর্কিত। কোন স্থানকোষের জন্য স্থানক্ষেত্র আকারে বড়ও হতে পারে, আবার ছোটও হতে পারে।
এখন আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন যে আমরা তো ত্রিমাত্রিক জগতের বাসিন্দা। আমরা যে শুধু পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ দিকেই যাওয়া আসা করি এমন না, আমরা তো উপরে নিচেও উঠতে নামতে পারি? সেটা সিঁড়ি দিয়ে একটা বিল্ডিঙের উপরে উঠাই হোক বা গাছে চড়াই হোক না কেন। স্থান-কোষ কি ত্রিমাত্রিক ভাবেও কাজ করবে?
বেশ কিছু অসাধারণ গবেষণা থেকে আমরা এখন জানি যে স্থান-কোষ তৃতীয় মাত্রাতেও কাজ করে। বিজ্ঞানীরা বাদুরের মাথায় হিপ্পোক্যাম্পাস থেকে বেতারের মাধ্যমে স্পাইক সংকেত প্রেরণ করে, কিংবা ত্রিমাত্রিক গোলকধাঁধায় একটা ইঁদুরকে ছেড়ে স্থান-কোষের সংকেত সংগ্রহ করে এটা নিশ্চিত করেছেন।
আমাদের মতো সমতলবাসী প্রাণীদেরও স্থানের তৃতীয় মাত্রায় ভ্রমণের জন্যেও স্থান-কোষের বর্তনী রয়েছে। ভেবে দেখলে এটা স্বাভাবিকই লাগবে। কিন্তু প্রশ্ন চলে আসে যে এই স্থানকোষগুলো আসলে কি করছে? এরা কি আসলেই আমাদের “রাস্তা খুঁজে বেড়ানো”-র জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে? নাকি এরা কেবলই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভ্রমণ-করার সময় একটা উপজাত হিসেবে সক্রিয় হয়?
এটা নির্ধারণ করার জন্য গবেষকরা একটা দারুণ পরীক্ষা করলেন। তারা ইঁদুরকে একটা সরলরৈখিক ট্র্যাকে দৌড়ানোর জন্য অভ্যস্ত করলেন। এই ট্র্যাকটা আর কিছুই নয়, একটা ট্রেডমিল, কিন্তু আকারে গোলাকার, অর্থাৎ ট্রেডমিলটা পুরনো যুগের মাউসের বলের মতো যে কোন দিকেই ঘুরতে পারে। তারপর তারা ইঁদুরটির মাথা একজায়গায় ধরে রাখার ব্যবস্থা করলেন। আর ইঁদুরটি চোখের সামনে একটা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি স্ক্রিন দিয়ে দিলেন।
গবেষণাটা বেশ মজার। কারণ ইঁদুরটি যতই দৌড়াক না কেন, সে মূলত এক জায়গাতেই স্থির আছে। অথচ ওর চোখের সামনে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছে সম্পূর্ণ অন্য একটা জগত, যেখানে ঘুরে বেড়ানোর উন্মু্ক্ত একটা জায়গা প্রদর্শিত হচ্ছে। ইঁদুরটির মস্তিষ্ক ভাবছে যে সে ওই উন্মুক্ত জায়গায় বিচরণ করছে। যেহেতু তার মস্তিষ্ক ভার্চুয়াল রিয়েলিটির গোলক-ধাঁধায় বিচরণ করার অভিজ্ঞতা লাভ করছে, তার হিপ্পোক্যাম্পাসের স্থান-কোষগুলোও অনুরূপ প্রতিক্রিয়া দেয়ার কথা।
এই পরীক্ষা থেকে ঠিক এই বিষয়টাই লক্ষ্য করা গেলো। এই ভার্চুয়াল সরলরৈখিক ট্র্যাকের বিভিন্ন স্থান-ক্ষেত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আলাদা আলাদা স্থান-কোষ পর্যবেক্ষণ করা গেলো। একদল স্নায়ু ট্র্যাকের শুরুর দিকে সক্রিয় হচ্ছে, অন্য স্নায়ুদল ট্র্যাকের শেষ দিকে পৌঁছালে উদ্দীপিত হচ্ছে। যদিও ইঁদুরটি একটি জায়গাতেই স্থির থাকছে, কিন্তু ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে থাকা তার মস্তিষ্ক গোলক-ধাঁধায় ভ্রমণ করার সাথে সাথে বিভিন্ন স্থান-কোষকেও সক্রিয় করে তুলছে। অর্থাৎ যে এই স্থান-কোষগুলো ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতেও কাজ করে।
গবেষকরা এই পরীক্ষাটাই একটু বদলালেন। এখন ইঁদুরটাকে ওই ট্র্যাকে দৌড়ানোর পাশাপাশি ভার্চুয়াল ট্র্যাকের শেষে পৌঁছে একটা বস্তু চাটতে অভ্যস্ত করা হলো যেখানে পুরস্কারসরূপ খাবার সরবরাহ করা হবে। প্রশ্ন হলো, যদি আমরা এই ট্র্যাকের শেষ দিকে যেসব স্থান-কোষ সক্রিয় হয়, সেগুলোকে কৃত্রিম ভাবে উত্তেজিত করি, যদিও ইঁদুরটি ওই জায়গায় পৌঁছায় নি, তখন কি হবে? ইঁদুরটি বোকা বনবে? দেখা গেলো, ওই ট্র্যাকের শেষে না পৌঁছেও সেখানকার স্থান-কোষগুলোকে কৃত্রিমভাবে উত্তেজিত করলে ইঁদুরটি অনেক আগে থাকতেই চাটা শুরু করে! এর মানে দাঁড়ায় যে নির্দিষ্টি স্থান-কোষ ওই স্থানের সাথে সম্পর্কিত আচরণকেও প্রভাবিত করতে পারে।
এখন যদি ওই ইঁদুরটা ভার্চুয়াল গোলকধাঁধার শেষে থাকা অবস্থায় গোলকধাঁধার শুরুর দিকে সম্পর্কযুক্ত স্থানকোষকে উদ্দিপীত করা হয় তখন কি ঘটতে পারে? আপনি যা ভাবছেন সেটাই! ইঁদুরটি ভার্চুয়াল গোলকধাঁধার শেষ সীমানা পার হয়ে আরো সামনের দিকে যেতে থাকে!
এই পরীক্ষাগুলো প্রমাণ করে যে এই স্থানকোষগুলোই আমাদের মানসিক ম্যাপ তৈরি করে। অর্থাৎ স্থানকোষ আমাদের ঘোরাঘুরি হওয়ার কারণে উৎপন্ন উপজাত নয়। বরং জিপিএস এর মতো স্থান-কোষই মস্তিষ্কে তৈরি মানসিক ম্যাপে আমরা কোথায় আছি সেটার অবস্থান নির্ধারণ করে।
এখন আমরা ভাবতে পারি যে মস্তিষ্কে বিভিন্ন স্থান-কোষ যেভাবে ছড়িয়ে থাকে, সেটা বাইরের পরিবেশের বিভিন্ন স্থানের সাথে কতটুকু সম্পর্কিত? বাইরের পরিবেশে যেখানে চেয়ার-টেবিল, দরজা-জানলা, রাস্তা-পথঘাট আছে, একইভাবে কি মস্তিষ্কের স্থান-কোষগুলোই সজ্জিত? দেখা গেলো, বিষয়টা এমন না আসলে। একই স্থান-কোষ একটি পরিবেশের (যেমন বাসা) যে স্থান-ক্ষেত্রে সক্রিয় হয়, সেটা হয়তো অন্য কোন পরিবেশের (যেমন অফিস) অন্য কোন স্থান-ক্ষেত্রে সক্রিয় হচ্ছে। এমনকি ওই স্থান কোষ তৃতীয় পরিবেশের (যেমন বাজার) কোন স্থান-ক্ষেত্রেই সক্রিয় হচ্ছে না। স্থান-কোষোর সক্রিয় হওয়ার যে ধাঁচ তা দুইটি পরিবেশের মধ্যে পার্থক্য কতটুকু তার উপর অনেকাংশেই নির্ভর করে। পরিবেশ বদলে যাওয়ার সাথে সাথে স্থান-কোষ ও স্থান-ক্ষেত্রের মধ্যে সম্পর্ক বদলে যাওয়াটাকে বলে রিম্যাপিং।
যেমন আপনি যদি ঘরের দেয়ালের রঙ বদলে ফার্নিচারগুলো নতুন জায়গায় সরান, তাহলে স্থান-ক্ষেত্র পরিবর্তন হয়ে যাবে। কিন্তু যদি আপনি দেয়ালে একটা নতুন ছবির ফ্রেম ঝুলান, তাহলে হয়তো স্থান-ক্ষেত্র মোটাদাগে একই থাকবে। পরিবেশ বদলে যাওয়ার সাথে স্থান-ক্ষেত্র ও স্থান-কোষের সম্পর্ক ঠিক কিভাবে বদলে যায় তার নিয়মগুলো বিজ্ঞানীরা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারেন নি। তবে বেশ কিছু আগ্রহোদ্দীপক বিষয় বিজ্ঞানীরা খেয়াল করেছেন।
যেমন ধরুন, আপনি যদি কোন ইঁদুরকে একটা সিলিন্ডার-আকৃতির চেম্বারে আটকে রাখলেন। সে চেম্বারে একটি কার্ড থাকবে। এখন ওই কার্ডটি ঘুরিয়ে দিলে ইঁদুরটির স্থান-ক্ষেত্রও ঘুরিয়ে যাবে, কিন্তু বিভিন্ন স্থান-ক্ষেত্রের মধ্যকার আপেক্ষিক সম্পর্ক একই থাকবে। অন্যদিকে চেম্বারটা একই রেখে যদি দৈর্ঘ্য বা আকার বদলে দেন, তখন স্থান-ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। আমরা রিম্যাপিং বিষয়ক বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে এটুকু বলতে পারি যে, স্থান-কোষ মূলত কোন প্রাণি তার বাইরের পরিবেশের ঠিক কোথায় আছে তার স্থানাঙ্ক নির্ধারণ করে শুধু তাই নয়, বরং পরিবেশের পরিচয় সম্পর্কেও একটা বার্তা দেয়।
মজার বিষয়, একই পরিবেশে থাকা ইঁদুর যদি দেখে যে, স্থানের সাথে সম্পর্কিত নয় এমন কোন বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয়ে গেছে, তাতেও স্থান-কোষের রিম্যাপিং হতে পারে। এ ধরণের বৈশিষ্ট্য হতে পারে ইঁদুর যে ঘরে আছে সেটাতে নতুন কোন গন্ধ, কিংবা ইলেকট্রিক শকের অবতারণা। যদি কোন ইঁদুরকে তার পরিচিত একটা প্রকোষ্ঠে ঘুরে বেড়ানোর সময় আপনি খুব সামান্য ইলেকট্রিক শক দিয়ে থাকেন, তাহলে তার মধ্যে ওই প্রকোষ্ঠ সম্পর্কে একটা ভীতি তৈরি করবে। এই নতুন আবেগ তার স্থান-কোষকে রিম্যাপিং করে ফেলে, যদিও প্রকোষ্ঠের কোন স্থানিক পরিবর্তন হয় নি।
এসব রিম্যাপিং পর্যবেক্ষণ থেকে আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন যে, হিপ্পোক্যাম্পাসের এই স্নায়ুগুলোকে “স্থান-কোষ” নাম দেয়া ঠিক হয়েছে কি না। যদিও প্রথম দিকের গবেষণাতে এই স্নায়ুকোষগুলো মস্তিষ্কের স্থানাঙ্ক ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে, কিন্তু এখন আমরা জানি এ কোষগুলো স্থানের সাথে সম্পর্কিত নয় এমন তথ্য নিয়েও কাজ করতে পারে। এ বিষয়ে আরেকটি বিখ্যাত পরীক্ষা সম্পর্কে জানা যাক, যেখানে ইঁদুরদের শব্দ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখানো হয়।
প্রথমে ইঁদুরকে একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ শুনিয়ে তাকে পুরস্কার (খাবার) পেতে অভ্যস্ত করানো হলো। তারপর তাকে একটা জয়স্টিক দেয়া হলো যেটা দিয়ে একটা স্পিকার থেকে বের হওয়া শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ইঁদুরটি প্রথমে জয়স্টিক দিয়ে এলোমেলো নাড়াচাড়া করলেও যখনই তারা ওই প্রথম ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তৈরি করতে পারবে, তখনই তাদের পুনরায় পুরস্কার দেয়া হবে। ইঁদুরটি জয়স্টিক নিয়ন্ত্রণের সাথে সাথে বিজ্ঞানীর তার হিপ্পোক্যাম্পাসের স্থান-কোষের তৎপরতা রেকর্ড করা শুরু করলেন। দেখা গেলো, কিছু স্থান-কোষ কম ফ্রিকোয়েন্সির শব্দের সাথে তৎপর হয়ে ওঠে, অন্যদিকে বেশি ফ্রিকোয়েন্সির শব্দে একেবারেই ভিন্ন স্থান-কোষ সক্রিয় হয়ে উঠছে! জয়স্টিক দিয়ে শব্দ নিয়ন্ত্রণের সাথে সাথে স্থান-কোষগুলো এমনভাবে সক্রিয় হয়ে উঠছে, যেটা তুলনা করা চলে ইঁদুরটির কোন পরিবেশে ঘুরে বেড়ানোর সাথে! এটার মানে দাড়ালো, ইঁদুরটি আসলে মস্তিস্কে একটি শব্দ-স্থান তৈরি করছে, যেখানে তারা আকাঙ্ক্ষিত ফ্রিকোয়েন্সিতে পৌঁছানোর জন্য মানসিকভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে!
এই গবেষণা স্থান-কোষ সম্পর্কে একটা নতুন মাত্রা যোগ করে। স্থান-কোষ যে শুধুমাত্র একটা ভৌত-পরিবেশের সাথেই সম্পর্কিত বিষয়টা এমন নয়, বরং স্থানের ধারণাটা আরো বিমূর্ত হতে পারে। অন্যভাবে বলা যায়, স্থানকোষ কোন অবিচ্ছিন্ন চলককে অনুসরণ করার কাজ করে। এই চলক হতে পারে পরিবেশে অবস্থান নির্ণয়ের স্থানাঙ্ক, যেমনটা একটা গ্রাফে X- ও Y- অক্ষে অবস্থান থেকে আমরা যেভাবে একটা বিন্দু খুঁজে পাই। আবার এই চলক হতে পারে শব্দের কোন নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি খুঁজে পাওয়া।
মস্তিষ্কের এই স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা ঠিক কিভাবে কাজ করে সেটা আমরা এখনো ভালোভাবে বুঝি না। তবে জন ও’কেফে তার দুই সহকর্মীর এডভার্ট মোজার ও মে-ব্রিট মোজার ২০১৪ সালে নোবেল পুরস্কার পান। তাদের সেই গবেষণা সম্পর্কে খানিকটা লিখেছিলাম: চিকিৎসাবিদ্যায় ২০১৪ সালের নোবেল: মস্তিষ্কের অবস্থান-নির্ণয়-ব্যবস্থা।
তথ্যসূত্র:
- Artem Kirsanov – Place cells: How your brain creates maps of abstract spaces
- Anderson, M.I., Jeffery, K.J., 2003. Heterogeneous Modulation of Place Cell Firing by Changes in Context. J. Neurosci. 23, 8827–8835. https://doi.org/10.1523/JNEUROSCI.23-…
- Aronov, D., Nevers, R., Tank, D.W., 2017. Mapping of a non-spatial dimension by the hippocampal–entorhinal circuit. Nature 543, 719–722.
- Bostock, E., Muller, R.U., Kubie, J.L., 1991. Experience-dependent modifications of hippocampal place cell firing. Hippocampus 1, 193–205. Experience-dependent modifications of hippocampal place cell firing
- Christopher D. Harvey, Forrest Collman, Daniel A. Dombeck, David W. Tank, 2009. Intracellular dynamics of hippocampal place cells during virtual navigation. Nature.
- Grieves, R.M., Jedidi-Ayoub, S., Mishchanchuk, K., Liu, A., Renaudineau, S., Jeffery, K.J., 2020. The place-cell representation of volumetric space in rats. Nat Commun 11, 789.
- Jeffery, K.J., 2011. Place Cells, Grid Cells, Attractors, and Remapping. Neural Plasticity 2011, 1–11.
- Latuske, P., Kornienko, O., Kohler, L., Allen, K., 2018. Hippocampal Remapping and Its Entorhinal Origin. Front. Behav. Neurosci. 11, 253. Laura Lee Colgin, Edvard I. Moser, May-Britt Moser, 2008. Understanding memory through hippocampal remapping. Trends in Neurosciences. Meredith Minear, Tesalee K. Sensibaugh, 2020. Neuroscience of Navigation.
- Moita, M.A.P., 2004. Putting Fear in Its Place: Remapping of Hippocampal Place Cells during Fear Conditioning. Journal of Neuroscience 24, 7015–7023.
- O’Keefe, J., Burgess, N., 1996. Geometric determinants of the place fields of hippocampal neurons. Nature 381, 425–428.
- Robinson, N.T.M., Descamps, L.A.L., Russell, L.E., Buchholz, M.O., Bicknell, B.A., Antonov, G.K., Lau, J.Y.N., Nutbrown, R., Schmidt-Hieber, C., Häusser, M., 2020. Targeted Activation of Hippocampal Place Cells Drives Memory-Guided Spatial Behavior. Cell 183, 1586-1599.e10.
- Wohlgemuth, M.J., Yu, C., Moss, C.F., 2018. 3D Hippocampal Place Field Dynamics in Free-Flying Echolocating Bats. Front. Cell. Neurosci. 12, 270.
Leave a Reply