১৯৮৭ সালের , ২৩ শে মে । কানাডার ওন্টারিও শহরের পুলিশ স্টেশনে রক্তাক্ত আর ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় হাজির হয়েছে এক লোক । বেশ দ্বিধাদ্বন্ধে ভুগছে সে। তার মনে হচ্ছে সে বোধহয় কাউকে খুন করে ফেলেছে । কিন্তু তার প্রায় কিছুই মনে নেই, ঝাপসা ঝাপসা কিছু স্মৃতি মাথায় আসছে । পুলিশ খোঁজ চালালে বুঝতে পারে খুন হয়েছে লোকটির শ্বাশুড়ি । শ্বশুরও মারাত্মক ভাবে আহত । ঘটনা শুনে কেনেথ পার্কস নামের লোকটি পুরো হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। ব্যক্তি জীবনে সে শান্তশিষ্ট লোক, শ্বশুরবাড়ির সাথে তার এমন কোনো ঝামেলা বাধেই নি যে খুনাখুনি হয়ে যাবে। তার মতে সে ঘুমের মধ্যে এই কাজটি করেছে। কিন্তু খুন যেহেতু করেই ফেলেছে সাজা তো পেতেই হবে। তাই লোকটাকে যথারীতি গ্রেফতার করা হলো।
পার্কস ঘুমের মধ্যে হাটাহাটি করার ব্যাধিতে ভুগছিলো যার কেতাবি নাম “সোমনাম্বুলিজম (Somnambulism)”। এই ব্যাধিতে আক্রান্তরা নিজের অজান্তেই ঘুমের মধ্যে হাটাহাটি করে এবং সেসময়ে ঘটা ঘটনার প্রায় কোনো কিছুই মনে রাখতে পারে না।
ঘুমের চারটি ধাপ আছে। ঘুমের বিশেষ একটা পর্যায় হলো রেম বা র্যাপিড আই মুভমেন্ট যেখানে ঘনঘন চোখের পাতার নড়াচড়া দেখা যায় । নন রেম পর্যায় নামেও একটা পর্যায় আছে যেখানে চোখের পাতার নড়াচড়া হয় না। নন রেমের ৩ নং ধাপ ঘুমের সবচেয়ে গভীর ধাপ। এই ধাপ থেকে কাউকে জাগিয়ে তোলা কঠিন। হৃৎস্পন্দন, শ্বাসপ্রশ্বাস যথাসম্ভব সর্বনিম্নতে চলে যায়, পেশিগুলো পুরোপুরি শিথিল হয়ে যায়। কেউ যদি সঠিকভাবে নন রেম-৩ ধাপ সম্পন্ন করে, তাহলে ঘুম থেকে উঠে সতেজ অনুভব করবে। স্লিপ ওয়াকিং এই ধাপেই হয়। রোগী ঘুমের মধ্যে হাঁটা হাঁটি করা ছাড়াও অস্পষ্ট কথাবার্তা বলা, রান্না করা, খাবার খাওয়া, গাড়ি চালানো ইত্যাদি কাজ করতে পারে। তাদের এসব কাজ হয় অযৌক্তিক এবং উদ্দেশ্যহীন।
ঘুমের মধ্যে হাঁটা ব্যাধি বেশ বিপদজনক হতে পারে। ১৯৯৫ সালে সুইজারল্যান্ডের লুসান ইউনিভার্সিটি হসপিটালের গবেষক ফ্রান্সসিসকা সিকলারি ও তার দল এবিষয়ে একটি গবেষণা করেন। তাদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় বিখ্যাত জার্নাল সায়েন্টিফিক এমেরিকান-এ। গবেষণায় দেখা যায় ৬৪ জন রোগীর অর্ধেকের বেশিই ঘুমের মধ্যে এমনসব আচরণ করেছে যা তাদের বা অন্যদের জন্যে ক্ষতিকারক হতে পারে। ঘুমের ঘোরে করা এসব সহিংস আচরণ মোটেও হেলাফেলা করবার বিষয় নয়। কিন্তু পার্কসের বিশ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে গিয়ে মানুষ খুন করে ফেলাটা বিরল ঘটনা বটে। ইতিহাস ঘাটলে অবশ্য এইরকম আরও কয়েকটি খুনের কথা জানা যায়৷ এই রোগের সঠিক কারণ এখনও পর্যন্ত অজানা। তবে এর ব্যাখ্যায় বেশ ক’টা হাইপোথিসিস প্রচলিত আছে। অনেকের মতে অপরিণত কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র স্লিপ ওয়াকিং-এর কারণ। এজন্য আট থেকে বার বছর বয়সী শিশুদের মধ্যেই স্লিপ ওয়াকিং বেশি দেখা যায়। কানাডার মন্ট্রিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডমিনিক পেটিট এর করা এক গবেষণায় দেখা যায় পনের শতাংশ শিশু জীবনে একবারেও জন্য হলে স্লিপ ওয়াকিং করেছে।
ইউনিভার্সিটি হসপিটাল অব বার্নের গবেষকরা ১৬ বছর বয়সী একজনের মাথায় ইলেকট্রোড বসিয়ে তার মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেন। গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন স্নায়ুবিদ ক্লডিও ব্যাসেতি। এক রাতে দেখা গেলো, ছেলেটি গভীর ঘুম ঘুমোচ্ছে ঠিকই কিন্তু সে স্লিপওয়াকিং করছে। গবেষকরা ছেলেটির শরীরে তেজস্ক্রিয় ট্রেসার প্রবেশ করায়। উদ্দেশ্য তার মস্তিষ্কের কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পাওয়া। দেখা যায় যে স্লিপওয়াকিং এর সময় মস্তিষ্কের চলাচল সম্পর্কিত কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণকারী অংশগুলো বেশি সক্রিয় থাকে এবং মনোযোগ , উপলব্ধি করার ক্ষমতা, পরিকল্পনা , বিবেক ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা অংশগুলো কম সক্রিয় থাকে।
আরও একটি গবেষণা চালানো হয় ইতালির নিগুরাডা হসপিটালে। এখানে একই সাথে এপিলেপ্সি এবং স্লিপ ওয়াকিং ডিসঅর্ডারে ভুগছে এইরকম রোগীর মস্তিষ্কের প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করা হয়। ফলাফল পাওয়া যায় যে রোগীর মধ্যমস্তিষ্ক জাগ্রত মানুষের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করছে কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলগুলো ঘুমন্ত অবস্থায় আছে। এইরকম আরও কয়েকটি গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করা হয় । এতে দেখা যায় যে স্লিপ ওয়াকিং এর সময় মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব এমনভাবে কাজ করে মানুষটি যেন গভীর ঘুমে আছে। ফ্রন্টাল লোব মানুষের বিবেকবুদ্ধি, সিদ্ধান্ত নেওয়া, মনোযোগ দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে। এই লোবে সমস্যা যুক্ত মানুষ নিজের কাজের সূদুরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে আন্দাজ করতে পারে না। এতে করে সহজেই সহিংস কার্যক্রমে যুক্ত হয়। তবে এই হাইপোথিসিস ঘুমের মধ্যে সংঘটিত হওয়া সহিংসতাকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারে না।
স্লিপ ওয়াকিং হরমোনের মাত্রার কম বেশির কারণেও হতে পারে । স্পেনের ন্যাশনাল হসপিটাল ফর প্যারাপ্লেগিকস এর স্নায়ুবিদ অ্যান্টোনিও অলিভিয়েরো একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় স্বাভাবিক ঘুমের সময় গামা অ্যামিনোবুটেরিক অ্যাসিড নামক রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়। এই রাসায়নিক মস্তিষ্কের মোটর ফাংশনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। শিশুদের স্নায়ুগুলো বিকাশমান পর্যায়ে থাকে তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে রাসায়নিক নিঃসৃত হয় না। এতে করে মস্তিষ্ক ঘুমের সময়ও শরীরকে নড়াচড়া করার নির্দেশ দিতে পারে। যার ফলে স্লিপওয়াকিং হয়। যদি বড় হবার পরও কোনোকারণে এই প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি বিকশিত না হয় তাহলে স্লিপ ওয়াকিং এর অভ্যাস থেকে যায়।
স্লিপওয়াকিং একটি বংশগত ব্যাধি। জামা পেডিয়াট্রিক্স জার্নালে ডমিনিক পেটিট ও তার দলের করা একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। বেশ দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা। গবেষকরা কানাডার কুইবেক প্রদেশে ১৯৯৭ বা ১৯৯৮ সালে জন্মগ্রহণ করেছে এমন প্রায় দুইহাজার শিশুকে নিয়ে কাজ করেন। সবাইকে পরিবারের কেউ স্লিপওয়াকিং করে কিনা এই ভিত্তিতে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করা হয়। দেখা যায় যে যাদের পিতামাতার স্লিপ ওয়াকিং ব্যাধি ছিলো না তাদের ২২.৫ শতাংশ জীবনে একবার হলেও স্লিপ ওয়াকিং করেছে। পিতামাতা উভয়ই স্লিপওয়াকিং করতো তাদের ক্ষেত্রে এটা ৬১.৫ শতাংশ যা প্রথম গ্রুপের তুলনায় প্রায় তিনগুণ। যদিও সুনির্দিষ্ট কোনো জিন প্রকারন এটা বংশানুক্রমে পরিবহন করে কিনা তা জানা যায়নি। তবুও এই পরীক্ষা থেকে আন্দাজ করা যায় যে, স্লিপওয়াকিং বংশগতভাবেও হতে পারে। এছাড়া ঘুমের অভাব,মানসিক চাপ ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, মদ্যপান, নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন স্লিপওয়াকিং এর সম্ভবনাকে বাড়িয়ে দেয়৷ তবে খুনের আলাপ শুনে স্লিপওয়াকিংকে অতোটাও ভয় পাবার দরকার নেই। সাধারণত স্লিপওয়াকিং দশ মিনিট বা তারও কম সময় স্থায়ী হয়। রোগী বিছানা থেকে উঠে স্বাভাবিকভাবেই কাজ করতে থাকে। তবে তার কোনো হুশ থাকে না। সহজে জাগিয়ে তোলাও সম্ভব হয় না। খুব একটা ঝামেলাও বাঁধায় না। হয়তোবা দেয়ালে আঘাত পেতে পারে কিন্তু গুরুতর কোনো বিষয় না। এটা যদি নিয়মিত ঘটতে থাকে তাহলে চিকিৎসের সাথে যোগাযোগ করা প্রয়োজন।
ফিরে আসি কেনেথ পার্কসের ঘটনায়। চিকিৎসকেরা মতামত দেন যে, পার্কস ইচ্ছাকৃতভাবে খুন করেনি, ঘুমের মধ্যেই ঘটনাটি ঘটেছে। পার্কসকে পরবর্তীতে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয় কানাডার সুপ্রিম কোর্ট। এটা ক্রিমিনাল অটোম্যাটিজম ডিফেন্সের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেইস হয়ে দাঁড়ায়। এখনও অবধি, ৬৮ টা ঘুমের মধ্যে খুনের কেইস আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। পার্কসের মতো একটি ঘটনা দেখা যায় যুক্তরাজ্যে। ২০০৩ সালের ঘটনা। ৩২ বছর বয়সী লোয়ী তার বৃদ্ধ বাবার সাথে ঘুমাতেন। একদিন বাসার পাশেই তার বাবার ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। পুলিশ সন্দেহ করার মতো অন্য কাউকে পায় না। সন্দেহের তীর যায় লোয়ীর দিকে। তাকে গ্রেফতার করা হয়। যদিও সে নিজেকে নির্দোষ দাবি করতে থাকে। স্লিপ ওয়াকিং-কে অটোম্যাটিজম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর মানে হল অনিচ্ছাকৃত ভাবে কিছু করা। মানসিক অসুস্থতা (ইনসেইন অটোম্যাটিজম) কিংবা অন্য কোনো ফ্যাক্টরের (নন-ইনসেইন অটোম্যাটিজম) কারণে এমনটা হতে পারে।
কেইসটি আদালতে উঠলে লোয়ীর আইনজীবীগণ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেয়। পরীক্ষা চালালে দেখা যায় লোয়ীর স্লিপওয়াকিং এর অভ্যাস আছে। প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণের উপর ভিত্তি করে আদালত সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে আসলেই নির্দোষ ছিলো। কেননা খুন করার সময় সে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। আর তাই তার খুনের ব্যাপারটা ইনসেইন অটোম্যাটিজম এর মধ্যে পড়ে। স্লিপ ওয়াকিং খুবই চাঞ্চাল্যকর এবং আগ্রহ উদ্দীপক ঘটনা যা গবেষক, সাধারণ মানুষ সবাইকেই ভাবিয়ে ছাড়ে। সেই সাথে আমাদেরকে বিশেষ কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করে। ঘুমের মধ্যে সংঘটিত অপরাধের জন্য রোগী নৈতিকভাবে কতটুকু দায়ি? ঘুমন্ত ও জাগ্রত অবস্থায় চেতনার স্তর কি করে নির্ধারণ করা যাবে? মস্তিষ্কের কোনো অংশ কি নিজের কাজের ফলাফল সম্পর্কে সচেতন করে? মস্তিষ্ক নিয়ে বিস্তর গবেষণাই কেবল এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারে।
রেফারেন্সঃ
Leave a Reply