প্রাণরাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

প্রাণরসায়নবিদরা গবেষণার দরকারে নানান রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। আমার সদ্য অনুবাদ করা জাপানিজ লেখক ও গবেষক মাসাহারু তাকেমুরার জনপ্রিয় কমিক্স বই “দ্য মাঙ্গা গাইড টু বায়োকেমিস্ট্রি” বই থেকে এই অংশটুকু নেওয়া। এই অংশে লেখক কমিক্স এর ভঙ্গিতে স্বল্প পরিসরে তুলে ধরেছেন প্রাণরসায়নবিদদের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা। লেখক এই অংশে একজন প্রাণরসায়নবিদ হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।    

বইয়ের প্রচ্ছদ

জীবপ্রযুক্তির নানান কৌশল ব্যবহার করে প্রোটিন এর কার্যক্রম সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে প্রাণরসায়নে কি কি ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়? গবেষণার ক্ষেত্রবিশেষে নানান রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পদ্ধতিই রয়েছে। সবকটাই এখানে তুলে ধরা সম্ভব না। তার চাইতে, আমি বরং নিজে কি কি রকমের পদ্ধতি ব্যবহার করেছি সেগুলোই তুলে ধরব। 

কলাম ক্রোমাটোগ্রাফি   

কলাম ক্রোমাটোগ্রাফি হল, একই ধর্ম বিশিষ্ট কতগুলো ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের মিশ্রণ থেকে সেগুলো পৃথক করবার একটা পদ্ধতি। উদাহরণস্বরুপ, আমরা  আমেরিকান পোকউইড গাছের নির্যাস থেকে কিংবা জুইসারে সদ্য ব্লেন্ডিং হওয়া গরুর থাইমাস থেকে, কিছু প্রোটিন পৃথক করতে পারি। কাচ কিংবা অন্য কোন পদার্থ দিয়ে নির্মিত একটা সরু, দীর্ঘ নলে বিশেষ ধরণের রেজিন প্যাক করে রাখা হয়। যেসব পদার্থ এই রেজিন এর সাথে লেগে থাকে সেগুলো আটকা পড়ে যায়। আর যেগুলো রেজিনে আটকা পড়ে না সেগুলোকে সহজেই সংগ্রহ করা যায়। 

ক্রোমাটোগ্রাফি বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে যেমন আয়ন বিনিময় ক্রোমাটোগ্রাফি, জেল পরিস্রাবণ ক্রোমাটোগ্রাফি, এবং অ্যাফিনিটি ক্রোমাটোগ্রাফি। রেজিন অথবা টার্গেট প্রোটিন এর উপর নির্ভর করে কোন ধরণের ক্রোমাটোগ্রাফি ব্যবহৃত হবে। উদাহরণ হিসেবে, আমরা এখন দেখব কি করে একটা বাছুরের থাইমাস থেকে ডিএনএ পলিমারেজ-α এনজাইম আলাদা করা যায়। 

ছবি- কলাম ক্রোমাটোগ্রাফি। সুত্র- দ্য মাঙ্গা গাইড টু বায়োকেমিস্ট্রি।

প্রথমে, থাইমাসকে ভালো করে পিষে এর কোষ গুলোকে ভেঙ্গে ফেলা হয়। তারপর উচ্চ ঘনমাত্রার লবণের (সোডিয়াম ক্লোরাইড) দ্রবণ ব্যবহার করে প্রোটিনসহ অন্যান্য উপাদান গুলোকে পৃথক করা হয়। পরবর্তীতে পাত্রে থাকা থাইমাসের এই তরল নির্যাসকে একটা দীর্ঘ গ্লাস টিউবের (কলাম) ভেতর দিয়ে প্রবাহিত করা হয়। গ্লাস টিউবের ভেতরে আয়ন বিনিময় রেজিন প্যাক করা ছিল। এখন থাইমাসের নির্যাসে থাকা প্রোটিন গুলো দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। কিছু প্রোটিন আয়ন বিনিময় রেজিন এ শোষিত হয়, বাকি গুলো কলামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বেরিয়ে যায়।

যেসব প্রোটিন কলামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বেরিয়ে পড়ে, সেগুলোকে কলামের নিচে রাখা একটা টেস্টটিউবে সংগ্রহ করা হয়। আর রেজিনে শোষিত হওয়া প্রোটিন গুলোকে পরে উচ্চ ঘনমাত্রার লবণ ব্যবহার করে রেজিন থেকে আলাদা করা হয় এবং টেস্টটিউবে সংগ্রহ করা হয়। ডিএনএ পলিমারেজ-α এনজাইম কলামে থেকে যায় এবং ০.৫ মোলার ঘনমাত্রার লবণ দ্রবণ দিয়ে আলাদা করা হয়। ( এটা হচ্ছে “নমুনা-১” )

নিচের ছবিটায় “নমুনা-১” থেকে ডিএনএ পলিমারেজ-α এনজাইম পৃথক করার পদ্ধতি দেখানো হয়েছে। 

সুত্র- দ্য মাঙ্গা গাইড টু বায়োকেমিস্ট্রি।

এই পদ্ধতির নাম অ্যাফিনিটি ক্রোমাটোগ্রাফি। এই পদ্ধতিতে বিশেষ কিছু অ্যান্টিবডি যুক্ত রেজিন ব্যবহার করা হয় কলামের ভেতরে। অ্যান্টিবডি গুলো কেবল ডিএনএ পলিমারেজ-α এনজাইম এর সাথেই যুক্ত হতে পারে। যখন নমুনা-১ গ্লাস টিউবের ভেতরে সরাসরি এই রেজিন এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন এটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়- কিছু অংশ রেজিনে শোষিত হয় এবং বাকিটা টিউব এর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বেরিয়ে যায়। ডিএনএ পলিমারেজ-α এনজাইম রেজিনে শোষিত হয়। পরে উচ্চ ঘনমাত্রার ম্যাগনেসিয়াম লবণ (৩.২ মোলার) রেজিনে মিশিয়ে এই এনজাইমকে আলাদা করে সংগ্রহ করা হয়। এইভাবে আলাদা করা ডিএনএ পলিমারেজ-α এনজাইম একশ ভাগ বিশুদ্ধ। 

এভাবে, আয়ন বিনিময় ক্রোমাটোগ্রাফি এবং অ্যাফিনিটি ক্রোমাটোগ্রাফি একসাথে ব্যবহার করে ডিএনএ পলিমারেজ-α এনজাইম পৃথকীকরণ করা যায়।                   

ইলেকট্রোফোরেসিস এবং ওয়েস্টার্ন ব্লট

এটি মূলত কোনো স্পেসিফিক প্রোটিন আলাদা করার একটা পরীক্ষামূলক পদ্ধতি। কোনো নমুনা তে কি ধরণের প্রোটিন আছে, এবং সেসব প্রোটিন এর সাইজ কেমন এসব জানা যায় এই কৌশল ব্যবহার করে। ইলেকট্রোফোরেসিস এ একটা পাতলা  জেলটিনাস স্ল্যাব এর উপর নমুনা লোড করে এর মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ চালনা করা হয়। তখন নমুনাটি জেলটিনাস স্ল্যাব এর উপর দিয়ে চালিত হয়। এসডিএস-পলিঅ্যাক্রিলামাইড জেল ইলেকট্রোফোরেসিস ( SDS-polyacrylamide gel electrophoresis) ব্যবহার করে আণবিক আকারের উপর ভিত্তি করে প্রোটিন আলাদা করা হয় (নিচের ছবির বাম পাশে দেখানো হয়েছে)। প্রোটিন গুলো আলাদা হয়ে যাবার পরে বিশেষ ফ্লুরোসেন্ট মার্কার অথবা রঞ্জক ব্যবহার করে সেগুলোকে শনাক্ত করা হয়। 

ছবি- ইলেকট্রোফোরেসিস এবং ওয়েস্টার্ন ব্লটসুত্র- দ্য মাঙ্গা গাইড টু বায়োকেমিস্ট্রি।

ওয়েস্টার্ন ব্লটিং (নিচের ছবিতে ডান পাশে) ও প্রোটিন আলাদা করার একটা পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে একটা পাতলা পর্দার উপর রাখা জেল এর উপর দিয়ে প্রোটিন পরিচালিত করা হয়। প্রোটিন গুলো পৃথকীকরণ হবার পরে এরা আবার আগের অবস্থানে ফিরে আসে। তখন বিশেষ কিছু অ্যান্টিবডি, এরা কেবল টার্গেট প্রোটিন এর সাথেই যুক্ত হয়, ব্যবহার করে প্রোটিন গুলো আলাদা ভাবে শনাক্ত করা হয়। ওয়েস্টার্ন ব্লটিং এর একটা প্রায়োগিক উদাহরণ হচ্ছে লেকটিন ব্লটিং। 

লেকটিন ব্লটিং

লেকটিন হচ্ছে এমন কিছু প্রোটিন যারা কেবল নির্দিষ্ট কিছু স্যুগার চেইন এর সাথে বাইন্ড করতে পারে। যেহেতু লেকটিন নির্দিষ্ট কিছু স্যুগার চেইন এর সাথে বাইন্ড করে, তাই বিভিন্ন প্রোটিন এ যুক্ত স্যুগার চেইন এর ধরণ শনাক্তকরণে লেকটিন ব্যবহার করা যায়। এটি অনেকটা ওয়েস্টার্ন ব্লটিং এর মতন। একটা পর্দায় প্রোটিন গুলোকে নিয়ে আলাদা করবার জন্যে লেকটিন ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ধরণের লেকটিন ব্যবহার করা হয় প্রোটিন এর সাথে। যেসব লেকটিন প্রোটিন এর সাথে বাইন্ড করে শুধুমাত্র সেগুলোই শনাক্ত করা যায়। এইভাবে পর্দায় পরিচালিত করা প্রোটিন গুলোয় কি ধরণের স্যুগার চেইন আছে সেগুলো শনাক্ত করা যায়। আর এই পদ্ধতির নাম লেকটিন ব্লটিং। 

নিচের ছবিতে  wheat germ agglutinin (WGA) লেকটিন ব্যবহার করে N-acetylglucosamine (GlcNAc) স্যুগার চেইন যুক্ত প্রোটিন শনাক্তকরণ পদ্ধতি দেখানো হয়েছে। 

ছবি- লেকটিন ব্লটিং। সুত্র- দ্য মাঙ্গা গাইড টু বায়োকেমিস্ট্রি।

তারা মাছ এর ডিম্বাণু কোষে থাকা প্রোটিন আলাদা করতে লেকটিন ব্লটিং কৌশল ব্যবহার করা হয়। লেকটিন হিসেবে থাকে WGA। এখানে প্রোটিনের উজ্জ্বল ভাবে গ্লো করা দুইটা ব্যান্ড পাওয়া যায়।  

সেন্ট্রিফিউগেশন

কলাম ক্রোমাটোগ্রাফির মতন সেন্ট্রিফিউগেশনও প্রোটিন, কোষ অঙ্গাণু, এবং অন্যান্য জৈব উপাদান পৃথক করার একটা পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ভিন্ন ভিন্ন ঘনত্বের পদার্থের মিশ্রণ থেকে একই ঘনত্ব বিশিষ্ট পদার্থ গুলোকে আলাদা করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় নমুনা দ্রবণকে একটা টেস্টটিউবে নেয়া হয়। তারপর নমুনা দ্রবণসহ টেস্টটিউবটিকে সেন্ট্রিফিউজ মেশিনের অক্ষের চারপাশে উচ্চ গতিতে ঘোরানো হয়। প্রোটিন এর মতন ছোট ছোট উপাদানকে আলাদা করতে আলট্রাসেন্ট্রিফিউগেশন করা হয়। তখন নমুনাসহ টেস্টটিউবকে প্রতি মিনিটে প্রায় দশ হাজার বার ঘোরানো হয়। ডিএনএ এবং অন্যান্য জৈবঅণুও পৃথক করা যায় এই পদ্ধতিতে।   

ছবি- সেন্ট্রিফিউগেশন।

এনজাইম রিয়েকশন মেজারমেন্ট    

এনজাইম কার্যক্রম পরিমাপের অনেক পদ্ধতিই আছে। যেমন রেডিও আইসোটোপ ব্যবহার করে কোনো একটা নির্দিষ্ট এনজাইম এর বিক্রিয়ায় কি পরিমাণ উৎপাদ তৈরি হয়েছে সেটা মাপা কিংবা যখন কোন এনজাইম এর উপস্থিতিতে বিক্রিয়ক কাজ করা শুরু করে তখন কি পরিমাণ উৎপাদ তৈরি হচ্ছে সেটা বোঝার জন্যে কোন রঙ এর পরিবর্তন ব্যবহার করা। 

আমি এখন রেডিও আইসোটোপ ব্যবহার করে ডিএনএ পলিমারেজ এনজাইম এর অ্যাক্টিভিটি পরিমাপ করব এবং রঙ পরিবর্তন বিক্রিয়া ব্যবহার করে α-অ্যামাইলেজ  এনজাইম এর অ্যাক্টিভিটি পরিমাপ করব। 

ডিএনএ পলিমারেজ এনজাইম এর অ্যাক্টিভিটি পরিমাপ করার পদ্ধতি        

প্রথমে একটা মাইক্রোটেস্টটিউবে নিচের উপাদান গুলো নিতে হবেঃ 

অ্যাক্টিভিটি পরিমাপ করার জন্য নির্দিষ্ট দ্রবণ ( ডিএনএ পলিমারেজ এনজাইম এর জন্য উপযুক্ত পিএইচ এবং বাফার দ্রবণসহ ), ডিএনএ পলিমারেজ এনজাইম, ছাঁচ ডিএনএ, নিউক্লিওটাইডস, এবং ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড কো-ফ্যাক্টর। মিশ্রনে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রেডিও আইসোটোপ যুক্ত নিউক্লিওটাইড যোগ করতে হবে, এবং এইভাবে মিশ্রণটি কিছু সময়ের জন্যে রেখে দিতে হবে। 

কিছুক্ষণ বিক্রিয়া সম্পাদিত হবার পর, দেখা যাবে ডিএনএ পলিমারেজ এনজাইম যে নতুন ডিএনএ সুতা তৈরি করেছে তার নিউক্লিওটাইড গুলো রেডিও আইসোটোপ যুক্ত। বিক্রিয়া করেনি এমন নিউক্লিওটাইড গুলোকে অপসারণ করে, তৈরি হওয়া নতুন ডিএনএ সুতাটিকে একটা রেডিও আইসোটোপ বোতলে স্থানান্তর করা হয়। তারপর তরল সিন্টিলেশন কাউন্টার যন্ত্র ব্যবহার করে ডিএনএ তে থাকা রেডিও আইসোটোপ এর সংখ্যা গণনা করা হয়। ডিএনএ তে যত বেশি সংখ্যক রেডিও আইসোটোপ থাকবে, ডিএনএ পলিমারেজ এনজাইম এর অ্যাক্টিভিটি তত বেশি হবে।

ছবি- ডিএনএ পলিমারেজ এনজাইম এর অ্যাক্টিভিটি পরিমাপ করার পদ্ধতি। সুত্র- দ্য মাঙ্গা গাইড টু বায়োকেমিস্ট্রি।      
আলফা-অ্যামাইলেজ  এনজাইম এর অ্যাক্টিভিটি পরিমাপ করার পদ্ধতি     

একটা টেস্টটিউবে স্টার্চ দ্রবণ নিয়ে তাতে α-অ্যামাইলেজ  এনজাইম দ্রবণ (যেমন লালা) যোগ করা হয়। তারপর অ্যামাইলেজ এনজাইম স্টার্চকে ভেঙ্গে ফেলবার পূর্বেই দ্রুত এই টেস্টটিউবে আয়োডিন যোগ করা হয়। স্টার্চ এই আয়োডিন এর সাথে বিক্রিয়া করে নীল-বেগুনি রঙ এর যৌগ গঠন করে। সময় গড়াবার সাথে সাথে অ্যামাইলেজ এনজাইম এর ক্রিয়ায় স্টার্চ ভাঙ্গতে থাকে এবং দ্রবণের রঙ পরিবর্তিত হতে থাকে (নীল-বেগুনি→ বেগুনি→ লাল→ কমলা→ ফ্যাকাশে কমলা)। সবশেষে, সম্পূর্ণ স্টার্চ যখন ভেঙ্গে যায় তখন দ্রবণ বর্ণবিহীন হয়ে যায়। স্পেকট্রোফটোমিটার ব্যবহার করে দ্রবণের বর্ণ পরীক্ষা করে α-অ্যামাইলেজ  এনজাইম এর অ্যাক্টিভিটি পরিমাপ করা হয়। 

ছবিসুত্র- দ্য মাঙ্গা গাইড টু বায়োকেমিস্ট্রি।

তথ্যসুত্র- দ্য মাঙ্গা গাইড টু বায়োকেমিস্ট্রি।

লেখাটি 109-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 897 other subscribers