আমরা মাংস খাই, ফল খাই, অনেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবজি খাই, আবার কেউবা মিষ্টি খাবারের নেশায় আসক্ত। আমাদের খাবার পছন্দের উপর বিরাট প্রভাব থাকে স্বাদের। কু-স্বাদের খাবার যতোই স্বাস্থ্যকর হোক না কেন, তা আমাদের গলা দিয়ে নামে না। সুস্বাদু খাবারের প্রতি কেন এই বিশাল আগ্রহ? আর এসব খাবারের স্বাদ কেনই বা ‘সু’ অনুভূতি জাগায়? এই প্রশ্নগুলোর জবাব আমরা পাই মানুষের বিবর্তন থেকে। স্বাদের সূচনা হয় আমাদের জিহ্বার স্বাদ কোরক নামক বিশেষ টিস্যুতে। আর শেষ হয় মস্তিষ্কের তৈরি ভ্রমের মধ্য দিয়ে।
স্বাদ কী
খাবার মুখে পুড়বার সঙ্গে সঙ্গেই হজম ক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। দাঁত দিয়ে খাবার চিবানোর সময় লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালারস (স্যালাইভা) এর সাথে খাবার মিশে আঠালো দলা তৈরি হয়। তখন এই লালারসের সাথে মিশ্রিত খাবারের ক্ষুদ্র কণা জিহ্বায় থাকা সূক্ষ্ম ছিদ্রপথ দিয়ে স্বাদকোরকের সংস্পর্শে আসে।
আমরা যা-ই খাই না কেন, সবই কোন না কোনো রাসায়নিক যৌগ। এসব যৌগ স্বাদকোরকের সঙ্গে বিক্রিয়া করে রাসায়নিক উদ্দীপনা তৈরি করে। আর এভাবেই চোখ-নাক বন্ধ করেই, এমনকি স্পর্শ না করেও আমরা বলতে পারি, “ওহ আচ্ছা, আমার প্রিয় সবেদা খাচ্ছি!”। সাধারণত আমরা খাদ্যের স্বাদ ভালো নাকি মন্দ তা বুঝি স্পর্শ করে, চোখে দেখে, গন্ধ শুঁকে কিংবা জিহ্বায় চেখে। একটা খাবারের সম্পূর্ণ উদ্দীপনা গ্রহণ করার পেছনে আছে এই সবগুলো প্রক্রিয়ার কারসাজি।
স্বাদ কেন
স্বাদের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি কোন বস্তু খাওয়া যাবে আর কোন বস্তু খাওয়া যাবে না। যেমন টক জাতীয় খাবারে অ্যাসিড থাকে। তাই টক জাতীয় খাবার বেশি পরিমাণে খেলে এসিডিটি হতে পারে। একইভাবে তিক্ত-বিচ্ছিরি স্বাদের কোনোকিছু অখাদ্য হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ফলে তা থেকে তেমন কোনো কাজ করার শক্তি পাওয়া যাবে না। আবার খাবার ঠিকভাবে হজম হবে কি-না তা-ও স্বাদের উপর নির্ভর করে। মাটির স্বাদের কিছু যদি খাওয়া হয় তাহলে সেটায় হজম হয়ে শক্তি উৎপাদন হওয়ার মতো তেমন কিছু নেই। কিছু ব্যতিক্রম বাদে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই স্বাদের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যগুলো আমাদের বেঁচে থাকতে এবং বিভিন্ন কাজকর্মের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি যোগানে কাজে দেয়।
লাখ লাখ বছর আগে থেকে আমাদের পূর্বপুরুষদের স্বাদ এবং খাদ্যের নির্বাচনের উপর তাদের আশেপাশের পরিবেশের প্রভাব ছিল। যে অঞ্চলে যে খাবার বেশি পাওয়া যেত সবাই সে খাবারই খেত, অন্য কোনো উপায়ও ছিল না। তারা কিছু দল আকারে থাকতো এবং নির্দিষ্ট সময় পরপর থাকার জায়গা পরিবর্তন করতো। এর কারণ হলো এক জায়গায় তাদের অবস্থান এবং খাবার সংগ্রহের জন্য তৈরি হওয়া খাদ্যের অপ্রাচুর্যতা এড়ানো। এই অবস্থায় তারা যদি কোনো জায়গায় কম শক্তির জোগান দেয় বা কম পুষ্টিগুণ আছে এমন খাবার খায় তাহলে এই স্থানান্তর, শিকার এবং পরবর্তীতে আবার খাবার সংগ্রহ করার মতো অবস্থায় থাকবে না। যারা এগুলা বুঝে ভালো এবং খারাপ খাবার চিনে রাখলো তারা টিকে গেলো। এভাবেই তারা ধীরে ধীরে কোন খাবারগুলো খেলে তাদের জন্য ভালো হবে তা বুঝতে শিখে গেলো।
স্বাদ কীভাবে
স্বাদের অনুভূতি সৃষ্টিতে আমাদের মূল নায়ক হলো টেস্টবাড বা স্বাদ কোরক। স্বাদ কোরক হলো অনেকগুলো স্বাদের অনুভূতি সংগ্রাহক কোষের সমষ্টি। স্বাদের এই অনুভূতি সংগ্রাহক কোষগুলোকে বলে গাস্টেটরি কোষ (gustatory cell)। স্বাদকোরকের জন্যই আমরা অনেকে করলাকে দুই চোখে দেখতে পারি না, আবার চকোলেটের জন্য পাগল হয়ে যাই।
আমরা নিজেদের জিহ্বায় লক্ষ করলে দেখবো যে জিহ্বার উপরের তল অনেকটা অমসৃণ। এতে অনেকগুলো বিন্দু বা গোলগোল অংশের মতো থাকে। এগুলা খালি চোখেই দেখা যায়। এদের নাম প্যাপিলা। এই প্যাপিলাগুলো স্বাদকোরকের সমষ্টি। অনেকগুলো স্বাদ কোরক (শ-খানেক) মিলে একেকটা প্যাপিলা গঠন করে। আমরা যখন খাবার মুখে নিয়ে দাঁত আর জিহ্বা দিয়ে ছোট ছোট খাদ্যকণায় পরিণত করি তখন তা লালার (স্যালাইভা) সাথে মিশ্রিত হয়। এরপর তা জিহ্বার উপরিতলে থাকা টেস্টবাডগুলার উপরের অংশের ছিদ্রপথ দিয়ে স্বাদ সংগ্রাহক অংশের কাছে যায়। এই স্বাদসংগ্রাহক অংশগুলো থাকে অনেকগুলো রিসেপ্টর বা উদ্দীপনা সংগ্রাহক কোষ। এদের সংখ্যা ৫০-১০০ টি। সেখান থেকে স্বাদের অনুভূতি গৃহীত হয়ে রাসায়নিক সংকেতের মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্কে পৌঁছায়।
স্বাদকোরক পাঁচ ধরনের স্বাদের উদ্দীপনা গ্রহণ করতে পারে- মিষ্টি, টক, লবণাক্ত, তিতা এবং উমামি (সোজা কথায় মাংসের স্বাদ)। ভিন্ন ভিন্ন যৌগের সাথে বিক্রিয়ায় স্বাদকোরক ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের অনুভূতি দেয়। যেমন- H+ (হাইড্রোজেন আয়ন) বা প্রোটনের সাথে স্বাদকোরকের বিক্রিয়ায় টক স্বাদের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। আমরা জানি, অ্যাসিড H+ আয়ন বা প্রোটন তৈরি করে। ফলে যে-সব খাবারে অ্যাসিড থাকে সবগুলার জন্যই টক স্বাদের অনুভূতি সৃষ্টি করে আমাদের মগজ।
এই স্বাদকোরকের সংখ্যা জিহ্বায় দুই থেকে আট হাজার হয়ে থাকে। এরা দশদিন অবধি বেঁচে থেকে “রান্না মজা হয়েছে” বলার সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সাহায্য করে।
জিহবার বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন স্বাদের গুজব
বাংলাদেশের ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বই (২০২১) সহ আরো বেশকিছু স্থানে এই আলোচনা দেখতে পাওয়া যায়। এখানে জিহ্বাকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে একেকটি অঞ্চলের জন্য একেক স্বাদের অনুভূতি পাওয়ার কথা বলা হয়ে থাকে। এই মত অনুযায়ী, আপনি যদি মিষ্টিজাতীয় কোনোকিছু জিহবার সামনের অংশে স্পর্শ করান তাহলে মিষ্টি স্বাদ পাবেন কিন্তু জিহবার দুইপাশে স্পর্শ করালে টক স্বাদ পাবেন। আবার জিহ্বার পিছনের দিকে স্পর্শ করালে করলা অপছন্দকারীরাও সেরকম তিতা স্বাদ পাবেন। কিন্তু আমরা যারা প্রতিদিন খাবার খাই (সবাই-ই খাবার খাই অবশ্যই, না খেলে কীভাবে বেঁচে আছেন জানি না) তারা জানি যে মিষ্টি জাতীয় কিছু মুখে নিলে তা যেখানেই স্পর্শ করুক না কেন আমাদের কাছে শুধু মিষ্টি স্বাদই অনুভূত হয়। এখান থেকে সাধারণ জ্ঞান ব্যবহার করেই বোঝা যায় কেন জিহ্বার বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন স্বাদের উদ্দীপনার বিষয়টা মিথ্যা। প্রকৃতপক্ষে যেকোনো অংশের স্বাদকোরকই সবরকম স্বাদের অনুভূতি গ্রহণ করতে পারে। স্বাদকোরক শুধু জিহ্বাতেই থাকে না। মুখগহবের উপরের কোমল তালু ও উপজিহবায়, এমনকি গলার উপরের অংশেও কিছু পরিমাণ পাওয়া যায়।
এই বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন স্বাদের মিথ ছড়ালো কীভাবে?
১৯০১ সালে হার্ভার্ডের সাইকোলজিস্ট ডার্ক পি. হ্যানিগ জিহ্বার রেখাচিত্রসহ একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেই গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল বিভিন্ন স্বাদের উদ্দীপনা জিহ্বার কোন অংশে সব থেকে দ্রুত গৃহীত হয় তা দেখানো। সেখানে দেখা যায় টক জাতীয় খাবার খেলে জিহবার দুইপাশে সবার আগে সেই অনুভূতি গৃহীত হয়। খেয়াল করুন, জিহ্বার প্রতিটি অংশেই কিন্তু এই স্বাদের অনুভূতি গৃহীত হয়। কিন্তু ডার্ক দেখান যে টকের জন্য জিহ্বার দুইপাশে খুবই সূক্ষ্ম সময় ব্যবধানে উদ্দীপনা সবার আগে গৃহীত হয়। একই জিনিস মিষ্টি খাবারের ক্ষেত্রে জিহ্বার অগ্রভাগে দেখা যায়। অর্থাৎ এখানে কোথায় স্বাদ গৃহীত হচ্ছে তা দেখানো হয় নি। প্রকৃতপক্ষে সূক্ষ্ম সময় ব্যবধানে কোন অংশে সবার আগে কোন স্বাদের অনুভূতি গৃহীত হচ্ছে তা দেখানো হয়েছে। এই ব্যবধান এতোই ক্ষুদ্র যে স্বাভাবিকভাবে আমরা এটা টেরই পাবো না। আবার জিহ্বার মাঝের দিকে যেকোনো খাবারেরই স্বাদের মাত্রা তুলনামূলক অনেকটা কম মনে হয়। এর কারণ হলো জিহ্বার মাঝের অংশে স্বাদ কোরক তুলনামূলক কম থাকে। পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পাঠ্যবইয়ে ‘আগে পরে উদ্দীপনা গ্রহণ’ এর বিষয়টি সঠিকভাবে উল্লেখ না করে শুধু ‘উদ্দীপনা গ্রহণ’ এর কথা বলা হয়েছে। ফলে আলোচনাটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে চলে গেছে এবং এই গুজবের জন্ম দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে জিহ্বার সব অংশ দিয়েই সব রকমের স্বাদের অনুভূতি গৃহীত হয়।
তথ্যসূত্র-
- An Evolutionary Perspective on Food and Human Taste – ScienceDirect
- Taste bud – Wikipedia
- Taste – Wikipedia
- Tongue map – Wikipedia
- Hänig, David (1901). “Zur Psychophysik des Geschmackssinnes”. Philosophische Studie
- Collings, V. B. (1974). “Human Taste Response as a Function of Locus of Stimulation on the Tongue and Soft Palate”. Perception & Psychophysics. 16: 169–174. doi:10.3758/bf03203270
- David V. Smith; Robert F. Margolskee (March 2001). “The Taste Map: All Wrong”. Scientific American
- Hoffmann, A. (1875). “Über die Verbreitung der Geschmacksknospen beim Menschen” [On the spread of taste buds in humans]. Archiv für Pathologische Anatomie und Physiologie und für Klinische Medicin (in German). 62 (4): 516–530. doi:10.1007/bf01928657
Leave a Reply