এনগ্রাম: স্মৃতির গাঠনিক একক

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

স্মৃতি আমাদের কাছে একটা সহজাত প্রবৃত্তি বলে মনে হয়। কোন একটা অভিজ্ঞতার তথ্য সযত্নে জমা রেখে পরবর্তীতে মনে করতে পারার যে ক্ষমতা, তাকে আমরা স্মৃতি বলে জানি। 

কখনো কি মনে হয়েছে মস্তিষ্কের মধ্যে স্মৃতি ঠিক কিভাবে তৈরি হয়? 

এনগ্রামকে বলা হয় স্মৃতি তৈরির গাঠনিক একক।এই লেখাতে আমরা এনগ্রাম নামক একটা ধারণার সাথে পরিচিত হবো। এর পরের লেখায় স্মৃতি তৈরির প্রক্রিয়ার পেছনে যে জীববিজ্ঞান ও নিউরো-কম্পিউটেশন আছে, সেটা সম্পর্কে জানবো।

এনগ্রাম কী

স্মৃতি নিয়ে অনেক আগে থেকেই বিজ্ঞানীদের আগ্রহ ছিলো। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, ১৯০৪ সালে জার্মান বিজ্ঞানী রিচার্ড সিমন সর্বপ্রথম এনগ্রামের ধারণা দেন। তিনি বলেন, কোন কিছু শেখা বা কোন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেলে আমাদের মস্তিষ্কে একটা পরিবর্তন হয় – যেন মস্তিষ্কে ওই ঘটনার একটা ছাপ পড়ে। এই পরিবর্তনকে তিনি নাম দেন এনগ্রাম। তিনি কল্পনা করলেন যে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর এনগ্রাম মস্তিষ্কে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কিন্তু পূর্বের অভিজ্ঞতার মতো কোন নতুন ঘটনা ঘটলে তা আবার জেগে উঠতে পারে। এই পুনরায় সক্রিয় হওয়ার যে ব্যপারটা, সেটাই হলো স্মরণ-প্রক্রিয়া।

জার্মান বিজ্ঞানী রিচার্ড সিমন।

সিমন আসলে তার সময়ের তুলনায় অনেক অগ্রসর ছিলেন। তার সমসাময়িক বিজ্ঞানী সমাজে এনগ্রামের ধারণাটা হালে পানি পায় নি। পরবর্তীতে কার্ল লেশলি নামক আরেক বিজ্ঞানী ইঁদুরকে একটা গোলকধাঁধায় পথ খুজে পেতে শিখালেন, তারপর ইঁদুরের মস্তিষ্কের কর্টেক্সের বিভিন্ন জায়গা কেটে কেটে দেখার চেষ্টা করলেন ইঁদুর ওই প্রশিক্ষণ ভুলে যায় কি না। যদিও মস্তিষ্কের বিভিন্ন জায়গায় কেটে ফেলায় ইঁদুরের স্মৃতি সার্বিকভাবেই কমে যায়, কিন্তু তার পরীক্ষা এনগ্রামের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় বিজ্ঞানীমহলে সন্দেহ তৈরি হয় যে এনগ্রাম আদৌ আছে কি না, আর থাকলেও সেটা ধরাছোয়ার বাইরেই থেকে যাবে।

আরো সমস্যা হলো রিচার্ড সিমনের এই এনগ্রামের সংজ্ঞাটা বেশ অস্পষ্ট – মস্তিষ্কে ঠিক কি ধরনের পরিবর্তন ঘটে সেটা তিনি বলতে পারেন নি। অবশ্য তখনকার সময়ে স্নায়ুবিজ্ঞান নিয়ে অনেক কিছুই অজানা ছিলো। সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞানীরা পরিস্কার হতে থাকলেন যে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ তড়িৎরাসায়নিক উদ্দীপনার মাধ্যমে  একটা সংযুক্ত-জালিকা তৈরি করে। সে অনুযায়ী, এসব স্নায়ুকোষগুলো নিজেদের মধ্যে যেভাবে এসব উদ্দীপনা দিয়ে “কথা” বলে, তার প্যাটার্নেই স্মৃতি জমা থাকার প্রক্রিয়াটি যুক্ত হতে হবে।

তবে বহু বছর পরে এই বিষয়ে পরীক্ষাগুলো করার জন্য সহযোগীতা আসলো জীববিজ্ঞানের একদম ভিন্ন এক শাস্ত্র থেকে — জেনেটিক্স। জেনেটিক্সের অগ্রগতি ও বিভিন্ন জীবপ্রযুক্তিগত পরীক্ষা-পদ্ধতি তৈরি হওয়ার পর নিউরোবিজ্ঞানীরা আরো সূক্ষ্মভাবে স্মৃতি নিয়ে গবেষণা শুরু করতে পারলেন।

এনগ্রাম কিভাবে মস্তিষ্কের স্নায়ুসংযোগের মাধ্যমে তৈরি হতে পারে এই ধারণাটা ঠিকমতো বোঝার জন্য আমাদের একটু প্রস্তুতি নিতে হবে। চলুন আগে জানা যাক নিউরোবিজ্ঞানীরা স্মৃতি তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে ঠিক কিভাবে জেনেটিক্সের পদ্ধতি ব্যবহার করেন।

নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কোন নতুন অভিজ্ঞতা (যেমন তীব্র শব্দের সাথে বিদ্যুৎ শক) প্রাণীর মস্তিষ্কে এনগ্রাম স্নায়ুকোষের (সবুজ বৃত্ত) মধ্যে আন্তঃসংযোগে এনগ্রাম হিসেবে জমা হয় (সবুজ ড্যাশ লাইন)। পরবর্তীতে একই ধরনের তীব্র শব্দ পেলে ওই এনগ্রাম সক্রিয় হয়ে ওঠে, আর প্রাণীর মধ্যে একই ধরনের (এ ক্ষেত্রে ভয়ে জমে যাওয়ার) প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। সূত্র Current Opinion in Neurobiology (2021)

“আপনার কি মনে পড়ছে?”

স্মৃতি নিয়ে গবেষণা করতে গেলে আমাদের দুইটা জিনিস লাগবে – একটি আচরণগত কাজ, আরেকটি হলো সে কাজ করার সময়ে মস্তিষ্কে যে পরিবর্তন হচ্ছে সেটা অনুসরণ করার কোন পদ্ধতি। একমাত্র মানুষদের সাথে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করার সময়ে আপনি তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারেন যে ভাই, আপনি কি এই ঘটনা মনে করতে পারছেন? তবে ওই প্রশ্ন করার সময়ে ওই ব্যক্তির স্নায়ু-সংযোগে কি পরিবর্তন হচ্ছে তা দেখতে হলে রীতিমতো ব্রেন-সার্জারি করতে হবে, যেটা করার প্রশ্নই আসে না। অন্যদিকে গবেষণাগারে ইঁদুরের মস্তিষ্কে সরাসরি পরীক্ষা করা সম্ভব যে একক-স্নায়ুকোষে কী হচ্ছে। সমস্যা হলো, ইঁদুর তো কথা বলতে পারে না, সে পরীক্ষককে বলতে পারবে না যে “আমার সব মনে পড়ছে”!

এই ত্রিশঙ্কুদশা থেকে উত্তরণের জন্য বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন চতুর পদ্ধতি অবলম্বন করেন। যেমন ধরা যাক, দুইটা ভিন্ন উদ্দীপনার মধ্যে কি ইঁদুরটি সংযোগ তৈরি করতে পারে? একটা বেশ প্রচলিত পরীক্ষা হলো এমন কোন পরিবেশ তৈরি করা যেটাতে ইঁদুর ভয় পায়। যেমন একটা আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ কোনো উদ্দীপনা, এমন কিছু যেটা সরাসরি ইঁদুরকে প্রভাবিত করবে না, যেমন কোন শব্দ, কিন্তু দ্বিতীয় একটা উদ্দীপনার সাথে এর একটা সম্পর্ক থাকবে। অন্যদিকে দ্বিতীয় উদ্দীপনাটি ইঁদুরকে সরাসরি প্রভাবিত করবে, যেমন বৈদ্যুতিক শক। বিদ্যুৎ শক প্রথম উদ্দীপনার একটু পরে, বা সাথে সাথেই প্রয়োগ করা হবে। বেশ কয়েকবার এই ঘটনা ঘটবে।

ইঁদুরে করা এই গবেষণাটি মূলত রাশিয়ান বিজ্ঞানী পাভলভের প্রতিষ্ঠিত ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিং পরীক্ষা পদ্ধতির একটি ভিন্নরূপ।

বিদ্যুৎ শক দিলে ইঁদুরের আচরণে একটা পরিবর্তন আসে, যেমন ভয়ে একদম জড় হয়ে যায়, যেটা আমাদের “আচরণগত” প্রতিক্রিয়া। কয়েকবার এই দুইটি উদ্দীপনা পর পর দেয়া হলে পরীক্ষায় একটা ছোট পরিবর্তন আনা যাক। এখন শুধু প্রথম উদ্দীপনা দেয়া হবে, শুধু প্রথম শব্দ বাজবে, কিন্তু কোন বিদ্যুৎ শক দেয়া হবে না। যদি বিদ্যুৎ শক না দিলেও ইঁদুর ভয়ে জড় হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে এই দুইটি উদ্দীপনার মধ্যে যে একটা সম্পর্ক আছে, সেরকম স্মৃতি ইঁদুরের মধ্যে তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ ইঁদুর মনে করতে পারছে যে এই বিশেষ শব্দের সাথে বিদ্যুৎ শকের মাধ্যমে ব্যাথা পাওয়ার একটা সম্পর্ক আছে। এই উদাহরণে শব্দকে কন্ডিশনাল উদ্দীপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে বিদ্যুৎ শককে যে কোন অন্য উদ্দীপকের সাথে যুক্ত করলেও একই ফলাফল পাওয়া যাবে।

নতুন স্মৃতি তৈরি হচ্ছে কিনা বোঝা যায় কি করে?

মানুষ বাদে অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে স্মৃতি তৈরি হচ্ছে কি না, সেটা নিশ্চিত করণের একটা পদ্ধতি না হয় পাওয়া গেলো। কিন্তু এই স্মৃতিটা মস্তিষ্কের মধ্যে কীভাবে তৈরি হচ্ছে সেটা কিভাবে দেখা যায়? এ ক্ষেত্রে জেনেটিক্সের কিছু পদ্ধতি বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করে থাকেন। 

স্মৃতি তৈরি যেহেতু জীববৈজ্ঞানিকভাবে বেশ জটিল একটা প্রক্রিয়া, স্নায়ুকোষ নিশ্চয়ই স্মৃতি তৈরির সময় অনেক ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। কিছু জিন যদি খুঁজে পাওয়া যায়, যারা সব সময় স্নায়ুকোষ যখন নতুন স্মৃতি তৈরির কাজটা করবে তখন সক্রিয় হয়ে ওঠে, তাহলে তাদের নির্ভরযোগ্য “প্রক্সি” হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে (না, এটা আপনার ক্লাস ফাঁকি দেয়া বন্ধুর পক্ষে রোল কলে সময় হাজিরা দেয়ার মতো ব্যপার নয়। বরং শ্রেণীশিক্ষককে বলা যে, স্যার, আমার বন্ধু স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় অংশ নিতে অন্য স্কুলে গিয়েছে, ও ক্লাস পালাচ্ছে না!)

সব কোষের মতো স্নায়ুকোষেও ডিএনএ থাকে, যেখানে বিভিন্ন কাজের জন্য দরকারী প্রোটিন কিভাবে বানাতে হবে তার “রেসিপি” লেখা থাকে। বিজ্ঞানীরা দেখলেন, কোন নিউরন যখন শেখার কাজে নিয়োজিত থাকে, তখন কিছু জিন সক্রিয় ভাবে প্রকাশিত হয়, অর্থাৎ ওইসব জিন থেকে আরএনএ তৈরি হতে থাকে (নিউরনের শেখা মূলত বিভিন্ন ইন্দ্রিয় থেকে আগত সংকেতের প্যাটার্ন চিনতে পারার প্রক্রিয়া, সে বিষয়ে অন্যদিন আলাপ করবো)। এসব জিনের মধ্যে দুইটি জিন পাওয়া গেলো, যারা অধিকাংশ সময়েই নিউরনের শেখা-পরবর্তী-গাঠনিক পরিবর্তন (অর্থাৎ নতুন সিন্যাপ্স সংযোগ তৈরি/বদল) এর সাথে জড়িত। যদিও এই দুইটা জিন থেকে যে সব প্রোটিন  (c-Fos ও Arc) তৈরি হয়, তারা কোষের ভেতরে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে থাকে। কিন্তু এদেরকে মোটামুটি নির্ভরযোগ্য মার্কার হিসেবে ব্যবহার করা যায় যে অমুক স্নায়ুকোষ এখন “শিক্ষণ পরবর্তী গাঠনিক পরিবর্তন” এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

যে কোন গবেষণাতেই অজস্র সমস্যার চ্যালেঞ্জ থাকে। যেমন কোন জিনের প্রকাশ হলো কি হলো না, সেটা এতো সহজে বোঝা যায় না। সাধারণত একটা কোষে কোন কোন জিনের প্রকাশ হচ্ছে, তা জানার জন্য আমরা ওই কোষ ভেঙে-চুড়ে, সেখান থেকে রাসায়নিকভাবে বিশুদ্ধ আরএনএ নিষ্কাশন করে, তারপর আরএনএ সিকোয়েন্স করে বলতে পারি অমুক জিন থেকে এই আরএনএ তৈরি হয়েছে। কিন্তু জ্যান্ত ইঁদুরের স্মৃতি তৈরির সময়ে এইভাবে আরএনএ নিষ্কাশন করলে ওই ইঁদুর-বেচারাকে মেরেই ফেলতে হবে, আর গবেষণার উদ্দেশ্য ভন্ডুল হয়ে যাবে।

এই নতুন সমস্যা সমাধানের জন্য বিজ্ঞানীরা জিন প্রকৌশলের সাহায্য নিতে পারেন। নির্দিষ্ট জিনের সাথে এমনভাবে আরেকটি নতুন জিন জোড়া লাগিয়ে দেয়া যায়, যেটা ফ্লুরোসেন্ট প্রোটিন তৈরি করবে। সেক্ষেত্রে প্রথম জিন যদি সক্রিয় হয়ে আরএনএ তৈরি করে, তাহলে এর সাথে জোড়া লাগানো জিনও ফ্লুরোসেন্ট প্রোটিন তৈরি করবে, যার প্রতিপ্রভা সংকেত দিয়ে আমরা বুঝতে পারবো যে হ্যাঁ, প্রথম জিনটা নিশ্চয়ই সক্রিয় হয়েছে!

বিদ্যুৎ শকের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি প্রাণী মস্তিষ্কে এনগ্রাম হিসেবে জমা হয়। মস্তিষ্কের বিভিন্ন এলাকা এই এনগ্রামে অংশ নিতে পারে, যাদের মধ্যে আন্তঃ- ও অন্তঃ- স্নায়ুসংযোগ তৈরি হয়।
এনগ্রাম স্নায়ুকোষ ডিএনএকে আমরা এমনভাবে রিকম্বিনেশন করতে পারি যাতে “প্রক্সি জিন” (c-fos) প্রকাশিত হলে তা পাশাপাশি সবুজ প্রতিপ্রভ প্রোটিন (GFP) তৈরি করবে। এটাকে ট্যাগিং বলে।
এই জেনেটিক প্রোগ্রামে আরো শর্ত যুক্ত করা যায়, যেমন tTA-TRE/Doxycycline (DOX) ব্যবহার, যাতে নির্ধারতি স্মৃতি তৈরির সময়ে একটি রাসায়নিকের উপস্থিতিতেই কেবলমাত্র এই প্রতিপ্রভ তৈরি হয়। Current Opinion in Neurobiology (2021)

এই জোড়া লাগানো জিনের কৃত্রিম ডিএনএ-কনস্ট্রাাক্ট কোন অক্ষতিকর ভাইরাসের সাহায্যে নিউরন কোষের মধ্যে পরিবহণ করা যায়। এই উপায়ে আমরা ইঁদুরের নিউরনকে জিনগতভাবে পরিবর্তন করে ফেলতে পারি।  

ইঁদুরের মস্তিষ্কে স্মৃতি তৈরি কীভাবে  হয়, এটা দেখতে গিয়ে আমরা বেশকিছু দারুণ সব পরীক্ষা-পদ্ধতি জেনে ফেললাম। বিজ্ঞানীদের গবেষণাগারে বেশ নিপুণভাবে এসব পদ্ধতির প্রয়োগ করে পরীক্ষাগুলো করতে হয়। সমস্যা হলো, একটা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে নতুন আরেকটা সমস্যা হাজির (হ্যাঁ এই লাইনে আমি চারবার সমস্যা শব্দটা বলেছি!)। যেমন ধরা যাক, ইঁদুরগুলোকে ব্রেনে সার্জারি করে উদ্দীষ্ট নিউরনকে জেনেটিক মডিফিকেশন না হয় করা হলো। কিন্তু ওই সার্জারীর ধকল থেকে সেরে না উঠলে ইঁদুরের মধ্যে ভয়ের কন্ডিশনিং উদ্দীপক স্মৃতি তৈরি করা যাবে না। কিন্তু মধ্যবর্তী সময়ে তো নতুন অনেক স্মৃতি তৈরি হবে। তাহলে আমরা ভয়-কন্ডিশনিং-পরীক্ষার পরে কীভাবে বুঝবো কোন প্রতিপ্রভ হওয়া নিউরনগুলো ভয়-কন্ডিশনিং-পরীক্ষা থেকে তৈরি হওয়া স্মৃতির সাথে জড়িত?

এজন্য আমাদের আবার ফিরে যেতে হবে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ পরিকল্পনা করার ধাপে। ফ্লুরোসেন্ট জিনটির আগে এমন কোন ডিএনএ সিকোয়েন্স জোড়া লাগাতে হবে, যারা কেবল নির্দিষ্ট কোন রাসায়নিকের উপস্থিতিতেই ফ্লুরোসেন্ট প্রোটিন তৈরি করবে। যদি ওই রাসায়নিক না থাকে, তাহলে প্রথম জিনটি প্রকাশিত হলেও ফ্লুরোসেন্ট প্রোটিন তৈরি হবে না। 

আপনি দেখতে পাচ্ছেন, যে এই কৃত্রিম ডিএনএ-র নির্মাণ করে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন “প্রোগ্রাম” তৈরি করতে পারেন, যারা জটিল সব শর্ত অনুযায়ী সক্রিয় হওয়ার ক্ষমতা রাখে!

এতক্ষণে আমরা মোটামুটি সব সমস্যার সমাধান জেনে ফেলেছি! বিজ্ঞানীরা এমন জেনেটিক প্রোগ্রাম তৈরি করছেন, যেটা ফ্লুরোসেন্ট প্রোটিন তৈরি করবে তখনই, যখন আগের জিনটি প্রকাশিত হচ্ছে, এবং, নির্দিষ্ট একটা রাসায়নিক উপস্থিত আছে। তারপর বিজ্ঞানীরা এই কৃত্রিম জেনেটিক প্রোগ্রাম ভাইরাসের “খোসার” মধ্যে পুরে নিউরন কোষের মধ্যে এই ভাইরাসগুলো প্রবেশ করিয়ে দেন “জিন-গান” এর মাধ্যমে। নিউরনে প্রবেশ করলে নিউরনের ডিএনএ রিকম্বিনেশনের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়। এখন সার্জারীর ধকল শেষে ইঁদুরকে ভয়-কন্ডিশনিং পরীক্ষার শুরুর আগে একটা ওষুধ দেয়া হলো, যেটাতে ওই নির্দিষ্ট রাসায়নিকটা আছে। তারপর ইঁদুরটিকে ইলেকট্রিক শকের সাথে একটি শব্দের কন্ডিশনাল স্মৃতি তৈরি করা হলো। এখন মাইক্রোস্কোপের নিচে ইঁদুরটির মস্তিষ্কটি নিলে আমরা দেখতে পারবো এই স্মৃতির মাধ্যমে তৈরি এনগ্রামটি প্রতিপ্রভা ছড়াচ্ছে, অর্থাৎ জ্বল-জ্বল করছে!    

এই পরীক্ষায় আমরা দেখলাম যে নতুন স্মৃতি তৈরি হওয়ার সাথে একদল নিউরন এনগ্রাম তৈরি করছে।

নতুন পরিবেশে নেয়ার পর ইঁদুরের হিপ্পোক্যাম্পাসে অল্প কিছু স্নায়ুকোষ Fos জিন প্রকাশ করছে (লাল রঙ) ছবি Yap and colleagues

এনগ্রাম কি আসলেই স্মৃতি ধারণ করে?

বিভিন্ন জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে স্মৃতির সাথে সম্পর্কিত নিউরন নিয়ে আরো প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সম্ভব। যেমন, যখন স্মৃতি স্মরণ করা হয়, তখন ঠিক কি ঘটে?  স্যামনের এনগ্রামের সংজ্ঞা মনে আছে, যে এনগ্রাম প্রাথমিক অভিজ্ঞতার সমরূপ কোন উদ্দীপক পেলে আবার সক্রিয় হয়ে উঠবে?  এটা খুব সহজেই পরীক্ষা করা যায় – ইঁদুরকে ওই শব্দটা আবার শোনালে সে ভয়ে জড় হয়ে যাবে। তখন শব্দ ও ইলেকট্রিক শকের সাথে জড়িত স্মৃতির নিউরনগুলো এই  উদ্দীপক পেয়ে সক্রিয় হয়ে প্রতিপ্রভা ছড়ায় – এটা আবার মাইক্রোস্কোপে দেখা সম্ভব।

এখানে আবার কার্যকারণের প্রশ্ন চলে আসে। এই নিউরনগুলো সক্রিয় হওয়ার মাধ্যমে কী স্মৃতির স্মরণ হচ্ছে, নাকি স্মৃতি স্মরণ করার একটা উপজাত হিসেবে এই নিউরনগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে? দেখা গেলো, আপনি যদি বেছে বেছে এই এনগ্রামের সাথে সংশ্লিষ্ট নিউরনদের নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারেন, বা মেরে ফেলতে পারেন, তাহলে কিন্তু শব্দের উদ্দীপনায় আর ইঁদুরটি সাড়া দেয় না, অর্থাৎ ভয়ে জড়ো হয়ে যায় না। অন্যদিকে আপনি যদি একই সংখ্যক নিউরন এলোমেলোভাবে ধ্বংস করেন, তাহলে ইঁদুরের মধ্যে ভয়ের চিহ্ন দেখা যায়, এমন কি তাকে শব্দের সাথে ইলেকট্রিক শক না দিলেও। এ থেকে বোঝা যায়, এনগ্রামে থাকা নিউরন স্মৃতি তৈরির জন্য কেবল অপরিহার্যই নয়, বরং গঠিত হওয়া স্মৃতি স্মরণ করার জন্যেও এদের প্রয়োজন। 

এই লেখাতে এনগ্রাম কি, সেটা আমরা জানলাম। পরের লেখায় মস্তিষ্ক কীভাবে এনগ্রাম তৈরি করে, সেটার গভীরে ডুব দেবো আমরা।

পরের কিস্তি: স্মৃতির এনগ্রাম কিভাবে তৈরি হয়

এ বিষয়ে আরো জানতে:

বিজ্ঞান জার্নাল সায়েন্সে ২০২০ সালে প্রকাশিত এই গবেষণাপত্রে এনগ্রাম বিষয়ক গবেষণার ঐতিহাসিক পটভূমি ও সাম্প্রতিক অগ্রগতির খুব সুন্দর বর্ণনা আছে:  Memory engrams: Recalling the past and imagining the future | Science
এ বিষয়ে আন্তন কারসভের ইউটিউবে থাকা ডকুমেন্টারিটাও দারুণ: https://www.youtube.com/watch?v=X5trRLX7PQY

লেখাটার ভাষাগত সম্পাদনা করেছে সুজয় কুমার দাশ এবং অনির্বাণ মৈত্র। তাদেরকে অনেক ধন্যবাদ!

লেখাটি 1,294-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading