কিছুদিন আগে “ভিনগ্রহ থেকে আসছে রেডিও সিগন্যাল, চিন্তায় বিজ্ঞানীরা” শিরোনামে একটি খবর ছাপা হয়। খবরের শিরোনামটি বিভ্রান্তিকর। মহাকাশ থেকে হরহামেশাই রেডিও সিগন্যাল আসতেই থাকে। এতে অবাক হওয়ারও কিছু না কিংবা চিন্তারও কোনো কারণ নেই। তবে বেশ মজার ব্যাপার হচ্ছে মহাকাশে এই ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক সিগন্যাল তৈরি হওয়ার কার্যকারণটি।
অদৃশ্য আলো
ইংরেজ বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন ভাবতেন আলো হচ্ছে করপাসল নামে এক প্রকার কণা দিয়ে তৈরি। আলোর নানা বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি আলোর ‘করপাসল তত্ত্ব’ দিয়েছিলেন। করপাসল তত্ত্ব মতে সকল উজ্জ্বল বস্তু থেকে করপাসল নামক এই কণা বের হয়। চোখে এসে এই কণা আঘাত করলে আমরা উজ্জ্বল বস্তুটিকে দেখতে পাই। যদি করপাসলের আকার ছোট হয় তাহলে তার উজ্জ্বলতা কম আর যদি করপাসলের আকার বড় হয় তাহলে তার উজ্জ্বলতা বেশি ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু অনেক আলোক ঘটনাই নিউটনের এই করপাসল তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। যেমন একটি চশমার লেন্সকে সাদা একটি কাগজের উপর রাখলে চশমার ঠিক যেই বিন্দুটা কাগজে স্পর্শ করছে সেখানে একটা কালো রঙ-এর রিং দেখতে পাওয়া যায়। এ রিং-কে নিউটনের রিং বলা হয়। কেন এমন হয় তা আলোর করপাসল তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। এমন মনে হচ্ছিল নিউটনের এই তত্ত্ব সঠিক নয়। এমন মনে হচ্ছিল আলো আদৌ কোনো কণা নয়।
১৬৭৮ সালের দিকে ওলন্দাজ বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস জ্যামিতির নানা উপপাদ্যের উপর ভিত্তি করে বলেন, আলো হচ্ছে একপ্রকার তরঙ্গ। আলো কীভাবে মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে তাও তিনি ব্যাখ্যা করেন। আলো যদি তরঙ্গ হয় তাহলে আলোর ব্যাতিচার, অপবর্তন, নিউটনের রিং বা এরকম যে ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা করপাসল তত্ত্ব দিয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না, তার ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল। হাইগেনসের এ তত্ত্বকে নাম দেওয়া হলো ‘আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব’। কিন্তু এ তত্ত্বেরও একটা সমস্যা দেখা দিল।
তরঙ্গ চলাচলের জন্য তো মাধ্যমের প্রয়োজন। কিন্তু আমরা জানি আলো সূর্য থেকে পৃথিবীতে কোনো মাধ্যমের উপস্থিতি ছাড়াই আসে। আলো যদি তরঙ্গই হয় তাহলে সে মাধ্যম ছাড়া কীভাবে পৃথিবীতে আসল? আলো আসলে কী ধরণের তরঙ্গ? এটির উত্তর একটু অন্যভাবে দেন অপর এক বিজ্ঞানী, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে দেখা যায় আলো একটি তাড়িৎ-চৌম্বক তরঙ্গ। এধরণের তরঙ্গ চলাচলের জন্য কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন নেই। তাই আলো দেদারসে কোনো মাধ্যম ছাড়াই কিংবা মাধ্যমের মধ্য দিয়েও চলাচল করতে পারে।
আইজ্যাক নিউটন আবিষ্কার করেছিলেন সূর্য থেকে আসা সাদা আলো আসলে সাদা না। একটি প্রিজমের মধ্যে দিয়ে এই সাদা আলোকে পাঠালে তা আরো অনেকগুলো রঙের আলোর একটি বর্ণালি ভাগ হয়ে যায়। সাদা আলোতে থাকে বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল রঙের একটি মিশ্রণ। প্রিজমের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় সকল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ভিন্ন ভিন্ন বলে, কিছু আলো কম পরিমাণ বেঁকে যায়, আর কিছু আলো বেশি পরিমাণে বেঁকে যায়। এভাবে একটি আলোতে আসলে আরো কী কী আলো মিশ্রিত আছে তা প্রিজম দিয়ে ভাগ করে দেখে ফেলা সম্ভব।
আঠারোশ শতকের দিকে উইলিয়াম হার্শেল নামক এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী আলোর তাপমাত্রা পরিমাপের চেষ্টা করেন। এজন্য আলোকে একটি প্রিজমের সাহা্য্যে বর্ণালিতে ভাগ করেন। নীল রঙের তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য নীল রঙের উপর একটি থার্মোমিটার রাখেন এবং লাল রঙের তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য লাল রঙের উপর একটি থার্মোমিটার রাখেন। তিনি দেখতে পান, নীল রঙের তাপমাত্রা লাল রঙের তাপমাত্রার চেয়ে সামান্য বেশি। অর্থাৎ নীল আলোর থেকে যতই লাল আলোর দিকে যাওয়া যায় ততই আলোর তাপমাত্রা কমতে থাকে। কাঠখোট্টা ভাষায় বললে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত বৃদ্ধি পায় তাপমাত্রা তত হ্রাস পায়। তবে এখানেই একটি ব্যাপার ঘটল।
উইলিয়াম হার্শেলের থার্মোমিটারটি লাল রঙের সামান্য পাশে, যেখানে কোনো আলো নেই সেখানে চলে গেল। উইলিয়াম হার্শেল খেয়াল করলেন এ জায়গাতেও তাপমাত্রার অস্তিত্ব আছে। তিনি প্রশ্ন করলেন, এখানে কোনো আলো যদি নাইই থাকে, তবে এই তাপমাত্রা কীসের? আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি ব্যাখ্যা দিলেন, লাল আলোতেই আলোক বর্ণালির সমাপ্তি ঘটে না। বরং লাল আলোর পরেও আরো আলো রয়েছে যা খালি চোখে দেখা যায় না। এধরণের আলোকে তিনি নাম দিলেন ইনফ্রারেড আলো। ল্যাটিন শব্দ ইনফ্রা শব্দের অর্থ হচ্ছে নিচে। ইনফ্রারেড আলোর খোঁজ লাল রঙের নিচে পেয়েছিলেন বলেই এমন নামকরণ করেছিলেন উইলিয়াম হার্শেল। বাংলায় ইনফ্রারেড আলোকে অবলোহিত আলো নামে ডাকা হয়। এর কয়েকবছর পরেই নীল রঙের পাশে আল্ট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনি আলোকরশ্মির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। অতিবেগুনি রশ্মিও খালি চোখে দেখা যায় না।
আজ আমরা জানি, বেগুনি থেকে লাল রঙের এ বর্ণালির ব্যান্ড খুবই বড় একটি ব্যান্ডের ছোট একটি অংশ। ৩৮০ ন্যানোমিটার থেকে কম বা ৬৮০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের থেকে বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট আলোকে আমরা খালি চোখে দেখতে পারি না। তবে এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বাইরেও আরো আলোর উপস্থিতি রয়েছে। সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকে নিয়ে আমরা একটি পরিপূর্ণ আলোক বর্ণালি পাই। এটি ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক তরঙ্গের বর্ণালি।
মহাকাশ থেকে সিগন্যাল
কৃষ্ণবস্তু নামে কল্পিত এক বস্তুর অবতারণা করেন বিজ্ঞানীরা। এই বস্তুর উপর যত ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক তরঙ্গ আপতিত হয় সকল তরঙ্গই এ শোষণ করে নেয়। এজন্য একে বলা হয় নিখুঁত শোষক (Perfect Absorber)। আবার এটি সকল কম্পাঙ্কের তরঙ্গদৈর্ঘ্য নিঃসরণও করে। এজন্য একে বলা হয় নিখুঁত নিঃসরক (Perfect Emitter)। নিঃসরণের ব্যাপারটা একটু বিস্তারিত বোঝা প্রয়োজন।
একটি কৃষ্ণবস্তু থেকে সবসময় ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক তরঙ্গ বের হবে। আর যেই তরঙ্গগুলো বের হবে তাতে একই সাথে যেমন রেডিও তরঙ্গ থাকবে, তেমনি ইনফ্রারেড তরঙ্গ, আল্ট্রাভায়োলেট তরঙ্গ ও দৃশ্যমান সবধরনের তরঙ্গই পাওয়া যাবে। তবে কোনো কোনো তরঙ্গের তীব্রতা তুলনামূলক বেশি হবে, আর কোনো কোনো তরঙ্গের তীব্রতা তুলনামূলক কম। কোন তরঙ্গের তীব্রতা বেশি হবে আর কোনটার কম তা নির্ভর করবে ঐ কৃষ্ণবস্তুর তাপমাত্রার উপর। এই তাপমাত্রা, কম্পাঙ্ক ও তরঙ্গের তীব্রতার যে সম্পর্কটি তা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নিখুঁতভাবে পরিমাপ করার জন্য একটি সূত্র প্রদান করেন বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লাঙ্ক। কৃষ্ণবস্তুর এই বিকিরণ সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে গিয়েই মূলত জন্ম হয় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের। তার সূত্র মতে এই তীব্রতার মান হবে –
$$ I_\lambda = \frac{8 \pi h c}{\lambda ^5}\frac{1}{e^{\frac{hc}{kT \lambda}}-1} $$
নিচের গ্রাফটি লক্ষ্য করুন। পাঁচ হাজার কেলভিন তাপমাত্রার একটি কৃষ্ণবস্তু থেকে বের হওয়া তরঙ্গগুলোর মধ্যে কোন কম্পাঙ্কের তীব্রতা কেমন তা হলুদ রঙের রেখা দিয়ে দেখানো হয়েছে। ভালো করে যদি গ্রাফটি লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখবেন ঐ বস্তুটি একই সাথে যেমন ৫০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সিগন্যাল বিকিরণ করছে তেমনি ১৫০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সিগন্যালও বিকিরণ করছে। এছাড়াও বাকি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সিগন্যালও কম-বেশি আছে। অর্থাৎ এই বিকিরণে সব কম্পাঙ্কের তরঙ্গই বিদ্যমান। আরেকটু ভালো করে খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, সব কম্পাঙ্ক এখানে বিদ্যমান থাকলেও ৬০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের দিকে এই রেখার তীব্রতা সবচেয়ে বেশি। এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সিগন্যাল হলুদ রঙের হয়। ফলে ৫০০০ কেলভিন তাপমাত্রার কৃষ্ণবস্তুকে হলুদ রঙে দেখতে পাওয়া যাবে।
আবার ৬০০০ কেলভিন তাপমাত্রার কৃষ্ণবস্তুর যে বিকিরণ দেখতে পাচ্ছেন তা ৫০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের দিকে তীব্রতা সবচেয়ে বেশি। এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সিগন্যাল নীলাভ রঙের হয়। আপনি যদি ১০০০ কেলভিন তাপমাত্রার কৃষ্ণবস্তুর জন্য তীব্রতা হিসাব করেন দেখবেন যে তা রেডিও অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি তীব্র। ঐ কৃষ্ণবস্তুকে আমাদের খালি চোখে দেখতে পাওয়া যায় না। ওদেরকে দেখতে প্রয়োজন বিশেষভাবে তৈরি রেডিও টেলিস্কোপ।
মূল আলোচনা যা আমি বোঝাতে চাচ্ছি তা হচ্ছে তাপমাত্রা আছে এমন প্রত্যেক বস্তু থেকেই একটা রেডিয়েশন বের হবে। নক্ষত্র কিংবা গ্যালাক্সি কিংবা মানুষের দেহেরও যেহেতু তাপমাত্রা রয়েছে তাই এর থেকেও শক্তি বের হবে। তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে সেটা রেডিও সিগন্যালও হতে পারে আবার ইনফ্রারেড সিগন্যালও হতে পারে। যেমন মানুষের দেহ থেকে ইনফ্রারেড সিগন্যাল বের হয়। এই সিগন্যাল থার্মাল গগলস দিয়ে শনাক্ত করা যায়। তাই অন্ধকারের মধ্যে মানুষদের শনাক্ত করতে সেনাবাহিনি বা অনুরুপ দলগুলো থার্মাল গগলস ব্যবহার করে।
তথ্যসূত্র
- ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক তরঙ্গের ইতিহাস নিয়ে জানতে দেখতে পারেন Herschel and the Puzzle of Infrared by Jack R. White Published in American Scientist
- কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ নিয়ে জানতে দেখতে পারেন Blackbody Radiation Cannot Be Explained Classically – Chemistry LibreTexts
Leave a Reply