গোল্ডিলকস জোন

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

ধরা যাক, আপনি ও আপনার বন্ধুরা মিলে ঠিক করলেন মহাকাশে নতুন বাসযোগ্য কোনো গ্রহ আবিষ্কার করবেন। খুবই ভালো কথা। কিন্তু এর আগে আপনাকে জানতে হবে যে, ‘বাসযোগ্য’ গ্রহ বলতে আসলে কী বোঝায়! শুধু তাই নয়, বাসযোগ্য হবার জন্য‌ কী কী দরকার, এগুলোর বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ থেকে শুরু করে সব কিছু।

বাসযোগ্য গ্রহের কথা মাথায় আসতেই সর্বপ্রথম আমরা চিন্তা করি, সেখানে পানির অস্তিত্ব আছে কি না। কারণ পানির অস্তিত্ব থাকলেই সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে, তাই না? চলুন আরও সহজে বুঝি। আমরা সবাই জানি, সকল জীব ডিএনএ/আরএনএ -ভিত্তিক। প্রাণের সৃষ্টি ও বিকাশের জন্য সর্বপ্রথম যে জিনিসটি দরকার তা হলো তরল পানি। এটির জন্যই আমাদের কোষের আকৃতি বজায় থাকে, কোষ সতেজ থাকে। প্রোটোপ্লাজম সজীব রাখতেও পানির বিকল্প নেই; যেভাবেই হোক পানির ব্যবস্থা করতে হবেই। প্রস্বেদন ও সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া চালু রাখতে পরিমাণমতো পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার। পানি একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্রাবক, আমাদের বিপাকীয় অনেক বিক্রিয়ায় এটির গুরুত্ব অপরিসীম। বুঝতেই পারছেন, বাসযোগ্য হবার জন্য পানির কত গুরুত্ব! এখান থেকেই আসে সৌরজগতের বাসযোগ্য এলাকার ধারণা। একে গোল্ডিলক জোনও বলে। আর আজকে আমরা এই গোল্ডিলক জোন নিয়ে আলোচনা করব। 

ছবি- সৌরজগতের গোল্ডলিকস জোন

তাহলে গোল্ডিলক জোন বিষয়টা কী? ধরা যাক, কোনো এক সৌরজগতে একটি নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে কিছু গ্রহ ঘুরছে! ভালো কথা, “নাই কাজ তো খই ভাজ” এরকম একটা ব্যাপার। তো এখানে মূল নক্ষত্রের থেকে যে দূরত্বে থাকলে গ্রহের তাপমাত্রা পানি বাষ্পীভূত হওয়ার মত বেশি হবে না, আবার পানি বরফে পরিণত হওয়ার‌ মতো কমও হবে না, একটা স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় থাকবে, তাকেই আমরা গোল্ডিলক জোন বলতে পারব। অর্থাৎ, কোনো নক্ষত্রজগতের যেখানে তরল পানি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি তাকে বলা হয় গোল্ডিলক জোন। তাই এক্সোপ্লানেট বা পৃথিবী সদৃশ গ্রহ খোঁজার ক্ষেত্রে শুরুতেই গোল্ডিলক জোনের কথা ভাবা হয়।

বাসযোগ্য এক্সোপ্লানেটের সন্ধানে গোল্ডিলক জোন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানীদের ধারণা, যদি কোনো গ্রহ এই মহাজাগতিক অঞ্চলের মধ্যে পড়ে, তবে এটিতে প্রাণের সৃষ্টি হওয়ার ভালো সুযোগ রয়েছে। যেমন, আমাদের সৌরজগতের দিকে তাকালেই দেখতে পারব যে, পৃথিবী এবং মঙ্গল গোল্ডিলক জোনের মধ্যে পড়ে। এজন্যই আমাদের গ্রহে পানির অস্তিত্ব বিদ্যমান। আমরা সবাই জানি, সম্প্রতি নাসার বিজ্ঞানীরা মঙ্গলে তরল পানির অস্তিত্ব পেয়েছে। এছাড়াও ইউরোপা এবং এনসেলাডাসও (বৃহস্পতি ও শনির চাঁদ) বিজ্ঞানীদের ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এই দুই উপগ্রহের পৃষ্ঠীয় বরফের নিচে মহাসাগর রয়েছে। যার ফলে এখানে হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট-এর সম্ভাবনা এবং মহাসাগরের নিচে জীবনের অস্তিত্বের সম্ভাবনা বাড়ে! 

হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট হল পৃথিবীর গভীর সমুদ্রে অবস্থিত এমন স্থান যেখানে ভূগর্ভের উত্তপ্ত পানির ফোয়ারা বেরিয়ে আসে। “হাইড্রো” মানে “জল” এবং “থার্মাল” মানে “তাপ”। সুতরাং,হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট হল এমন স্থান যেখানে পানির উৎস তাপ দ্বারা চালিত হয়।। এই ভেন্টগুলি সাধারণত সক্রিয় আগ্নেয়গিরি, হটস্পট বা টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের স্থানে পাওয়া যায়। হাইড্রোথার্মাল ভেন্টগুলি সাধারণত ৬০০ থেকে ৪,০০০ মিটার (২,০০০ থেকে ১৩,০০০ ফুট) গভীরতায় পাওয়া যায়। হাইড্রোথার্মাল ভেন্টগুলি পৃথিবীর জীবজগতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ভেন্টগুলির চারপাশে বসবাসকারী প্রাণীরা কেমোসিন্থেসিস নামক একটি রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্য তৈরি করে। কেমোসিন্থেসিস সম্পর্কে অন্য একদিন লিখবো না হয়। এটি একটি রাসায়নিক শক্তি থেকে খাদ্য তৈরীর পদ্ধতি যেখানে শক্তি ও কার্বন তৈরী হয়।  এই প্রক্রিয়াতে, প্রাণীরা হাইড্রোজেন সালফাইড এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের সাথে পানির রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি এবং কার্বন তৈরি করে। পৃথিবীতের হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট হলো- গ্যালাপোগাস দ্বীপপুঞ্জের আশেপাশে, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের আশেপাশে, জাপানের আশেপাশে, ইতালির আশেপাশে, ফিলিপাইনের আশেপাশে।

গোল্ডিলক জোনের মধ্যে আবিষ্কৃত এক্সোপ্লানেটগুলির আরও কয়েকটি উদাহরণ দেখে যাক! 

কেপলার-৪৫২বি

ছবি- কেপলার-৪৫২বি

‘আর্থস কাজিন’ নামে অভিহিত করা হয়েছে এটিকে। কেপলার-৪৫২বি প্রায় ১৪০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত একটি এক্সোপ্লানেট। আমাদের সূর্যের মতো এটিও একটি নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে এবং বাসযোগ্য অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। পৃথিবীর সাথে কেপলার-৪৫২বি-এর আকার এবং বয়সের সাদৃশ্যের কারণে বিজ্ঞানীরা এটিকে “প্রাইম সাসপেক্ট” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

প্রক্সিমা সেন্টোরি সি

ছবি- প্রক্সিমা সেন্টোরি সি

এই এক্সোপ্লানেটটি প্রক্সিমা সেন্টোরি সিস্টেমের অংশ, যার মধ্যে প্রক্সিমা সেন্টোরি সি-ও রয়েছে। প্রক্সিমা সেন্টোরি সিস্টেম হল আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র সিস্টেম। এটি কুম্ভ নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থিত, এবং এটি সূর্য থেকে প্রায় ৪.২ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এই সিস্টেমেরই কেন্দ্রে রয়েছে প্রক্সিমা সেন্টোরাই এবং এর চারপাশে ঘুরছে প্রক্সিমা সেন্টোরি বি, প্রক্সিমা সেন্টোরি সি, প্রক্সিমা সেন্টোরি ডি। প্রক্সিমা সেন্টোরি সি হলো একটি গ্যাস জায়ান্ট, যার ভর পৃথিবীর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি এবং এটি তার নক্ষত্রকে এমন দূরত্বে প্রদক্ষিণ করে যা এটিকে বাসযোগ্য অঞ্চলের মধ্যে রাখে। এটিও গোল্ডিলক জোনের মধ্যে অবস্থিত। যদিও এটি নিজে বাসযোগ্য নয়, এই গ্যাসদৈত্যের উপস্থিতি সিস্টেমে ছোটো ও পাথুরে গ্রহ হবার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে।

ট্র্যাপিস্ট-১ ই, এফ এবং জি

ছবি- ট্র্যাপিস্ট-১ ই, এফ এবং জি

ট্র্যাপিস্ট-১ সিস্টেম ছাড়াও এর তিনটি এক্সোপ্লানেট, যথা- ট্র্যাপিস্ট-১ ই, এফ এবং জি গোল্ডিলক জোনের মধ্যে পড়ে। এই গ্রহগুলি পাথুরে এবং তাদের পৃষ্ঠে তরল পানির জন্য উপযুক্ত অবস্থায় থাকতে পারে। ট্র্যাপিস্ট-১ সিস্টেম সম্ভাব্য বাসযোগ্য এক্সোপ্লানেটগুলি খুঁজে পাওয়ার জন্য একটি সম্ভাব্য হটস্পট হিসাবে উল্লেখযোগ্য। 

এলএইচএস ১১৪০বি

ছবি- এলএইচএস ১১৪০বি

পৃথিবী থেকে প্রায় ৪০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত একটি এক্সোপ্লানেট। এটি একটি লাল বামন নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে এবং গোল্ডিলক জোনের মধ্যে পড়ে। এই এক্সোপ্লানেটটি পৃথিবীর আকারের প্রায় দেড় গুণ বড় এবং এটি গঠন পাথুরে। বায়ুমণ্ডল থাকার সম্ভাবনা এবং তরল পানির সম্ভাবনার কারণে এটির আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছিল।

উপরে আমি “ট্রাপিষ্ট-১” শব্দটা ব্যবহার করেছি তাই না? এই ট্রাপিষ্ট-১ কী? ট্রাপিষ্ট-১ সিস্টেম হল একটি নক্ষত্রজগত, যা ৩৯ আলোকবর্ষ দূরে কুম্ভ নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থিত। কুম্ভ নক্ষত্রমণ্ডল নিয়ে অন্যদিন আলোচনা করবো নাহয়! এই সিস্টেমের কেন্দ্রে একটি অতি-শীতল বামন তারা রয়েছে, যার নাম ট্রাপিস্ট-১। এই তারাটি আমাদের সূর্যের চেয়ে অনেক ছোট এবং কম উজ্জ্বল।

ট্রাপিস্ট-১ সিস্টেমে সাতটি গ্রহ রয়েছে, যাদের নাম ট্রাপিস্ট-১ বি থেকে ট্রাপিস্ট-১ এইচ পর্যন্ত। এই গ্রহগুলির মধ্যে ছয়টি আকারে পৃথিবীর মতো। এই সিস্টেমের গ্রহগুলি নক্ষত্রের খুব কাছাকাছি ঘোরে। সবচেয়ে কাছের গ্রহ, ট্রাপিস্ট-১বি, এটি দেড় দিনে নক্ষত্রের চারপাশে একবার ঘোরে। সবচেয়ে দূরের গ্রহ, ট্রাপিস্ট-১এইচ, এটির নক্ষত্রের চারপাশে বিশ দিনে একবার ঘোরে। ট্রাপিস্ট-১ সিস্টেমের গ্রহগুলির মধ্যে তিনটি, ট্রাপিস্ট-১ই, ট্রাপিস্ট-১এফ, এবং ট্রাপিস্ট-১জি, এগুলোর নক্ষত্রের “বাসযোগ্য অঞ্চলে” অবস্থিত।

সুতরাং বলা যায়, গোল্ডিলক জোন একটি মহাজাগতিক কম্পাস হিসেবে কাজ করে, যা আমাদের সম্ভাব্য বাসযোগ্য গ্রহের অন্বেষণ এবং বহির্জাগতিক জীবনের সন্ধানে পথ দেখায়। আমাদের সৌরজগতের মধ্যে গোল্ডিলক জোন আমাদের বাসযোগ্যতার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলি বুঝতে সাহায্য করে এবং পৃথিবীর বাইরেও জীবনের সন্ধানে সাহায্য করে। 

তথ্যসুত্রঃ

লেখাটি 155-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Responses

  1. Tasfia Ahsan Avatar
    Tasfia Ahsan

    খুবই সুন্দর করে সাজিয়ে লিখা হয়েছে। এতো তথ্যের জন্য লেখক ও বিজ্ঞান ব্লগকে ধন্যবাদ💙

  2. ❤️❤️❤️❤️Nice

  3. ভালো লিখেছেন……

  4. A.S. Swopnil Avatar
    A.S. Swopnil

    অত্যন্ত চমৎকার লেখনী। এই ব্লগের লিখা পড়লেই নতুন কিছু শেখা যায়। লেখক জনাব মুনিম শাহরিয়ার কে অসংখ্য ধন্যবাদ এত সুন্দর করে নতুন কিছু তুলে ধরার জন্য। দোয়া ও শুভকামনা রইল❤️

Leave a Reply to A.S. SwopnilCancel reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো, মাসে একবার। নিউজলেটারে সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে বিশ্লেষণ থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading