একটি মৃত প্রাণীর ডিএনএ সংগ্রহ করে সেই ডিএনএ থেকে আবার একই প্রাণীকে সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে আমরা রিজেনেসিস বলতে পারি। এভাবে যেকোনো মৃত প্রাণী, হতে পারে কোনো বিলুপ্ত প্রজাতির সদস্যকেও পৃথিবীর বুকে ফিরিয়ে আনা (তাত্ত্বিকভাবে) সম্ভব। এখন নিয়ান্ডার্থাল মানুষদেরকে নিয়ে সামান্য তথ্য তুলে ধরি।
নিয়ান্ডার্থাল এবং ডেনিসোভানদেরকে বিবেচনা করা হয় হোমো স্যাপিয়েন্সের সবচেয়ে কাছের আত্মীয় হিসেবে। আজ থেকে সাড়ে ছয় লক্ষ বছর পূর্বে নিয়ান্ডার্থালদের এবং আমাদের একটি কমন এনসেস্টর (সাধারণ পূর্বপুরুষ) পৃথিবীতে ছিলো। আর আনুমানিক ৪,৩০,০০০ বছর আগে থেকে ৪০,০০০ বছর আগে পর্যন্ত সময়কালটিতে নিয়ান্ডার্থালরা পৃথিবীতে ছিলো। এরপর তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
এই লেখায় আমি ফিরিয়ে আনতে চেয়েছি নিয়ান্ডার্থাল মানুষদের। শুধু বৈজ্ঞানিক এবং কৌশলগত দিকগুলোকে আমলে নিয়ে সাজানো হয়েছে লেখাটি। তবে দরকারি নৈতিক উদ্বেগ এবং কৌশলগত কার্যক্ষমতার ব্যাপারটা কিছুটা পাশ কাটিয়ে যেতে পারি, সেজন্যে ক্ষমাপ্রার্থী। ধরা যাক, ক্রিসপার/ক্যাস৯ জিন সম্পাদনার প্রযুক্তি, মেইজ প্রযুক্তি, ডিএনএ সংশ্লেষণ মেশিন, ক্লোনিং, এগুলো সবই এখন বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত; একইসাথে নিচে বর্ণনা করা প্রত্যেকটা ধাপ প্রায় শতভাগ কার্যকর।
আমাদের কাছে আছে সম্পূর্ণ নিয়ান্ডার্থাল জিনোম অনুক্রম (সভান্তে প্যাবোকে ধন্যবাদ)। এখন দরকার এই ডিএনএ টিকে একটি পরিপূর্ণ নিয়ান্ডার্থাল মানুষে রুপান্তর করা। বর্ণনার সুবিধার্থে লেখাটিকে তিনটি অংশে ভাগ করেছি। প্রথম অংশে থাকবে কম্পিউটার তথ্যভিত্তিক জিনোম অনুক্রমকে জৈবিক জিনোমে রুপান্তর। দ্বিতীয় অংশে থাকবে ঐ ডিএনএ কে মানব স্টেম কোষে প্রবেশ করিয়ে ভ্রূণ সৃষ্টি করা। সবশেষে ভ্রূণটিকে উপযোগী আশ্রয় কোষে (শিম্পাঞ্জি অথবা মানুষ) স্থানান্তর করে স্বাভাবিক জন্মদান করানোই আমাদের মূল লক্ষ্য।
জিনোম অনুক্রমকরণ করা মানেই এই নয় যে, জিনোমের সকল জিন এবং তাদের কার্যপদ্ধতিগুলোও জেনে ফেলা। বিষয়টা মাথায় রেখেই আমরা সম্পূর্ণ নিয়ান্ডার্থাল জিনোমের জৈবিক সংস্করণ অর্থাৎ ডিএনএ তৈরী করতে চাচ্ছি।
ডেটাবেজের জিনোম থেকে জৈবিক জেনোম
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াইস ইন্সটিটিউটে জর্জ চার্চের দল তৈরি করেছে মেইজ প্রযুক্তি (MAGE technology)। মেইজ মানে হল মাল্টিপ্লেক্স অটোমেটেড জিনোমিক ইন্জিনিয়ারিং। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটা জীবের পুরো জিনোমকে অন্য আরেকটা জীবের জিনোমে রুপান্তরিত করে ফেলা সম্ভব। ধরা যাক, একটা কবুতরের জিনোমের সাথে ঘুঘু পাখির জিনোমকে তুলনা করে মোট দশ লক্ষ জায়গায় অমিল পাওয়া গেল। এখন যদি কবুতরের জিনোমকে ঘুঘু পাখির জিনোমে রুপান্তর করতে চাই, তাহলে কবুতরের কোষের ডিএনএতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঐ দশ লক্ষ জায়গায় জিন সম্পাদনা করে ঘুঘু পাখির জিন প্রতিস্থাপন করতে হবে।
জিন প্রকৌশল ব্যবহার করে দশ লক্ষ জায়গায় পরিবর্তন করা একপ্রকার অসম্ভব কাজ। কিন্তু মেইজ প্রযুক্তি এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে কাজ করছে। প্রথমে কবুতরের স্টেম কোষের জিনোমকে ১৩০০০ খন্ডে আলাদা করতে হবে। প্রতি খন্ডে থাকা ডিএনএ এর দৈর্ঘ্য হবে এক লক্ষ বেসপেয়ার (কবুতরের জিনোম দৈর্ঘ্য ১৩০ কোটি বেসপেয়ার এর মতো)। এরপর ঘুঘু পাখির জিনোমকে ছাঁচ হিসেবে বিবেচনা করে সে অনুযায়ী কবুতরের জিনোম খন্ডগুলোতে জিন সম্পাদনা (ক্রিসপার/ক্যাস৯-কে ধন্যবাদ) করতে হবে। সবরকম আণবিক পরিবর্তন সম্পন্ন হওয়ার পর, সবগুলো খন্ডকে একত্রে জুড়ে দিলেই কবুতরের স্টেম কোষের জিনোম ঘুঘু পাখির জিনোমে রুপান্তরিত হয়ে যাবে।
এখন এখানে কবুতরের জায়গায় মানুষকে প্রতিস্থাপন করা যাক। আর ঘুঘু পাখির জায়গায় নিয়ান্ডার্থাল মানুষকে। অর্থাৎ এখন মানব স্টেম কোষের জিনোমকে অনেকগুলো খন্ডে ভাগ করতে হবে। তারপর নিয়ান্ডার্থাল মানুষের সাথে তুলনা করে ঐ খন্ডগুলোতে জিন সম্পাদনা করতে হবে। সবশেষে সবগুলো খণ্ডকে একসাথে জুড়ে দিলেই কাজ সম্পন্ন হবে। অতএব কম্পিউটার ডেটাবেজে থাকা নিয়ান্ডার্থাল জিনোম এখন হয়ে গেলো স্টেম কোষের ভেতর নিয়ান্ডার্থাল জৈবিক ডিএনএ!
জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি ক্রিসপার/ক্যাস৯ যেভাবে কাজ করে সেটা সংক্ষেপে জানা যাক: প্রথমে উদ্দিষ্ট জিনকে টার্গেট করে তৈরী করা হয় গাইড আরএনএ অণু। এই গাইড আরএনএ এর কাজ হল ক্যাস৯ প্রোটিনকে জিন সম্পাদনার জায়গাটা চিনিয়ে দেওয়া। ক্যাস৯ প্রোটিন গাইড আরএনএ এর দেখানো জায়গায় ডিএনএ কে কেটে দু’টুকরো করে ফেলে। কোষের ডিএনএ এর একটি প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ডিএনএ তে কোনো গ্যাপ থাকলে সেটা মেরামত করে নেওয়া। এই মেরামতের সময়টাতেই বিজ্ঞানীরা তাদের পছন্দের জিনকে ঢুকিয়ে দিতে পারেন, আবার চাইলে জিনটিকে নিষ্ক্রিয়ও করে দিতে পারেন।
আবার আপনি চাইলে, মেইজ ব্যবহার না করে সরাসরি ডিএনএ সংশ্লেষণ প্রযুক্তির সহায়তাও নিতে পারেন। সেখানেও আপনি জৈবিক ডিএনএ পেয়ে যাচ্ছেন। তবে এক্ষেত্রে ডিএনএ কিন্তু স্টেম কোষের ভেতর থাকছে না। এক্ষেত্রে স্টেম কোষের ডিএনএ, কৃত্রিমভাবে সংশ্লেষণ করা ডিএনএ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয়।
ডিএনএ সিন্থেসাইজার মেশিন বা জিন মেশিনে চারটি আলাদা রিজার্ভয়ারে অ্যাডিনিন, থাইমিন, সাইটোসিন এবং গুয়ানিন নিউক্লিওটাইডস থাকে; যারা একটি নলের সাহায্যে সংশ্লেষণ কলামের সাথে যুক্ত থাকে। সংশ্লেষণ কলামে থাকা সিলিকা বীড, ডিএনএ অণুকে একত্রে রাখতে সাহায্য করে। রিএজেন্ট এবং দ্রাবক যোগ করাসহ পুরো প্রক্রিয়াটিকে মাইক্রোপ্রসেসরের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
ধরুন আপনি ATG সিকোয়েন্সকে সিন্থেসিস করাতে চান। সেক্ষেত্রে প্রথমে সংশ্লেষণ কলামকে A যুক্ত বীড দিয়ে পূর্ণ করা হয়। তারপর তাতে রিজার্ভয়ারের T প্রয়োগ করা হয়। প্রতি T এর ডান পাশকে কেমিক্যাল দিয়ে এমনভাবে ব্লক করা হবে যাতে আরেকটি T এসে যুক্ত হতে না পারে। A এর সাথে যুক্ত হতে না পারা T গুলোকে কলাম থেকে বের করে দেয়া হয়। এরপর A এর সাথে যুক্ত T থেকে রাসায়নিকভাবে ব্লক সরিয়ে দেয়া হয়। এবার G যুক্ত বীড দিয়ে সিন্থেসাইজার কলামকে পূর্ণ করা হবে, আরেকটি G এসে যাতে যুক্ত না হয় সেটা নিশ্চিত করে, T এর সাথে যুক্ত না হওয়া G গুলোকে বের করে দেয়া হয়।
ব্যস! ATG সিন্থেসিস সম্পন্ন।
জৈবিক ডিএনএ কে মানব স্টেম কোষে স্থানান্তর
মেইজ প্রযুক্তিতে আমরা প্রথমেই মানুষের স্টেম কোষের জিনোম সম্পাদনা করে সেটাকে নিয়ান্ডার্থাল জিনোমে রূপান্তর করেছি। এবারে আলোচনা করা যাক কি করে মেইজ ব্যবহার না করে কৃত্রিম ভাবে তৈরি ডিএনএ কে স্টেম কোষে স্থানান্তর করা যেতে পারে সেই বিষয়ে।
একটা উপায় হতে পারে, স্টেম কোষের একটা ক্রোমোজোমের জায়গায় নিয়ান্ডার্থালের একটা ক্রোমোজোম, এভাবে সম্পূর্ণ জিনোম প্রতিস্থাপন করা (এটা গবেষকরা ইস্টে ব্যবহার করলেও, স্তন্যপায়ীদের কোষে এখনও এই পদ্ধতিটি চালু হয় নি)। এরপর এই স্টেম কোষের জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে ইনডিউসড প্লুরিপটেন্ট স্টেম কোষে (iPSC) বা এমব্রায়োনিক স্টেম কোষে রুপান্তর করা সম্ভব। আর এই এমব্রায়োনিক স্টেম কোষ কাজ করবে অনেকটা নিষিক্ত ডিম্বাণুর মতোই। এগুলো থেকে তৈরি হবে নতুন নিয়ান্ডার্থাল টিস্যু, অঙ্গ এবং শরীর। আমরা পেয়ে যাব নিয়ান্ডারথাল ভ্রূণ। (সম্প্রতি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাগডালেনা জেরনিকা-গোয়েটজ এর নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী মানব স্টেম কোষ থেকে ভ্রূণের মডেল তৈরীর ঘোষণা দিয়েছেন।)
ভ্রূণ কে উপযোগী আশ্রয় কোষে স্থানান্তর
এখন সাধারণ ক্লোনিং যেভাবে করা হয় সেভাবেই ভ্রূণটিকে একটি আশ্রয় (সারোগেট) স্ত্রীদেহে স্থানান্তর করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সারোগেট মাদার হতে পারে শিম্পাঞ্জি অথবা কোনো একজন দুঃসাহসী মানবীও! এখানে একটা ঘটনা বেশ প্রাসঙ্গিক। ২০০০ সালের দিকে পিরেনিয়ান আইবেক্স প্রজাতির শেষ সদস্য মৃত্যুবরণ করলে, এই প্রজাতিকে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিলো। কয়েক বছর পর, ২০০৩ সালে একটি পিরেনিয়ান আইবেক্স কে সফলভাবে ক্লোনিং করে ফিরিয়ে আনা (রিসারেকশন!) হলেও, কিছুক্ষণ পরই ফুসফুসের জটিলতাজনিত কারণে তার মৃত্যু ঘটে। এতে করে এই ক্লোনিং পদ্ধতি যথেষ্ট প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। তবে আশার কথা হচ্ছে, একটা জীবকে ক্লোন করার বিভিন্ন উপায় নিয়ে প্রতিনিয়তই গবেষণা হচ্ছে এবং এর কার্যকারিতা আরো বাড়ছে।
এবার আলোচনা করা যাক নিয়ান্ডার্থালরা পৃথিবীতে ফিরে আসলে সেটার প্রভাব কেমন হতে পারে সে বিষয়ে। প্রথমত আমরা হোমো স্যাপিয়েন্সরা হাজার বছর ধরে ক্রমাগত মিউটেশনের মধ্য দিয়ে আজকের এই পর্যায়ে এসেছি। এখনকার পৃথিবীর পরিবেশে আমরা খাপ খাইয়ে নিয়েছি। কিন্তু যে নিয়ান্ডার্থাল জিনোমকে আমরা পুনর্জীবন দিতে চাচ্ছি, তার জিনোম আজ থেকে কম করে হলেও চল্লিশ হাজার বছর আগের সময়কার। এই চল্লিশ হাজার বছরে পৃথিবীর পরিবেশ অনেকটাই বদলে গেছে। ফলত স্বাভাবিক ভাবেই পুনর্জীবিত নিয়ান্ডার্থাল মানুষটা বিপদজনক অবস্থায় থাকবে।
দ্বিতীয়ত পৃথিবীতে নিয়ান্ডার্থালদের ভূমিকা ঠিক কী হবে? তারা আমাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবে? সমাজে তাদের অবস্থানটা ঠিক কোথায় হবে? হোমো স্যাপিয়েন্সদের বুদ্ধিমত্তা, হিংসা, এসবের সাথে তারা কি আদৌ পেরে উঠবে। তাছাড়া নিয়ান্ডার্থালদেরকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আরো একটা আশঙ্কা রয়ে যায়। একজনের ফিরে আসা কিন্তু অন্য একজনের জন্য সবসময় সুখকর হয়না। প্রত্যাবর্তনের নামে অন্যের ভূমি দখল করে নৃশংসতা চালানোর উদাহরণ বর্তমান পৃথিবীর মানুষের কাছে বেশ পরিচিত। নিয়ান্ডার্থালদেরকে ফিরিয়ে আনার আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কিনা, এ নিয়েও সংশয় আছে। তবে এখনো অবধি উপরে উল্লেখ করা কোনো প্রযুক্তি বা পদ্ধতিই এ ব্যাপারে সাফাল্য দেখাতে পারে নি। কিন্তু আমাদের আশাহত হওয়ারও দরকার নেই। কারণ এসকল সংশয় দূর করতে এবং নিশ্চয়তা দেয়ার লক্ষ্যেই বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
তথ্যসুত্র:
- (Book) Regenesis: How Synthetic Biology Will Reinvent Nature and Ourselves by Ed Regis and George Church
- (Book) Neanderthal Man: In Search of Lost Genomes by Svante Pääbo
- Would it be possible to recreate some Neanderthals? – The Tech Interactive
Leave a Reply