হোমারের ইলিয়ড আর প্রাচীন গ্রীক পুরাণের মহাবীর অ্যাকিলিস যুদ্ধবিগ্রহ থেকে ইস্তফা নিয়েছেন আজ। অনেক হয়েছে মরণপণ লড়াই! এবার কিছুদিন সুখে-শান্তিতে দিনাতিপাত করা যাক। আর তাই তো যুদ্ধের ময়দান থেকে ঢাল-তলোয়ারসমেত সোজা হেঁটে চললেন এক গহীন অরণ্যের পানে। সেখানে পৌঁছে রং-বেরঙের পাখিদের কলকাকলি আর পশুদের আতিথেয়তায় রীতিমতো মুগ্ধ তিনি। খোশগল্প-আড্ডায় বেশ চমৎকার কাটতে লাগলো সময়।
কিছুদিন পরের কথা। একনাগাড়ে এভাবে অনেকদিন আমোদ-ফুর্তিতে থেকে অ্যাকিলিসের সুঠাম দেহে জেঁকে বসেছে অলসতা। কেননা, আগের মতো শারীরিক কসরত করা হয় না আর। করা হয় না দৌড়-ঝাপ, নড়াচড়াও। এখন উপায়? অনেক ভেবেচিন্তে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ডেকে পাঠালেন বনের সকল পশুদের। এবং সমবেত সকলের উদ্দেশ্যে জানালেন, তাদের সঙ্গে এক দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে চান তিনি। কিন্তু, অদম্য এ বীরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে এমন দুঃসাহস কার আছে?
একে দুইয়ে সবাই যখন নারাজ, ঠিক তখন সবাইকে চমকে দিয়ে জঙ্গলের চির ধীরস্থির কচ্ছপ এগিয়ে এলো। সম্মত হলো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের। তবে জুড়ে দিলো একটি শর্ত। কী সেই শর্ত? কচ্ছপের চেয়ে কয়েক মিটার পেছন থেকে দৌড় শুরু করতে হবে মহাবীর অ্যাকিলিসকে। ছোট্ট কচ্ছপের এমন সরল আবদার সাদরে গ্রহণ করলেন অ্যাকিলিস। দেখালেন সহানুভূতি।প্রতিযোগিতার দিন-তারিখ ঠিক হলো। প্রধান বিচারক নির্বাচিত হলো বনের রাজা সিংহ।
নিয়ম অনুযায়ী নির্ধারিত দিনে ময়দানে উপস্থিত হয়েছেন অ্যাকিলিস। সীমানার ওপাশে সারিবেঁধে দাঁড়িয়েছে বনের অন্যসব পশুরা। হনুমান আর বানরেরা ঝুলেছে গাছে। ভারিক্কি ভঙ্গিতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে প্রতিপক্ষ কচ্ছপ।তার এমন দুরন্ত সাহস দেখে বনের সকল পশুকুল শুরু করেছে কানাঘুঁষা। কেউ কেউ আবার বলছে- “বোকা কচ্ছপ! খরগোশের সাথে জিতে গেছো বলে অ্যাকিলিসের সঙ্গে জিতে যাবে, এমনটা ভাবলো কি করে!”
এখন প্রশ্ন আপনার কাছে প্রিয় পাঠক। কী মনে হয় আপনার? আর কিছুক্ষণের ভেতর শুরু হতে যাওয়া এ প্রতিযোগিতায় কে জিতবে? অ্যাকিলিস নাকি কচ্ছপ? স্বাভাবিকভাবেই এ প্রতিযোগিতায় অ্যাকিলিসেরই জেতার কথা, তাই-না? কিন্তু, কেউ যদি মনে করে থাকেন প্রতিযোগিতায় কচ্ছপ জিতবে, তাহলে আপনাকে স্বাগতম এক নতুন দুনিয়ায়। যার নাম জেনোর প্যারাডক্স। এখানে মহাবীর অ্যাকিলিস যতই চেষ্টা করুক না কেন, তিনি কখনোই জিততে পারবে না।
প্যারাডক্সের সূচনার কথা
খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ অব্দ। গ্রীসের ইলিয়া শহর।
বনেদি এক পরিবারের কোল আলো করে জন্ম নিয়েছে ছোট্ট এক শিশু। নাম তার জেনো। সময়ের দুরন্তপনায় বড় হতে থাকে সে। গুরু পারমেনাইডিসের সাহচর্যে আয়ত্ত করে দার্শনিক নানান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। গড়ে তোলেন পৃথিবীর প্রথম মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র, ইলিয়াতিক স্কুল। দক্ষিণ ইতালিতে অবস্থিত স্কুলটিতে জেনো তার শিষ্যদের নিয়ে সর্বদাই মত্ত থাকতেন জ্ঞানগর্ভ আলোচনায়।
একবার তিনি আলোচনার ঘোরে সন্ধান পান এক ভিন্ন দুনিয়ার। সেখানেও মেলে ধরেন জ্ঞানের ডালপালা। কুড়িয়ে আনেন এক নতুন যুক্তিবিজ্ঞান, জেনোর প্যারাডক্স। কী ছিল সেসব? আসলে এগুলো মূলত প্রাচীন যুক্তিবিজ্ঞানের সুবিখ্যাত ধাঁধার পসরা। যেখানে থরে থরে সাজানো আছে যুক্তির মূর্ত নিদর্শন। আপাতদৃষ্টিতে এদের সাধারণ মনে হলেও তর্কের ভিত্তিতে যা সমাধান করা জটিল। এখানে এসে আটকে যায় আমাদের চিন্তাধারা, তৈরি হয় রূঢ় রহস্য, যার যৌক্তিক সমাধানও মনে হবে অযৌক্তিক।
আর এভাবেই মহান দার্শনিক জেনো অনন্য সাধারণ পরিস্থিতিকে বিভিন্ন প্যারাডক্সের ফাঁদে ফেলে এক ধরণের নতুন সমস্যার জন্ম দিয়েছেন। জীবদ্দশায় প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে তৈরি করে গেছেন সর্বমোট দশটি প্যারাডক্স। যার মধ্যে অন্যতম “অ্যাকিলিস এন্ড দ্য টরটোয়েজ”। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, ছোট্ট এক কচ্ছপের কাছে মহাবীর অ্যাকিলিসের হেরে যাওয়ার করুণ আখ্যান। চলুন যুক্তি-তর্কের সেই গল্পেরই সূচনা করা যাক। ঘুরে আসা যাক কিছুটা অতীতে, অ্যাকিলিস বনাম কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতার মাঠ থেকে।
দৌড়ের মাঠে অ্যাকিলিস বনাম কচ্ছপ
পূর্বের ঘটনায় ফিরে আসি ৷ মাঠের চারিদিকে বিরাজ করছে চূড়ান্ত উত্তেজনা।কিছুক্ষণের ভেতরেই শুরু হবে দৌড়। মহাবীর অ্যাকিলিস শর্তমতো দাঁড়িয়েছেন কচ্ছপের ঠিক ১০ মিটার পশ্চাতে। বিচারক সিংহ এসে বসেছে মাঠের একেবারে শেষপ্রান্তে। তার হাতে শামুকের খোলসের বাঁশি। ফুঁ দিতেই শুরু হয়েছে ভোঁ দৌড়। এবার যৌক্তিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পালা।
মনে করুন, কচ্ছপ X অবস্থান থেকে দৌড় শুরু করেছে, আর অ্যাকিলিস শুরু করেছে কচ্ছপের ঠিক পেছনের W অবস্থান থেকে। দৌড় শুরুর প্রথম পর্যায়ে, অ্যাকিলিস দৌড়ে যখন X অবস্থানে এসেছে তখন ছোট্ট কচ্ছপ তার গুটি গুটি পায়ে সামান্য এগিয়ে পৌঁছে গেছে Y অবস্থানে। অ্যাকিলিস যখন Y অবস্থানে এসেছে তখন কচ্ছপ আবারও সামান্য এগিয়ে পৌঁছে গেছে নতুন Z অবস্থানে। আবার, অ্যাকিলিস যখন Z অবস্থানে পৌঁছুবে তখন কচ্ছপও পৌঁছে যাবে আরেক নতুন অবস্থানে। কী বিপদ! এভাবে অ্যাকিলিস যতই চেষ্টা করছে, কিছুতেই কচ্ছপকে ধরতে পারছে না।
চটে গেলেন অ্যাকিলিস। ততক্ষণে হর্ষধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে চারিধার। মনে মনে ভাবছেন তিনি, পেছন থেকে দৌড় শুরুর সিদ্ধান্তটাই সকল নষ্টের গোড়া। আর ওপাশের সারিবাঁধা পশুরা অবাক নয়নে দেখছে, মহাবীর অ্যাকিলিস কচ্ছপটিকে কিছুতেই অতিক্রম করতে পারছেন না। এগোচ্ছেন কেবল পেছন-পেছনে। অ্যাকিলিস কী কচ্ছপকে কখনোই অতিক্রম করতে পারবেন না? গণিত কী বলে? চলুন সেটিও দেখে আসি।
দৌড়ের মাঠে অ্যাকিলস ও কচ্ছপ; ছবিসূত্র: Plantonic Realms
গাণিতিক পর্যবেক্ষণ
মহাবীর অ্যাকিলিসের ভক্তকুল তার এমন করুণ পরিণতি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। ছোট্ট কচ্ছপের কাছে এমন নিদারুণ হার যেন চির লজ্জার। আর তাই দৌড় প্রতিযোগিতার মাঠ থেকে সোজা গণিতের মঞ্চে এবার টেনে নামানো হলো অ্যাকিলিস ও কচ্ছপকে। শুরু হলো চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ। ধরা যাক, ছোট্ট কচ্ছপের গতিবেগ সেকেণ্ডে ১ মিটার। আর অ্যাকিলিসের গতিবেগ সেকেন্ডে ১০ মিটার। অ্যাকিলিস কচ্ছপের ১০ মিটার পেছন থেকে দৌড় শুরু করেছে।
দৌড় শুরুর প্রথম ১ সেকেন্ড। অ্যাকিলিস পৌঁছে গেছে কচ্ছপের অবস্থানে। আর কচ্ছপ তার আপন গতিতে পৌঁছে গেছে ১ মিটার সামনে। এবার, অ্যাকিলিস যখন আরো ১ মিটার অগ্রসর হবে তখন কচ্ছপও অতিক্রম করবে ০.১ মিটার। আবার, অ্যাকিলিস যখন ০.১ মিটার অগ্রসর হবে তখন কচ্ছপ অতিক্রম করবে আরো ০.০১ মিটার। যেন উপরে বর্ণিত ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটছে এখানে। কিন্তু এমনটি তো হওয়ার কথা না, আসল ফাঁকিটা কোথায়?
গাণিতিক হিসাব-নিকাশ; ছবিসূত্র: Philosophico-Scientific Adventures
জেনোর ফাঁকি
মহান দার্শনিক জেনো প্যারাডক্সটি রচনার সময় এক অনন্য কল্পনার জগতে বিভোর ছিলেন। যেখানে তিনি চতুর্থ মাত্রার সময়কে ভেঙে ফেলেছেন, কেটে টুকরো টুকরো করেছেন তৃতীয় মাত্রার স্থানকেও। আর আসল ফাঁকিটুকু এখানেই।
কেননা, প্যারাডক্সটিতে পুরো দৌড় প্রতিযোগিতার মাঠকে অসীম ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যার ফলে সেখানে দুরন্ত মহাবীর অ্যাকিলিসও এক প্রাণান্তকর লড়াইয়ে বারবার হেরে যাচ্ছেন ছোট্ট মন্থর গতির কচ্ছপের কাছে। যা বাস্তবে অসম্ভব। একটি নির্দিষ্ট সময়কে অসীম ভাগে বিভাজন করলেও এর যোগফল হবে সসীম। চলুন বিশ্লেষণ করে দেখি-
যেমন: অ্যাকিলিসের অতিক্রান্ত দূরত্বকে সিরিজের আকারে লিখলে পাই,
দূরত্ব= ১০ + ১+ ০.১ +…..+ ১০ (২-n) +…(চলবে)
অর্থাৎ, একইরকম হিসেব অনুযায়ী মাত্র ১.১১ সেকেন্ডে অ্যাকিলিস ছোট্ট কচ্ছপকে অতিক্রম করে যাওয়ার কথা। কিন্তু সসীম সময়ের অসীম বিভাজন তা হতে দিচ্ছে না। আর এটিই মহাবীর অ্যাকিলিসকে বারবার হারতে বাধ্য করেছে ছোট্ট কচ্ছপের কাছে।
তথ্যসূত্রঃ
1. Zeno’s Paradoxes – IEP
2. What Is the Answer to Zeno’s Paradox? – Slate
3. Zeno’s Paradox of the Tortoise and Achilles – Platonic Realms
4. Zeno Paradox 1: Achilles and the Tortoise – Philosophico-Scientific Adventures.
Leave a Reply