যখন আমরা কোন ঘটনা-অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাই, বিভিন্ন ইন্দ্রিয় থেকে আসা তথ্য মস্তিষ্কের একটা বড় সংখ্যক স্নায়ুকে আলোড়িত করে। কিন্তু এই “বড় সংখ্যক” স্নায়ুর মধ্য থেকে মাত্র অল্প একটা অংশই দিন শেষে এনগ্রামের অংশ হয়। এতগুলো আলোড়িত স্নায়ুর মধ্য থেকে ঠিক কোন স্নায়ুকোষ এনগ্রামের অংশ হিসেবে নির্বাচিত হবে এটা কিসের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়? এখানে কি কোন ধরণের নির্বাচন কাজ করে? কোন ভাবে স্নায়ুকোষ নির্বাচন বদলানো সম্ভব?
এসব প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো হ্যাঁ। তবে বিস্তারিত ব্যখ্যার আগে চলুন আরো কিছু পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে জানা যাক।
আগের লেখাতে আমরা এনগ্রামের সাথে পরিচিত হয়েছি। কিভাবে বিজ্ঞানীরা নানারকমের কৌশল ব্যবহার করে স্মৃতির সাথে জড়িত কোন এনগ্রাম সনাক্ত করতে পারেন, তা জেনেছি। এই লেখাতে আমরা এনগ্রাম সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানবো।
এনগ্রাম-স্নায়ু মস্তিষ্কে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো থাকে
ধরা যাক অ্যামিগডালার কথা। অ্যামিগডালা মস্তিষ্কে আবেগের কেন্দ্র। ভয়ের মতো আদিম ও শক্তিশালী আবেগ উৎপন্ন করার ক্ষেত্রে অ্যামিগডালা একটা বড় ভূমিকা রাখে। গত লেখা থেকে শব্দ ও বিদ্যুৎ শক পরীক্ষার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? অ্যামিগডালার অধিকাংশ নিউরনই এই পরীক্ষার সময় বিভিন্ন ইন্দ্রিয় থেকে আসা সংকেত পেয়ে আন্দোলিত হয়ে স্পন্দন তৈরি করে। কিন্তু এদের মধ্য থেকে শেষমেশ মাত্র ১০-২০% নিউরন এনগ্রাম গঠনে বরাদ্দপ্রাপ্ত হয়। অন্যদিকে, হিপ্পোক্যাম্পাসের ডেন্ট্যাট গাইরাস নামক অংশে এই সংখ্যাটা আরো কম, ২-৬%। অর্থাৎ এনগ্রাম গঠনকারী স্নায়ু তুলনামূলকভাবে বিক্ষিপ্ত (sparse)। এই বিক্ষিপ্ততার পরিমাণ আবার মস্তিষ্কের একেক জায়গায় একেক রকম।
আরেকটা অদ্ভূত ব্যপার হলো, বিভিন্ন ধরনের স্মৃতির জন্য কোন মস্তিষ্ক-অঞ্চলে এনগ্রাম গঠনকারী স্নায়ুর বিক্ষিপ্ততার পরিমাণ একই রকম। যেমন ধরা যাক, কোন ঘটনার সাথে জড়িত পুরস্কার (খাবার) কিংবা ভয় (ইলেকট্রিক শক): এই দুইটি স্মৃতির মধ্যে ভয়ের স্মৃতি হয়তো তীব্র হবে। কিন্তু ভয়ের ক্ষেত্রে এনগ্রাম-তৈরিকারী-নিউরনের সংখ্যা পুরস্কারের চেয়ে সংখ্যায় বেশি নয়। তার মানে মস্তিষ্কে এমন কোন প্রক্রিয়া থাকতে হবে যেটা প্রতিটি স্মৃতির ক্ষেত্রেই এনগ্রাম তৈরি স্নায়ুর বিক্ষিপ্ততা (অর্থাৎ কতগুলি নিউরন এনগ্রাম তৈরি করবে) কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।
কিন্তু কেন এই নিয়ন্ত্রণ? বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা যায় যে মস্তিষ্ক তথ্য-সংরক্ষণ ও কম্পিউটেশনের জন্য একটি বিক্ষিপ্ত বিতরণ ব্যবস্থা (Sparse Distributed System) ব্যবহার করে। এ ধরণের ব্যবস্থা অধিক পরিমাণ তথ্য ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে পারে, অন্যদিকে অনাকাঙ্ক্ষিত এলোমেলো সংকেত প্রতিরোধও করতে পারে। এ কারণে এনগ্রামে স্নায়ুসমূহের বিক্ষিপ্ততা একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যা সংরক্ষণ করতে হবে। আজকে এই লেখাতে আমরা দেখবো মস্তিস্ক কিভাবে এনগ্রাম স্নায়ুসমূহের সংরক্ষণশীলতা বজায় রাখে।
স্নায়ু-উদ্দীপন ক্ষমতা ঠিক করে এনগ্রামে অংশগ্রহণ
আমরা জানি স্নায়ু হলো তড়িৎ-রাসায়নিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারা বিশেষায়িত কোষ, যারা স্বল্পস্থায়ী তড়িৎরাসায়নিক বিভব-স্পন্দন তৈরি করে। একে বলা হয় একশন পটেনশিয়াল বা স্পাইক। যখন স্নায়ুকোষের ঝিল্লীতে তড়িৎ-বিভব নির্দিষ্ট একটা সীমা অতিক্রম করে, তখন এসব স্পাইক তৈরি হয়। কোন স্নায়ু তার কোষঝিল্লী আয়নিত করে তড়িত-বিভব বাড়ানোর জন্য কতোটুকু প্রস্তুত থাকবে, সেটা আবার ভিন্ন একটা বৈশিষ্ট্য, যাকে উদ্দীপন-ক্ষমতা (excitability) বলা যেতে পারে।
স্নায়ুকোষের উদ্দীপন-ক্ষমতা বোঝার জন্য দুইটা গাড়ির সাথে তুলনা করা যেতে পারে। মনে করেন আপনি একটা সাধারণ গাড়ির সাথে স্পোর্টস কারের এক্সেলারেশন তুলনা করছেন। উচ্চ গতিতে পৌঁছাতে সাধারণ গাড়ির এক্সেলারেশন প্যাডেলে বেশি চাপ দিতে হবে। অন্যদিকে স্পোর্টস কারের প্যাডেলে হালকা চাপ দিলেই দ্রুত এক্সেলারেশন হয়ে উচ্চগতিতে পৌঁছে যাবে। ঠিক তেমনি, দুইটি স্নায়ুকোষের উদ্দীপন-ক্ষমতায় পার্থক্য থাকলে বেশি উদ্দীপন-ক্ষমতা সম্পন্ন স্নায়ুটি খুব দ্রুত স্পাইক তৈরির একশন পটেনশিয়াল তৈরি করতে পারে, সে জন্য এর খুব বেশি ইনপুট প্রয়োজন নেই।
দেখা গেলো, এক দল স্নায়ুকোষের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট সময়ে কেবল যেগুলো উদ্দীপন-ক্ষমতা বেশি থাকে, সেগুলোই অধিকাংশ সময়ে কোন স্মৃতির সাথে জড়িত এনগ্রাম তৈরি করতে অংশ নেয়।
স্নায়ুসমূহের উদ্দীপন-ধর্মটা যদি বদলে দেয়া যায় তাহলে কী হবে? বেশ কিছু পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা স্নায়ুর উদ্দীপন-ক্ষমতা বদলাতে পারি। যেমন স্নায়ুকে এমন ভাবে জেনেটিক্যালি বদলানো যায়, যাতে তার উপর আলো ফেললে তার প্রতিক্রিয়ায় কোষঝিল্লীতে বিশেষ আয়ন-চ্যানেল উন্মুক্ত হবে (এই প্রক্রিয়াকে বলে অপ্টোজেনেটিক্স, অপ্টোজেনেটিক্স নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই লেখায়)। এই আয়ন-চ্যানেল খুলে যাওয়ার ফলে বাইরে থাকা ধনাত্মক-আয়নসমূহ কোষের মধ্যে এসে তড়িত বিভব বাড়িয়ে নতুন স্পাইক তৈরির সীমায় নিয়ে যাবে। এর ফলাফল হলো কোষটি খুব সহজেই উদ্দীপিত হবে।
দেখা গেলো, পূর্বের লেখায় উল্লিখিত ভয়ের স্মৃতি তৈরির পরীক্ষায় যদি নির্দিষ্ট কিছু স্নায়ুর উপরে আলো ফেলে তাদের উদ্দীপনা-ক্ষমতা বাড়ানো হয়, নতুন এনগ্রাম তৈরি সময় ওই উদ্দীপ্ত স্নায়ুসমূহই অংশ নেয়। সেই স্মৃতি স্মরণ করার প্রক্রিয়ার সময়েও এই আলো-ফেলা স্নায়ুকোষগুলো এনগ্রামে সক্রিয় হতে দেখা যায়। পরীক্ষার মাধ্যমে এদেরকে নিষ্ক্রিয় করে দেখা গেল কন্ডিশনাল সংকেত দিলেও ভয়ে জমে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া ইঁদুরের মধ্যে তৈরি হচ্ছে না। তার মানে, কৃত্রিমভাবে উদ্দীপন-ক্ষমতা বাড়ানো এই স্নায়ুগুলো আসলেই ওই পরীক্ষার স্মৃতির এনগ্রামে অংশ নিচ্ছে।
স্নায়ুর উদ্দীপন ধর্ম ঠিক করে কোন স্নায়ু স্মৃতি-এনগ্রামে অংশ নেবে নাকি না। এখানে একটা প্রশ্ন হয়তো আপনার মাথায় এসেছে – কোন স্নায়ুর যদি উদ্দীপন ক্ষমতা বেশি হয় তাহলে সেটাতো বার বার বিভিন্ন স্মৃতির এনগ্রামে অংশ নিতেই থাকবে। সেটা কেন হয় না? প্রথমতঃ, যে কোন স্নায়ুর উদ্দীপন ক্ষমতার একটা বৃদ্ধি-ক্ষয় চক্র আছে, সময়ের সাথে সাথে সেটা বাড়ে, তারপর আবার কমতে থাকে (এটা নিয়ে আমরা একটু পরেই আলোচনা করছি)।
দ্বিতীয়তঃ, স্নায়ুসমূহের মধ্যে কিন্তু একটা প্রতিযোগিতাও কাজ করে। দেখা গেছে, যে স্নায়ু এনগ্রামে অংশ নেয়, তা আরো অনেকগুলো প্রতিবেশী স্নায়ুর সাথে যুক্ত থাকে, যাদেরকে সে এনগ্রামে অংশ নিতে বাঁধা দেয়। এ ধরণের প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করে যে মস্তিষ্কের একটা অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি উদ্দীপন-ক্ষমতা বিশিষ্ট স্নায়ুগুলো তাদের প্রতিবেশীদের পরোক্ষভাবে দমন করে রাখতে পারে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, যদি আপনি এই “দমন” ক্ষমতাকে আটকাতে পারেন, তাহলে এনগ্রামের আকার বড় হয়ে যায়।
একই ঘটনার স্মৃতি মস্তিষ্কে ছড়িয়ে থাকে
এতক্ষণ আমরা মস্তিষ্কে একটি মাত্র অঞ্চলে (অ্যামিগডালা) তৈরি হওয়া এনগ্রাম সম্পর্কে জানলাম। এরকম আরো কিছু গবেষণায় মস্তিষ্কের অন্যান্য অঞ্চলেও “ভয় তৈরি কন্ডিশনিং”-স্মৃতির এনগ্রাম তৈরি হতে দেখা গেছে, যাদের মধ্যে আছে হিপ্পোক্যাম্পাস ও কর্টেক্সের এলাকা। আলাদা আলাদা মস্তিষ্ক অঞ্চলে থাকা এসব এনগ্রামসমূহ কিভাবে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে? বা তারা কি আসলেই একই স্মৃতির সাথে সম্পর্কিত নাকি আলাদা আলাদা স্মৃতি? বৈজ্ঞানিক জার্নাল ন্যাচার কমিউনিকেশনে প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে এটার একটা উত্তর পাওয়া যায়। তারা টিস্যু ক্লিয়ারিং নামক একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে নিউরাল টিস্যুকে স্বচ্ছ্ব বানিয়ে ফেলেন। এর ফলে স্নায়ুসমূহকে জেনেটিক্যালি ইন্জিনিয়ারিং করে আগে বর্ণিত ফ্লুরোসেন্স প্রোটিন জুড়ে দেন রিপোর্টার জিনের সাথে। এর ফলে কোন ঘটনার সাথে জড়িত স্মৃতি তৈরি বা সক্রিয় হলে পুরো মস্তিষ্ক জুড়েই সেটার এনগ্রাম দৃশ্যমান হয়।
গবেষকবৃন্দ দেখলেন যে ভয়ের ঘটনার সাথে জড়িত স্মৃতির এনগ্রাম মস্তিষ্কের বিভিন্ন এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে! এদের মধ্যে হিপ্পোক্যাম্পাস ও অ্যামিগডালা তো রয়েছেই, পাশাপাশি থ্যালামাস, হাইপোথ্যালামাস, ও ব্রেনস্টেমও যুক্ত। এই গবেষণাটি এনগ্রাম-সমাহার ধারণা সমর্থন করে। এনগ্রাম-সমাহার অনুকল্প অনুযায়ী, কোন স্মৃতি মস্তিষ্কের একক জায়গায় থাকে না। বরং তারা মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকে। সম্ভবত মস্তিষ্কের একেক অঞ্চল একটি স্মৃতির সাথে জড়িত ভিন্ন ভিন্ন দিক জমা রাখে। যেমন হতে পারে এনগ্রামের অ্যামিগডালার অংশটি হয়তো ভয়ের সাথে জড়িত আবেগের অংশ, হিপ্পোক্যাম্পাস ওই স্মৃতির স্থানিক অংশ, আর কর্টেক্স হয়তো বিদ্যুৎ শকের সাথে জড়িত অনুভূতি জমা রাখে।
একাধিক স্মৃতির মধ্যে কিভাবে সম্পর্ক-স্থাপন হয়
এতক্ষণ আমরা একটামাত্র স্মৃতি নিয়ে কথাবার্তা বলেছি। কিন্তু মস্তিষ্কে তো অজস্র স্মৃতি থাকে। মস্তিষ্কে একাধিক স্মৃতির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করাটা গুরুত্বপূর্ণ; যাতে পরবর্তীতে এদেরকে নতুন কোন বিমূর্ত ধারণা বা নীতিতে একীভূত করা যায়। প্রশ্ন হলো, কিভাবে ভিন্ন ভিন্ন স্মৃতির মধ্যে সম্পর্ক-স্থাপন করা যায়?
ভেবে দেখুন, দুইটি স্মৃতির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করার প্রক্রিয়াটি নিজেও কিন্তু “আচরণগত প্রাসঙ্গিক ঘটনা”। এটাকে “স্মৃতির-স্মৃতি” হিসেবে বিবেচনা করা যায়, কারণ দুইটি স্মৃতির মধ্যে সম্পর্কটা মস্তিষ্কের কোথাও না কোথাও জমা রাখতে হবে।
একাধিক স্মৃতির মধ্যে মস্তিষ্ক কিভাবে সম্পর্ক তৈরি করে, সে সম্পর্কে অনেকগুলো মতামত আছে। এদের মধ্যে একটি হলো সমাপতন (overlap)। দুইটি এনগ্রামের মধ্যে কিছু নিউরন থাকতে পারে যেগুলো দুই স্মৃতিতেই অংশ নেয়, অর্থাৎ তাদের সমাপতন হয়। দুইটি স্মৃতি কতটুকু সম্পর্কিত, তা এদের মধ্যে কতগুলো স্নায়ুকোষ সমাপতিত তা দিয়ে নির্ধারিত হতে পারে।
একটু আগে উল্লেখ করেছিলাম যে স্নায়ুসমূহের উদ্দীপন ধর্ম নির্ধারিত করে যে কোন স্নায়ু একটা স্মৃতি তৈরিতে অংশ নেবে কি না। আপনার মাথায় হয়তো প্রশ্ন এসেছে, যে তাহলে তো একই স্নায়ু বার বার স্মৃতি তৈরিতে অংশ নেয়ার কথা। কেন একই স্নায়ু বারবার এনগ্রাম প্রতিযোগিতায় জেতে না? আসলে এই উদ্দীপন ধর্ম ধ্রুবক নয়, স্নায়ুসমূহ কতটুকু সক্রিয় হতে পারবে সেটা ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়। কোন স্নায়ুর উচ্চ উদ্দীপন ধর্ম মাত্র কয়েক ঘন্টা স্থায়ী হতে পারে। এর পর তা আবার কমে যায়। এর ফলে একই স্নায়ু বারবার স্মৃতি এনগ্রামে অংশ নেয়ার প্রতিযোগিতায় জিততে পারে না, তাই মস্তিষ্কের স্মৃতি-ধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ার ভয় থাকে না।
এ ব্যপারে আরেকটা গবেষণার কথা জানা যাক। ইঁদুরে ইলেকট্রিক শকের সাথে দুইটি স্মৃতি তৈরি করা হলো দুইটি ভিন্ন ভিন্ন শব্দের সাথে। শব্দ দুইটির সথে যখন ভয়ের কন্ডিশনিং সেশনগুলোর দূরত্ব ৬ ঘন্টার কম হয়, তখনো প্রথম স্মৃতির এনগ্রামে যুক্ত অনেকগুলো স্নায়ু উদ্দীপন-ধর্মের চূড়ান্তে থাকে। এদের মধ্যে অনেকেই দ্বিতীয় স্মৃতি তৈরি হওয়ার সময়ও সমাপতিত হয়।
এখন আপনি যদি কোন তড়িৎ-শক না দিয়েই কেবল প্রথম শব্দ বাজান , তাহলে ধীরে ধীরে ইঁদুরের মধ্যে প্রথম শব্দের সাথে ভয়ে জড়ো হয়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়াও লোপ পেতে থাকবে। শুধু তাই না, দ্বিতীয় শব্দ বাজালেও দেখা যাবে ইঁদুরটি আগের মতো ভয়ে জড়ো হয়ে যাচ্ছে না। তারমানে, দুইটি স্মৃতি একসাথে কাজ করছিলো, সেগুলো ব্যবহারের অভাবে একটু একটু করে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে আপনি যদি দুইটি শব্দের কন্ডিশনিং সেশনগুলোর সময় পার্থক্য ২৪ ঘন্টা করেন, তাহলে দেখা যাবে দুইটি স্মৃতির এনগ্রামে যুক্ত স্নায়ুকোষগুলোর বেশিরভাগই আলাদা (সমাপতিত নয়)। আগের মতো প্রথম শব্দের সাথে ইঁদুরকে ইলেকট্রিক শক না দিলে প্রথম শব্দে ভয়ের প্রতিক্রিয়া লোপ পাবে, কিন্তু দ্বিতীয় শব্দে সে ঠিকই ভয়ে জড় হয়ে যাবে। এই পরীক্ষা থেকে বোঝা যায় দুইটি এনগ্রাম-স্নায়ুর মধ্যে সমাপতন যত বেশি, তাদের স্মৃতির মধ্যে সম্পর্ক ততো দৃঢ়।
স্নায়ু-জনপুঞ্জ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, স্মরণের ফলে দুইটা আলাদা এনগ্রামের মধ্যে নতুন স্নায়ুর সংযোগ-পথ তৈরি হয়। এমন কি স্মরণ-প্রক্রিয়ায় কোন এনগ্রামের নিউরন-সজ্জা পুনর্বিন্যস্ত হতে পারে। তার মানে হলো, যদি বাইরের কোন উদ্দীপক দুইটি আলাদা এনগ্রামকে বারবার সক্রিয় করে, তাহলে এনগ্রামদ্বয়কে সরাসরি যুক্ত করে দেয়া সুবিধাজনক। এটাতে পরবর্তীতে কোন উদ্দীপনা একটি স্মৃতিকে স্মরণ করলে এর সাথে সংযুক্ত দ্বিতীয় স্মৃতিও সাথে সাথে মনে পড়ে যাবে।
একই সাথে মনে করার প্রক্রিয়ায় দুইটি স্মৃতি-এনগ্রামের মধ্যে তৈরি সংযোগ-পথের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, এরা কিন্তু সংশ্লিষ্ট স্মৃতি মনে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় নয়। অর্থাৎ দুইটি এনগ্রামের সংযোগ স্নায়ু-পথ এদের মধ্য ঠিক কিসের স্মৃতি আছে সেটা বহন করে না।
সারাংশ
এই অধ্যায়ের শেষে এসে চলুন একটা সারাংশ টানা যাক। অভিজ্ঞতার স্মৃতি স্নায়ু সমূহের সিন্যাপ্স সংযোগে জমা থাকে, যে স্নায়ুগুলো আবার বেশ বিক্ষিপ্ত। এদেরকে ওই স্মৃতির এনগ্রাম বলে। এই বিক্ষিপ্ততা মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলে ভীষণভাবে সংরক্ষিত। স্নায়ুসমূহ নিজেদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকে, যে কারা নতুন স্মৃতির এনগ্রামে অংশ নেবে। এসব এনগ্রাম সক্রিয় করে আমরা স্মৃতিটাকে জাগিয়ে তুলতে পারি, সুনির্দিষ্টভাবে স্নায়ুগুলো নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে স্মৃতি ভুলিয়েও দিতে পারি। একই ঘটনার স্মৃতির বিভিন্ন অংশ মস্তিষ্কের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়। একাধিক স্মৃতির মধ্যে আবার কিছু স্নায়ুর সমাপতন হতে পারে, কিংবা একসাথে মনে করার মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে নতুন স্নায়ুপথ তৈরি হয়ে সংযুক্ত হতে পারে। সম্ভবত এভাবেই একাধিক স্মৃতি যুক্ত করে আমরা বিমূর্ত ধারণা নিয়ে চিন্তা করতে পারি, জটিল যুক্তির মালা গাঁথতে পারি। আমাদের প্রতীতি (cognition) রহস্য বোধ হয় লুকিয়ে আছে এই এনগ্রামের মাঝে।
তথ্যসূত্র:
- Building Blocks of Memory in the Brain | Artem Kirsanov | YouTube
- Brain-wide mapping reveals that engrams for a single memory are distributed across multiple brain regions | Nature Communications
- Experimental evidence for sparse firing in the neocortex – ScienceDirect
- Understanding Hierarchical Temporal Memory | by Richa Singh | Medium
- Memory engrams: Recalling the past and imagining the future | Science
Leave a Reply