‘ইনজেনুইটি’র মঙ্গল জয়!

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

১৯ এপ্রিল ২০২১।পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের আকাশে বিকেলের শেষ আভা ফুটে উঠেছে। ঠিক সেসময় পৃথিবী থেকে প্রায় ২২৫ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে লাল গ্রহের আকাশে প্রথমবারের মতো সফলভাবে উড্ডয়ন সম্পন্ন করে মনুষ্য নির্মিত হেলিকপ্টার ‘ইনজেনুইটি’। মুহূর্তটা এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, প্রথম বিমান আবিষ্কারক ‘রাইট ভাইদের’ স্মরণে ‘ইনজেনুইটি’র প্রথম উড্ডয়ন’কে ‘রাইট ব্রাদার্স মোমেন্ট’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন নাসার বিজ্ঞানীরা। আর যেই স্থান থেকে হেলিকপ্টারটি উড়েছিল সেটির নামকরণ করা হয় ‘রাইট ব্রাদার্স ফিল্ড’! মঙ্গলের পাতলা বায়ুমণ্ডলে ৩ মিটার উঁচুতে মাত্র ৩০ সেকেন্ড ভেসে ছিল হেলিকপ্টারটি। ইনজেনুইটির জন্য এটি একটি ক্ষুদ্র পদক্ষেপ, কিন্তু মানবজাতির জন্য বিরাট এক অগ্রগতি।

এবারে হেলিকপ্টারটি সম্পর্কে আরও জানা যাক। ২০১৪ সালে নাসার অন্তর্গত ‘জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরি’ ও মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানি ‘অ্যারোভায়রনমেন্ট’ মঙ্গলগ্রহে প্রেরিত রোভারের সঙ্গে একটি স্কাউট হেলিকপ্টার প্রেরণের পরিকল্পনা করে এবং হেলিকপ্টারটির নকশা প্রণয়ন করে। নাসার ‘এইমস রিসার্চ সেন্টার’ এবং ‘ল্যাংলি রিসার্চ সেন্টার’ও গবেষণাকার্যে সহায়তা করে। সেখান থেকেই মূলত ‘ইনজেনুইটি’র যাত্রা শুরু। মজার ব্যাপার হলো প্রথমদিকে এর ডাকনাম ছিল ‘জিনি’। পরবর্তীতে হেলিকপ্টারটির আনুষ্ঠানিক নামকরণের জন্য নাসা একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে এবং ২০২০ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালাবামা অঙ্গরাজ্যের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী ‘ভানিজা রুপানি’ এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন। তিনি হেলিকপ্টারটির নামকরণ করেন ‘ইনজেনুইটি’। সেই থেকেই হেলিকপ্টারটি’র এই নামে পরিচিত হয়! প্রায় ১.৮ কিলোগ্রাম ভর এবং ১৯ ইঞ্চি উচ্চতা সম্পন্ন হেলিকপ্টারটি নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য নাসা মোট বিনিয়োগ করেছে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি মার্কিন ডলার। প্রায় ৫ বছরের সফল নির্মাণ কাজ শেষে ২০১৯ সালে ‘পার্সিভারেন্স’ রোভারের সাথে সংযুক্ত করা হয় হেলিকপ্টারটিকে।

পার্সিভারেন্স রোভার।

‘মার্স-২০২০ মিশন’ প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে এবং জেযেরো ক্রেটারে অতীতে কোন প্রাণের অস্তিত্ব বা কোন সম্ভাবনা ছিল কিনা এবং মঙ্গলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মিশন চালাতে ৩০ জুলাই ২০২০ এ ‘অ্যাটলাস-ভি ৫৪১’ রকেটে করে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে রোভার ‘পার্সিভারেন্স’ এবং ‘ইনজেনুইটি’। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের ‘কেপ ক্যানাভেরাল স্পেস ফোর্স স্টেশন’ থেকে উৎক্ষেপণ করা হয় মহাকাশযান’টিকে। এই মিশনে ব্যবহৃত ‘পার্সিভারেন্স’ রোভারটি লম্বায় ১০ ফিট এবং চওড়ায় ৯ ফিট ও উচ্চতায় প্রায় ৭ফিট। রোভারটির ওজন ১০২৫ কিলোগ্রাম। রোভারটিতে বড় ও শক্তিশালী বাহু এবং চাকা,ইনজুনিইটিসহ হিসেবে আনলে ২৩ টি ক্যামেরা এবং ৭টি অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল। মঙ্গলগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব খোঁজার জন্যই এসব যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। যাহোক, প্রায় ২০৪ দিনের ভ্রমণ শেষে ২০২১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রোভারটি মঙ্গলগ্রহের জেযেরো খাদে অবতরণ করে। শুরু করে বৈজ্ঞানিক গবেষণা!

‘ইনজেনুইটি’র একটি ‘পাখা ঘূর্ণন পরীক্ষা’ (rotor spin test)

তখন পর্যন্ত রোভারটির ভেতর একটি চেম্বারে বন্দী ছিল ‘ইনজেনুইটি’ হেলিকপ্টারটি। পরিকল্পনা’র অংশ হিসেবে ২০২১ সালের ৩ এপ্রিল ইনজেনুইটিকে ‘পার্সিভিয়ারেন্স’ থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। তারপর বিভিন্ন ধাপে উড্ডয়নের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে হেলিকপ্টারটি। ১৯ এপ্রিল প্রথম উড্ডয়ন সম্পন্ন করে।

‘ইনজেনুইটি’র গঠনকাঠামো ছিল অত্যন্ত উন্নত। প্রায় ১৯ ইঞ্চি উচ্চতার হেলিকপ্টার’টির প্রতিটি পাখার ব্যাস ছিল ১.২ মিটার। এগুলোর প্রতি মিনিটে ২৪০০ বার ঘুরতে সক্ষম ছিল (মঙ্গলের স্বল্প ঘনত্বের বায়ুমণ্ডলে এত উচ্চ গতি ছাড়া উড্ডয়ন সম্ভবপর ছিলো না)।

প্রথম উড্ডয়নের সময় হেলিকপ্টার থেকে
তোলা ছবি।

হেলিকপ্টারে ব্যবহৃত ব্যাটারির ক্ষমতা ছিল ৩৫–৪০ ওয়াট–ঘণ্টা। এটিকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যাতে এটির ব্যাটারিগুলোকে রিচার্জ করার জন্য সৌর প্যানেল ব্যবহার করতে পারে। হেলিকপ্টারটি’তে তেজষ্ক্রিয়তা–প্রতিরোধী ব্যবস্থাও ছিল, যেটি মঙ্গলগ্রহের অত্যন্ত শীতল আবহাওয়াতেও টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল কপ্টারটিকে। ইনজেনুইটিতে গবেষণার জন্য বেশকিছু অতিরিক্ত যন্ত্রপাতিও ছিল। এগুলোর মধ্যে জাইরোস্কোপ, ভিজুয়াল ওডোমেট্রি, ইনক্লিনোমিটার, অ্যাল্টিমিটার এবং হ্যাজার্ড ডিটেক্টর অন্যতম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইনজেনুইটিকে পরিচালনা’র জন্য লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করেছিলেন নাসা’র বিজ্ঞানীরা। দেখতে ছোট হলেও দারুণ ক্ষমতার অধিকারী ছিল ‘ইনজেনুইটি’!

এক নজরে ইনজেনুইটি-

আয়তনঃ ১২১ সে.মি. x ৪৯ সে.মি. x ৫২ সে.মি.

ভরঃ ১.৮ কিলোগ্রাম

ব্যাটারিঃ সৌরশক্তি চালিত লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি(৬ টি)

ক্ষমতাঃ ৩৫–৪০ ওয়াট–ঘণ্টা।

ক্যামেরাঃ ২টি

প্রথম উড্ডয়নঃ ১৯ এপ্রিল ২০২১

শেষ উড্ডয়নঃ ১৮ জানুয়ারি ২০২৪

উড্ডয়ন সংখ্যাঃ ৭২ টি

সর্বমোট উড্ডয়নকালঃ   ২ ঘন্টা ৮ মিনিট ৫৫ সেকেন্ড

উড্ডয়ন এলাকার পরিমাণঃ  ১৭.২৪২ কিলোমিটার

সর্বোচ্চ উচ্চতা অতিক্রমঃ ২৪ মিটার

সর্বোচ্চ গতিঃ ৩৬ কি:মি:/ঘন্টা

উড্ডয়ন স্থানঃ জেযেরো খাদ,মঙ্গলগ্রহ।

‘ইনজেনুইটি’র প্রাথমিক মিশন ছিল ৫ টি সফল উড্ডয়ন সম্পন্ন করা। মাত্র ৩ সপ্তাহের ভেতর সেটি পূরণ করে ফেলে হেলিকপ্টার’টি। ২০২১ সালের এপ্রিলের ৩ তারিখ ‘ইনজেনুইটি’কে পার্সিভারেন্স থেকে উন্মুক্ত করা হয়। হেলিকপ্টারটি নামিয়ে দেয়ার পর পার্সিভারেন্স সেটির কাছ থেকে প্রায় ১০০ মিটার দূরে সরে যায়, এর ফলে হেলিকপ্টারটি নিরাপদে উড্ডয়ন করতে পারে। এরপরই আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! এপ্রিলের ১৯ তারিখ মঙ্গলের আকাশে প্রথমবারের মতো উড্ডয়ন করে ‘ইনজেনুইটি’। বিজ্ঞানীরা পার্সিভারেন্স রোভার থেকে সেই দারুণ মূহুর্তটির ভিডিও করে রাখে। এরপরই কয়েকদিনের মধ্যেই ‘ইনজেনুইটি’ পরপর কয়েকটি উড্ডয়ন সম্পন্ন করে ফেলে। ৩০ এপ্রিল,চতুর্থ উড্ডয়ন এর সময় এটি মঙ্গল গ্রহের দারুণ কিছু রঙিন ছবিও তোলে। প্রতিটি উড্ডয়নে ৩-৫ মিটার পর্যন্ত উড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল হেলিকপ্টারটি’কে।

কিন্তু খুব দ্রুতই সেই সীমানা অতিক্রম করে ফেলে ‘ইনজেনুইটি’। এরপর মে মাসের ৭ তারিখে হেলিকপ্টারটি তার কাঙ্ক্ষিত ৫ম উড্ডয়ন সফলভাবে সম্পন্ন করে! এসময় এটি পূর্বের অবস্থানের চেয়ে ১২৯ মিটার দূরত্বে সরে যায় এবং পার্সিভারেন্স রোভারকে পথ প্রদর্শন শুরু করে। ধীরে ধীরে উড্ডয়নের সংখ্যা বাড়াতে শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। প্রায় এক বছর ধরে একুশটি সফল উড্ডয়ন সম্পন্ন করার পর ২০২২ সালের মার্চের দিকে বিজ্ঞানীরা প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর ‘ইনজেনুইটি’কে উড্ডয়নের পরিকল্পনা করেন। মাঝে যোগাযোগের সমস্যার কারণে কিছুদিন উড্ডয়ন বন্ধ রাখা হয়েছিল। এরপর ২০২৩ সালের অক্টোবরের ৫ তারিখ সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠেছিল হেলিকপ্টার’টি। এসময় মঙ্গলের পৃষ্ঠ থেকে ২৪ মিটার উঁচুতে উড়তে সক্ষম হয় ‘ইনজেনুইটি’। এরপরই ধীরে ধীরে দিন ঘনিয়ে আসতে শুরু করে হেলিকপ্টারটির। 

পার্সিভারেন্স রোভার থেকে তোলা 
‘ইনজেনুইটি’র সর্বশেষ ছবি।

প্রায় তিনবছর সফলভাবে গবেষণাকার্য চালানোর পর অবশেষে বিশ্রাম নেয় হেলিকপ্টারটি। ইনজেনুইটিকে সর্বশেষ আকাশে ওড়ানো হয়েছিল ১৮ জানুয়ারি। ৪০ ফুট উঁচুতে উঠে সেটি ভেসে ছিল সাড়ে চার সেকেন্ড। অবতরণের সময় ভূমি থেকে প্রায় তিন ফুট ওপরে থাকা অবস্থায় হঠাৎ সেটির সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে আবার সংযোগ স্থাপন করে দেখা যায়, হেলিকপ্টারটির ‘এক বা একাধিক’ পাখা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে নিজের ওড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে ‘ইনজেনুইটি’! সেই সাথে শেষ হয় ‘ইনজেনুইটি’র দীর্ঘ তিন বছরের মঙ্গলযাত্রা!

তথ্যসূত্র-

লেখাটি 66-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 897 other subscribers