উপবাস কি স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

আজকে যে বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি, সেটাকে ইংরেজীতে ‘Fasting’ বলে। তবে আমরা একে বিভিন্ন নামে ডাকি। কেউ বলেন ‘উপবাস’, কেউ বলেন ‘উপোস’, আবার কেউ বা বলেন ‘রোজা’। সাধারণ চিন্তা থেকে মনে হয় যে দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকলে বুঝি শরীরের ভীষণ রকম ক্ষতি হয়। কিন্তু শুধু খাবার খেলেই কি শরীর ভালো থাকে? আচ্ছা, একটু উল্টোভাবে চিন্তা করলে কেমন হয় – খাবার না খেলেই কি স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যায়? কিছু বিজ্ঞানী কিন্তু সেটাই করেছেন। চলুন, আজকে সেই গল্প শোনা যাক!

আপনি কি জানেন সুস্বাস্থ্য কাকে বলে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সুস্বাস্থ্য শুধুমাত্র রোগ বা দুর্বলতার অনুপস্থিতি নয়, বরং এটি সম্পূর্ণ শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে ভালো থাকার একটি অবস্থা। তাহলে কোনো কাজ বা কিছু স্বাস্থ্যকর হবে তখনি, যখন সেটি শারীরিক ও মানসিকভাবে আমাদেরকে শক্তিশালী রাখবে এবং সামাজিক সুস্থতার দিক দিয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাহলে উপবাস তখনি ফলপ্রসূ হবে, যখন এই উপকারগুলো পাওয়া যাবে। আদৌ কি উপবাসের এসব উপকারিতা আছে?

a glass bowl filled with nuts on top of a table

গত কয়েক বছরে সারা পৃথিবীতেই উপবাস বা রোজার জনপ্রিয়তা অনেক বেড়েছে। তবে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা ইতিহাসে অনেক পুরনো একটা রীতি। অনেকের মতে, প্রাচীন গ্রীকরা, এমন কি  সক্রেটিস এবং হিপোক্রেটিসের মতন ব্যক্তিবর্গও নাকি উপবাস করতেন। তো, উপবাস আসলে কী? এটা কীভাবে করা হয়? এর মানে হলো নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত না খেয়ে থাকা। উপবাসের একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো দিনের একটা বৃহৎ সময় খাবার-পানীয় থেকে বিরত থাকা এবং বাকি সময়টা খাবার-পানীয় গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে উপবাসটি একধরণের চক্রাকার পদ্ধতিতে আবর্তিত হয়। মুসলিমদের রোজাসহ প্রায় সকল ধর্মের অনুসারীরা বিভিন্ন ভাবে উপবাস অনুসরণ করে থাকেন। 

person pouring tea into cup

এছাড়াও আরও কয়েক প্রকারের উপবাস রয়েছে, যেগুলো অনেকেই চর্চা করেন। যেমনঃ একই রুটিন অনুসরণ করে প্রতিদিন একই সময়ে সকালের নাশতা অথবা দুপুর বা রাতের খাবার খাওয়া এবং বাকি সময়ে খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত থাকা, কিছুদিন খাবারে সীমাবদ্ধতা আনা (পানি, দুধ-চিনিমুক্ত  চা-কফি পান করা; কিন্তু ক্যালরিযুক্ত খাবার থেকে দূরে থাকা) এবং বাকি দিনগুলোতে মনমতো স্বাস্থ্যকর  খাদ্যসামগ্রী গ্রহণ করা, সপ্তাহে ৫ দিন স্বাভাবিকভাবে খাওয়া এবং, বাকি ২ দিনে  ৫০০-৬০০ ক্যালোরির মধ্যে খাদ্য গ্রহণ সীমাবদ্ধ করা, দিনে শুধুমাত্র পানি ও ব্ল্যাক কফি পান করা ইত্যাদি। এগুলো মূলত ‘বিরতিহীন উপবাস’ (intermittent fasting) এর উদাহরণ। 

উপবাসের যেমন ভিন্ন ভিন্ন ধরণ রয়েছে, তেমনি রয়েছে বহুমুখী প্রভাব। প্রথমেই ডায়াবেটিসকে যারা ভয় পান, তাদেরকে সুখবর দিবো। ২০২৩ সালে করা একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রতি সপ্তাহে ৩ দিন বিরতিহীন উপবাস করেছে, এমন ২০৯ জনের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বেড়েছে, যা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে পারে। এক্ষেত্রে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকে এবং অত্যাধিক বৃদ্ধি-হ্রাসের মতো ঘটনাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। তাছাড়াও উপবাস আমাদের ফ্যাট সেলগুলোকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখে এবং অতিরিক্ত বৃদ্ধি রুখে দেয়। 

Free Man Heartache photo and picture

আপনি কি জানেন আমাদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে প্রদাহ হয়? কিন্তু অতিরিক্ত প্রদাহ আপনার স্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এর ফলে হৃদরোগ, ক্যান্সার এবং রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই প্রদাহের জন্য সি-রিঅ্যাক্টিভ প্রোটিন বিশেষভাবে দায়ী। ১৮টি গবেষণার একটি পর্যালোচনা বলছে, ‘বিরতিহীন উপবাস’ এই প্রোটিনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিতে পারে। আরেকটি ছোট্ট গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ১ বছরের জন্য ‘বিরতিহীন উপবাস’ প্রদাহের মাত্রা এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারে। 

হৃদরোগের কথা যেহেতু আসলই, তাহলে এবার হৃৎপিন্ডে উপবাসের প্রভাব নিয়ে কথা বলা যাক। দুঃখজনক হলেও সত্য, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ১৯ মিলিয়ন মৃত্যুর জন্য হৃদরোগ দায়ী। একাধিক গবেষণা থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, এই রোগ থেকে বাঁচতে হলে খাদ্যাভাস পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, কারও রুটিনে উপবাসকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে এটা তার হৎপিন্ডের জন্য উপকারী হতে পারে। মেটাবলিজম জার্নালের একটি গবেষণায় পর্যালোচনা প্রকাশ করেছে, উপবাস মানুষের মধ্যে হৃদরোগের জন্য দায়ী মোট কোলেস্টেরলের মাত্রা এবং বিভিন্ন ঝুঁকিকে হ্রাস করতে পারে। আরেকটি পর্যালোচনায় দেখা গিয়েছে, উপবাস আমাদের দেহের রক্তচাপ, রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা, মোট কোলেস্টেরল এবং এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে ফেলতে ভূমিকা রাখে।

a computer generated image of a human brain

হৃৎপিন্ডের কথা বললাম। কিন্তু যদি মস্তিষ্কের কথাই না বলি, তাহলে কেমন একটা হয়ে যায় না? ২০১৮ এবং ২০২১ সালের দুটি গবেষণা প্রমাণ করে, উপবাস স্নায়ুকোষের সংখ্যা বাড়িয়ে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে পারে। এছাড়াও এটি নিউরোডিজেনারেটিভ ডিজঅর্ডার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। যেমনঃ এটি পারকিনসন’স ডিজিজ থেকে দেহকে সুরক্ষা দিতে পারে। তাছাড়া উপবাসে অভ্যস্ত ব্যক্তির দেহে আলঝেইমারের জন্য দায়ী বিটা-অ্যামাইলয়েড প্রোটিনের অত্যাধিক সক্রিয়তা হ্রাস পেতে পারে।

এখানেই কি শেষ? না, উপবাস গ্রোথ হরমোনের নিঃসরণ বাড়ায়, যা বৃদ্ধি, বিপাক, ওজন হ্রাস এবং পেশী শক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আরেকটি চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, ২০২১ সালে একদল গবেষক জানান, উপবাসের ফলে  অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমে সহায়ক ব্যাকটেরিয়ার বৈচিত্র্য বেড়েছে, যার মধ্যে ক্রিস্টেনসেনেলা (Christensenella) প্রজাতি রয়েছে, যা দীর্ঘায়ুর সাথে সম্পর্কিত। আরেকটি জরুরি বিষয় হলো, ‘বিরতিহীন উপবাস’ রোজা রাখার ফলে আমাদের দেহে অটোফ্যাজি ঘটে। এর ফলে কোষস্থ বিভিন্ন উপাদানের পুনর্ব্যবহার ঘটে এবং অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত জিনসগুলোকে কোষ ঝেরে ফেলার সুযোগ পায়, যা কোষের দীর্ঘায়ু বাড়াতে পারে। 

আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি জার্নালে প্রকাশিত একটি পর্যালোচনা উল্লেখ করেছে যে বিরতিহীন উপবাস কিছু পরিস্থিতিতে ক্যান্সারের প্রতিকার এবং প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে। এটি কিছু ব্যক্তির মধ্যে কেমোথেরাপির বিষাক্ততা এবং টিউমার বৃদ্ধি হ্রাস করেছে। তবে এখনি পুরো জোর দিয়ে বলা যায় না যে উপবাস করলে ক্যান্সার দূর হয়ে যায়। কিন্তু এটি যে ক্যান্সারের বৃদ্ধিকে কমিয়ে দিতে পারে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ক্যান্সার সায়েন্স জার্নালে Effect of fasting on cancer: A narrative review of scientific evidence শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধ এখনো পর্যন্ত সেই কথাই বলছে। 

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, সঠিকভাবে রোজা রাখলে একটি রুটিন-ভিত্তিক জীবন যাপন করা যায়। এর ফলে খাবারের সাথে সাথে স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন দিকেও শৃঙ্খল আসে। এছাড়াও উপবাসের সময় খাদ্যগ্রহণে সীমাবদ্ধতা থাকায়, দেহের ইম্পালস বা উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। এর ফলে মাদক এবং পর্নোগ্রাফি থেকে অনেকখানি দূরে থাকা সম্ভব হয়। ফলে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি থেকে সুরক্ষা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ২০২১ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে কিছু ক্ষেত্রে রোজা উদ্বেগ এবং বিষণ্নতা কমাতে সাহায্য করতে পারে।

এতক্ষণ ধরে উপবাসের বিভিন্ন উপকারিতা শুনলেন। এমতাবস্থায় যদি এই লেখাটায় উপসংহার টেনে দিই, তাহলে একমুখী আলোচনা হয়ে যাবে। আসলে উপবাসের বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং ঝুঁকিও রয়েছে। তবে তার আগে বলে নিই, এই সমস্যাগুলো তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যারা আগে থেকেই অসুস্থ অথবা এমন ব্যক্তিবর্গ, যারা  সঠিকভাবে উপবাস করেননি কিংবা ভুল পদ্ধতিতে খাদ্যগ্রহণ করেছেন। তো, উপবাসের নেতিবাচক প্রভাবগুলোর মধ্যে রয়েছে পানিশূন্যতা, নিম্ন রক্তচাপ, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, তীব্র মাথা যন্ত্রণা ইত্যাদি। 

তাহলে এই পুরো বিষয়টির মূলভাব কী দাঁড়াচ্ছে? উপবাস বিশেষত ‘বিরতিহীন উপবাস’ আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। কিন্তু যদি এটি অবহেলার সাথে করা হয় অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিরেকে ভুল পদ্ধতিতে ভুল ধরণের উপবাসকে বেছে নেওয়া হয়, তাহলে শরীরের ক্ষতি হতে পারে। উপবাস বা রোজা আমাদের রূটিন ও জীবনকে নতুন করে গড়ে তোলার একটা উপায়। তাই স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে শরীর-মনের কল্যাণের জন্য এটিকে নিজের জীবনের সাথে যুক্ত করা উচিৎ। 

তথ্যসূত্র-

(এই লেখাটির সকল তথ্য পিয়ার রিভিউড জার্নাল থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নেওয়া এবং বিসিএস এ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মেডিকেল অফিসার পদে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ডা এমরান আহমেদ কর্তৃক মূল্যায়িত)

লেখাটি 235-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 897 other subscribers