ডার্ক এনার্জি এবং ডার্ক ম্যাটারঃ মহাবিশ্বের রহস্যময় গঠনের অনুসন্ধানে

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

১.

নিউটনীয় স্থান-কালের সনাতন ধারণাকে আমূল বদলে দিতে যে মানুষটার অবদান, পদার্থবিদ্যায় নোবেল বিজয়ী সেই আলবার্ট আইনস্টাইন এর একটি উক্তি এরকম, “Nature conceals her mystery by her essential grandeur,” অর্থাৎ প্রকৃতি তার অপরিহার্য মহিমা দ্বারা তার রহস্য গোপন করে। কুহেলিকাময় সে রহস্যের অবগুণ্ঠন উন্মোচনে মানবের নিরন্তর প্রয়াস। মাঝে মাঝে প্রকৃতির অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের অন্তরালে লুক্কায়িত রহস্য আমাদের করে বিমূঢ়, হতবিহবল। কখনওবা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সুবিশাল কলেবরের উপমা খুঁজতে গিয়ে হয়ে পড়ি দিশেহারা। উন্মীলিত নেত্রে বিশ্বজগতের যতখানি ধরা দেয়, তা যেনো অকূল পাথারের বুকে একফোঁটা জল। আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্যি যে, মহাবিশ্বের গঠনের মাত্র ৫% আমাদের পরিচিত ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের সমন্বয়ে পরমাণু দ্বারা গঠিত, যাকে সাধারণ বা ব্যারিওনিক (baryonic) পদার্থ বলে। আর অবশিষ্ট ৯৫% গঠনের সরাসরি প্রত্যক্ষণ অদ্যাবদি সম্ভব হয়নি। অনুমান করা হয় যে, এই ৯৫% গঠনের কিয়দংশ রয়েছে ডার্ক এনার্জি (Dark Energy) বা তমোশক্তির দখলে, বাকিটা ডার্ক ম্যাটার (Dark Matter) বা তমোপদার্থের। মহাবিশ্বের গতিশীল তথা ত্বরান্বিত সম্প্রসারণের জন্য তমোশক্তিকে দায়ী করা হয়। আর মহাবিশ্বের শতসহস্র ছায়াপথের যে প্রকাণ্ড ভর ও পরিসর, তার সংগঠনে তমোপদার্থের বিশেষ অবদান রয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।

২.

গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে এডুইন হাবল সহ বেশ কয়েকজন জ্যোতির্বিদ আবিষ্কার করেন যে ছায়াপথগুলো ক্রমান্বয়ে আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, যে ছায়াপথ যত দূরে, সেটির দূরে সরে যাওয়ার হার তত বেশি। তখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিলো যে সময়ের পরিক্রমায় মহাকর্ষ বল এই হারকে কমিয়ে দেবে। তখন হয়তো ছায়াপথগুলো দুর্বল মহাকর্ষ বলের অধীনে থেকে পরস্পরকে আকর্ষণ করতে শুরু করবে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে ১৯৯৮ সালে দুটি ভিন্ন গবেষক দল আলাদাভাবে দাবি করেন যে তাঁরা আরও নির্ভুলভাবে পরিমাপ করে দেখতে পান মহাবিশ্বের প্রসারণের হার পূর্বের তুলনায় বেশি। অর্থাৎ এক প্রকার অদৃশ্য বল মহাকর্ষের বিপরীতে ছায়াপথগুলোকে ক্রমান্বয়ে অধিকতর হারে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এই অদৃশ্য বলকেই ডার্ক এনার্জি বা তমোশক্তি নামে অভিহিত করা হয়। তবে ডার্ক এনার্জির মধ্যে ডার্ক বা কৃষ্ণতার কোনো ব্যাপার নেই, এরূপ নামকরণের উদ্দেশ্য একটাই – এখন পর্যন্ত ডার্ক এনার্জির অস্তিত্ব সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়নি।

মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে তার গাঠনিক উপাদানসমূহের অবদান

মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ (Cosmic Microwave Background Radiation) বিশ্লেষণ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন মহাবিশ্বের প্রায় ৬৮% গঠিত হয়েছে ডার্ক এনার্জি দ্বারা। কিন্তু বিজ্ঞানীদের কাছে তমোশক্তির গঠন বিষয়ক কোনো অকাট্য ও যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা নেই। একটি ধারণা অনুসারে, তমোশক্তি হলো জগতের মৌলিক শক্তিগুলোর পঞ্চম রূপ, যাকে কুইন্টেসেন্স (Quintessence) বলা হয়। এটি তরলবৎ এবং মহাবিশ্বের সর্বত্র বিরাজমান। বিজ্ঞানীমহলে প্রচলিত অপর একটি মতবাদ অনুসারে, তমোশক্তির যে বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের জানা, সেগুলো আইনস্টাইনের মহাজাগতিক ধ্রুবকের (Cosmological Constant) সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে এই ধ্রুবক সংযোজন করেছিলেন ‘মহাবিশ্বকে মহাকর্ষ বলের প্রভাবে মহাসংকোচনের হাত থেকে রক্ষা করে স্থির মহাবিশ্ব মডেল দাঁড় করাতে।’ কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে যেহেতু প্রমাণিত হয় যে মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল, তাই তিনি এই ধ্রুবককে শেষ পর্যন্ত তাঁর জীবনের ‘সবচেয়ে বড় ভুল (biggest blunder)’ হিসেবে অভিহিত করেন। তবে বর্তমানে বিষয়টি আবার আলোচিত হচ্ছে কারণ মহাকর্ষের বিপরীতেই মহাবিশ্ব ক্রমান্বয়ে প্রসারিত হচ্ছে।  

স্ট্যান্ডার্ড কসমোলজি অনুসারে, ডার্ক এনার্জির ক্ষেত্রে শক্তি ঘনত্ব $(\rho)$ মহাজাগতিক স্কেল ফ্যাক্টর তথা রবার্টসন ওয়াকার স্কেল ফ্যাক্টরের $(a)$ উপর নির্ভর করে না, অর্থাৎ $\rho \propto a^{-0}$। ভিন্নভাবে বলা চলে, তমোশক্তির শক্তি ঘনত্ব ধ্রুবক এবং এই কারণে শূন্যস্থানের প্রসারণেও এর ঘনত্ব অপরিবর্তনশীল থাকে।  

৩.

ডার্ক ম্যাটার বা তমোপদার্থ আদতে কালো বা কৃষ্ণ নয়, যেমন কৃষ্ণ নয় কৃষ্ণগহ্বর। যে কোনো ধরনের আলো তমোপদার্থ ভেদ করে যেতে পারে, যেনো একে স্বচ্ছ মনে হয়। সাধারণ বা ব্যারিওনিক পদার্থের সাথে এ পদার্থ মিথস্ক্রিয়া করে না এবং আলো বা কোনো তড়িৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণে দৃশ্যমান নয়। ছায়াপথের গতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় যে এর কেন্দ্রস্থ সাধারণ পদার্থের চারপাশে বহির্দিকে বলয়াকারে তমোপদার্থ অবস্থান করে। এই ব্যাপারটি ছায়াপথরাজির (Galaxy Cluster) বেলায়ও সত্য, অর্থাৎ প্রতিটি আলাদা ছায়াপথের চারপাশে আলাদাভাবে চক্রাকারে তমোপদার্থের বিস্তার বিরাজমান থাকে এবং এই তমোপদার্থই ঐ ছায়াপথটির উপর প্রভাব বিস্তার করে। মহাকর্ষীয় লেন্সিং (Gravitational Lensing) বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করা যায় যে তমোপদার্থের ভর রয়েছে। মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ বিশ্লেষণ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন মহাবিশ্বের প্রায় ২৭% গঠিত হয়েছে ডার্ক ম্যাটার দ্বারা। CERN এর Large Hadron Collider এ বিজ্ঞানীরা ডার্ক ম্যাটারের কণা আবিষ্কারের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

১৯৩০ এর দশকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রিটজ জুইকি কোমা ক্লাস্টারের প্রায় ১,০০০টি ছায়াপথের ছবি অধ্যয়ন করে কিছু অদ্ভুত আচরণ খেয়াল করেন। ছায়াপথগুলো এতোটাই দ্রুত সরে যাচ্ছিলো যে তাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। তখন তিনি অনুমান করেছিলেন যে কোনো ‘ডার্ক ম্যাটার’ ছায়াপথগুলোকে একত্রে ধরে রেখেছে। কয়েক দশক পরে, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভেরা রুবিন এবং কেন্ট ফোর্ড ছায়াপথের ঘূর্ণন হার অধ্যয়ন করছিলেন এবং তখন একই রকম অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করেন। বিস্তারিত করে বলতে গেলে বলা যায়, কোনো সর্পিলাকার ঘূর্ণায়মান ছায়াপথের কেন্দ্রের ঘনীভূত পদার্থের তুলনায় বাইরের দিকের নক্ষত্রগুলোর ঘূর্ণন ধীরগতির হওয়া উচিৎ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় নক্ষত্রের অবস্থান ছায়াপথের যেখানেই হোক না কেনো, গতির তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো তারতম্য হয় না। এক্ষেত্রে ধরে নেয়া হয় যে ছায়াপথের বহির্দিকের নক্ষত্রগুলোর ওপর এক রহস্যময় বল ক্রিয়া করে, আর একেই ডার্ক ম্যাটার নামে অভিহিত করা হয়।

স্ট্যান্ডার্ড কসমোলজি অনুসারে, মহাবিশ্বের যে উপাদানের শক্তি ঘনত্ব মহাজাগতিক স্কেল ফ্যাক্টর বিপরীত ঘনক্ষেত্রের সমানুপাতিক, অর্থাৎ $\rho \propto a^{-3}$, সেটি হচ্ছে পদার্থ। রেডিয়েশনের বেলায় শক্তি ঘনত্ব স্কেল ফ্যাক্টরের বিপরীত চতুর্থ ঘাতের সমানুপাতিক, অর্থাৎ $\rho \propto a^{-4}$। তাত্ত্বিকভাবে, তমোপদার্থ বা ডার্ক ম্যাটার বলতে মহাবিশ্বের ঐসব উপাদানকে নির্দেশ করে যারা $\rho \propto a^{-3}$ মেনে চলে। আর বাস্তবে ডার্ক ম্যাটার বলতে নন-ব্যারিওনিক পদার্থকেই বুঝায়।

৪.

তমোশক্তি কাজ করে অনেকটা প্রতি-মহাকর্ষ (anti-gravity) বলের ন্যায়। অর্থাৎ মহাকর্ষ বল যেমন দুইটি মহাজাগতিক বস্তুকে একে অপরের নিকট আকর্ষণে ভূমিকা রাখে, বিপরীতভাবে প্রতি-মহাকর্ষ বল বিকর্ষণ বলের মতো একে অপরকে দূরে সরিয়ে দেয়। আর এতেই এই মহাবিশ্ব ক্রমান্বয়ে পূর্বের তুলনায় অধিকতর হারে প্রসারিত হচ্ছে। অপরপক্ষে তমোপদার্থ আকর্ষণ বলের মতো আচরণ করে, অনেকটা মহাজাগতিক আঠার মতো। এর কারণ হচ্ছে তমোপদার্থ মহাকর্ষ বলের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে, তবে আলোর শোষণ, প্রতিফলন বা নির্গমন করে না। গবেষকগণ তমোশক্তি এবং তমোপদার্থের গাঠনিক রহস্য উন্মোচনে নিরন্তর গবেষণা করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি দ্য ইউরোপিয়ান ফিজিক্যাল জার্নাল প্লাসে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে ইতালির ন্যাপলস বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক অতিসূক্ষ্ম রশ্মি ভারসাম্য যন্ত্রের একটি প্রোটোটাইপ আবিষ্কারের দাবি করেছেন যা ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন এবং মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়া পরিমাপ করে তমোশক্তির উৎস সম্পর্কে একটি নতুন ধারণা দিতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এছাড়া তমোশক্তি সমীক্ষা (Dark Energy Survey বা DES) হচ্ছে সারা বিশ্বের চার শতাধিক গবেষকের সমন্বয়ে গঠিত একটি বৃহৎ মহাজাগতিক প্রকল্প। এর সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মি ন্যাশনাল অ্যাক্সিলারেটর ল্যাবরেটরিতে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে তমোশক্তির বৈশিষ্ট্য অধ্যয়ন করা। এ লক্ষ্যে ৫৭০ মেগাপিক্সেল ডার্ক এনার্জি ক্যামেরার (DECam) সাহায্য নেয়া হচ্ছে, যা বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে সংবেদনশীল ক্যামেরাগুলির মধ্যে একটি। অন্যদিকে একপ্রকার কাল্পনিক মৌলিক কণিকা এক্সিওনকে (Axion) তমোপদার্থের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করা হয়। লন্ডনের কিংস কলেজের একদল গবেষক সম্প্রতি এই এক্সিওনের ক্ষয়হার নির্ণয় করে তমো পদার্থের গঠন সম্পর্কে নতুন ধারণা প্রদান করেন।

যদিও মহাবিশ্বের রহস্য অন্তহীন, মানুষের অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার আকাঙ্ক্ষাও তেমনি দুর্নিবার। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে কোনো এক সময় তমোশক্তি এবং তমোপদার্থের সম্পূর্ণ গাঠনিক রহস্য উন্মোচিত হবে। তখন জয় হবে মানুষের মানবতার, মানবসভ্যতা এগিয়ে যাবে আরও এক ধাপ।

তথ্যসূত্রঃ

১. Dark Energy and Dark Matter; Center for Astrophysics, Harvard & Smithsonian, https://www.cfa.harvard.edu/research/topic/dark-energy-and-dark-matter

২. Dark Matter and Dark Energy; National Geographic, https://www.nationalgeographic.com/science/article/dark-matter

৩. What are ‘dark matter’ and ‘dark energy’? The European Space Agency, https://www.esa.int/Science_Exploration/Space_Science/What_are_dark_matter_and_dark_energy

৪. What’s the difference between dark matter and dark energy? Astronomy, https://www.astronomy.com/science/whats-the-difference-between-dark-matter-and-dark-energy/

৫. What are dark matter and dark energy? Argonne National Laboratory, https://www.anl.gov/science-101/dark-matter-and-dark-energy

৬. Thermal noise-limited beam balance as prototype of the Archimedes vacuum weight experiment and B-L dark photon search; The European Physical Journal Plus, Vol. 139, 158 (2024)

৭. The Dark Energy Survey, https://www.darkenergysurvey.org/

৮. Axion star explosions: A new source for axion indirect detection; Phys. Rev. D 109, 043018 (2024)

লেখাটি 202-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 897 other subscribers