এবারের বইমেলায় প্রকাশিত বিজ্ঞানের বইগুলোর মধ্যে আগ্রহের শীর্ষে ছিলো দ্য মাঙ্গা গাইড টু বায়োকেমিস্ট্রি। তার একটি কারণ তো অনুবাদকের বিজ্ঞান-লেখালেখির সাথে পূর্ব-পরিচিতি, আরেকটি কারণ এই বইয়ের বিষয়বস্তু প্রাণ-রসায়ন। খুব মজার, রসালো বিষয় হিশেবে এর সুনাম একেবারেই নেই, বরং আছে উল্টোটা। উচ্চ মাধ্যমিকে জীবনবিজ্ঞান প্রথম পত্রের ‘কোষ-রসায়ন’ অধ্যায় দিয়ে শিক্ষার্থীরা পরিচিত হয় এই বিষয়টির সাথে। সেখানে নানারকম প্রোটিন, লিপিড, শর্করার নাম,রকমফের আর ব্যবহারাদি মুখস্ত করতেই তাদের জান কাবার! এরপর এমবিবিএস কিংবা জীবনবিদ্যার কোনো বিষয়ে অনার্সে পড়লে মুখ গুঁজতে হয় ঢাউস সাইজের লেনিনজারে। এহেন কুখ্যাত বিষয়ের ওপর ‘কমিক’ বই লেখা হয়েছে,সেটা আবার বাংলাতেও অনুবাদ করেছেন কেউ—এই ব্যাপারে তাই উৎসুক না থেকে পারি নি।
বইয়ের নাম দ্য মাঙ্গা গাইড টু বায়োকেমিস্ট্রি। মাঙ্গা’র জন্ম স্থল সূর্যোদয়ের দেশ জাপান। বিশ্বায়নের যুগে বিনোদনের বাজার এখন আর দেশীয় গণ্ডিতে সীমিত নাই। তরুণদের মধ্যে জাপানি এনিমে’-র জনপ্রিয়তা তারই এক সাক্ষ্য। মাঙ্গা’ও গত কয়েক বছরে ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে উঠেছে পাঠকমহলে। ভুল না করে থাকলে,একুশে বইমেলাতেও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি স্টলে ইংরেজিতে অনূদিত মাঙ্গা দেদারসে বিক্রি হতে দেখেছি। মাঙ্গা’ বর্গটির (category) মধ্যে কমিক ছাড়াও বিভিন্ন সচিত্র উপন্যাস (graphic novel)’ও পড়ে। টিনটিনের মতো মাঙ্গা’ কমিকস রঙিন হয় না,মূলত সাদা-কালোই হয়। ‘মাঙ্গা গাইড’ জাপানিজে প্রকাশিত কিছু শিক্ষামূলক কমিক বই-এর সিরিজ। শারীরতত্ত্ব,পরিসংখ্যান,ক্যালকুলাস বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় পঞ্চাশটি খণ্ড আছে এই সিরিজের। ইংরেজি, ফরাসি, চীনা প্রভৃতি ভাষায় এর অনুবাদ’ও হয়েছে।
বাংলা বিজ্ঞান-সাহিত্যে জাপানি মাঙ্গা’ সিরিজ সংযোজনের পটভূমি ভূমিকাতেই স্পষ্ট করেছেন সাংবাদিক ও বিজ্ঞানলেখক আবদুল গাফফার। প্রাণরসায়নের মতো জটিল বিষয়ে একটি বই অনুবাদের প্রকল্প হাতে নেওয়া আনকোরা লেখকের পক্ষে বেশ সাহসের কাজই বটে। কিন্তু সুজয় কাজটি করতে পেরেছেন অন্তত দুই কারণে: প্রথমত, দেশের একটি শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার স্নাতক পড়াশুনা এই বিষয়েই; দ্বিতীয়ত, বইয়ের প্রচ্ছদে তার নাম নতুন উঠলেও অন্তর্জালে ব্লগ মারফত বিজ্ঞান লেখালেখির চর্চা নিয়মিত।
এই বইয়ের চরিত্র মোটামুটি তিনজন: কুমি, নেমেটো এবং নেমেটোর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক কুরোসাকা। ভূমিকায় কুমি’কে ‘হাইস্কুলের শিক্ষার্থী’ বলা হয়েছে,যদিও বইয়ের এক অংশে সে মাধ্যমিক স্কুলে সরলরেখার সমীকরণ শিখেছে বলে উল্লেখ করেছে। যাহোক,কনিষ্ঠতম চরিত্র কুমি তার ওজন নিয়ে খুবই চিন্তিত। সে চায় ‘ডায়েট’ করে ওজন কমাতে। ‘ডায়েটে’ থাকা অবস্থায় ফল খাওয়া উচিত কী-না এই বিষয়ে কুমি এবং তার বন্ধুস্থানীয় নেমেটো’র কথোপকথন দিয়ে বইটি শুরু হয়। নেমেটো জানায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘প্রাণ-রসায়ন’ নামে যে বিষয়টি নিয়ে সে পড়ছে,সে জিনিশ পড়লে কুমি বুঝতে পারবে কেন অতিরিক্ত শর্করা খেলে শরীরের মেদ বাড়ে। এখান থেকেই কুমির প্রাণরসায়নে আগ্রহ জাগে এবং নেমেটোর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিক্ষকের সাথে কথা বলতে সে আগ্রহী হয়। এরপর তারা ডুব দেয় কোষের ভেতরে,যেখানে ঘটে চলেছে অসংখ্য রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া। কোষের ভেতরের অঙ্গানুর পর এসেছে শ্বসন আর সালোকসংশ্লেষণের কথা এবং ধীরে ধীরে লিপিড, প্রোটিন, শর্করা, নিউক্লিক এসিড ইত্যাদি প্রাণ-অণুর (Biomolecules) পরিচয়।
মোটাদাগে পাঁচটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই বইয়ের বিষয়বস্তু। নীরস পাঠ্যবইয়ের মতো কোনো প্রাণ-অণুর একটা শিরোনাম দিয়ে ‘রচনা লিখন’-এর মতো তার আদ্যোপান্ত বিবরণ এবং উপকারিতা/অপকারিতা বর্ণনাপূর্বক সমাপন এই বইতে করা হয় নি। বরং বাস্তব জীবনের সাথে আগে সম্পর্কিত করেই তারপর ওই বিষয়বস্তুতে প্রবেশ করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায় ‘আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রাণরসায়ন’-এ যেমন ‘কোলেস্টেরল খারাপ’ এই বহুল প্রচারিত ধারণা থেকে শুরু করে ফ্যাটি এসিড, লিপিড, কোলেস্টেরল হয়ে একেবারে আর্টারিওসক্লেরোসিস পর্যন্ত পৌঁছেছে আলাপচারিতা। সালোকসংশ্লেষণ ও শ্বসনের চক্রগুলো যতোটা সম্ভব সরল করে দেখানো হয়েছে। প্রাণরসায়নকে জৈব-বিবর্তনের বৃহৎ ক্যানভাসে দেখার ইশারা আছে গ্লাইকোলাইসিসের আলোচনায়। ভালো লেগেছে প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষে দু’তিন পাতায় বৈজ্ঞানিক ধারণা ও পরিভাষাগুলোকে কিছুটা বইয়ের ভাষায় অনুচ্ছেদ আকারে সন্নিবেশিত করা,যাতে করে ধারণাগুলো কেবল আকস্মিক আলাপের ভাসাভাসা স্মৃতি না হয়ে থাকে। প্রাণরসায়নবিদেরা কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদের সিদ্ধান্তগুলো নেন এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারেও আলাদা পরিচ্ছেদ রাখা আছে।
এনজাইম অংশে, একটু বিস্ময়করভাবেই, মাইকেলিস-মেন্টেন সমীকরণের প্রসঙ্গ আনা হয়েছে। এই সমীকরণ এনজাইম গতিবিদ্যা (enzyme kinetics)’র কিছুটা উচ্চতর বোঝাবুঝি দাবি করে। তবে এ’ও সত্য গাণিতিক সমীকরণের প্রয়োগ পাঠককে বুঝিয়ে দেবে,
“এনজাইম-ঘটিত বিক্রিয়াগুলো অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট এবং অনুমানযোগ্য। এগুলো রাসায়নিক এবং গাণিতিক নিয়মনীতি একদম ঠিকঠাক(?) মেনে চলে..”
বইয়ের তিন চরিত্রের বিভিন্ন খুনসুটি মাঝেমধ্যে হাস্যরস তৈরি করেছে। কমিকে ছবির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার ছবিগুলোও যুতসই! জাপানি সংস্কৃতি,খানাপিনার অনেক ব্যাপারের উল্লেখও পাঠক পাবেন এখানে। বইয়ের ফ্ল্যাপে একে হাইস্কুল শিক্ষার্থীদের উপযোগী বলা হলেও উচ্চমাধ্যমিকের বুৎপত্তি ছাড়া এই বই ঠিকঠাক হৃদয়ঙ্গম করা যাবে তা মনে করি না। তবে নবম-দশম শ্রেণির কেউ যে এটা পড়ে মজা পাবেন, সে-কথা বলাই বাহুল্য। কৌতুকরস সঞ্চার করে বলতে চাই স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্যেও এই বই ‘মূল খাবারে’র আগে ‘ক্ষুধাবর্ধক'(Appetizer)-এর কাজ করতে পারে!
এই বইয়ে মূলত আক্ষরিক অনুবাদ করা হয়েছে। অনুবাদে অন্তত দুটো চ্যালেঞ্জ চিন্তা করা সম্ভব। প্রথমত,আলাপের ঢঙ’টা বজায় রাখা এবং দ্বিতীয়ত, বৈজ্ঞানিক বিশ্বস্ততা বজায় রাখা। প্রথম গুণটা না থাকলে এই বইকে মাঙ্গা/কমিক হিশেবে পাঠের যৌক্তিকতা থাকে না,আর দ্বিতীয়টা না থাকলে এটা টিনটিনের মতো কোনো কমিকসে পর্যবসিত হয়। বইয়ের মূল লেখক মাসাহারু তাকেমুরা একজন প্রাণরসায়নবিদ, অনুবাদক’ও এই বিষয়-সংশ্লিষ্ট। বৈজ্ঞানিক আলাপের অংশে অনুবাদের বেশিরভাগটাই চলনসই হয়েছে। তবে কিছু জায়গায় আরো ভালো করা যেতো। অনুবাদক কিছু অংশে পারিভাষিক শব্দের অনুবাদ করেছেন,কোথাও আধা-অনুবাদ করেছেন,আবার এমন অনেক জায়গায় করেন নি যেখানে করা সম্ভব ছিলো। যেমন ‘জৈবভূরাসায়নিক সাইকেল’, ‘মাইক্রোবায়োলজিস্ট’, ‘টেম্পলেট’, ‘স্কিপ’, ‘কোষ মেমব্রেন’ ইত্যাদি। কিছু জায়গায় মনে হয়েছে সাধারণ আলাপচারিতার ভাষা আরো সহজাত হতে পারতো। ইংরেজি ‘পান'(Pun)/রসিকতা করা হয়েছে যেখানে, সে অংশগুলোও আরেকটু চৌকসভাবে অনুবাদ করা সম্ভব ছিলো।
বইয়ের সম্পাদনাগত কিছু ত্রুটির কথা না বললেই নয়। খুব মসৃণভাবে একটা আলাপ যখন এগোচ্ছে,তার মধ্যে এই ত্রুটিগুলো মাঝেমধ্যে বিরক্তির উদ্রেক করে। ছবির সম্পাদনায় কিছু জায়গায় ভুল আছে। যেমন ৬৯ পৃষ্ঠায় বর্ণনায় বলা হয়েছে ইলেকট্রন ট্রান্সপোর্ট চেইনে প্রোটন থাইলাকয়েডের ভেতর থেকে বাইরে আসে, কিন্তু ছবিতে দেখানো হয়েছে উল্টোটা; ৯৭ পৃষ্ঠায় পাইরানোজ গঠনের নিচে লেখা হয়েছে ফিউরানোজ; ১৭৩ পৃষ্ঠায় আলফা হেলিক্সকে বিটা হেলিক্স লেখা হয়েছে। মুদ্রণ প্রমাদ আছে কয়েক জায়গায়। তথ্যগত কিছু ভ্রান্তির সুযোগও রয়ে গেছে। যেমন ১৭০ পৃষ্ঠায় অ্যামিনো এসিডের ছকে কিছু নামে ভুল আছে; ২২৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে একটি নিউক্লিওটাইড তার পেন্টোজ শর্করার ৩’-নাম্বার কার্বনে থাকা ‘ফসফেট’ দিয়ে পরবর্তী নিউক্লিওটাইড এর ৫’-কার্বনের সাথে যুক্ত থাকে, আদতে ফসফেট যুক্ত থাকে ৫’-কার্বনের সাথেই; ২২৭ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ডিএনএ পলিমারেজ ছাঁচ সুতার ‘কপি’ করে নতুন সুতা তৈরি করে,আসল ব্যাপারটা হচ্ছে সে ‘পরিপূরক’ করে নতুন সুতা তৈরি করে; ১৯৯ পৃষ্ঠায় এক গ্রাফ থেকে অন্য গ্রাফে চলক বদলানো হলেও একক বদলানো হয় নাই ইত্যাদি।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের কমিক বই অনুবাদের একটা মাইলফলক মনে করি চমক হাসান অনূদিত ‘গল্পে জল্পে জেনেটিক্স’কে। ল্যারি গনিকের ‘দ্য কার্টুন গাইড টু জেনেটিক্স’-এর অনুবাদ ছিলো সেটা। অনুবাদকের প্রতি অনুরোধ থাকবে এই বইখানি পড়ে দেখার (যদি না আগেই পড়ে থাকেন!)। দ্য মাঙ্গা গাইড টু বায়োকেমিস্ট্রি’ অনুবাদ করা নিঃসন্দেহে একটা উচ্চাভিলাষী প্রকল্প ছিলো। তাতে অনুবাদক বিফল নন মোটেই। স্নাতক পর্যায়ের বহু বিষয় এখানে যেমন সহজ ভাষায় উঠে এসেছে,তাতে কমবয়সী যে তরুণ এই বই পড়বেন,তাতে তার উপকার হবে এ-কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। বইয়ের প্রচ্ছদ খুবই আকর্ষণীয়। পৃষ্ঠার মান ভালো। তবে অনুবাদের সাবলীলতায় এবং সম্পাদনায় আরেকটু সচেতন হলে সম্ভবত বইটা আরো চমৎকার হতে পারতো। বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য ‘মাঙ্গা গাইড’ সিরিজের বিজ্ঞান বইগুলো অনুবাদ করে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্বেষা প্রকাশন। তাদেরকে সাধুবাদ জানাতে হয়। সামনে এরকম আরো বই আসুক,সুজয় অনুবাদ কিংবা জনপ্রিয়-বিজ্ঞান প্রবন্ধে আরো বিকশিত হোন-এই শুভকামনা জানাই।
Leave a Reply