তিন মাত্রার স্থান আর এক মাত্রার সময় নিয়ে চতুর্মাত্রিক মহাবিশ্ব আমাদের। আমরা নিজেরা তিন মাত্রার জীব। তিন মাত্রা বলতে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতার কথা বলছি। কিন্তু ফ্ল্যাটল্যান্ড সমতল বিশ্বের গল্প। সেখানকার নাগরিক সবাই দ্বি-মাত্রিক। অর্থাৎ তাঁদের বড়জোর দুইটা মাত্রা- দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ আছে। রহস্য থ্রিলারও না, আবার বিজ্ঞান কল্পকাহিনীও বলা যায় না। তাই কেবল গল্পই বলি। তবে বিদ্রূপাত্মক গল্প। লেখক সমতল বিশ্বের নাগরিকদের অবয়বের পরিচয় দিয়েছেন চেনাজানা দুই মাত্রার সব জ্যামিতিক আকৃতি দিয়ে।
প্রত্যেক ব্যক্তির সামাজিক শ্রেণি নির্ধারিত হয়েছে তার দেহের আকৃতি অনুসারে। সমতল বিশ্বে সবথেকে নীচু শ্রেণির নাগরিক হলেন নারীরা। এরা সরলরেখা। সমাজে এদের একেবারেই বুদ্ধিহীন জীব ধরা হয়। সবথেকে ওপরতলার নাগরিক হলেন যাজকরা। এরা সবাই বৃত্ত। এদের কোণ সবথেকে বেশী। কোণকে তুলনা করা যায় মগজের সাথে। যার যত বড় কোণ তার বিচার-বুদ্ধি সবার থেকে এগিয়ে। সেক্ষেত্রে বৃত্তরা সর্ববিদ্যায় পারদর্শী। বলা যায় সমাজ পরিচালনার কাঠি ওদের হাতেই। পুরুষদের শ্রেণি অনুসারে বাহুর সংখ্যা বাড়ে কমে।
নিচুতলার পুরুষরা হল সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ। এরা শ্রমিক শ্রেণি, কিংবা পুলিশ, খানসামা। কিংবা কেউ কিছু করে না, বেকার। চুরি-ডাকাতি সহ নানা অপকর্মের সাথে লিপ্ত থাকে এই শ্রেণির মানুষজনই। সমবাহুরা মধ্যবিত্ত বলতে পারেন। কোণের দিক দিয়ে এরা সমদ্বিবাহুদের কিছুটা ছাড়িয়ে যাওয়ায় এদের শ্রেণি অবস্থান খানিকটা ওপরে। বর্গরা হলেন আইনবিদ্যায় পারদর্শী। জ্ঞান-গরিমায় তাঁরা অনেকটাই এগিয়ে। এরকম করে শ্রেণি অবস্থান অনুসারে পঞ্চভুজ, ষড়ভুজ, দ্বাদশভুজ পর্যন্তও হতে পারে দেহের আকৃতি।
নীচু শ্রেণির নাগরিকেরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে নীচু তলাতেই অবস্থান করেন। খুব কম সংখ্যকই এদের মধ্য থেকে কেউ ওপরের তলায় উঠে আসতে পারে। যারা একটু একটু করে নিজের কোণ বাড়াতে পারেন প্রজন্মান্তরে তাঁদের মধ্য থেকেই কেবল কেউ উঁচুতলায় উঠে আসতে পারে। তাঁদের ঘরে জন্ম নিতে পারে সমবাহু ত্রিভুজ সন্তানের। আর তা খুবই বিরল ঘটনা। হাজার বছরে একটা এমন ঘটনা ঘটে। কেননা এই তলার মানুষদের শিক্ষা দীক্ষায় একবারেই সুযোগ পায় না। তাই এদের সন্তানেরা এদের মত করেই বাঁচে। আবার যারা সামর্থ্যবান তারা অপারেশনের মাধ্যমেও সমবাহু বানিয়ে নিতে পারেন। জন্ম নেওয়া সমবাহু ত্রিভুজ শিশুটাকে কেড়ে নেওয়া হয় সমদ্বিবাহু মাতাপিতার কাছে থেকে। সন্তানহীন কোনো উঁচুতলার ত্রিভুজ কিংবা বর্গের ঘরে পালিত হয় সে।
তবে এসুযোগ কেবলই পুরুষদের জন্য। নারীরা আজীবন সরলরেখা। যেমন একটা সমবাহু ত্রিভুজের ছেলে বর্গ, নাতি পঞ্চভুজ হতে পারে। কিন্তু কন্যা সন্তান সবসময়ই সরলরেখা। নারীদের ব্যাপারে ধরেই নেওয়া হয়েছে এদের বুদ্ধির আর পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাই তাদের শিক্ষার রাস্তা একবারেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, সমতল বিশ্বে শ্রেণিবিভাজনটা কতটা স্পষ্ট। সেখানকার ওপরতলার মানুষদের বক্তব্য এই বিভাজন প্রকৃতি নিজের হাতেই করেছে। যাজক শ্রেণির বৃত্তরা তাই সবাইকে এই মন্ত্রে দীক্ষিত হতে বলে, সবার উচিত প্রতিনিয়ত নিজ শ্রেণি অতিক্রম করে উঁচু শ্রেণিতে উঠার চেষ্টা করে যাওয়া।
যদিও বেশ কয়েকবার সমদ্বিবাহুদের মধ্যে এই শ্রেণিবিভাজন প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছে। যাজকেরা সেসব স্ফুলিঙ্গ নিভিয়েও দিয়েছে সমান দক্ষতার সঙ্গে। লেখক নিজে একজন বর্গ। নিজেকে তিনি একজন শখের গণিতবিদ হিসেবে দাবি করেন। শখের হলেও অন্য সকলের চেয়ে গণিত জ্ঞান তাঁর খানিকটা হলেও বেশী। অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে লেখকের বাবা যিনি একজন সমবাহু ত্রিভুজ পূর্বপুরুষ সমদ্বিবাহুদের শ্রেণি অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। দ্বিমাত্রিক বিশ্বের অনেক রহস্যই লেখক তাঁর গাণিতিক জ্ঞান দিয়ে উদ্ঘাটন করতে পেরেছিলেন।
সমতল বিশ্বে একে অন্যকে চেনে স্পর্শ করে অনুভবের মাধ্যমে। তবে এ রীতি কেবল নীচু শ্রেণির মানুষদের মধ্যেই প্রচলিত। উঁচু শ্রেণির মানুষেরা বুদ্ধির দিক দিয়ে উন্নত হওয়ায় এরা দেখার মাধ্যমেও চিনতে পারে। ছোটবেলা থেকেই এদের সন্তানদের সে শিক্ষা দেওয়া হয়। এদের শ্রেণিতে দেখে চেনার পদ্ধতিকে অসভ্যতা মনে করা হয়। তবে নারীদের চেনা যায় আওয়াজ শুনেই। এদের কাছে কেউ ভিড়তে চায় না। কোণের পরিমাণ কম হওয়ায় যেকোনো সময় এরা আঘাত করতে পারে উঁচু শ্রেণির মানুষদের। তাই এরা সাংঘাতিক। লেখক অবশ্য এই কথাটা প্রচলিত এই প্রথাকে ব্যঙ্গ করেই বলেছেন।
সমতল বিশ্বের নাগরিকদের ধারণা তাঁদের সমতল বিশ্বই একমাত্র জগৎ। এছাড়া আর কোনো জগৎ হতে পারে না। অর্থাৎ প্রকৃতিতে মাত্রা কেবল দুটিই হতে পারে। এর থেকে বেশী কিংবা ভিন্ন মাত্রার জগৎ ভাবাও তাদের সমাজে অনেক বড় পাপ, দণ্ডনীয় অপরাধ। এখানকার যাজকদের মধ্যে সবার সেরা প্রধান বৃত্তই একমাত্র সর্বদ্রষ্টা। এরই মধ্যে গণিতবিদ বর্গ একদিন স্বপ্ন দেখেন একমাত্রিক জগতের। সে জগৎ সরলরেখার জগৎ। একমাত্রিক বিশ্বের রাজা, যিনি কিনা সবথেকে বড় সরলরেখা, তাঁর সাথে কথা হয় লেখকের। অনেক কিছু জানেন একমাত্রিক জগৎ নিয়ে। যেমন সেখানকার সবাই সরলরেখা অথবা বিন্দু। সেখানে একজন পুরুষকে অবশ্যই দুটি নারীকে বিয়ে করতে হবে। বিবাহিত দম্পতি কখনোই একসঙ্গে থাকতে পারে না। তাদের মধ্যে কথা হয় কেবল শব্দ বিনিময় দিয়ে। এভাবেই তাদের সন্তান হয়। তবে একসাথে তিনটা সন্তান। দুটো মেয়ে আর একটা ছেলে।
এরপর একদিন লেখকের কাছে হাজির হয় ত্রিমাত্রিক এক গোলক। সে তাঁকে ত্রিমাত্রিক বিশ্বের কথা বলে। সেখানকার ত্রিমাত্রিক প্রাণীদের ব্যাপারে জানায়। এমনকি দেখার ব্যবস্থাও করে দেয়। আর বলে, সে যেন তাঁর দ্বিমাত্রিক বিশ্বের মানুষদের কাছে ত্রিমাত্রিক জগতের কথা প্রচার করে। গণিতবিদ বর্গ তাই সমতল বিশ্বের মানুষদের কাছে ত্রিমাত্রিক জগতের কথা প্রচার করার চেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু কোনোভাবেই তিনি সফল হলেন না। কেননা দ্বিমাত্রিক জগতের প্রাণীদের তিন মাত্রার জগতের অস্তিত্ব কল্পনা করা কিংবা দেখা সম্ভব নয়। উল্টে আইন ভঙ্গের দায়ে তাঁর ঘাড়ে নেমে আসে আজীবন কারাবাসের শাস্তি। সারাজীবন অন্ধকার চারদেয়ালের ভেতরেই পচে মরতে হয় দুর্ভাগা এই গণিতবিদকে।
বইটি মোট দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে মোট ১২টি চ্যাপ্টার, আর দ্বিতীয় ভাগে ১০ টি চ্যাপ্টার। এডুইন এ. অ্যাবট এর জীবনের সেরা কাজ ভাবা হয় এই ‘ফ্ল্যাটল্যান্ড’ গল্পটিকে। এটিকে আঠারো শতকের ব্রিটিশ সমাজের দর্পণও বলা যায়। লেখক দ্বিমাত্রিক জগতের গল্প বলতে গিয়ে আঙুল তুলছেনে সে সময়কার সমাজের যত অবিচার-বৈষম্য আর কু-প্রথার প্রতি। দেখিয়েছেন শ্রেণিবিভাজন প্রথার নিষ্ঠুর চিত্রকে। ইতিহাসে যে-ই সমাজে প্রচলিত যত প্রথা আর সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে গিয়ে হেঁটেছে আলোর পথে, তাঁকেই হয় কারাবাস করতে হয়েছে কিংবা পুড়ে মরতে হয়েছে।
ফ্ল্যাটল্যান্ড সেসব দলিত, শোষিত মানুষের গল্প। সেসব আলোর দিশারী মানুষের গল্প যারা আলোর হদিস দিতে গিয়ে কাঁটা পড়েছেন কুসংস্কারের ধারালো চাপাতিতে। এক অসাধারণ গল্প এই ফ্ল্যাটল্যান্ড। গণিত আর জ্যামিতিক আকৃতির উপস্থিতি থাকায় বিজ্ঞানের পাঠকদের দারুণ লাগবে আশা করি। আর বিজ্ঞানের নয়, তারাও গল্পের রস উপভোগ করতে পারবেন সহজেই। বইয়ে জায়গায় জায়গায় ছোট ছোট ঢীকা আর ছবি দেওয়া আছে। তাই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না।
অনুবাদক অগ্রজ উচ্ছ্বাস তৌসিফ অনুবাদের কাজটিও করেছেন বেশ সাবলীল ভাবেই। আঠারো শতকের ইংরেজিতে লেখা গল্পের এইরকম সহজ বাংলা অনুবাদ করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না তা বলা বাহুল্য! তবে বইয়ের বাঁধাই নিয়ে কিছুটা আফসোস হতে পারে। অন্যান্য কিছু প্রকাশনীর তুলনায় বাঁধাই মোটামুটি বলা যায়। তবে বানান ভুল বা অন্য কোনো অসংগতি চোখে পড়ে নি।
একনজরে-
ফ্ল্যাটল্যান্ডঃ বহুমাত্রিক জগতের খোঁজে
লেখকঃ এডুইন এ. অ্যাবট
অনুবাদকঃ উচ্ছ্বাস তৌসিফ
প্রকাশকঃ আফসার ব্রাদার্স
মুল্যঃ ২৭৫ টাকা
পৃষ্ঠাঃ ১৩৬
Leave a Reply