(ইংরেজ গণিতবিদ গডফ্রি হ্যারল্ড হার্ডির (৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৭ – ১ ডিসেম্বর ১৯৪৭) এই লেখাটি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত সোসাইটি (আর্কিমিডিয়ানস) কর্তৃক প্রকাশিত ইউরেকা, ইস্যু ৩-এ ১৯৪০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়। সংখ্যাতত্ত্বে অসামান্য অবদানের পাশাপাশি জীববিজ্ঞানে হার্ডি–উইনবার্গ নীতির জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তবে সম্ভবত ভারতীয় গণিতবিদ শ্রীনিবাস রামানুজনের গাণিতিক প্রতিভার আবিষ্কার তাঁর জীবনের সবচেয়ে ‘রোমান্টিক’ ঘটনা। আপনারা যারা দ্য ম্যান হো নিউ দ্য ইনফিনিটি শীর্ষক ছবিটি দেখেছেন, তারা এই কথার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। হার্ডি তাঁর কাজকে বিশুদ্ধ গণিত হিসেবে অভিহিত করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন, হয়তো যুদ্ধের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং সামরিক ক্ষেত্রে গণিতের ব্যবহারিক প্রয়োগের কারণে। ১৯৪০ সালে প্রকাশিত অ্যা ম্যাথম্যাটিসিয়ানস অ্যাপোলজি নিবন্ধে তিনি বলেছেন, “আমি কখনও ‘উপযোগী’ কিছু করিনি। আমার কোনো আবিষ্কারই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভালো বা মন্দের জন্য এই পৃথিবীর মনোজ্ঞতায় ন্যূনতম কোনো বৈষম্য সৃষ্টি করেনি।” নিচে ইউরেকা, ইস্যু ৩-এ তাঁর ম্যাথম্যাটিকস ইন ওয়ার টাইম শিরোনামের লেখাটি অনূদিত হলো।)
এই মেয়াদের শুরুতেই আমাকে ইউরেকার জন্য একটি নিবন্ধ লিখতে বলেছিলেন সম্পাদক। আমিও অনুভব করলাম যে সম্পাদক মশাইয়ের সে নিমন্ত্রণ আমার গ্রহণ করাই সমীচীন হবে। কিন্তু তিনি আমাকে যে সমস্ত বিষয়ের ওপর লিখতে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেগুলো ঐ সময় আমার কাছে নিতান্তই অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিলো। ‘ট্রাইপোস সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি’ – সত্যি বলতে, স্নাতকের শুরু থেকে আমি কখনোই ট্রাইপোসের ব্যাপারে অতটা আগ্রহী ছিলাম না, আর এখন তো পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় আমার আগ্রহ আরও কমে গেছে। ‘ক্যামব্রিজে আমার স্মৃতিচারণ’ – অবধারিতভাবেই আমি এখনও সে পর্যায়ে উপনীত হই নি। অথবা সম্পাদক যেমনটা বলেছিলেন, ‘কিছুটা আরও বিষয় সংশ্লিষ্ট, কিছুটা গণিত এবং যুদ্ধ সম্পর্কিত’ – সবগুলো বিষয়ের মধ্যে এটিই আমার কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি অসম্ভব মনে হয়েছিলো। আমি খেয়াল করলাম যে যুদ্ধের ময়দানে গণিতের ভূমিকা নিয়ে আমার বলার মতো একেবারে কিছুই ছিলো না, শুধু আমাকে বুদ্ধিবৃত্তিক অবজ্ঞা আর নৈতিক বিতৃষ্ণায় পূর্ণ করা বাদে।
পরে অবশ্য আমি নিজের ধারণা পরিবর্তন করেছিলাম, এবং প্রথমে যে বিষয়টি আমার কাছে সবচেয়ে বাজে বলে মনে হয়েছিলো সেটিকেই নির্বাচন করেছিলাম। গণিতের, বিশেষত আমি যে ধরনের গণিত নিয়ে কাজ করি সেগুলোরও ব্যবহার রয়েছে যুদ্ধের দামামা বেজে গেলে। আমি মনে করি সে সম্পর্কে আমার কিছু কথা বলা উচিৎ, এবং আমার মতামত যদি অসংলগ্ন বা বিতর্কিত হয়, তাহলে সম্ভবত আরও ভালো, কারণ তখন হয়তো অন্যান্য গণিতবিদের কাছ থেকে প্রতিউত্তর পাওয়া যাবে।
একটা বিষয় পরিষ্কার করে রাখা ভালো। গণিত বলতে আমি প্রকৃত গণিতকেই বুঝি, যে গণিত ফার্মার, অয়লারের, গাউসের, অ্যাবেলের, এবং সে গণিত নয় যা প্রকৌশলীদের পরীক্ষাগার থেকে উদ্ভূত হয়ে গণিতবিদের কাছে আসে। আমি শুধু বিশুদ্ধ গণিতের কথাই ভাবছি না (যদিও স্বাভাবিকভাবে সেটিই আমার ধ্যানজ্ঞান), আমি ম্যাক্সওয়েল, আইনস্টাইন, এডিংটন এবং ডিরাককে প্রকৃত গণিতবিদ হিসেবে গণ্য করি। আমি গাণিতিক জ্ঞানের সামগ্রিক অংশকে অন্তর্ভুক্ত করছি যার একটি অবিনশ্বর নান্দনিক মূল্য রয়েছে, যেরূপ সেরা ছিলো গ্রীক গণিত; যেরূপ সর্বোত্তম রূপে শাশ্বত ধ্রুপদী কোনো সাহিত্য হাজার বছর পরেও হাজারো মানুষের তীব্র আবেগীয় পরিতৃপ্তির সক্ষমতা রাখে। কিন্তু আমি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বা বায়ুগতিবিদ্যা বা অন্য কোনো গণিত নিয়ে চিন্তান্বিত নই, যা বিশেষত যুদ্ধের নিমিত্তে উদ্ভাবিত। এটা (কেউ এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে যাই চিন্তা করুক না কেন) জঘন্যভাবে কদর্য এবং অসহনীয়ভাবে নিষ্প্রতিভ। এমনকি লিটলউডও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে মর্যাদাবান করতে পারেননি, এবং তিনি যদি না পারেন, তবে তা করার সাধ্য কার?
চলুন আমরা কিছু সময়ের জন্য গণিতের এই অশুভ উপজাতগুলোকে পাশ কাটিয়ে প্রকৃত বিষয়বস্তুর দিকে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করার চেষ্টা করি। সত্যিকারের গণিত যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ কোনো উদ্দেশ্য পূরণ করে কিনা আর যদি করেই থাকে তবে তা ভালো না মন্দ সেটি আমাদের বিবেচনা করতে হবে। যুদ্ধকালীন আমাদের কি আনন্দিত বা দুঃখ ভারাক্রান্ত, গর্বিত বা ত্রপান্বিত হওয়া উচিৎ এই কারণে যে আমরা গণিতবিদ?
এটা যেকোনো মূল্যে পরিষ্কার, প্রকৃত গণিতের (বিশেষ কোনো শাখা ব্যতিরেকে) যুদ্ধে সরাসরি কোনো উপযোগিতা নেই। সংখ্যাতত্ত্ব, আপেক্ষিকতাবাদ বা কোয়ান্টাম বলবিদ্যা যুদ্ধের কোনো উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে এমনটা অদ্যাবদি কেউ খুঁজে পান নি, এবং কেউ বছরের পর বছর ধরে তা করবে সেটাও খুব অসম্ভাব্য বলে মনে হয়। এবং আমি এতে উদ্বেলিত, কিন্তু আমার এই কথা বলার দরুন খুব সম্ভবত একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রণোদিত হতে পারে।
কখনও কখনও এটাও বলা হয় যে বিশুদ্ধ গণিতবিদেরা তাদের বিষয়ের ‘অনুপযোগিতা’ নিয়ে গৌরবান্বিত বোধ করেন এবং এর কোনো ‘ব্যবহারিক’ প্রয়োগ নেই বিধায় আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন। আমি নিজে এই দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করার জন্য অভিযুক্ত হয়েছি। একবার আমি একটি বক্তৃতায় বলেছিলাম এবং পরে এটি মুদ্রিতও হয়েছিলো, “বিজ্ঞানকে উপযোগী বলা হবে যদি এর বিকাশ সম্পদ বন্টনের বিদ্যমান বৈষম্যকে জোরদার করে, অথবা আরও সরাসরি বললে, মানব জীবনের ধ্বংসকে যদি উৎসাহিত করে।” এবং ১৯১৫ সালে লিখিত এই বাক্যটি অবজারভারে উদ্ধৃত করা হয়েছিলো এইতো মাত্র কয়েক মাস আগে। এটি অবশ্যই একটি সচেতন আলঙ্কারিক বাগ্বাহুল্য ছিলো (যদিও যখন লিখিত হয়েছিলো তখন খুব সম্ভবত এটি মার্জনীয় ছিলো)। অভিযোগটি সাধারণত গাউস আরোপিত একটি অসতর্কতামূলক বিবৃতির উপর ভিত্তি করে দায়েরকৃত।
এর প্রভাব এইরূপ যে, গণিত যদি বিজ্ঞানের রানি হয়, সর্বোচ্চ ‘অনুপযোগিতার’ জন্য সংখ্যাতত্ত্বকে গণিতের রানি বলা যেতে পারে, যা সর্বদা আমার নিকট বরং অশোভনভাবে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে বলে বোধ হয়। সংখ্যাতত্ত্বকে যদি কোনো ব্যবহারিক এবং সম্মানজনক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতো, যদি একে সরাসরি মানবের আনন্দ বা দুর্দশা লাঘবের দিকে অগ্রসর করা যেতো (যেমন শারীরবিদ্যা এমনকি রসায়নও পারে), তাহলে গাউস বা অন্য কোনো গণিতবিদ এরূপ প্রয়োগ নিয়ে নিন্দা বা অনুশোচনা করার মতো বোকা হতেন না। কিন্তু অপরপক্ষে বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ সামগ্রিকভাবে ভালোর জন্য যতটা না হয়ে থাকে, মন্দের জন্য যদি কমপক্ষে ততটাও হয় (এটি এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি যা সর্বদা অতি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিৎ এবং সর্বোপরি যুদ্ধের সময় তো বটেই) তবে গাউস এবং অপরাপর গণিতবিদদের এতে উল্লসিত হওয়া ন্যায়সঙ্গত যে এমন একটি বিজ্ঞান রয়েছে মানুষের আটপৌরে কার্যকলাপ থেকে যার যোজন দূরত্বকে যে কোনো মূল্যে অক্রূর ও অনাবিল রাখাই সমীচীন।
এটা চিত্তগ্রাহী হত যদি বিষয়টির এখানেই যবনিকাপাত ঘটতো, কিন্তু আমরা এতো সহজে কলকারখানায় গণিতের ব্যবহার সংক্রান্ত বিষয়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারি না। পরোক্ষভাবে এর অস্তিত্বের জন্য আমরাই দায়ী। গোলাবারুদ উৎপাদন ও চালনা বিশারদ এবং উড়োজাহাজ নকশাকার প্রচুর গাণিতিক প্রশিক্ষণ ব্যতিরেকে তাদের কর্মকাণ্ড সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে পারেন না, আর বিশুদ্ধ গণিতের প্রশিক্ষণই সর্বোত্তম প্রশিক্ষণ। এই ধরনের পরোক্ষ উপায়ে গণিতের প্রকৃষ্ট অংশ সমূহও যুদ্ধের সময় অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং সব উদ্দেশ্য চরিতার্থকরণে গণিতবিদদের আবশ্যকতা অনিবার্য হয়ে ধরা দেয়। এই উদ্দেশ্যাদির অধিকাংশই অবজ্ঞাপূর্ণ এবং বিষণ্ণ – অন্তরক সমীকরণের সংখ্যাতাত্ত্বিক সমাধানের থেকে অধিকতর হৃদয়বিদারক আর কিই বা হতে পারে? কিন্তু এই সমাধান নির্ণয়ে গণিতবিদই বাছাই করতে হবে, পরীক্ষাগারের কোনো গতানুগতিক পদ্ধতি হলে চলবে না। কারণ গণিতবিদরা উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং তাদের মস্তিষ্ক ক্ষুরধার। তাই আমরা পছন্দ বা অনুশোচনা যাই করি না কেনো, গণিত এখন সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। অধিকন্তু আমাদের যে অনুতাপ করা উচিৎ যা প্রথমে মনে হয়েছিলো তাও এখন ততটা সুস্পষ্ট নয়, যেহেতু তা নির্ভর করে যুদ্ধে বিজ্ঞানের প্রভাব সম্পর্কে আমাদের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
আধুনিক ‘বৈজ্ঞানিক’ যুদ্ধ সম্পর্কে দুইটি প্রকটভাবে বিরোধী মতামত রয়েছে। প্রথম এবং সবচেয়ে স্পষ্ট মতবাদটি হলো যুদ্ধের ওপর বিজ্ঞানের প্রভাব হলো কেবল এর ভয়াবহতাকে বিবর্ধিত করে তোলা – যুদ্ধরত সংখ্যালঘুদের যাতনা বৃদ্ধি এবং তাদেরকে অন্যান্য শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্তি – এই উভয় পদ্ধতিতে। এটি একটি গোঁড়া দৃষ্টিভঙ্গি এবং এই বিষয়টি পরিষ্কার যে যদি এই দৃষ্টিভঙ্গি ন্যায়সঙ্গত হয় তবে আত্মপক্ষ সমর্থনের সম্ভাব্য হাতিয়ার কেবল বদলা নেয়ার উপযোগিতার মধ্যেই নিহিত। কিন্তু এর থেকে অনেকটা ভিন্ন একটি মতামতও রয়েছে যা বেশ অখণ্ডনীয়।
এই ধারণা পোষণ করা যেতে পারে যে আধুনিক যুদ্ধবিগ্রহ প্রাক-বৈজ্ঞানিক কালের যে কোনো যুদ্ধের তুলনায় কম ভয়ঙ্কর, যতক্ষণ পর্যন্ত যুযুধান পক্ষসমূহ যে কোনো মূল্যে অবগত – বোমা সম্ভবত বেয়নেটের তুলনায় অধিক করুণাময়, কাঁদানে গ্যাস এবং সালফার গ্যাস হলো সামরিক বিজ্ঞানে এ যাবতকালের আবিষ্কৃত সবচেয়ে মানবিক অস্ত্র, এবং এই প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ নির্ভর করে শ্লথ চিন্তামূলক ভাবাবেগবাদের ওপর। এই ঘটনাটি হ্যাল্ডেন তাঁর ক্যালিনিকাস গ্রন্থে জোর দিয়ে উপস্থাপন করেছিলেন। এই ব্যাপারে প্রত্যাশা করা অমূলক নয় যে ঝুঁকির সাম্যতা আনয়নে বিজ্ঞান যা প্রত্যাশা করেছিলো, তা দীর্ঘমেয়াদে মঙ্গলদায়ক হবে; যেরূপ একজন বেসামরিক ব্যক্তির জীবন একজন সৈনিকের জীবনের থেকে বেশি মূল্যবান হতে পারে না; বা একজন নারীর জীবন একজন পুরুষের জীবনের তুলনায় নয়; যেরূপ একটি নির্দিষ্ট গোত্রের উপর বর্বরতার মাত্রার তুলনায় ভালো যে কোনো কিছু; এবং সংক্ষেপে বলতে গেলে, যেরূপ একটি যুদ্ধ যত দ্রুত ‘সর্বাত্মক’ পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হয়, ততই মঙ্গল। এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি যদি সঠিক হয়, তবে সাধারণত বিজ্ঞানীদের এবং বিশেষত গণিতবিদদের তাঁদের পেশা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কারণ কিছুটা কমে আসতে পারে।
এই দুটি চরম বৈপরীত্যমূলক মতামতের মাঝে ভারসাম্য বজায় রাখা দুরূহ বৈ কি, আমি তো তা করার চেষ্টাই করবো না। আমি নিজের কাছে খুব সম্ভবত একটি সহজ প্রশ্ন রেখে সমাপ্ত করতে চাই, এবং আমি মনে করি সব গণিতবিদেরই এই একই কাজ করা উচিৎ। এমন কোনো দৃশ্যপট কি রয়েছে যেখানে আমরা নিখাদ আত্মপ্রত্যয়ের সাথে বলতে পারি যে যুদ্ধে গণিত ‘ভালো কিছু করে’? আমার কাছে এর দুটি উত্তর রয়েছে (যদিও আমি এটা ভান করতে পারি না যে এগুলো আমাকে কিছুটা স্বস্তির অনুভূতি প্রদান করছে)।
প্রথমত, এটা খুবই সম্ভাব্য যে গণিত একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক তরুণ গণিতবিদের জীবন রক্ষা করবে, যেহেতু তাঁদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ‘হিতকর’ উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহৃত হবে এবং তাদের সামনে থেকে আগলে রাখবে। ‘সক্ষমতার সংরক্ষণ’ দাপ্তরিক আদর্শ বাণীগুলোর মধ্যে একটি; এখানে ‘সক্ষমতা’ বলতে কার্যত গণিত, পদার্থবিদ্যা বা রসায়নবিদ্যার সক্ষমতা বুঝায়। এবং যদি স্বল্প সংখ্যক কয়েকজন গণিতবিদকেও সংরক্ষণ করা যায়, তবে একে যে কোনো মূল্যে একটি অর্জন বলে ধরে নিতে হবে। এটা সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ বা দার্শনিকদের জন্য কিছুটা কঠিন হতে পারে, যাদের দেহাবসানের সম্ভাবনা কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু কেউই এখন ‘মানবিকতা’ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো পর্যায়ে নেই। এটা উত্তম যে অন্তত কয়েকজনকে সংরক্ষণ করা উচিৎ, যদি তাঁরা সর্বাপেক্ষা যোগ্য না ও হয়।
দ্বিতীয়ত, একজন বয়স্ক ব্যক্তি (যদি সে অনেক বেশি বয়সী না হয়) গণিতের মাঝে এক নিরুপম বেদনার উপশম খুঁজে পেতে পারেন। কারণ সমস্ত কলা এবং বিজ্ঞানের মধ্যে গণিত হলো সর্বাপেক্ষা অনাড়ম্বর এবং সর্বাপেক্ষা সংস্রবহীন; এবং সব মানুষের মধ্যে একজন গণিতবিদকে এমন হতে হয় যে প্রাত্যহিক একঘেয়েমি থেকে অনায়াসে শরণ গ্রহণ করতে পারে। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, “আমাদের অভিজাত আবেগগুলোর মধ্যে অন্তত একটি বাস্তব দুনিয়ার বিষাদপূর্ণ নির্বাসন থেকে উত্তমরূপে পরিত্রাণ লাভ করতে পারে।” কিন্তু ব্যক্তির অত্যধিক বয়স কাম্য নয়, এবং (অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ) সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি নিতান্তই দুঃখজনক। গণিত একটি মননশীল বিষয় নয়, বরং একটি সৃজনশীল বিষয়। কেউ যখন তার সৃষ্টির শক্তি বা আকাঙ্ক্ষা হারিয়ে ফেলে, তখন সে গণিতের কাছ থেকে কোনো প্রবোধ লাভ করতে পারে না। এবং একজন গণিতবিদের সাথে এই ঘটনা ঘটা অতিশয় সাধারণ ঘটনা। এটা দুঃখের বিষয়, কিন্তু সেক্ষেত্রে যে কোনো ভাবেই হোক সে অতটা গুরুত্ব বহন করে না, আর তাকে নিয়ে মাথা ঘামানোটাও বোকামি।
(গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধের বিভীষিকা। গত বছরের অক্টোবরে ইসরায়েলে হামাসের হামলার জেরে সম্প্রতি ইরান ইসরায়েল দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটকে করেছে আরও ঘনীভূত। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, বিশ্ব আরেকটি যুদ্ধের ভার বহন করতে পারবে না। একজন ক্ষুদ্র গণিতপ্রেমী হিসেবে আক্ষেপ এই যে আজকের রাষ্ট্রনায়কেরা যদি বিশুদ্ধ গণিতবিদ হার্ডির মতো চিন্তাধারা লালন করতেন, তবে হয়তো নিপীড়িতের আর্তনাদ আর শোষিতের উতরোল গগনবিদারী হয়ে প্রতিধ্বনিত হতো না। ভবিষ্যৎ এর জন্য আমাদের ক্ষমা করবে কি?)
তথ্যসূত্র-
- গডফ্রি হ্যারল্ড হার্ডি | উইকিপিডিয়া
- The Archimedeans, The Cambridge University Mathematical Society
- Eureka Archive
- ট্রাইপোসঃ এটি একটি একাডেমিক পরীক্ষা যা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয়েছিলো। একজন শিক্ষার্থীকে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করার জন্য যে কতকগুলো পরীক্ষা দিতে হতো, সেগুলো ট্রাইপোসের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। গণিতের শিক্ষার্থীদের গাণিতিক ট্রাইপোস দিতে হতো।
- লিটলউডঃ জন এডেনসর লিটলউড (১৮৮৫ – ১৯৭৭) একজন ইংরেজ গণিতবিদ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি রয়্যাল গ্যারিসন আর্টিলারিতে দ্বিতীয় লেফটেন্যান্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নতিসাধনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। লিটলউডের সাথে হার্ডির সহযোগ গণিতের জগতে বিখ্যাত হয়ে আছে হার্ডি – লিটলউড অনুমানের কারণে।
Leave a Reply