ওনডিন্স কার্স: রূপকথার নিঃশ্বাসহীন ঘুমন্ত মানবের বৈজ্ঞানিক আখ্যান

সে অনেককাল আগের কথা। ষোড়শী সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী স্বর্গলোকের জলদেবী ওনডিন পৃথিবী ভ্রমণে এসেছেন। ঘুরে ফিরে দেখছেন এখানে-সেখানে। আচমকা একদিন তার দৃষ্টি যায় মর্ত্যলোকের এক সুদর্শন যুবকের পানে। পেলিমো নামের সেই যুবক সেসময় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন সুশোভিত গাছের ছায়ায়। প্রথম দর্শনে দেবী তার প্রেমের ডোরে বাঁধা পড়েন। জলের অতলে থেকে তাকে চোখে চোখে রাখেন সর্বদা।

সময়-সুযোগ বুঝে একদিন দেবী আবির্ভূত হন পেলিমোর সম্মুখে। দেন প্রণয়ের প্রস্তাব। তাঁর এমন মোহনীয় রূপ-লাবণ্য দেখে পেলিমোও হয়ে পড়ে পুরোপুরি হতবাক। যেন স্বচ্ছ জলে স্নান করে আসা এক প্রস্ফুটিত পদ্ম এসে উপস্থিত হয়েছে তার সম্মুখে। তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যায় সে। যদিও ঘটে এক বিপত্তি।

দেবীর প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করে সদ্য বাগদান সম্পন্ন হওয়া হবুবধু বার্থার সঙ্গে যে সে করে বসলো বিশ্বাসঘাতকতা! অভিজাত ঘরের মেয়ে বার্থা কীভাবে মেনে নেবে এটা? একসময় পাণিপ্রার্থী পেলিমোর সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলেন দেবী। তখন দেবীকে উদ্দেশ্য করে পেলিমো আওড়ালেন এক অমিয় বাণী- “ও-হে প্রিয়তমা! আমার প্রতিটি জাগ্রত নিঃশ্বাস তোমার প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততায় সর্বদা প্রদর্শন করবে আনুগত্য।” সুখের পরশে শুরু হলো তাদের নতুন পথচলা।

জলদেবী ওনডিন; ছবি সূত্র: এনশিয়েন্ট পিকচারস

সময় গড়িয়ে যায়। বছর পেরোতেই দেবীর কোল আলোকিত করে আসে ফুটফুটে এক ছেলেসন্তান। কিন্তু ছেলের জন্মের পর দেবীদেহের সৌন্দর্য হ্রাস পেতে থাকে। ভাটা পড়ে তার মোহনীয় রূপ-লাবণ্যে। বয়সের ভার তাঁর প্রতিটি অঙ্গে প্রতীয়মান হতে থাকে একের পর এক।

কিন্তু, সৃষ্টির এমন অমোঘ সত্য পেলিমোর মনকে করতে লাগলো চূর্ণবিচূর্ণ। এককালের চোখধাঁধানো রূপ-মাধুর্য্যের এমন পতন তার হৃদয়কে পরিচালিত করলো মন্দ পথে। সে যেতে লাগলো তার অতীতের বাগদত্তা স্ত্রী বার্থার গৃহে। প্রথম প্রথম এটি দেবীর চোখ এড়িয়ে গেলেও একদিন ধরা পড়ে গেলো তারা। বার্থার বাহুডোরে নিদ্রিত প্রিয়তমকে দেখে রাগে-দুঃখে-ঘৃণায় দিশেহারা হয়ে পড়লেন এককালের মোহনীয় রূপের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।

আর মনে মনে ভাবেন, মানবসত্তা বড়ই অদ্ভুত। যার জন্য সে অমরত্বকে ত্যাগ করে মানবজীবন বেছে নিয়েছে, স্বর্গলোক ছেড়ে এসে মর্ত্যলোকে সংসার পেতেছে, নশ্বর দেহের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে হারিয়েছে নিজের চিরকৌমার্য, সে কীভাবে এমন অটুট সম্পর্কে কষাঘাত করতে পারে? চিড় ধরাতে পারে পবিত্র বন্ধনে? রাগের মাথায় দেবী তাকে করে বসলেন অভিসম্পাত-

“তুমি নিজেই তো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলে, আমাকে তোমার প্রতিটি জাগ্রত নিঃশ্বাসে ভালোবাসবে বলে। তবে তথাস্তু, যতক্ষণ তুমি জেগে থাকবে, ঠিক ততক্ষণই নিঃশ্বাস তোমার সঙ্গী হবে। কিন্তু যে-ই তুমি ঘুমিয়ে পড়বে, তোমা থেকে বিদায় নেবে সে।”

জলদেবী ওনডিনের অভিশাপ লেগে গিয়েছিল। বীভৎস করে তুলেছিল পেলিমোর স্বাভাবিক জীবন। জানা যায়, সে আর কখনোই ঘুমোতে পারে নি। তার মৃত্যু হয়েছিল নিদ্রার অভাবে, ডর-ভয়ে কাতরাতে কাতরাতে। ফরাসি রূপকথার সেই পবিত্র দেবীর অভিশাপের নামে পরবর্তীতে নামকরণ করা হয় এক বিরল রোগের, যার নাম ওনডিন্স কার্স। কিন্তু, জানেন কি- কী সেটি? চলুন জেনে আসা যাক।

বাগদত্তা স্ত্রীর সঙ্গে পেলিমো; ছবি সূত্র: মিস্ট্রিয়াস ওয়ার্ল্ড

ওনডিন্স কার্স কী?

হেমন্তের সকাল। ১৮১১ সাল।

সাহিত্যিক ফ্রেডেরিক ডে লা মট মাত্রই লিখে সমাপ্ত করেছেন রূপকথার এই শৈল্পিক উপখ্যান। যেখানে দেখানো হয়েছে, পৃথিবীর এক বিশ্বাসঘাতক মানবের উপর জলদেবীর অভিশাপের করুণ পরিণতি। যার প্রভাবে ঘুমন্ত ব্যক্তি শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে ভুলে যায়। নিয়ন্ত্রণ হারায় সচল স্নায়ুতন্ত্রের। অথচ জাগ্রত অবস্থায় এ সমস্যা একদমই থাকে না। দিব্যি ঘুরে বেড়ায় সে।

চিকিৎসাশাস্ত্রে একে বলা হয় কনজেনিটাল সেন্ট্রাল হাইপো-ভেনটিলেশন সিনড্রোম (congenital central hypoventilation syndrome)৷ অ্যালভিওলার হাইপো-ভেনটিলেশন হিসেবেও অবিহিত করেন কেউ কেউ। অত্যন্ত বিরল এই রোগকে ভয়ংকর অমঙ্গল হিসেবেই দেখেন অনেকে।

একটি বাস্তব উদাহরণ

সাউথ হ্যাম্পশায়ার, ইংল্যান্ড।

সর্বদা আমোদ-ফুর্তিতে থাকা একজোড়া শালিক দম্পতি পিটার ডার্বিশায়ার ও কিম ডার্বিশায়ার। একদিন তাদের ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় একমাত্র সন্তান। নাম রাখা হয় লিয়াম ডার্বিশায়ার। ছোট্ট লিয়ামের আগমন অনাবিল আনন্দ নিয়ে আসে ডার্বিশায়ার পরিবারে। যদিও লিয়াম তার নিজের ভেতরে করে নিয়ে আসে এক বিরল রোগ। যা ধীরে ধীরে উঁকি দিতে থাকে তার শরীরযন্ত্রে।

জন্মের কয়েকদিনের মাথায় ঘুমের মধ্যে লিয়ামের শ্বাস আটকে যেতে থাকে। বন্ধ হয়ে পড়ে ফুসফুসের স্বাভাবিক কাজ। আর তাই দ্রুততার সাথে তাকে ডাক্তারের শরণাপন্ন করা হয়। ডাক্তার জানান, লিয়াম ওনডিন্স কার্স রোগে আক্রান্ত। আরও জানান, মাত্র সপ্তাহ ছয়েক পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকবে সে। এটা শুনে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে বাবা-মা দু’জনের।

কিন্তু মহান স্রষ্টার পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। ছোট্ট লিয়ামের বয়স এখন আঠারো। ডাক্তারদের পূর্বানুমানকে ভুল প্রমাণ করে আজও বেঁচে আছে সে। ফুসফুসে পুরছে পৃথিবীর মুক্ত বাতাস। যদিও কণ্টকাকীর্ণ এ পথের যাত্রাটা এতটাও সহজ ছিল না। আজও ঘুমোতে যাওয়ার পূর্বে নাকে-মুখে লাগিয়ে নিতে হয় একটি নলাকার শ্বাসযন্ত্র। সর্বক্ষণ নজরবন্দি করে রাখা হয় তাকে। ঘুরে দেখা হয় একটু পরপর। কারণ বেখেয়ালি ঘুম যেকোনো সময় হতে পারে তার চিরনিদ্রার কারণ।

ঘুমন্ত লিয়াম ডার্বিশায়ার; ছবি সূত্র: হেলথ্ এন্ড মেডিসিন

কেন হয় এই রোগ?

ঠিক কোন কারণে মানব শরীরে এমন বিরল রোগের আবির্ভাব হয়েছে তা আজও পুরোপুরি জানা যায় নি। তবে, এখন পর্যন্ত করা গবেষণা অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণকারী অংশে সৃষ্ট জটিলতার কারণে তৈরি হয় এ সমস্যা। এক্ষেত্রে পিএইচওএক্স২বি নামক জিনের বহুলাংশে প্রভাব রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। জিনটি মানব ভ্রুণের নিষেকের পর প্রাথমিক নিউরন তৈরিতে কাজ করে।

যেখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ জৈবনিক কার্যাদি। হৃদপিণ্ডের ছান্দসিক স্পন্দন, ফুসফুসের উদ্দাম নাচন, খাবারের শক্তি ভেঙে হজম, জৈবিক আলোড়ন ও রেচন। এরূপ জিনে মিউটেশনের প্রভাবে প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে তৈরি হয় ওনডিন্স কার্স সিনড্রোমের।

মিউটেশনের প্রভাব; ছবি সূত্র: রিসার্চ গেট

আরও বিশদ লক্ষণ

চলুন জেনে আসা যাক এমন রোগে আক্রান্ত রোগীদের জীবনপ্রবাহ কেমন হয়-

  • বেঘোর ঘুমে তারা অ্যাপনিয়া সমস্যায় ভোগে। ফলস্বরূপ বাধাগ্রস্ত হয় বহিঃশ্বসন প্রক্রিয়া। থেমে যায় শ্বাসযন্ত্রের পেশিকোষের নড়াচড়া। ফলে ফুসফুস হয়ে পড়ে কর্মহীন-অসার। বন্ধ করে দেয় নিজের চিরায়ত কার্যকলাপ।
  • এরূপ পরিস্থিতিতে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়৷ ব্যাহত হয় রক্ত চলাচল। বৃদ্ধি পায় কার্বনডাই-অক্সাইডের হার। এর ফলে ত্বক, ঠোঁট ও জিহ্বা ধারণ করে পুরোপুরি নীলাভ বর্ণ।
  • তৈরি হতে পারে ডিসফ্যাগিয়ার মতো জটিলতার। এসময় রোগীর খাবার গ্রহণে পতিত হয় সমস্যায়। দেখা দেয় ভয়াবহ হির্শপ্রুংস রোগ। এর ফলে রোগীর পরিপাকতন্ত্রেও চলে আসে অসারতা। বাধাগ্রস্ত হয় স্নায়বিক সংযোগ। আটকে যায় মানববর্জ্য প্রস্থানের প্রক্রিয়া।
  • এছাড়াও মাথাব্যথা, ক্লান্তি ও উচ্চ রক্তচাপের মতো জটিল পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয় এসময়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিমপ্যাথেটিক গ্যাংলিয়াতে তৈরি হতে পারে জীবননাশক বিদঘুটে টিউমার। যা হতে পারে আরো অকালে মরণযাত্রার কারণ।

চিকিৎসা

ভয়ংকর এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের প্রতিরাতের বেলায় ভেন্টিলেশন প্রক্রিয়ায় আবদ্ধ থাকতে হয়। চিকিৎসা হিসেবে দেওয়া হয় সার্জিক্যাল ট্রাকিয়োটমি, বাইফেসিক কুইরাস ভেন্টিলেশন ও ফ্রেনিক নার্ভ পেসিং-এর মতো পদ্ধতি। তবে এ সবগুলো চিকিৎসাই খুবই ব্যয়বহুল। যা সাধারণ মানুষদের নাগালের বাইরে।

কিছু কিছু গবেষক মনে করেন- পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত মারা যাওয়া এমন অনেক শিশুই আছে যারা মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হওয়ার পর আক্রান্ত ছিল ওনডিন্স কার্স রোগে। যাদের মৃত্যুর জন্য আমরা স্বাভাবিক শিশুমৃত্যুর কারণকেই দায়ী করি। ধরে নেই অন্য কোনো রোগেই মারা গেছে তারা।

নিজ রুমে ও বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলায় লিয়াম; হেলথ্ এন্ড মেডিসিন

শেষকথা

লিয়াম ডার্বিশায়ার; জটিল এই রোগের বিপরীতে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা এক অদম্য যোদ্ধা। তার এমন আক্ষেপময় জীবন নাড়া দেয় মানুষের অন্তরকে। ভাবেন তো- মহান রব কতটুকু ভালো রেখেছেন আমাদের? দিয়েছেন অফুরন্ত নেয়ামত ভোগের সুখ ও একটি সুন্দর-স্বাভাবিক জীবন।

মনোবলে দৃপ্ত লিয়ামও প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে এমন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে। আর তাই বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত হেসে-খেলে স্কুলে যায় সে। মেতে ওঠে নানান খেলায়, বাসার পাশের ঘাসে মোড়ানো আঙিনায়। এভাবেই বড় হতে চায় সে। চায় অন্যদের মতো হাসি-আনন্দে বাঁচতে। হাসিখুশি এই মুখটা দেখেই বাবা-মার অন্তরটা প্রশান্তিতে ভরে উঠে। আর মনের গহীনে আশা বাঁধেন তাঁরা। স্বপ্ন দেখেন, একদিন তাঁদের ছেলে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে।

বেঁচে থাকুক লিয়াম, পূর্ণতা পাক তাঁদের আশা।

তথ্যসূত্র:

1. Schmidt, A; Thews, G (1989). “Autonomic Nervous System”. In Janig, W. Human Physiology (2 ed.). New York, NY: Springer-Verlag. pp. 333–370.
2. Takeda, S. I., Fujii, Y., Kawahara, H., Nakahara, K., & Matsuda, H. (1996). Central alveolar hypoventilation syndrome (Ondine’s curse) with gastroesophageal reflux. Chest110(3), 850-852.
3. Antic, N. A., Malow, B. A., Lange, N., McEvoy, R. D., Olson, A. L., Turkington, P., … & Weese-Mayer, D. E. (2006). PHOX2B Mutation–confirmed Congenital Central Hypoventilation Syndrome: Presentation in Adulthood. American journal of respiratory and critical care medicine174(8), 923-927.
4. Gronli, J. O., Santucci, B. A., Leurgans, S. E., Berry‐Kravis, E. M., & Weese‐Mayer, D. E. (2008). Congenital central hypoventilation syndrome: PHOX2B genotype determines risk for sudden death. Pediatric pulmonology43(1), 77-86.
5. Bachetti T, Robbiano A, Parodi S, Matera I, Merello E, Capra V, Baglietto MP, Rossi A, Ceccherini I, Ottonello G (2006) Brainstem anomalies in two patients affected by congenital central hypoventilation syndrome. Am J Respir Crit Care Med 174: 706-709.
6. Mellins, R. B., Balfour, H. H., Turino, G. M., & Winters, R. W. (1970). Failure of automatic control of ventilation (Ondine’s curse): report of an infant born with this syndrome and review of the literature. Medicine49(6), 487-504.

লেখাটি 86-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 905 other subscribers