সালটা ১৯৬৭। ইংল্যান্ডের স্বনামধন্য ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা চলছে মহাবিশ্বের সূচনালগ্নে জন্ম নেওয়া নক্ষত্রগুলো নিয়ে। সেইসব নক্ষত্র খুঁজে বের করতে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়েরই মাঠে বসানো হয়েছে একসারি রেডিও টেলিস্কোপ। নক্ষত্র থেকে বের হওয়া রেডিও সিগন্যালগুলো এ ধরনের টেলিস্কোপ দিয়ে শনাক্ত করা যায়। রেডিও টেলিস্কোপের এই সারিবদ্ধ গুচ্ছকে পোশাকি ভাষায় বলা হয় ‘রেডিও ইন্টারফেরোমিটার’। অনেকগুলো রেডিও টেলিস্কোপ পাশাপাশি সারিবদ্ধভাবে রেখে তৈরি করা হয়েছে এই ইন্টারফেরোমিটারটি। মহাকাশের বস্তুগুলো থেকে আসা রেডিও সিগন্যালগুলোই এই ইন্টারফেরোমিটারগুলোতে ধরা পড়ে।
রেডিও টেলিস্কোপের থেকে রেডিও ইন্টারফেরোমিটার ব্যবহারের সুবিধা হচ্ছে অনেক বড় এলাকা এভাবে ধরা যায়। দুইটি একই উচ্চতাবিশিষ্ট কিন্তু ভিন্ন সাইজের মুখের বালতির কথা চিন্তা করুন। যে বালতির মুখ ছোট তা পানি দিয়ে ভর্তি হতে সময় কম লাগবে আর যে বালতির মুখ বড় তা পানি দিয়ে ভর্তি হতে সময় বেশি লাগবে। একইভাবে একটি রেডিও টেলিস্কোপের ডিশ যত বড় হবে তত বেশি পরিমাণ সিগন্যাল ধরা যাবে। কিন্তু ডিশের সাইজ আমরা যেমন খুশি তেমন বড় করতে পারি না। বড় করতে করতে এমন একসময় আসে যখন ডিশটি অভিকর্ষের টানে ভেঙ্গে পড়ে। তাই বিজ্ঞানীরা ঠিক করলেন এভাবে ডিশের সাইজ বড় না করে অন্য একটা কাজ করা যায়। ছোট ছোট বালতিতে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে পরে সেই বালতির পানি চাইলে বড় আরেকটি বালতিতে রেখে সংগ্রহ করা যায়। একইভাবে কয়েকটি রেডিও টেলিস্কোপ থেকে সিগন্যালগুলো আলাদা আলাদাভাবে নিয়ে পরে সব সিগন্যাল একসাথে সংগ্রহ করে ফেলা যায়। এইযে অনেকগুলো রেডিও টেলিস্কোপ একসাথে যুক্ত করে দেওয়া আর তা থেকে সব সিগন্যাল নিয়ে একটা সিগন্যাল বানানোর যন্ত্র, একেই বলে ‘রেডিও ইন্টারফেরোমিটার’। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরাও তাদের তৈরি করা ইন্টারফেরোমিটার দিয়ে মহাবিশ্বের সূচনালগ্নে জন্ম নেওয়া নক্ষত্রের এসব নাড়ি-নক্ষত্র বের করতে ব্যাস্ত ছিলেন।
প্রতি বছর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য বিজ্ঞানীরা কিছু শিক্ষার্থীকে কাজ দেন। পিএইচডি শিক্ষার্থীরা গবেষণা করেন আর তাদের নানা কাজ বুঝিয়ে দিয়ে সাহায্য করেন বিজ্ঞানীরা। সেই ১৯৬৭ সালেই ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির জন্য আবেদন করেন ‘ডেইম সুস্যান জোসেলিন বেল বার্নেল’ মস্ত বড় নামের অধিকারী এক মেয়ে। যদিও সবাই তাকে জোসেলিন বেল বলেই ডাকেন। জোসেলিন বেলের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান কোয়াসার নামক এক রহস্যময়ী বস্তু খোঁজার গবেষণা নিয়ে। কোয়াসারের ব্যাপারে আমরা এখনও সঠিক ও নিশ্চিতভাবে জানি না। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিও ইন্টারফেরোমিটার দিয়ে কোয়াসার খোঁজার যে প্রজেক্ট চলমান ছিল তার দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. মার্টিন রাইলি। জোসেলিন বেলের আগ্রহের বিষয় নিয়ে যেহেতু কাজ করছিলেন ড. মার্টিন রাইলি তাই জোসেলিন বেল ড. রাইলির সাথে দেখা করে তার আগ্রহের ব্যাপারে জানালেন। ড. মার্টিন রাইলি নানা বাছ বিচারের পর জোসেলিন বেলের উপর আস্থা করতে পারলেন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শিক্ষার্থী হিসেবে যুক্ত হলেন জোসেলিন বেল। পিএইচডিতে জোসেলিন বেলের সুপারভাইজার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন আরেক বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যান্টনি হেউইশ।
ছোটবেলায় পড়ালেখা শুরু করলেও কিছুদূর যাওয়ার পরই বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন জোসেলিন বেল। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে বিজ্ঞান পড়তে দিবে না। বেলের একমাত্র অপরাধ তিনি মেয়ে, আর মেয়েদেরকে বিজ্ঞানের পরিবর্তে শিখতে হবে ‘সেলাই করা ও গৃহস্থালির কাজকর্ম’। এটি জানার পর মনমরা হয়ে পড়েন জোসেলিন বেল। বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে না পারলে তার জ্যোতির্বিজ্ঞানী হয়ে উঠার স্বপ্নও যে আর কোনোদিন পূরণ হবে না। তাহলে উপায়? বিষয়টি জোসেলিন বেল তাঁর বাবা-মার কাছে জানালেন। খবরটি তাঁর বাবা-মার কানে পৌঁছালে তাঁরা রাগে ফেটে পড়েন। স্কুল কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোর্টে আপিল করেন। অবশেষে জয় হয় বেলের বাবা-মার। এগিয়ে যাওয়া শুরু হয় জোসেলিন বেলের। বাবা-মার জ্ঞান চর্চার সুবাদে বেলের বাসা ছিল একটা আস্ত লাইব্রেরি। একদিন সেই লাইব্রেরি ঘাটাঘাটি করতে গিয়েই বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী হ্রেড হোয়েলের লেখা ‘Frontiers of Astronomy’ বইটি খুঁজে পেয়েছিলেন। বইটিতে রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে পরিচিতিমূলক একটি অধ্যায় আছে। সেই অধ্যায়টি পড়ে কিশোরী বেলের এতই ভালো লেগেছিল যে তিনি তখনই ঠিক করে ফেলেন, তিনি বড় হয়ে রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞানী হবেন।
ক্যামব্রিজে জোসেলিন বেল কাজ করেন পিএইচডি শিক্ষার্থী হিসেবে। প্রথমে ভেবেছিলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগই পাবেন না তিনি। তারপরও কীভাবে এখানে টিকে গেলেন সে হিসাব মিলাতে পারছিলেন না। ভেবেই নিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো একটা ভুল হয়েছে। তাই সেই ভুলের কারণে তিনি এখানে টিকে গেছেন। যেদিন তাদের এই ভুলটি ধরা পড়ে যাবে সেদিন জোসেলিন বেলকে তারা বের করে দিবেন, এমন ধারণা নিয়েই কাজ করছিলেন জোসেলিন বেল। তাই জোসেলিন বেল ঠিক করলেন তিনি সাধারনের চেয়ে পরিশ্রম বেশি করবেন। এতই কাজ করবেন যে, যখন ভুলটি ধরা পড়বে তখন যাতে তাঁর কাজের অভিজ্ঞতার কারণে হলেও বের না কর হয়। এমনই ভয় নিয়ে দিন যাচ্ছিল জোসেলিন বেলের।
মহাবিশ্বের আনাচে-কানাচে থেকে যেসব সিগন্যাল আসছে সেসব সিগন্যাল এসে ধরা পড়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিও ইন্টারফেরোমিটারে। সেসব সিগন্যালকে একটি প্রিন্টার চার্ট আকারে প্রিন্ট করে ফেলা হয়। এখানে যেসব সিগন্যাল আসছে সবগুলোই কিন্তু মহাবিশ্বেরই সিগন্যাল না। আমরা যে টেলিফোনে কথা বলি সেসব সিগন্যালও ধরা পড়ে এই ইন্টারফেরোমিটারে। আকাশে বজ্রপাত হলেও একটি রেডিও সিগন্যাল তৈরি হয়। সেই সিগন্যালও এই ইন্টারফেরোমিটারে ধরা পড়ে যায়। জোসেলিন বেলের কাজ হচ্ছে পুরো গোয়েন্দা শার্লক হোমসের মতো। চার্টে থাকা এই সিগন্যালগুলো দেখে কোন সিগন্যালগুলো মহাকাশ থেকে আসছে আর কোন সিগন্যালগুলো মানুষের কারণে আসছে তা আলাদা করাই জোসেলিন বেলের দুই চোখের খেলা। প্রতিদিন ১০০ ফুট পরিমাণ চার্ট বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করা লাগত জোসেলিন বেলের। ১০০ ফুট মানে প্রায় ৯ তলা বিল্ডিং এর উচ্চতার সমান।
আমাদের প্রত্যাশিত সিগন্যাল (মহাকাশের সিগন্যাল) বাদে যে অপ্রত্যাশিত সিগন্যাল (মানুষের তৈরি সিগন্যাল) আছে সেগুলোকে বলা হয় সিগন্যাল নয়েজ। বর্তমানে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করে খুব সহজেই এই সিগন্যাল থেকে নয়েজ আলাদা করে ফেলা যায়। কিন্তু জোসেলিন বেলসহ বাকি পিএইচডি শিক্ষার্থীদেরকে অ্যান্টনি হেউইশ নির্দেশ দিলেন প্রোগ্রামিং করে এই কাজটি না করতে। প্রোগ্রামিং করে করলে অনেক সময় কিছু দুর্বল সিগন্যালকে চার্ট থেকে মুছে ফেলে কম্পিউটার। আর তাছাড়া খালি চোখে চার্ট দেখার ফলে মানব সৃষ্ট সিগন্যাল আর মহাকাশের সিগন্যালের মাঝে তফাৎ বোঝার কৌশলটাও আয়ত্ত করা হয়ে যায়। জোসেলিন বেলকে ঘন্টার পর ঘন্টা এসব কাগজ নিয়ে বসে থাকতে হতো। প্রতিটা সিগন্যালকে ম্যাগনিফাইয়িং গ্লাস দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হতো। কয়েক রাতের ঘুম বাদ দিয়ে কঠিন অধ্যাবসায়ের পরই সেসব সিগন্যাল নিয়ে একটা রিপোর্ট লিখে জমা দিতেন জোসেলিন বেল। এভাবেই দিন কাটছিল জোসেলিন বেলের।
১৯৬৭ সালেরই কোনো এক রাত। কফির মগে চুমুক দিচ্ছেন জোসেলিন বেল আর তাঁর রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মহাকাশ থেকে আসা সিগন্যালের চার্টের স্তুপ। দিনভর যে সিগন্যালগুলো ইন্টারফেরোমিটার ধরতে পেরেছে তা রাতের বেলায় বিশ্লেষণ করাই জোসেলিন বেলের কাজ। ততদিনে কোন সিগন্যাল মহাকাশের কোনো দুর নক্ষত্র থেকে আসছে আর কোন সিগন্যাল পাশের বাসার রেডিও থেকে আসছে তা বুঝে ফেলতে ওস্তাদ হয়ে গেছেন জোসেলিন বেল। কফির মগ হাতে নিয়ে একটু এগিয়ে গেলেন জোসেলিন বেল। হঠাৎ একটি সিগন্যালের চার্টের দিকে তাঁর তীক্ষ্ণদৃষ্টি পড়ল। সিগন্যালের স্পাইকগুলোর পর্যায়কাল একটু অস্বাভাবিক লাগছে। কাগজটি হাতে নিলেন জোসেলিন বেল। আসলেই! এটি একটি নক্ষত্র থেকে আসা রেডিও সিগন্যাল। কিন্তু এটির পর্যায়কাল এতো কম কেন? ভাবতে থাকলেন জোসেলিন বেল!
জোসেলিন বেল যে সিগন্যালটি দেখতে পাচ্ছিলেন তা প্রতি ১.৩৩ সেকেন্ড পরপর আসছিল। বিষয়টি এমন যে, একজন লোক পাহাড়ের উপরে টর্চ লাইট হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রতি ১.৩৩ সেকেন্ড পর পর তিনি আপনার দিকে টর্চ লাইটটি একবার অন করছেন আবার অফ করে ফেলছেন। এক্ষেত্রে আপনার কাছে একটি সিগন্যাল আসছে, আলোর সিগন্যাল। জোসেলিন বেল চিন্তা করলেন ওই নক্ষত্রে কে দাঁড়িয়ে আছে যে পৃথিবীর দিকে রেডিও সিগন্যাল পাঠাচ্ছে তাও প্রতি ১.৩৩ সেকেন্ড পর? বিষয়টি কোনোভাবেই মেলাতে পারছেন না জোসেলিন বেল।
সঙ্গে সঙ্গে জোসেলিন বেল তাঁর পিএইচডি সুপারভাইজার অ্যান্টনি হেউইশকে টেলিফোন করেন। তিনি জানান, তিনি এমন কিছু সিগন্যাল খুঁজে পেয়েছেন যা তিনি ব্যাখ্যা করতে পারছেন না। অ্যান্টনি হেউইশ ধারণা করলেন, “নিশ্চয়ই এই মেয়েটা উল্টা-পাল্টা তারের সংযোগ দিয়েছে। তাই সিগন্যাল উল্টা-পাল্টা আসছে।” কিন্তু পরেরদিন যখন ড. হেউইশ নিজ চোখে এই সিগন্যালটি দেখলেন তখন তিনি বললেন, “এগুলো তেমন কিছু না! টেলিফোন লাইন বা অন্য কোনো রেডিও উৎস থেকে আসা মানব সৃষ্ট রেডিও সিগন্যাল হবে হয়ত। এগুলো নিয়ে বেশি চিন্তা করো না।”
কিন্তু এসব চার্ট দেখতে দেখতে ওস্তাদ বনে যাওয়া জোসেলিন বেলের মন বলছে এগুলো মোটেও মানুষের সৃষ্টি সিগন্যাল না। তিনি বারবার বিষয়টা ড. হেউইশকে বুঝালেন। অবশেষে ড. হেউইশ বললেন, “আচ্ছা বুঝলাম যে এগুলো মানুষের পাঠানো সিগন্যাল না। তাহলে এগুলো পাঠাচ্ছে কে? অন্য গ্রহের এলিয়েন? সবুজ রঙের মানুষ?”
জোসেলিন বেল বুঝতে পারলেন এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে হলে এলিয়েনের প্রসঙ্গ টানতে হবে। কিন্তু এলিয়েনের প্রসঙ্গ টেনে বিষয়টি বিজ্ঞানী মহলে উপস্থাপন করলে হাসির পাত্র হতে হবে। তাই তিনি চুপ করে গেলেন।
শীতকালীন ছুটি চলছে দেশ জুড়ে। কিন্তু উৎসবের কারণে তারাদের তো আর কোনো ছুটি দেওয়া হয় না। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও থেমে নেই। এই শীতের মাঝেও তাদের আকাশ পর্যবেক্ষণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে জোসেলিন বেলও আছেন। রাতে রেডিও রিসিভারগুলো দেখছেন তিনি। শীতে ভিতরের অনেক যন্ত্রপাতি জমে গেছে। সেগুলোকে গরম করার জন্য জোসেলিন বেল মাঝে মাঝে মুখ খুলে হা করে একটু উষ্ণ ফুঁক দিয়ে দেন। এতে রিসিভারগুলো আবার সঠিক অবস্থায় ফিরে আসে। তবে একি! তিনি দেখলেন সেই অস্বাভাবিক পালস আবার দেখা যাচ্ছে। তবে এবার দেখা যাচ্ছে আকাশের অন্য এক দিক থেকে। এবারের পর্যায়কাল ১.২ সেকেন্ড। জোসেলিন বেল চিন্তা করলেন, যদি আগের সিগন্যালটি কোনো এলিয়েনই পাঠিয়ে থাকে তাহলে এটিও এলিয়েনই পাঠাবে। কিন্তু মহাবিশ্বের এই দুই প্রান্তের এলিয়েন কীভাবে একই কম্পাংকের সিগন্যাল বেছে নিলেন। আর কেনই বা তারা পৃথিবীর মত একটি গ্রহকেই বেছে নিলেন। জোসেলিন বেল ধারণা করলেন তা বিষয়টি কোনোভাবেই এমন হতে পারে না যে এরা এলিয়েন। বরং এরা হয়ত এমন কোনো নক্ষত্র যাদের ব্যাপারে আমরা এখনও জানি না। তিনি তাঁর সুপারভাইজার হেউইশকে ফোন দিয়ে বিষয়টা জানালেন। এবার ড. হেউইশও সন্দেহ করা শুরু করলেন আসলেই বিষয়টা কী হতে পারে। একই বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন দুইটি বস্তু এভাবে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু বিজ্ঞানীদের কাছে আমরা একে উপস্থাপনই বা করব কীভাবে? তারা উভয়েই কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তাই তারা ঠিক করলেন আপাতত এলিয়েনের ধারনা নিয়েই তারা আগাবেন। তাই এই দুইটি অজানা ‘এলিয়েন’-এর নাম রাখা হলো ‘Little Green Man’ বা ‘ছোট্ট সবুজ লোক’।
জন পিলকিংটন নামে একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এই রেডিও সিগন্যালগুলোর ডিসপার্শন মেজারমেন্ট দেখলেন। ডিসপার্শন মেজারমেন্ট দেখে তিনি সিদ্ধান্ত দিলেন এই সিগন্যালগুলো আমাদের সৌরজগতের বাইরে থেকেই এসেছে। এটি যেহেতু সৌরজগতের বাইরে থেকে এসেছে তাই কোনোভাবেই এই সিগন্যাল মানব সৃষ্ট হতেই পারে না। যেহেতু ড. হেউইশ বা জোসেলিন বেল কেউই এটার একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছিলেন না তাই তাঁরা ঠিক করেন ক্যামব্রিজে একটা সভা আয়োজন করবেন এই সিগন্যালের ব্যাখ্যার ব্যাপারে।
সভায় ক্যামব্রিজে থাকা সকল জ্যোতির্বিজ্ঞানী চলে এলেন। ড. হেউইশ পুরো আবিষ্কারটি ব্যাখ্যা করলেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন ড. ফ্রেড হোয়েল, যার বই পড়েই কিশোরী অবস্থায় জোসেলিন বেল রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞানি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই সভায় ড. হেউইশের কথা শোনার পর ফ্রেড হোয়েল একটা ব্যাখ্যা দিলেন। ব্যাখ্যাটা গ্রহণযোগ্য। তিনি বললেন, নিউট্রন নক্ষত্রের দুই চুম্বক মেরু থেকে যদি রেডিও সিগন্যাল বের হয় তাহলে সেটি অনেকটা লাইটহাউজের মতো আচরণ করবে। যখন একটি চুম্বক মেরু টেলিস্কোপের দিকে থাকবে তখন টেলিস্কোপ একটা সিগন্যাল ধরতে পারবে। যখন চুম্বক মেরু টেলিস্কোপের দিকে থাকবে না তখন কোনো সিগন্যাল আসবে না। যেহেতু তাত্ত্বিকভাবে পালসার অনেক দ্রুত ঘুরতে পারে তাই এইরকম অস্বাভাবিক পর্যায়কাল এসেছে। এখন আমরা জানি জোসেলিন বেলের আবিষ্কার করা ওই দুই বস্তু আসলেই দুইটি পালসার ছিল। পালসারের পদার্থবিজ্ঞান অল্প-স্বল্প বুঝে উঠার আগেই জোসেলিন বেল দুই দুইটি পালসার আবিষ্কার করে বসে আছেন।
খবরটি আমজনতার কাছে খুবই রোমাঞ্চকর মনে হলো। এমন একটা বস্তু আবিষ্কার হয়েছে যেটা কি না প্রায় প্রতি ১.৩৩ সেকেন্ডে নিজ অক্ষের উপর একবার ঘুরে আসতে পারে। যদি আপনি ওই পালসারে দাঁড়াতে পারতেন আর ওই পালসারটি যদি আমাদের সূর্যকে প্রদক্ষিণ করত তাহলে আপনি একবার চোখ ফেললেই দেখতেন দিন হয়ে গেছে, আরেকবার চোখ ফেললেই দেখতেন রাত হয়ে গেছে। এতই দ্রুত হচ্ছে সেই পালসার।
এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য তাকে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া উচিত না? আসলেই, দেওয়া উচিত এবং পালসার আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কার দেওয়াও হলো। তবে জোসেলিন বেলকে না, দেওয়া হলো ড. মার্টিন রাইলিকে আর ড. হেউইশকে। কেন জোসেলিন বেল, যিনিই কিনা পালসার আবিষ্কার করেছিলেন তিনিই নোবেল পাবেন না?
এর কারণ হিসেবে অ্যান্টনি হেউইশ বলেছিলেন, “জাহাজের নাবিক হলো মূল। সেই জাহাজকে গন্তব্যে নিয়ে যায়। জাহাজের কোনো কর্মচারী যদি নিকটবর্তী কোনো দ্বীপ দেখে সবাইকে জানায়ও তাহলে সেই জাহাজকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়াতে কর্মচারীর কোনো ভূমিকা আদতে থাকে না।”
জোসেলিন বেল পিএইচডি শিক্ষার্থী ছিলেন। এ কারণেই নাকি জোসেলিন বেলকে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয় নি। যদিও এটিকে মূল কারণ হিসেবে অনেকে মনে করছিলেন না। অনেকে ধারনা করছিলেন, জোসেলিন বেল নারী ছিলেন। আর নারী হয়ে সে পুরুষের থেকে ভালো আবিষ্কার কীভাবে করতে পারেন এই বিষয়টাই সেই সমাজের লোকদের মাথায় ঢুকছিল না। যদিও জোসেলিন বেল নিজে এর জন্য কোনো প্রকার সমালোচনা করেন নি। বরং তিনি বলেছেন কোনো পিএইচডি শিক্ষার্থীকে খুবই বিরল কোনো আবিষ্কার না করলে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া উচিত হবে না। এতে নোবেল পুরষ্কারের মানের হানি হবে। আর পালসার আবিষ্কার তেমন কোনো খুবই বিরল আবিষ্কার ছিল না, এটি ছিল কেবলই একটি দুর্ঘটনা।
যদিও এসবের চরম সমালোচনা করেন জোসেলিন বেলের ছোটবেলার রোল-মডেল জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রেড হোয়েল। নোবেল পুরষ্কার তো দূরে থাক, পালসারের আবিষ্কর্তা হিসেবে সবাই হেউইশের নামই বলছিল। বিষয়টি কতটা ঘৃণিত হতে পারে ভেবে দেখেছেন? শুধু একজন মেয়ে হওয়ার কারণে তাঁর আবিষ্কার আরেকজন ব্যক্তি নিজের আবিষ্কার বলে চালিয়ে দিতে পেরেছিলেন। একজন মেয়ে হওয়ার অপরাধে প্রেসের লোকেরা তাকে ছোট করে দেখছিলেন। এই বিষয়টি সত্যি অনেক দুঃখের। জোসেলিন বেল এসব বিষয়গুলোকে পাত্তা না দিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর কাজ চালিয়ে গিয়েছেন। বর্তমানে তিনি এক্স-রশ্মি জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেন। যদিও পরবর্তীতে তাকেই পালসারের আবিষ্কর্তা হিসেবে পরিচিতি দেওয়া হয়েছে এবং এর জন্য ‘ব্রেকথ্রু প্রাইজ’-ও পেয়েছেন তিনি।
তথ্যসূত্র–
- জোসেলিন বেলের আবিষ্কার করা পালসার নিয়ে প্রকাশ করা গবেষণাপ্রবন্ধ ও সোর্সটির ডিসপার্শন মেজার (ডিসপার্শন মেজার নিয়ে পরের একটি অধ্যায়ে আলোচনা আছে) সম্পর্কিত হিসাব পাবেন এখানে Hewish, A., Bell, S. J., Pilkington, J. D., Scott, P. F., & Collins, R. A. (2013). 74. Observation of a Rapidly Pulsating Radio Source. In A Source Book in Astronomy and Astrophysics, 1900–1975 (pp. 498-504). Harvard University Press.
- জোসেলিন বেলের নোবেল না পাওয়া নিয়ে জোসেলিন বেলের নিজের মুখে করা মন্তব্য জানতে পড়ুন Bell Burnell, S. J. (1979). Little Green Men, White Dwarfs or Pulsars?. Cosmic Search, 1(1), 16.
- পালসারের ব্যাপারে আরো বিস্তারিত জানতে এই অধ্যায়টা দেখতে পারেন Verschuur, G. (2015). Pulsars In The invisible universe: the story of radio astronomy. Springer.
Leave a Reply