সময়টা ২০১৭ সালের ২১মার্চ। ‘মেইল অনলাইন’ নামক একটি অনলাইন পত্রিকায় ছাপা হয় এক বিস্ময়কর খবর। খবরের শিরোনাম ছিল যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং। ❝১২০০০ বছর আগের একটি ভিনগ্রহের কৃত্রিম উপগ্রহ, যেটি মানুষের উপর গোয়ান্দাগিরির জন্য তৈরি করা হয়েছিল সেটি ইলুমিনাতি এবং ইউএফও বিশেষজ্ঞ’র দক্ষ সৈনিকদের দ্বারা ধ্বংস করা হতে পারে।❞ আর এই শিরোনামের মাধ্যমেই আবার আলোচনায় আসে “ব্ল্যাক নাইট স্যাটেলাইট” নামে এক ষড়যন্ত্রতত্ত্ব।
‘ব্ল্যাক নাইট স্যাটেলাইট’ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে এটি একটি রহস্যময় উপগ্রহ যা পৃথিবীর মেরু কক্ষপথের কাছে পরিভ্রমণ করছে! এটি নিম্ন কক্ষপথের একটি কৃত্রিম উপগ্রহ। কিছু ষড়যন্ত্র-মতবাদ প্রবক্তারা দাবি করেন যে, এটি একটি বহির্জাগতিক বস্তু যার বয়স হবে প্রায় ১৩,০০০ বছর এবং এপসাইলন বুস্টার নামের সোলার সিস্টেম থেকে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। খুব অদ্ভুত মনে হতে পারে, কিন্তু সত্যিই এসব গুজবে এখনো অনেক মানুষ বিশ্বাস করে। তাদের মতে, মানুষ মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছে মাত্র ৬০-৬৫ বছর আগে। আর এটা রয়েছে ১৩,০০০ বছর আগে থেকে,তাহলে নিশ্চয়ই এটি এলিয়েন স্যাটেলাইট।
এই স্যাটেলাইটের সাথে কিন্তু বিখ্যাত উদ্ভাবক নিকোলাস টেসলার নাম জড়িয়ে রয়েছে। ব্ল্যাক নাইট কিংবদন্তির প্রথম উৎপত্তিই হয় তার সময়। ১৮৯৯ সালে নিকোলাস টেসলা তার এক রেডিও সম্পর্কিত পরীক্ষার সময় প্রাকৃতিক বহির্জাগতিক উৎসের পুনরাবৃত্তি শোনেন। যদিও সেসময় তিনি এটিকে তেমন পাত্তা দেননি, তবে ষড়যন্ত্রতত্ত্ববিদ’রা দাবি করেন এটি ‘ব্ল্যাক নাইট স্যাটেলাইট’ এর কারণেই হয়েছিল। আবার, ১৯২৮ সালে নরওয়ের অসলোর একজন সৌখিন বেতার অপারেটর “জোরগেন হালস” প্রথম দীর্ঘ বিলম্বিত প্রতিধ্বনি শুনতে পান। ডেইলি এক্সপ্রেস তাদের খবরে উল্লেখ করে, “১৮৯৯ এবং ১৯২৮ সালের শব্দসমূহ একটি রহস্যই থেকে যায়, কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে, এর ফলে এলিয়েন স্যাটেলাইট তত্ত্ব সত্য হয়ে যায় না।”
১৯৫৪ সালে ইউএফও বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী ডোনাল্ট কীহো আমেরিকার এয়ার ফোর্স এর রেডিওতে একটি বিশেষ সিগন্যাল রেকর্ড করেন। উক্ত সিগন্যাল নিয়ে গবেষণার পর তিনি জানান এটি পৃথিবী থেকে বহু দূরে অবস্থান করে পৃথিবীর অরবিটে পরিভ্রমণ করা কোন স্যাটেলাইট থেকে এসেছে। তারপরই মূলত এই স্যাটেলাইটের নাম দেওয়া হয় ‘ব্ল্যাক নাইট স্যাটেলাইট’ এবং পরবর্তিতে একটি গবেষণা দল তৈরি করা হয় যাদের কাজ হচ্ছে এই স্যাটেলাইট থেকে আসা সিগন্যাল গুলো নিয়ে গবেষণা করা।
১৯৫৪ সালে, তিনি সংবাদপত্রে বলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিমান বাহিনীর প্রতিবেদন অনুযায়ী, পৃথিবীর কক্ষপথে দুইটি উপগ্রহ শনাক্ত করা হয়েছে। ঐ সময় কোনো দেশের কাছে উপগ্রহ পাঠানোর প্রযুক্তি ছিল না। কীহো ঐ সময় ‘ব্ল্যাক নাইট স্যাটেলাইট’ সম্পর্কে একটি বই লেখেন কিন্তু সেটা অতটা জনপ্রিয় হয়নি। এর ফলে অন্তরালেই থেকে যান ‘ব্ল্যাক নাইট স্যাটেলাইট’ ষড়যন্ত্রতত্ত্বের এই প্রবক্তা।
১৯৫৭ সালে এক খবরে প্রকাশ হয় যে, স্পুৎনিকের উপর একটি অজানা বস্তুর ছায়া পড়েছে। বস্তুটি তখন তার পোলার অরবিটে ছিল। ১৯৫৭ সালে আমেরিকা বা রাশিয়া কারও ঐ প্রযুক্তি ছিলনা। ১৯৬০ সালেই প্রথম কোনো দেশ অরবিটিং স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে। ১৯৬০ সালে প্রদক্ষিণরত অবস্থায় এই রহস্যময় বস্তুটিকে আবার খুঁজে পাওয়া যায়। তখন ভর বের করা হয় ১০ টন। এত এত প্রমাণ, তাহলে কি সত্যিই এলিয়েনরা আমাদের উপর গবেষণা করার জন্য ১৩ হাজার বছর আগে থেকেই পৃথিবীর কক্ষপথে স্যাটেলাইট বসিয়ে রেখেছে!? ইউটিউবেও এই স্যাটেলাইট সম্পর্কে অনেকগুলো ভিডিও আছে। সেসব জায়গায় আরো অনেক আজগুবি তথ্য রয়েছে এই স্যাটেলাইট সম্পর্কে। আজগুবি বলার কারণ হলো, আসলে এরকম কোনো স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথে নেই।
হ্যাঁ, পুরোটাই মানুষের অদ্ভুত কল্পনা’র মিশেলে তৈরি। প্রথমেই আলোচনা করা যাক ইন্টারনেটে পাওয়া ব্ল্যাক নাইট স্যাটেলাইটের ছবি সম্পর্কে। ইন্টারনেটে পাওয়া স্যাটেলাইটের ছবিগুলো এডিট করা নয় বরং এগুলো একদম সত্যি। তবে ছবিগুলো কোনো ‘ব্ল্যাক নাইট স্যাটেলাইটের’ নয় বরং এটি আসলে ‘নাসা’র ইভা মিশনের সময় হারিয়ে যাওয়া মহাকাশযানের একটি অংশ যা ‘থারমাল ব্ল্যাঙ্কেট’ নামে পরিচিত। এর কথা প্রথম জানা যায় ১৯৯৮ সালে তোলা এক ছবির উপর ভিত্তি করে। সেসময় ‘নাসা’র STS-88 (বর্তমান ISS এর সূচনা) মিশন চলছিল। একজন নভোচারী কিছু ছবি তোলেন যাতে দেখা যায় পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের উপর বিচিত্র একটা কালো বস্তু, পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সেটিকেই এখন ‘ব্ল্যাক নাইট স্যাটেলাইট’ এর ছবি হিসেবে দেখানো হয়।
১৮৯৯ সালে নিকোলাস টেসলার রহস্যময় সংকেত পাওয়ার কথা আগেই বলেছি। যদিও টেসলা বলেছিলেন, হয়তো তিনি কোনো বুদ্ধিমান সভ্যতা থেকে সংকেত পাচ্ছেন, তবুও এলিয়েন বিশ্বাসীরা এই সংকেতকে ‘ব্ল্যাক নাইট স্যাটেলাইট’ এর কারসাজি হিসেবে উল্লেখ করেন। দীর্ঘদিন ধরে এই সংকেতের রহস্যটি স্যাটেলাইটের গল্পটিকে টিকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু এখন এটি আর রহস্য নেই। আমরা জানি, অনেক মহাজাগতিক বস্তুও বেতার সংকেত নিঃসরণ করে (যেমনঃপালসার)। পালসার হলো দ্রুত ঘূর্ণনশীল নিউট্রন নক্ষত্র, যারা নির্দিষ্ট সময় পরপর সংকেত প্রদান করে। ১৯৬৭ সালে একজন আইরিশ জ্যোতিঃপদার্থবিদ জোসেলিন বেল-বার্নেল সর্বপ্রথম পালসার আবিষ্কার করেন। এর পরই ‘স্কেপটোইড পডকাস্ট’ এর সময় ‘ব্রায়ান দান্নিং’ দেখান যে, টেসলা’র ১৮৯৯ সালের রেডিও সংকেত এর বৈশিষ্ট্যাবলি পালসার এর সাথে মিলে যায়, এবং পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে এই পালসার আবিষ্কৃত হয়। এখন বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে, নিকোলাস টেসলা আসলে কোনো একটি পালসার এর নির্দিষ্ট বেতার সংকেত পাচ্ছিলেন!
১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ‘টাইম ম্যাগাজিন’ একটি আর্টিকেল প্রকাশ করে। সেখানে রিপোর্ট করা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী পৃথিবীর নিম্নকক্ষপথে একটি কালো বস্তু চিহ্নিত করেছে যেটিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা স্যাটেলাইট হিসেবে মনে করা হচ্ছে। ষড়যন্ত্রকারীরা এটিকেও ব্ল্যাক নাইট স্যাটেলাইটের প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এর পরই সেই ম্যাগাজিনে আরেকটি আর্টিকেল প্রকাশ করা হয়, যেখানে লেখা হয়, “এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর একটি অনুসন্ধানমূলক ‘ডিসকভারার VIII স্যাটেলাইট’।” ১৯৬৩ সালে নভোচারী ‘গর্ডন কুপার’ তার ‘মার্কারি -৯’ মিশনের সময় পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে একটি ‘ইউএফও’ বা অজানা বস্তু দেখতে পান বলে নিশ্চিত করেন। কিন্তু পরে তার এ-ই কথার কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি। তাই এ ধারণাকেও বাতিল করা হয়।
‘ব্ল্যাক নাইট স্যাটেলাইট’ জিনিসটা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব হলেও সত্যিই কিন্তু একটি ‘ব্ল্যাক নাইট রকেট’ রয়েছে। নাহ, চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। এটি আসলে একটি ব্রিটিশ রকেট, যেটি ১৯৫৮-১৯৬৫ সালের মধ্যে সচল ছিল। সেসময় এই রকেট দ্বারা পরিচালিত মিশনের উদ্দেশ্য ছিল মহাকাশ থেকে কীভাবে সহজেই বিভিন্ন স্যাটেলাইট বা রকেট ফিরিয়ে আনা যায় তা নিশ্চিত করা। মিশনের নাম ছিল “ব্ল্যাক নাইট স্যাটেলাইট লঞ্চার”। কিন্তু সেই মিশনে কোনো বস্তু মহাকাশে রেখে আসা হয়নি, তাই এর সাথে “ব্ল্যাক নাইট স্যাটেলাইট” এর কোনো সম্পর্ক নেই!
উত্তর আয়ারল্যান্ডের ‘অ্যামাগ প্লানেটারিয়াম’ এর সিনিয়র শিক্ষা সমর্থন কর্মকর্তা ‘মার্টিনা রেডপ্যাথ’ এর মতেঃ
“ব্ল্যাক নাইট স্যাটেলাইট কতগুলো সম্পর্কবিহীন গল্পের সমন্বয়ে তৈরি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কিছু অস্বাভাবিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ, বিভিন্ন সায়েন্স ফিকশন রাইটারদের অদ্ভুত কিছু ধারণা এবং সাধারণ জনগণের এই স্যাটেলাইট এর ছবি সম্পর্কে ভুল ধারণা। এগুলোর সংযুক্তি’তেই কিছু গল্প তৈরি করে মানুষ সেগুলো ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছে।”
ব্ল্যাক নাইট স্যাটেলাইট সম্পর্কে অনেক তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে; এমনকি অনেক ইউটিউব ভিডিও রয়েছে এই স্যাটেলাইট নিয়ে। তবে সব জায়গায়ই দেখানো স্যাটেলাইট আসলে ‘নাসা’র ইভা মিশনের তাপরোধক ব্ল্যাংকেট’। এর মানে দাঁড়ায়, কোনো মহাকাশচারী যদি মহাকাশে কোনো বস্তু ফেলে দেয় বা দূর্ঘটনাবশত পড়ে যায়, তাহলেও ষড়যন্ত্রতত্ত্ববিদরা সেটাকেও ভিনগ্রহীদের কারসাজি বলবে!
আমাদের মহাবিশ্ব অনেক বড় এবং এখানে অনেক এলিয়েন সভ্যতা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে (যেগুলো জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত খোঁজে চলছেন)। তবে এক্ষেত্রে ‘ব্ল্যাক নাইট স্যাটেলাইট’কোনো সমাধান নয়! বর্তমানে ব্ল্যাক নাইট স্যাটেলাইট নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। তবে এরকম অসংখ্য ষড়যন্ত্রতত্ত্ব নিয়ে প্রতিনিয়ত কথা হচ্ছে পৃথিবীতে। এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই হয়তো সমাধান করা যাবে না, ফলে কিছু মানুষ সবসময় সেগুলোতে বিশ্বাস করে যাবে!
তথ্যসূত্র-
- The ‘Black Knight’ satellite: A hodgepodge of alien conspiracy theories | Space
- Black Knight satellite conspiracy theory – Wikipedia
- Martina Glass – Astronotes
- The Truth About the Black Knight Satellite Mystery
- Black Knight Satellite seen over Philippines – ‘100 percent alien proof’ – claim | Weird | News | Express.co.uk
- ব্ল্যাক নাইট স্যাটেলাইট – উইকিপিডিয়া
Leave a Reply