গভীর রাত। চারিধারে থমথমে পরিবেশ। বাতাসে বইছে রক্তচোষা বীভৎস লাশের গন্ধ। এমন ভয়ংকর পরিবেশে এই তল্লাটের সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে। এ সময় অশরীরী কেউ কেউ অতি সন্তর্পণে বেরিয়ে আসছে অন্ধকার শ্মশান, পরিত্যক্ত ভবন ও জামতলার গা ছমছমে ঘন ঝোপের আড়াল থেকে।
পূর্ণিমার ঝলমলে রূপালী রাতে সতর্ক ভঙ্গিতে খাবারের খোঁজ করছে তারা। কী খাবার? তরতাজা ফুটন্ত রক্ত! কখনো রূপসী নারীর অবয়বে, কখনো আবার সুদর্শন যুবকের বেশ ধরে তারা ঘুরে-ফিরে। সুযোগ পেলেই ফাঁকা ঘরে আলতো করে ঢুকে পড়ে। ভাব জমায়, মেতে উঠে অন্তরঙ্গ কামলীলায়। অতঃপর, ঘাড় মটকে টগবগে উষ্ণ রক্তে নিজেদের তৃষ্ণা মেটায়। তাদের পরিচয়– রক্তচোষার দল, ভ্যাম্পায়ার!
কারা তারা?
৮ নভেম্বর, ১৮৪৭ সাল। ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড।
ছোট্ট শহরটির শান্ত-স্নিগ্ধ এক পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন ফুটফুটে শিশু ব্রাম স্টোকার। জন্মের ৭ বছর পর্যন্ত যে কি-না এক অজানা রোগে পড়েছিল বিছানায়। এসময় স্টোকারের মমতাময়ী জননী তাকে শোনাতেন নানান গল্প– হরর কাহিনী, রূপকথার ঘটনা, আর রক্তখেকো পিশাচদের উপাখ্যান।
১৯ শতকের সেসময়ে মহামারী কলেরার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়লে আক্রান্তদের জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলা হতো। আর এ বিবর্ণ বিষয়টিও গভীর দাগ কাটে ছোট্ট স্টোকারের মনে।
রোমহষর্ক ঘটনার বর্ণনা ও ভৌতিক গল্পের সংস্পর্শে বেড়ে ওঠা স্টোকার বড় হয়ে নিজেকে একজন লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। লিখেন অন্ধকারে ঘুরে বেড়ানো রক্তচোষাদের উপন্যাস। এগিয়ে নেন নিজের প্রথম বই– ড্রাকুলা।১৮৯৭ সালে বইটি প্রকাশের পরপরই পৃথিবীর সাহিত্যপাড়ায় সৃষ্টি হয় তুমুল আলোড়ন । পাঠকমহল প্রথমবারের মতো সবিস্তারে জানতে পারেন রহস্যময় রক্তচোষাদের বৃত্তান্ত।
তারপর? তারপর ধীরে ধীরে রোমহষর্ক ভ্যাম্পায়ার চরিত্র জায়গা করে নেয় বিভিন্ন রূপকথা ও লোককথার উপাখ্যানে। মুভি-সিরিজের ঝলমলে পর্দায় তাদেরকে দেখানো হয় রক্তাক্ত পিশাচ হিসেবে। যাদের আপাদমস্তক পচনধরা দেহ, মড়মড়ে সব হাড়, সূচালো দাঁত, তীক্ষ্ণ নখ। যদিও এরও অনেক পূর্বেই ভ্যাম্পায়ারদের বীভৎসতা প্রচলিত ছিল লোকমুখে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে– কীভাবে জন্ম নিলো এই ভ্যাম্পায়ারের কাহিনী? বাস্তবে কী কখনো ছিলো ভ্যাম্পায়ার চরিত্র? কিংবা এখনো কী দেখা মেলে তাদের? আজও কী ঘুরে-ফিরে আলো ঝলমলে চাঁদরাতে? চলুন জেনে আসি। ঘুরে আসি ভ্যাম্পায়ার চরিত্রের বৈজ্ঞানিক জগৎ থেকে।
মেডিকেল কন্ডিশন
আরো অনেক মিথের মতো ভ্যাম্পায়ার মিথের সাথেও জড়িয়ে আছে এক করুণ বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা। ধারণা করা হয়, পোরফিরিয়া নামক এক বিরল জেনেটিক রোগ এই মিথের সত্যিকার উৎস। পূর্ব ইউরোপের রাজ পরিবারের ব্যক্তিদের মধ্যে এ ব্যাধিটি প্রবল হয়ে ওঠেছিল একসময়। যা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য পরিবারবর্গে।
প্রকৃত কারণ
লোহিত রক্তকণিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন উপাদান হিমোগ্লোবিন। এর মাধ্যমে দেহের কোণে কোণে সঞ্চারিত হয় অক্সিজেন। আর এই হিমোগ্লোবিনে বিদ্যমান থাকে একটি রিং। এটি কার্বন, নাইট্রোজেন আর হাইড্রোজেনের অনন্য সমন্বয়ে গঠিত হয়। এর নামই পোরফাইরিন।
রক্তে থাকা এনজাইম এই পোরফাইরিন-কে হেম-এ রূপান্তর ঘটায়। কিন্তু, পোরফিরিয়ার রোগীদের মারাত্মক ঘাটতি থাকে এই এনজাইমের। ফলশ্রুতিতে তাদের দেহে বেড়ে যায় পোরফাইরিনের পরিমাণ। যা ধীরে ধীরে দেহকোষে জমা হয়ে তৈরি করে নানান সমস্যা।
ফলস্বরূপ, রক্তে পোরফাইরিন নামক এই গুরুত্বপূর্ণ অণুর আতিশায্য, অন্যদিকে হেম নামক আরেক অণুর হ্রাসের ফলে ঘটে এই রোগের প্রাদুর্ভাব।
গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ
এ রোগে আক্রান্ত রোগীরা–
ভ্যাম্পায়ারের মতোই আচরণ করে। সূর্যের আলো সহ্য করতে পারে না তারা। তাদের দাঁতও ক্রমশ ধারণ করে রক্তাক্ত বাদামী রং।
সূর্যের আলোতে গেলে তাদের দেহ, মুখ, হাত, নাক, কান, গলাসহ বেশিরভাগ অঙ্গই হয়ে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত। ঝলসে যেতে পারে দেহাবয়ব। ফোস্কা পড়ে এখানে সেখানে। এসময় কালচে রক্তবর্ণ ধারণ করে ত্বক। আক্রান্ত স্থানে লোম গজায় অস্বাভাবিকভাবে হারে, পশুর মতো। অতঃপর তারা হারিয়ে ফেলে মানসিক ভারসাম্য। অতিরিক্ত পোরফাইরিন জমা হয় দাঁতে-মাড়িতে-মুখে। সেখানকার ত্বকেও জমাটবাঁধে রক্তিম আভা। দেখে মনে হবে যেন মানুষটা এখনই রক্ত চুষে এসেছে।
চিকিৎসা
বীভৎস এ রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। নেই উপযোগী কোনো পথ্য। অর্থাৎ, এতে আক্রান্ত হলে দিনের বেলা বসে থাকতে হয় আবদ্ধ ঘরে। ড্রাকুলার মতো হতে হয় নিশাচর।
এরূপ সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহের সম্পূর্ণ রক্ত নিয়মিত পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে। এতে করে হ্রাস পাবে যকৃতে অতিরিক্ত আয়রনের পরিমাণ। এছাড়াও, যেসব খাদ্যে প্রচুর পরিমাণে আয়রন বিদ্যমান– কলা, ডুমুর, বেদানা, আঙুর; সেসব খাদ্যগ্রহণও নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
সর্বোপরি, সময়মতো রোগটি শনাক্ত করা গেলে এর লক্ষণসমূহের জটিলতা নির্মূল করা সম্ভব।
পরিশেষে
চার হাজার বছর পূর্বে, প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতায়ও ছিল ভ্যাম্পায়ারদের লৌকিক উপস্থিতি। ইহুদি পুরাণে বর্ণিত আছে এক ভয়ঙ্কর দেবীর কাহিনী, যার নাম লিলিথ। তাকে বলা হয় সকল অশুভ সত্তার মা (The mother of all demons) । অর্থাৎ রূপকথা কিংবা উপকথায় যত ডেমন আছে– সবাই জন্ম নিয়েছে এই লিলিথের গর্ভাশয় থেকে।
লিলিথ রাতের আঁধারে অপরূপা কুমারী সেজে পুরুষদের ঘরে প্রবেশ করতো। তাদের সঙ্গে সম্পন্ন করতো কামলীলা, সংগ্রহ করতো বীর্য। অতঃপর, সেসব পুরুষদের ঘাড় মটকে রক্তপান করতো সে। আর সংগৃহীত বীর্য ব্যবহার করতো পরবর্তী ডেমনদের জন্মদানে। আর এভাবেই তার গর্ভে জন্মেছে অজস্র অশুভ আত্মা।
পৌরাণিক সে যুগ পেরিয়ে এসেছি আমরা। তবে, কিছু কিছু মেডিকেল কন্ডিশন এখনো সেই লৌকিক ভ্যাম্পায়ারদের কথা স্মরণ করায় আমাদের। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় তাদের বীভৎসতা।
যদিও এখন আর এই মেডিকেল কন্ডিশন (পোরফিরিয়া) এত বড় ব্যাধি নয়। এর প্রকৃত কারণও এখন বোধগম্য, যার প্রতিকারও খুবই সন্নিকটে। কিন্তু তখন? তখন মানুষের কাছে এই ব্যাধি ছিল এক অত্যাশ্চর্য রহস্য। আর তাই মানুষ একে ঘিরে রটিয়েছিল এতোসব কৌতূহলোদ্দীপক রোমাঞ্চকর গল্প।
তথ্যসূত্র–
Leave a Reply