ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর এবং জার্মান চিকিৎসক রবার্ট কখ- অণুজীববিদ্যার দুই বড়ো স্তম্ভ। বিদ্যাজগত এবং জনপরিসরে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কার,অপবিজ্ঞান আর অলৌকিক চিন্তাভাবনার জাল ভেদ করে উনিশ শতকের শেষ দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো রোগের জীবাণুতত্ত্ব (Germ theory of disease)। এর অর্থ, রোগ কোনো অলৌকিক অরিশক্তির প্রভাবে ঘটে না, ঘটে না কোনো অশুভ বায়ুর প্রভাবে; রোগের কারণ খালি চোখে দেখা যায় না এমন সব প্রাণ। চিকিৎসাশাস্ত্রে এ ছিলো এক ‘প্যারাডাইম শিফট’! আজকে আমরা যে আধুনিক ওষুধপত্র, অ্যান্টিবায়োটিক, ভ্যাকসিন ব্যবহার করি, তা মূলত এই জীবাণুতত্ত্বেরই প্রয়োগ। পাস্তুর এবং কখ—দু’জনে ছিলেন এই অভিযাত্রার সামনের সারিতে। আমরা শুরু করবো উনিশ শতকের গোড়া থেকে। সে-যুগের মানুষ কী ভাবতো রোগ সম্পর্কে? কিছু রোগ যে ছোঁয়াচে, একজন থেকে আরেকজনে ছড়াতে পারে, এই ধারণা ছিলো বাস্তবসম্মত। সে সময়ের অনেক চিন্তক এর তত্ত্বায়ন করতেও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকেরা খুব আশ্বস্ত হন নি তাতে। তারা মেনে নিয়েছিলেন যে কিছু রোগ হয়তো ছোঁয়াচে, ধরা যাক সিফিলিস কিংবা র্যাবিস; কিন্তু মহামারি সৃষ্টি করা রোগগুলো যেমন কলেরা,প্লেগ ছোঁয়াচে তত্ত্বের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছিলো।
সেসময়ের প্রচলিত তত্ত্বটি ছিলো ‘মিয়্যাজমা তত্ত্ব’, যার দাবি পচনশীল মাংস,জলাজঙ্গল এবং অন্যান্য দূষিত উৎসের ‘খারাপ বায়ু’ই রোগের কারণ। কিন্তু আঠারো শতকের মাঝামাঝি থেকে বিভিন্ন প্রমাণাদি আসতে লাগলো এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে। বিজ্ঞানীদের কাছে উত্তম কোনো বিকল্পও ছিলো না যা কি-না ব্যাখ্যা করতে পারবে রোগ কীভাবে বিভিন্ন দূরত্বে ছড়িয়ে পড়ে, এবং কীভাবে বহু লোককে একসাথে আক্রমণ করতে পারে। যারা ছোঁয়াচে রোগের কথা বলতেন,তারাও বুঝে উঠতে পারেন নি ছোঁয়াচের বস্তুটা কী আসলে,এটা কী কোনো বিষ যা একজন থেকে অন্যজনে ছড়াচ্ছে, না কি কোনো ছোটো প্রাণী, না কি কণা। তবে ধীরে ধীরে বিজ্ঞান অগ্রসর হতে থাকে। চিকিৎসাজগতে শুরু হয় ‘অটোপ্সি’র (মৃত ব্যক্তির দেহ কেটে অভ্যন্তরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরীক্ষণ) চর্চা। ১৮৩৭ সনের দিকে এলো কোষতত্ত্ব: স্লেইডেন এবং সোয়ান নামে দু’জন বিজ্ঞানী প্রস্তাব করলেন যেকোনো জীবিত বস্তু আসলে কোষ’ নামক ক্ষুদ্র কার্যকর ও গাঠনিক একক দিয়ে তৈরি। কোষতত্ত্বের আবির্ভাবের পর বিজ্ঞানীরা কোষ স্তরে রোগের চিহ্ন খুঁজতে শুরু করলেন (শাস্ত্রীয় নাম Cellular Pathology)।
কোষতত্ত্বের অন্যতম প্রস্তাবক থিওডর সোয়ানের ল্যাবে কাজ করতেন জ্যাকব হেনলি বলে একজন চিকিৎসক এবং অঙ্গসংস্থানবিদ (Anatomist)। কিডনিতে হেনলির লুপ বলে যে অংশটি পাওয়া যায়, তার আবিষ্কারক এই জার্মান ভদ্রলোক। হেনলি এনাটমি থেকে একসময় রোগ সংক্রমণ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তার ধারণা ছিলো ছোঁয়াচে তত্ত্বের আদি প্রবক্তারা যে বস্তুর খোঁজ করছিলেন, যার মাধ্যমে রোগ ছড়াবে, সেটি আসলে কোনো ‘বস্তু’ নয়, বরং অণুবীক্ষণিক জীবিত সত্তা। মিয়্যাজমা তত্ত্বে যে খারাপ বায়ুর কথা বলা হতো, সেই বায়ুর নিজস্ব কোনো দোষ নেই; কিন্তু ওই বায়ু রোগ সৃষ্টিকারী সত্তাকে বহন করলেই যতো সমস্যা। কিন্তু হেনলি ভেবেছিলেন তাঁর এই ধারণা প্রমাণ করা যাবে না। ভাগ্যের পরিহাস, তাঁরই এক ছাত্র কয়েক যুগ পড়ে এই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছিলেন! সে-কথায় আমরা পরে আসবো।
এই প্রেক্ষাপটে আবির্ভূত হন লুই পাস্তুর। পাস্তুর খুব মেধাবি ছাত্র ছিলেন না, পদার্থবিজ্ঞান- রসায়ন এসব ছিলো তাঁর কাজের প্রাথমিক এলাকা। তিনি রাসায়নিক কেলাসের ‘কাইরালিটি’ (Chirality) পর্যবেক্ষণ করে দারুণ সমাদৃত হন। কেলাস নিয়ে আরো কিছুকাল গবেষণার পর ১৮৫৪ সালে পাস্তুর চাকরি পেলেন লিল বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাঁর কাজের বিষয়বস্তু ছিলো ফার্মেন্টেশন বা গাঁজন। পাস্তুর শুরুতে ভেবেছিলেন এই ব্যাপারটা পুরোটাই রাসায়নিক, কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে অ্যালকোহল দেখার পর তিনি মত বদলান। ১৮৫৭ সালে তিনি এক গবেষণাপত্রে দেখালেন অণুবীক্ষণিক ছত্রাক ঈস্ট দুধের শর্করাকে ল্যাকটিক এসিডে পরিণত করে বলে দুধ নষ্ট হয়ে যায়। বছর ঘুরতেই তাঁর আরেক প্রকাশনা, এবারের বিষয় ঈস্ট কীভাবে শর্করা থেকে অ্যালকোহল তৈরি করতে পারে।
এরপর পাস্তুর মন দিলেন শতাব্দীপ্রাচীন ধারণা ‘স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টি’তত্ত্বে (Spontaneous Generation)। অ্যারিস্টটলের সময় থেকে প্রচলিত এই তত্ত্বমতে জড় বস্তু থেকে জীবনের উদ্ভব ঘটতে পারে। পাস্তুর তাঁর ধ্রুপদী পরীক্ষণের মাধ্যমে এই তত্ত্বের অসারতা প্রমাণ করলেন। তিনি দেখালেন খোলা মাংসে বা তার স্যুপে যে পোকা ধরে, বা দূষিত হয়ে যায় এর কারণ সেখানে বাতাস বা অন্য কোনো মাধ্যম-বাহিত অণুজীব জন্মায়। মুখ-বন্ধ পাত্রে দেখা যায় মাংস অবিকৃত আছে, অর্থাৎ মাংস থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো অণুজীব তৈরি হয় নি। পাস্তুর দেখেছিলেন যখন বিয়ার বা ওয়াইনে খুব বেশি অণুজীব থাকে, তখন সেই পানীয় টকে যায়। তিনি এমন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন যা অনুসরণ করে পানীয়কে উত্তপ্ত করলে এর স্বাদ অটুট থাকবে, আবার জীবাণুও মারা যাবে। এই পদ্ধতি আমরা এখনো ব্যবহার করি (উন্নততর রূপে),পাস্তুরাইজেশন নামে। ফরাসি দেশের মদ শিল্পের জন্য এ ছিলো এক বিরাট আশীর্বাদ।
স্কটল্যান্ডের এক শল্যচিকিৎসক, জোসেফ লিস্টার পাস্তুরের গাঁজন বিষয়ক লেখাপত্র পড়ে দারুণ উৎসাহিত হন এবং রোগীদের সার্জারি-পরবর্তী জীবাণু-সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে ফেনল ব্যবহার শুরু করেন। ফরাসি দেশে ১৮৫৫ থেকে ১৮৬৫ রেশমের গুটিপোকায় (silkworm) এক মারাত্মক মড়ক দেখা দেয়। ফ্রান্স সেসময় প্রচুর রেশম রপ্তানি করতো, তাই বিচলিত ফরাসি সরকার পাস্তুরের শরণাপন্ন হয়। আরো অনেক বিজ্ঞানীও সেসময় এই রোগ নিয়ে কাজ করছিলেন। দুই বছর বিভিন্ন ব্যর্থ চেষ্টা এবং অন্যান্য প্রতিযোগী বিজ্ঞানীদের সাথে বাদানুবাদের পর পাস্তুর বললেন এই রোগ ছোঁয়াচে এবং রোগাক্রান্ত (বাদামি দাগ দেখে চেনা যায়) গুটিকে দ্রুত আলাদা করতে পারলে এই রোগের সংক্রমণ কমানো যাবে। এই বুদ্ধি কাজে দিলো।
পাস্তুরের অনুসন্ধান ছিলো এই রোগ বিশেষ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ফলাফল। তিনি দুই ধরনের ব্যাকটেরিয়া আলাদা করতে সক্ষম হন এবং দেখান এরা দুটো আলাদা ধরনের রোগেই কেবল পাওয়া যাচ্ছে। যে জীবাণু তত্ত্বের কথা বলে আমরা শুরু করেছিলাম, তার জন্য এটা ছিলো এক গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা। পাস্তুর এখানে আসলে বিশেষ রোগের সাথে বিশেষ অণুজীবের ‘সুনির্দিষ্ট’ সম্বন্ধের দিকেই ইঙ্গিত করলেন। তবে এরপরেও বিজ্ঞানী মহলে রোগ এবং জীবাণুর সাক্ষাৎ কার্যকরণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতে বেশ সময় লাগলো।
রবার্ট কখ বয়সে পাস্তুরের চেয়ে বিশ বছরের ছোট; ছাত্র হিশেবে ছিলেন দারুণ মেধাবী। শুরুতে তিনি জ্যাকব হেনলির অধীনে কাজ শুরু করেন, যার কথা আমরা আগেই বলেছি, রোগ সংক্রমণ বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে যিনি অণুজীবের সাথে রোগ-সংযোগের সম্ভাব্য সংযোগের ধারণা দিয়েছিলেন, কিন্তু তার প্রমাণে ছিলেন অপারগ। স্নাতক সম্পন্ন করার পর কখ গ্রামে চলে গেলেন এবং অ্যানথ্রাক্স বলে গবাদিপশুর ব্যাকটেরিয়াঘটিত একটি রোগ নিয়ে কাজ শুরু করেন। এই গবেষণাই হেনলির অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে।
পূর্বতন গবেষকরা ইতোমধ্যে ব্যাসিলাস এনথ্রাসিস ব্যাকটেরিয়াকে অ্যানথ্রাক্সের সাথে সম্পর্কিত বলে চিহ্নিত করেছিলেন। কখ রোগাক্রান্ত, কিন্তু জীবিত গরু এবং ভেড়ার প্লীহা থেকে জীবাণুমিশ্রিত জৈব নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরির ইঁদুরের শরীরে প্রবেশ করালেন। ঠিকই অ্যানথ্রাক্সের লক্ষণ দেখা দিলো। এরপর তিনি ওই ব্যাকটেরিয়াকে ‘কালচার’ করার চেষ্টা করলেন, অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে তৈরি কোনো পুষ্টি মাধ্যমে বংশবৃদ্ধির সুযোগ দিলেন। তার মাধ্যম ছিলো স্থানীয় কসাইদের কাছ থেকে সংগৃহীত গরুর চোখের তরল। এরপর কালচার করা ব্যাকটেরিয়া দিয়ে সুস্থ প্রাণিকে সংক্রমিত করলেন। এবারেও অ্যানথ্রাক্সের লক্ষণ দেখা গেলো। এরপর তিনি ওই নতুন সংক্রমিত প্রাণী থেকে ব্যাসিলাস আলাদা করে অণুবীক্ষণযন্ত্রের নিচে দেখতেও সক্ষম হলেন। এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এক বিপ্লব ঘটে গেলো। বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন বিজ্ঞানী একটি অণুজীবকে পৃথক করলেন এবং তা দিয়ে কৃত্রিমভাবে নির্দিষ্ট রোগের সংক্রমণ ঘটালেন। যাত্রা শুরু হলো আধুনিক জীবাণুতত্ত্বের।
১৮৭৬ এবং ১৮৭৭ সালে কখ অ্যানথ্রাক্স এবং তার ব্যাকটেরিয়া নিয়ে সবিস্তারে দুটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। ব্যাকটেরিয়ার কিছু ছবিও অন্তর্ভুক্ত করেন সেখানে। পরের বছর একটি প্রবন্ধে তিনি বললেন তাঁর পরীক্ষার ধাপগুলি অনুসরণ করে যেকোনো রোগের জীবাণুই নির্দিষ্ট করা যাবে। এই ধাপগুলিকে একত্রে কখের শর্তাবলি (Koch’s Postulate) বলা হয়ে থাকে। কোনো রোগের সাথে কোনো জীবাণুর কারণ-সম্বন্ধ স্থাপন করতে সাধারণভাবে শর্তগুলো এরকম:
- রোগের সমস্ত নমুনায় ওই জীবাণুর উপস্থিতি থাকবে।
- জীবাণুটিকে তার পোষক থেকে আলাদা করতে হবে এবং পুষ্টি মাধ্যমে এককভাবে বংশবৃদ্ধি (pure culture) করতে দিতে হবে।
- পুষ্টি মাধ্যমে কালচার করা জীবাণু সুস্থ প্রাণিতে প্রবেশ করালে ঐ বিশেষ রোগটিই সৃষ্টি করতে হবে।
- নতুনভাবে আক্রান্ত প্রাণিদেহ থেকে জীবাণুটিকে আবারো আলাদা করতে হবে এবং প্রথমোক্ত জীবাণুর নমুনার সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে।
প্রাথমিকভাবে এই নিয়মগুলো রোগের জীবাণুকে নির্দিষ্ট করতে দারুণ সহায়ক হয়েছিলো। অবশ্য কখের জীবদ্দশাতেই এই চারটি শর্তের কিছু সীমাবদ্ধতা দেখা দিতে শুরু করে। উল্লেখ্য হেনলিও এরকম কিছু নিয়ম প্রস্তাব করেছিলেন বিধায় কখনো কখনো কখের সাথে তার নামটিও উচ্চারিত হয়।
ইতিহাসের এই পর্যায়ে লুই পাস্তুর’ও অ্যানথ্রাক্স গবেষণায় মন দিলেন। পাস্তুরের মূল আগ্রহ ছিলো অ্যানথ্রাক্সের ভ্যাক্সিন আবিষ্কারে। ইতোমধ্যে তার ঝুলিতে আছে চিকেন কলেরার ভ্যাকসিন তৈরির অভিজ্ঞতা। পাস্তুর বুঝেছিলেন কোনোভাবে কোনো রোগের জীবাণুকে দুর্বল করা(attenuate) গেলে (রোগ-সৃষ্টির ক্ষমতা হ্রাস করা) সেই দুর্বল জীবাণুকে যদি সুস্থ মানুষের শরীরে প্রবেশ করানো যায়, তাহলে তার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ওই জীবাণুকে চিনে রাখে। পরবর্তীতে ওই জীবাণুঘটিত রোগটি আর হতে পারে না। এই চিকিৎসা সেকালের ইউরোপে ছিলো দারুণ অভিনব।
পাস্তুর এবং তাঁর দল উচ্চ তাপমাত্রায় (৪২-৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) উত্তপ্ত করে দেখলেন অ্যানথ্রাক্স ব্যাকটেরিয়া তার রোগ-সংক্রমণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এই নমুনা দিয়েই তৈরি হলো ভ্যাক্সিন। পাস্তুর প্রচারে ভীষণ আগ্রহী ছিলেন। ১৮৮১ সালে জনসমক্ষে তিনি এক পরীক্ষার আয়োজন করেন। পঞ্চাশটি ভেঁড়া নিয়ে তাদের অর্ধেককে এই ভ্যাক্সিন দেন। এক মাস পর দেখা যায় ভ্যাকসিন-পাওয়া ভেড়াগুলোই বেঁচে আছে কেবল, রোগে ভুগে মারা গেছে বাকি অর্ধেক। এই সফল পরীক্ষণের খবর দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
১৮৮২ সালে কখ যক্ষ্মার জীবাণু আবিষ্কার করলেন (Mycobacterium tuberculosis)। কখ পরবর্তীতে ‘টিউবারকিউলিন’ বলে একটি ওষুধও আবিষ্কার করেছিলেন, যদিও সেটা কাজ করে নি। যাহোক, একই বছরে পাস্তুর আবিষ্কার করলেন র্যাবিসের ভ্যাক্সিন। পরের বছর কখ গেলেন মিসরে এবং তারপর ভারতে, কলেরা রোগের ওপর কাজ করতে। তাঁর লক্ষ্য ছিলো কলেরার জীবাণু ভিব্রিও কলেরি (Vibrio cholerae) শনাক্ত করা। ব্যাকটেরিয়া কালচার করার জন্য পূর্বের মতো চক্ষু-তরলের বদলে পুষ্টিসমৃদ্ধ তরল সুরুয়া (broth) ব্যবহার করতে চাইলেন। কিন্তু এই তরল খুব সহজেই অন্যান্য জীবাণু দিয়ে দূষিত হয়ে যাচ্ছিলো। জিলেটিন একটা বিকল্প হতে পারতো, কিন্তু বহু জীবাণু সহজেই একে বিয়োজিত করতে পারে।
হঠাৎ একদিন সন্ধান পাওয়া গেলো এক ল্যাব সহকারীর স্ত্রী’র কাছ থেকে। তিনি একটি জিনিশ দিয়ে জেলি বানাতেন, যা কি-না পুষ্টিমাধ্যম বানানোর সকল শর্তই পূরণ করে—স্বচ্ছ, উচ্চ গলন তাপমাত্রা, ব্যাকটেরিয়া দ্বারা অবিয়োজনযোগ্য। এই বস্তুটির নাম হলো ‘অ্যাগার’। সামুদ্রিক শৈবাল থেকে এটি সংগ্রহ করা হতো। কখের গবেষণাগারে দ্রুতই অ্যাগার ব্যবহার করে পৃথকীকৃত ব্যাকটেরিয়া কালচার করার কাজ শুরু হয়। ল্যাবের আরেকজন সহকারী একটি চওড়া, বৃত্তাকার পাত্র ডিজাইন করলেন, যার ভেতর অ্যাগার রেখে কাজ করা যাবে। সহকারীর নাম অনুসারের পাত্রটির নাম হলো পেট্রিডিশ। অ্যাগার আর পেট্রিডিশ বিজ্ঞানীদের নতুন নতুন আবিষ্কৃত ব্যাকটেরিয়া নিয়ে কাজ করার দারুণ সুযোগ করে দিলো।
কলেরার জীবাণু নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কখ আরেক সমস্যায় পড়লেন। এই জীবাণু শুধু মানুষেই রোগ বাধায়, তাই অন্য প্রাণীতে তিনি ঠিকঠাক পরীক্ষা করতে পারছিলেন না (কখের তৃতীয় শর্তের লঙ্ঘন)। তবে তিনি দেখাতে সক্ষম হন কলেরার কোনো ঘটনাই এই জীবাণুরা অনুপস্থিতিতে হচ্ছে না।
কখ যখন যক্ষ্মা আর কলেরা নিয়ে কাজ করছেন,পাস্তুর তখন, ১৮৮৮ সনে, প্যারিস শহরে গড়ে তুলছেন তার স্বপ্নের পাস্তুর ইনস্টিটিউট। পরের দশকগুলোতে এই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা দারুণ সব কাজ করেছেন। ক্যালেন্ডারের পাতায় নতুন শতক আসতে আসতে জীবাণুতত্ত্ব ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা গনোরিয়া, প্লেগ, আমাশয়, টিটেনাস সহ বহু রোগের কারণসূচক ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করে ফেললেন। ১৮৯৫ সালে পাস্তুর পরলোকগমন করেন, তাঁকে সমাহিত করা হয় তাঁর ইনস্টিটিউটেই। ১৯১০ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কখ বেঁচে রইলেন জীবন্ত কিংবদন্তি হিশেবে। তাঁর জীবদ্দশায় ১৮৯০ এর দশকেই বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকেরা রোগের জীবাণুতত্ত্বে পূর্ণ ইমান এনে চর্চায় ও গবেষণায় তার প্রয়োগ শুরু করেন।
তথ্যসূত্র-
Leave a Reply