নয়েজ দিয়ে শুরু
এককালে টেলিফোনে কথা বলার সময় অনেক ঝিরঝির শব্দ শোনা যেত। ওয়াকিটকিতে এই ঝিরঝির আওয়াজ আজও শোনা যায়। এই ঝিরঝির শব্দকে কেতাবি ভাষায় বলে ‘সিগন্যাল নয়েজ’ বা ‘হোয়াইট নয়েজ’। এই হাবিজাবি নয়েজ অন্য কোনো বস্তু থেকে তৈরি হয়ে এখন এসে টেলিফোনের সিগন্যালের সাথে মিশে গেছে। টেলিফোনের স্পষ্ট আওয়াজের সাথে এই হাবিজাবি সিগন্যাল মিশে যাওয়ার কারণে মূল আওয়াজ বিকৃত হয়ে গেছে। তাই এই সিগন্যাল নয়েজ দূর করা খুবই প্রয়োজনীয় এক কাজ হয়ে উঠল টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে।
বেল কমিউনিকেশন ল্যাবের লোকদের কাছে হটটপিক হয়ে দাঁড়াল ‘সিগন্যাল নয়েজ’ আসলে কোথা থেকে আসছে তা খুঁজে বের করা ও তা দূর করার কোনো একটা উপায় বের করা। বেল কমিউনিকেশন ল্যাবে তখন কাজ করেন কার্ল জানস্কি নামের এক ভদ্রলোক। কার্ল জানস্কি পেশায় একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। বেল কমিউনিকেশনে জয়েন করার কিছুদিন পরেই তার বস তাকে এই সিগন্যাল নয়েজ কোত্থেকে আসছে তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব দেন।
সিগন্যাল রিসিভ করার জন্য ইঞ্জিনিয়াররা যে যন্ত্র ব্যবহার করেন তার নাম ‘অ্যান্টেনা’। যেমন আপনার দেখা ‘রেডিও’-এর সাথে দেখবেন একটি দন্ডাকার অ্যান্টেনা লাগানো। মোবাইলে যখন রেডিও চালাতে চান তখন আপনাকে বলবে সাথে একটি কানফোন লাগিয়ে নিতে। এই কানফোন তখন অ্যান্টেনা হিসেবে কাজ করে। রেডিও’র অ্যান্টেনা আসলে কোনো একটি রেডিও চ্যানেল থেকে পাঠানো রেডিও সিগন্যাল গ্রহণ করে, তারপর নানাভাবে প্রসেস করে অবশেষে তা আপনাকে রেডিও-এর মাধ্যমে শোনায়।
কোনো রেডিও সিগন্যাল কোথা থেকে আসছে তা জানতে হলে আগে আমাদেরকে ঐ সিগন্যালটি রিসিভ করতে হবে। এরপর নানা বিশ্লেষণ করলে বুঝা যাবে ঐ সিগন্যাল কোথা থেকে আসছে। তাই সিগন্যাল নয়েজও কোথা থেকে আসছে তা খুঁজে বের করার আগে কার্ল জানস্কি একটি অ্যান্টেনা বানিয়ে সেই সিগন্যাল নয়েজ ধরার চেষ্টা করলেন। কার্ল জানস্কির ব্যবহার করা অ্যান্টেনাটি ছিল পাশাপাশি বসানো একসারি ডাইপোল অ্যান্টেনা।
সিগন্যাল ধরার যন্ত্র
ধরুন কোনো একটি স্থান থেকে আপনার অ্যান্টেনার দিকে রেডিও সিগন্যাল আসছে। এই রেডিও সিগন্যাল আমরা সরাসরি পরিমাপ করতে পারি না। তবে আমরা কারেন্টের মান পরিমাপ করতে পারি। তাই আমরা যদি রেডিও সিগন্যাল পরিমাপ করতে চাই তাহলে এই রেডিও সিগন্যালগুলোকে আগে আমাদের কারেন্টে রূপান্তর করে তারপর কাজ করতে হবে। একটি অ্যান্টেনা দিয়ে রেডিও সিগন্যালকে কারেন্টে রূপান্তর করা সম্ভব। আমরা এখানে একটি বিশেষ ধরণের অ্যান্টেনা নিয়ে কথা বলতে পারি যার নাম ‘হাফ ওয়েভ ডাইপোল অ্যান্টেনা’।
ডাইপোল বা দ্বিমেরু শব্দটা দিয়ে বুঝায় এই অ্যান্টেনার দুইটা প্রান্ত আছে। এই দুই প্রান্তের দুই পোল সাধারণত একটি মেটাল রড দিয়ে তৈরি করা হয়। দুই প্রান্তের মাঝে একটি রিসিভার থাকে। আর এটিকে হাফ ওয়েভ কেন বলা হচ্ছে? কারণ আমরা যত মিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সিগন্যাল পরিমাপ করতে চাচ্ছি তার ঠিক অর্ধেক তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সমান এই দুই প্রান্তের মাঝের দূরত্ব থাকে। তাই এটি হাফ ওয়েভ ডাইপোল অ্যান্টেনা।
এখন যখন এই অ্যান্টেনার মধ্য দিয়ে কোনো একটি রেডিও সিগন্যালের অংশ গমন করে তখন ফ্যারাডের সূত্রানুসারে এই অ্যান্টেনাতে একটি কারেন্ট আবেশিত হয়। ডাইপোলের একপাশ পজিটিভ ও অন্যপাশ নেগিটিভ চার্জে চার্জিত হচ্ছে ইলেকট্রিক ফিল্ডের ফলে। যেহেতু ইলেকট্রিক ফিল্ডটা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনশীল তাই এই কারেন্টটিও পরিবর্তনশীল কারেন্ট (AC) হয়। আর এই কারেন্ট এক পোল থেকে আরেকপোলে যাওয়ার সময় মাঝে রাখা রিসিভারে ধরা পড়ে। সেই ধরা পড়া কারেন্টই আমরা তখন কম্পিউটার স্ক্রিনে দেখতে পাই। এটাই হচ্ছে হাফ ওয়েব ডাইপোল অ্যান্টেনার কাজ করার প্রক্রিয়া।
নয়েজ সিগন্যালটি আসলে কোথা থেকে আসছে তা বোঝার জন্য কার্ল জানস্কি একটা ফন্দি আটলেন। জানস্কি ভাবলেন তার সাথে থাকা অ্যান্টেনাটি আকাশের বিভিন্ন দিকে তাক করবেন। যেই দিকে তাক করা অবস্থায় সিগন্যাল সবচেয়ে শক্তিশালী দেখতে পাবেন, সেই দিক থেকেই সিগন্যাল আসছে বলে নিশ্চিত হয়ে যাবেন। তাই তিনি তার অ্যান্টেনার নিচে চারটি চাকা লাগিয়ে দিলেন। এই চাকার ফলে অ্যান্টেনাটি ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরানো সম্ভব ও সম্পূর্ণ আকাশ পর্যবেক্ষণ করে ঠিক কোন জায়গা থেকে সিগন্যাল আসছে তাও বলে দেওয়া সম্ভব। ছোটবেলায় পার্কে খেলনা ঘোড়ায় চড়েছেন? ওইযে অনেকগুলো ঘোড়া থাকে কাঠের আর সেগুলো একটা দন্ডকে কেন্দ্র করে ঘুরে? – ওই খেলাটিকে ‘মেরি গো রাউন্ড’ বলে। কার্ল জানস্কির অ্যান্টেনাটি যেহেতু সেভাবেই ঘুরতে পারত তাই কেউ কেউ তার তৈরি করা এই অ্যান্টেনাটিকে ‘জানস্কির মেরি গো রাউন্ড’-ও বলে থাকেন।
কার্ল জানস্কির এই অ্যান্টেনাটি প্রথমদিকে ৬০ কিলোহার্জ কম্পাঙ্কের সিগন্যাল শনাক্ত করতে পারত। নিম্ন কম্পাঙ্কের যে সিগন্যালগুলো আছে সেগুলো নিয়ে আগেই রেডিও ইঞ্জিনিয়াররা বিস্তর গবেষণা করেছিলেন। কিন্তু উচ্চ কম্পাঙ্কের রেডিও সিগন্যালগুলো নিয়ে তখনও খুব একটা কাজ হয়নি। তাই কার্ল জানস্কি চিন্তা করলেন ২-২০ মেগাহার্জ কম্পাঙ্কের মধ্যে কাজ করবেন। পরবর্তীতে ১৯২৯ সালে এই মান বাড়িয়ে ২০.৫ মেগাহার্জ কম্পাঙ্ক (তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১৪.৫ মিটার) শনাক্ত করতে পারে এমন অ্যান্টেনা তৈরি করে নেন জানস্কি।
রহস্যের খোঁজে জানস্কি
১৯৩২ সালে প্রচণ্ড ঝড়ের এক রাত। ঝড়ের সাথে কোথাও কোথাও বজ্রও পড়ছে। আকাশ থেকে বজ্র কখনো আমাদের কাছে আসলে সেটির সাথে একটি রেডিও সিগন্যালও চলে আসে। রেডিও সিগন্যাল আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। তবে আপনার কাছে যদি তখন একটি অন করা রেডিও থেকে থাকে তাহলে দেখবেন বজ্রপাত হওয়ার সাথে সাথে আমাদের হাতে থাকা রেডিওটিও একটু ঝিরঝির আওয়াজ করে উঠবে। ঝড়ের সাথে থাকা এই বজ্রের ফলে সৃষ্ট রেডিও সিগন্যালই আপনার রেডিওতে ঝিরঝির আওয়াজ তৈরি করে। বেল কমিউনিকেশন ল্যাবে যে সিগন্যাল নয়েজ নিয়ে এত কাজ চলছিল সেই সিগন্যাল নয়েজের অধিকাংশই এই বজ্রের ফলে সৃষ্ট রেডিও সিগন্যাল থেকেই আসছিল।
সেই ঝড়ের রাতে কার্ল জানস্কি না ঘুমিয়ে কাজ করছেন তার ল্যাবে। বিষয় হচ্ছে ‘সিগন্যাল নয়েজ’। বাইরে একটা বজ্র পড়লো। কার্ল জানস্কি সেই সিগন্যাল তার অ্যান্টেনায় ধরা পড়েছে কি না তা দেখতে অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকেন। এভাবে কয়েকদিন গেল। কার্ল জানস্কি বিগত কয়েকদিন ধরে এসকল সিগন্যালই তার অ্যান্টেনায় দেখতে পাচ্ছেন। এবার তিনি এই সিগন্যালগুলোর বৈশিষ্ট্য ও এরা আসলে কোথা থেকে এসেছে তা বের করতে চাচ্ছেন। যেই কথা সেই কাজ। বসে পড়লেন খাতা-কলম নিয়ে। কিন্তু একটা মজার বিষয় ঘটল। প্রাপ্ত সিগন্যালগুলো তিনি বিশ্লেষণ করে দেখলেন এখানে তিন ধরনের সিগন্যাল আছে। এদেরকে তিনি তিনটি গ্রুপে ভাগ করলেন। গ্রুপ ১ – স্থানীয় কিছু এলাকায় হওয়া বজ্রপাতের ফলে সৃষ্ট রেডিও সিগন্যালের ফলে সৃষ্ট নয়েজ, গ্রুপ ২ – দূরবর্তী কিছু এলাকায় হওয়া বজ্রপাতের ফলে সৃষ্ট রেডিও সিগন্যালের ফলে সৃষ্ট নয়েজ ও গ্রুপ ৩ – অজানা কোনো এক উৎস থেকে আসা রেডিও সিগন্যাল। গ্রুপ ১ ও গ্রুপ ২ নিয়ে কার্ল জানস্কির মূল কাজ হওয়ার কথা থাকলেও কার্ল জানস্কি কাজ করতে চান গ্রুপ ৩-এ থাকা অজানা উৎস থেকে আসা রেডিও সিগন্যাল নিয়ে। এটা নিয়ে তার আগ্রহের কমতি নেই।
কার্ল জানস্কির অনুসন্ধিৎসু মন থাকায় তিনি অনুসন্ধান করতে বের হলেন। কী সেই বস্তু যা থেকে রেডিও সিগন্যালটি আসছে। তিনি আরো কয়েকবার সিগন্যাল নেওয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি একটি প্যাটার্ন খুঁজে পেলেন। তাঁর অ্যান্টেনায় ধরা পড়া সিগন্যালগুলো প্রতি ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট পরপর ধরা পড়ে। মানে আজকে রাত ২টায় যদি সেই অজানা সিগন্যালটি অ্যান্টেনায় শনাক্ত করা হয় তাহলে আগামীকাল রাত ঠিক ১টা ৫৬ মিনিটে আবার ওই সিগন্যালটি ধরা পড়বে।
জানস্কি প্রথমে ভেবেছিলেন সিগন্যালটি বোধহয় সূর্য থেকে আসছে। কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের কারণে সূর্য থেকে রেডিও তরঙ্গ নির্গত হয়। কিন্তু খুব দ্রুতই তিনি বুঝতে পারলেন অ্যান্টেনায় ধরা পড়া সিগন্যালটি আসলে সূর্য থেকে আসছে না। বরং সেটি এমন কোনো এক জায়গা থেকে আসছে যা আমাদের সৌরজগতের বাইরে। এর পেছনে ছিল কার্ল জানস্কির কয়েকমাসের একটি পর্যবেক্ষণ।
তিনি লক্ষ্য করলেন যেই উৎস থেকে এই রহস্যময় ঝিরঝির সিগন্যালটি আসছে সেটি আসলে প্রতিদিন অল্প অল্প করে আকাশের পূর্ব থেকে পশ্চিমে সরে যাচ্ছে। এখান থেকে তাঁর মাথায় যে চিন্তাটি এলো তা হচ্ছে, আকাশের যত নক্ষত্র আছে তা প্রতিদিন অল্প অল্প করে পূর্ব থেকে পশ্চিমে সরে যায়। এভাবে অল্প অল্প সরতে সরতে ৩৬৫ দিনে পুরো আকাশ একবার ঘুরে আসে। কার্ল জানস্কি পরীক্ষা করে দেখলেন আসলেই যেই উৎস থেকে ঝিরঝির সিগন্যালটি আসছে সেটি সামান্য সরতে সরতে ৩৬৫ দিন পর আবার তার পূর্বের জায়গাতেই ফিরে এসেছে। তাই তিনি বললেন এই সিগন্যাল আমাদের সৌরজগত থেকে নয় বরং সৌরজগতের বাইরে কোনো দুরবর্তী নক্ষত্র থেকে আসছে। তাই তিনি এই রহস্যময়ী ঝিরঝির (ইংরেজিতে বলে স্ট্যাটিক) সিগন্যালকে নাম দেন ‘কসমিক স্ট্যাটিক’।
রহস্যের সমাধান
পদার্থবিজ্ঞানে ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও কার্ল জানস্কির জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে বিস্তর গবেষনা চালানোর মতো জ্ঞান ছিল না। তাই তিনি নিজের পরিচিত কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানীর সাথে তাঁর এই আবিষ্কারের বিষয়টি জানালেন। তাঁর পরিচিত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাকে বললেন এই অজানা উৎসটি হয়তোবা আমাদের গ্যালাক্সির কোনো অঞ্চলে থাকা মহাজাগতিক গ্যাস ও ধূলিকণা থেকে বের হওয়া রেডিও সিগন্যাল। তিনি কার্ল জানস্কিকে পরামর্শ দিলেন, তিনি যেন এই অজানা উৎস আকাশের ঠিক কোন জায়গায় অবস্থিত সেটি নির্ণয় করেন ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ওই অবস্থান দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন যে ওই অবস্থানে আসলে কী রয়েছে। তাহলে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাদের কাছে থাকা আকাশের ক্যাটালগ দেখেই বলে দিতে পারবেন সিগন্যালটি কী থেকে আসছে।
তাঁর বন্ধুর সাথে কথা বলার পর কার্ল জানস্কি একের পর এক পাওয়া তথ্যগুলো মেলানোর চেষ্টা করলেন। তিনি দেখতে পেলেন সিগন্যালগুলো আসছে আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রের দিক থেকে, আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রের অঞ্চলটি পড়েছে স্যাজিটেরিয়াস নামে একটি নক্ষত্রমণ্ডল বরাবর। এই স্যাজিটেরিয়াস প্রতিদিনই অল্প অল্প করে পূর্ব থেকে সরে যায় আর বছর শেষে পূর্বের অবস্থানে ফিরে আসে। স্যাজিটেরিয়াস অঞ্চল থেকে যদি কোনো রেডিও সিগন্যাল বের হয় তাহলে তা আমাদের পৃথিবীতে থাকা কোনো অ্যান্টেনা ঠিক ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট পরপর শনাক্ত করবে। কারণ পৃথিবী নিজ অক্ষের সাপেক্ষে ঘুরছে। ফলে পৃথিবী পৃষ্ঠে থাকা কোনো অ্যান্টেনা ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট পরপরই ওই স্যাজিটেরিয়াসের মুখোমুখি হবে। এর আগে বা পরে নয়। স্যাজিটেরিয়াসে থাকা মহাজাগতিক ধুলো থেকেও কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের প্রভাবে রেডিও সিগন্যাল বের হওয়া সম্ভব বলে পদার্থবিজ্ঞান আমাদের বলে। এসব থেকে কার্ল জানস্কি ধরেই নিলেন, আসলেই হয়ত মিল্কিওয়ের কেন্দ্র থেকেই এই ঝিরঝির সিগন্যালটি আসছে।
এসব চিন্তা করতে করতেই হটাৎ একদিন তাঁর বসের কাছ থেকে ডাক পান কার্ল জানস্কি। তাঁর বস তাকে জানান, বেল কমিউনিকেশন ল্যাবে ‘অজানা উৎস’ খোঁজা থেকেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। তাই তিনি কার্ল জানস্কিকে নতুন একটি প্রজেক্টে কাজ শুরু করতে বলেন। জানস্কি তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গী ‘অজানা উৎস’-এর সেই অনুসন্ধান নিজের ইচ্ছা সত্ত্বেও ত্যাগ করেন। সেই আক্ষেপ জানিয়ে ১৯৩৪ সালে তিনি তাঁর বাবাকে লেখা এক চিঠিতে জানান,
“আমি আপনাকে কি বলেছিলাম যে আমার কাছে প্রমাণ আছে তরঙ্গগুলো আসলে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে আসছে? আমি এখন আর সেই মহাজাগতিক তরঙ্গ নিয়ে কাজ করছি না। … (নতুন প্রাপ্ত প্রজেক্ট) মহাজাগতিক তরঙ্গের মতো এতোটা ইন্টারেস্টিং না। আর এটি খুব একটা খ্যাতিও ডেকে আনবে না। যদিও আমি নিজেই বাসাতে সেই সিগন্যালগুলো নিয়ে কিছুটা তাত্ত্বিক কাজ করার চেষ্টা চালাচ্ছি।”
পরবর্তীতে কার্ল জানস্কির বস তাকে বিষয়টি নিয়ে আবার ঘাটাঘাটি করার সুযোগ দেন এবং একটি রিপোর্ট লিখতে বলেন। আবার পুরোদমে কাজে লেগে যান কার্ল জানস্কি। অজানা উৎসটি আসলেই স্যাজিটেরিয়াস অঞ্চল কি না বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি আকাশে বস্তুটির অবস্থান পরিমাপ করলেন। তিনি দেখলেন যেই অজানা উৎস থেকে সিগন্যাল আসছে তা প্রায় দক্ষিণ আকাশে। তিনি গেলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর কাছে। গিয়ে আকাশের দিকে তাক করে জিজ্ঞেস করলেন ওই জায়গায় কী আছে! জ্যোতির্বিজ্ঞানী তখন তাকে জানিয়ে দিলেন ওই জায়গায় আছে আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র ‘স্যাজিটেরিয়াস’। মূলত আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে আছে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল। এর আশেপাশের ধূলিকণা আর দুপাশ থেকে বের হওয়া রেডিও জেট-ই বারবার ধরা পরছিল জানস্কির অ্যান্টেনাতে। অবশেষে কার্ল জানস্কির মুখ থেকে একটি মুচকি হাসি বেরুলো। তাঁর দীর্ঘ কয়েক বছরের তদন্তের সমাধান হলো। তাঁর এই অনুসন্ধানের তিনি ইতি টেনে রচনা করলেন “A note on the source of interstellar interference” নামক গবেষনাপত্রটি। আর এভাবেই আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে অদেখা রশ্মি, রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে দেখে রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক হলেন কার্ল জানস্কি।
তথ্যসূত্র–
- আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে আসা সিগন্যালকে অজানা সোর্স থেকে আসা সিগন্যাল হিসেবে শনাক্ত করে লেখা কার্ল জানস্কির গবেষনাপ্রবন্ধ Jansky, K. G. (1932). Directional studies of atmospherics at high frequencies. Proceedings of the Institute of Radio Engineers, 20(12), 1920-1932.
- অজানা সোর্সটির উৎস আমাদের পৃথিবী নয় বরং পৃথিবীর বাইরে কোনো এক জায়গা থেকে ও সেই জায়গার একটা স্থানাংক প্রদান করে প্রকাশ করা কার্ল জানস্কির বক্তব্য Jansky, K. G. (1933). Radio waves from outside the solar system. Nature, 132(3323), 66-66.
- অজানা সোর্সটির অবস্থান নির্ণয় করার কৌশল ও তা থেকে প্রাপ্ত ডাটা নিয়ে লেখা কার্ল জানক্সির বক্তব্য Jansky, K. G. (1933). Electrical disturbances apparently of extraterrestrial origin. Proceedings of the Institute of Radio Engineers, 21(10), 1387-1398.
- অজানা সোর্সটি আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রের স্যাজাটেরিয়াস অঞ্চল হতে পারে বলে প্রথমবারের মত কার্ল জানস্কি তার গবেষনাপ্রবন্ধে উল্লেখ করেন Jansky, K. G. (1933). Electrical phenomena that apparently are of interstellar origin. Popular Astronomy, 41, 548-555.
- অজানা সোর্সটি নিয়ে কার্ল জানস্কি আর কাজ করতে পারছেন না জানিয়ে তার বাবাকে লেখা চিঠি বিষয়ে Verschuur, G. (2015). The invisible universe: the story of radio astronomy. Springer.
- অজানা সোর্সটি আসলেই আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র সে বিষয়ে নানা প্রমাণ পেশ করে কার্ল জানস্কির লেখা গবেষনাপ্রবন্ধ Jansky, K. G. (1935). A note on the source of interstellar interference. Proceedings of the Institute of Radio Engineers, 23(10), 1158-1163.
- এনবিসি প্রোগ্রামকে দেওয়া কার্ল জানস্কির ইন্টারভিউ Kraus, J. (1981, Oct-Nov-Dec). The First 50 years of Radio Astronomy Part 1: Karl Jansky and His Discovery of Radio Waves from Our Galaxy. Cosmic Search, 3(12), 8-10.
Leave a Reply