টেস্টোস্টেরনের নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছেন, তাই না? নাও শুনে থাকতে পারেন। এটা এক ধরণের সেক্স হরমোন, যা পুরুষের দেহে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে এবং নারীর দেহে সামান্য থাকে। টেস্টোস্টেরনের মাত্রা স্বাভাবিক পুরুষের যৌন বিকাশ এবং কার্যকারিতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোগের ঝুঁকি হ্রাস থেকে শুরু করে দাঁড়ি-গোঁফ উঠার সাথেও এই হরমোনের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু কারও কারও ক্ষেত্রে এই হরমোন উৎপাদন ও নিঃসরণের মাত্রা কম হতে পারে। আর এর ফলে যৌনসুখ কিংবা যৌন উদ্দীপনা হ্রাস পায়। এছাড়াও বিষণ্ণতা, ক্লান্তি, বিরক্তি, ইরেক্টাইল ডিসফাংশন (যৌন উদ্দীপনার ফলে যথাযথভাবে লিঙ্গোত্থান না ঘটা) ইত্যাদি সমস্যাও হতে পারে। তাহল এখন উপায় কী?
ব্যায়াম এবং ভার উত্তোলন
লাইফস্টাইল-সম্পর্কিত অনেক রোগ প্রতিরোধ করার জন্য ব্যায়াম সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলির মধ্যে একটি। শুধু তাই নয় এটি আপনার টেস্টোস্টেরনের মাত্রাও বাড়িয়ে দিতে পারে। ২০১৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিল যে অতিরিক্ত ওজনবিশিষ্ট কিছু পুরুষদের ক্ষেত্রে উচ্চ ক্যালোরি গ্রহণের বাধা-নিষেধের তুলনায় শারীরিক কার্যকলাপ ও কায়িক শ্রম বৃদ্ধি টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বাড়ানোর জন্য বেশি উপকারী। কয়েকটি গবেষণার একটি বিশেষ পর্যালোচনায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে ব্যায়ামের ধরণ এবং শারীরিক কসরতের তীব্রতা টেস্টোস্টেরনের মাত্রার উপরে ভালোই প্রভাব ফেলে।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে দেখলাম যে ভারোত্তলনের সাথে পুরুষের শরীরে টেস্টোস্টেরনের স্বল্পমেয়াদী বৃদ্ধির একটা যোগসূত্র রয়েছে। এছাড়াও এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিওলজির একটি গবেষণাপত্র অনুসারে পুশআপ, জাম্পিং জ্যাক এবং স্কোয়াট জাম্পের মতো ব্যায়ামগুলো বিশেষভাবে এই হরমোনের সক্রিয়তা বাড়াতে ভূমিকা রাখে বলে জানা গিয়েছে। এ ধরণের ব্যায়ামকে ‘হাই-ইন্টেন্সিটি ইন্টারভাল ট্রেইনিং’ (সংক্ষেপে এইচআইআইটি) বলে।
খেতে হবে খাবার
আপনি যা খান তা টেস্টোস্টেরনের মাত্রার পাশাপাশি অন্যান্য হরমোনকেও প্রভাবিত করতে পারে। ঘন ঘন ডায়েটিং অথবা অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ-দুটোই টেস্টোস্টেরনের মাত্রার উপরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই যদি কোনো পুরুষ তার দেহের এই গুরুত্বপূর্ণ সেক্স হরমোনটির মাত্রা বাড়াতে চান, তবে তাকে প্রয়োজনানুসারে প্রোটিন, চর্বি ও কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার খেতে হবে। সুষম খাদ্য এবং বিভিন্ন খাদ্যের সংমিশ্রণে তৈরি ডায়েটই পারে আমাদের স্বাস্থ্যকে প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করতে। এর ফলে দেহের অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি টেস্টোস্টেরনসহ যেকোনো হরমোনের মাত্রা ও কার্যকারিতা প্রভাবিত হয়।
পর্যাপ্ত পরিমাণ আমিষ জাতীয় খাদ্য আপনার টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বজায় রাখতে এবং দেহের অতিরিক্ত চর্বি কমাতে সাহায্য করতে পারে। আবার যে ধরণের চর্বিযুক্ত খাবার স্বাস্থ্যকর (আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট), সেগুলো পরিমাণগত খেলে টেস্টোস্টেরনের মাত্রায় ভারসাম্য বজায় থাকে। কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে কম চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ এই হরমোনের উৎপাদন মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। একইভাবে অন্যান্য খাবারের সাথেও টেস্টোস্টেরনের সম্পর্ক আছে। তাই আপনার শরীর, রোগ আর রুচি অনুসারে প্রয়োজনীয় খাদ্যগুলো গ্রহণের মাধ্যমে আপনি টেস্টোস্টেরনের মাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেন।
একাধিক গবেষণাপত্রের উপর ভিত্তি করে লেখা Medical News Today এর একটি প্রবন্ধ বলছে যে সবুজ শাক-সবজি, জিংকযুক্ত খাবার, আদা, পেঁয়াজ, ডালিম ইত্যাদি খাবার দেহের মধ্যে যৌন হরমোনের কার্যকারিতা ও পরিমাণ বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এছাড়াও সো পালমেটো এবং অশ্বগন্ধারও টেস্টোস্টেরনের উৎপাদন বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা থাকতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা, যদিও এটি নিয়ে এখনো বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন।
দুশ্চিন্তা কমিয়ে ফেলুন
দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতা, হতাশা-এই শব্দগুলোর সাথে আপনি নিশ্চয়ই পরিচিত? আজকের বিশ্বে এই জিনিসগুলো খুবই বাজে রূপ ধারণ করেছে। যৌন আকাঙ্ক্ষা কমিয়ে দেওয়া কিংবা টেস্টোস্টেরনের মাত্রা হ্রাসের সাথেও এই মানসিক যন্ত্রণার যোগসাজশ রয়েছে। ভারতীয় গবেষকদের গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে এই দুশ্চিন্তা বা হতাশার কারণে দেহে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। আর দেহের মধ্যে কর্টিসল বেড়ে গেলে, এর প্রভাবে টেস্টোস্টেরন কমে যায়। মানে এক কথায় বললে কর্টিসল এবং টেস্টোস্টেরনের মাত্রা একে অপরের ব্যাস্তানুপাতিক।
স্ট্রেস ও অত্যাধিক কর্টিসল খাদ্য গ্রহণ, ওজন বৃদ্ধি এবং দেহে ক্ষতিকর চর্বি সঞ্চয় বাড়িয়ে দিতে পারে। এই পরিবর্তনগুলো টেস্টোস্টেরনের মাত্রাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম। আর তাই স্বাস্থ্য এবং যৌন হরমোন- উভয়ের উন্নতির জন্য আপনাকে অতিরিক্ত চাপ কমিয়ে ফেলতে হবে। মানসিকভাবে দমে না যাওয়া, কর্মচাঞ্চল্যতা ধরে রাখা, রাতে ঠিকমতো ঘুমানো এবং মানসিক চাপ থেকে মুক্তির কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে আপনি অনেকটাই কর্টিসলের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পারবেন, যা আপনার দেহের টেস্টোস্টেরনকে বাড়িয়ে তুলতে ভূমিকা রাখবে।
লাগতে পারে ভিটামিন ডি
ভিটামিন ডি একটি জরুরি মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট, যা সুস্বাস্থ্যের জন্য বিভিন্ন দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ভিটামিনের গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০০ কোটি লোকের শরীরে চাহিদার সাপেক্ষে এই উপাদানের ঘাটতি রয়েছে। গবেষণা বলছে যে ভিটামিন ডি এর স্বল্পতার সাথে টেস্টোস্টেরনের মাত্রার অধঃপতনের সম্পর্ক রয়েছে। ২০১৭ সালে ১০২ জন পুরুষের উপরে করা গবেষণায় দেখা যায় যে ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং ইরেক্টাইল ডিসফাংশনের সমস্যা কিছুটা হলেও সমাধান হয়।
কিন্তু এখনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয় যে ভিটামিন ডি এর পর্যাপ্ততা টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বাড়াতে ভূমিকা রাখে। কারণ কিছু পরস্পরবিরোধী ফলাফলও পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ২০২০ সালে প্রকাশিত একটি পর্যালোচনাপত্রে বলা হয় যে ভিটামিন ডি এর এই কার্যকারিতা মেকানিক্যালি চমকপ্রদ হলেও, ক্লিনিক্যালি এখনো পুরোপুরি আশাজনক নয়।
তবে দেহে ভিটামিন ডি এর সঠিক মাত্রা বজায় রাখতে নিয়মিত সূর্যালোকের সংস্পর্শে আসার চেষ্টা করুন বা একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে ভিটামিন ডি এর সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে পারেন। ভিটামিন ডি এবং আপনাদের দেহে এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানতে পড়তে পারেন ‘ভিটামিন ডি কতটুকু দরকার?’ লেখাটি।
আরামদায়ক ও পর্যাপ্ত ঘুম দরকার
ঘুমের ব্যাপারটা দুশ্চিন্তা কমানোর কথায় একটু বলেছিলাম। এখন আসুন, বিস্তারিত কিছু জানা যাক। দেখুন, ঘুম একটা বিশেষ পদ্ধতি, যেটি আমাদের মন, স্মৃতি এবং শরীরের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য সমষ্টিগত ভূমিকা পালন করে থাকে। একজন চিত্রশিল্পী যেমন তুলির শেষ আঁচড়ের মাধ্যমে তার আঁকিবুঁকি শেষ করেন, তেমনি ঘুমের মাধ্যমেও শরীরের চূড়ান্ত উন্নয়ন সম্ভবপর হয়। ২২৯৫ জন কিশোর ছেলে এবং পুরুষদের উপর করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে নিম্ন মানের ঘুমের সাথে টেস্টোস্টেরনের ঘাটতির সম্পর্ক থাকতে পারে।
ঘুমের আদর্শ পরিমাণ এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ভিন্নতর হয়। তবে ২০১১ সালের একটি ছোট্ট সমীক্ষায় দেখা গেছে যে প্রতি রাতে যারা মাত্র ৫ ঘন্টা ঘুমান, তাদের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা ১০%-১৫% হ্রাস পেয়েছিল। মজার বিষয় হলো, বয়স্ক পুরুষদের উপরে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ৯.৯ ঘন্টা পর্যন্ত ঘুমালে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। উল্টোভাবে, ৯.৯ ঘন্টার বেশি ঘুমানোর কারণে আবার টেসটোসটেরনের মাত্রা কমে যাওয়ার প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে।
যদিও কিছু লোক কম ঘুম দিয়েই ভালো থাকতে পারে, তবে গড়পড়তা বেশিরভাগ গবেষণায় প্রতি রাতে কমপক্ষে ৭ ঘন্টা ঘুমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে খুব বেশি ঘুমানোর চাইতে প্রয়োজন ভালোভাবে আরামের সাথে ঘুমাতে পারা, যাতে করে সেই সময়ের মধ্যে শরীরের ক্লান্তি দূর হয় এবং শরীর বিভিন্ন জিনিসের রিকভারি করার সুযোগ পায়। আর এতে করে টেস্টোস্টেরনের মতো সেক্স হরমোন এবং যৌন উদ্দীপনা বৃদ্ধিও ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয়।
অ্যালকোহল এবং অন্যান্য রাসায়নিক বাদ
গবেষণায় দেখা গেছে যে এস্ট্রোজেনের মতো রাসায়নিক পদার্থও টেস্টোস্টেরনের মাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে। বিসফেনল-এ (বিপিএ), প্যারাবেনস, ডিডিটি, এন্ডোসালফান, থ্যালেট ইত্যাদি রাসায়নিক পদার্থ আপনার দেহের এই যৌন হরমোনটির কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে, হ্রাস করে এর উৎপাদনও। এমনকি গবেষণা বলছে যে এগুলো শুক্রাণুর ডিএনএকে নষ্ট করে ফেলে এবং বীর্যের কার্যকারিতা নষ্ট করে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে অনেক সময়ই এই রাসায়নিক পদার্থগুলো প্লাস্টিক, সার এবং কীটনাশকের মধ্যে পাওয়া যায়। তাই প্লাস্টিকের ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে ফেলুন।
এবার আসি অ্যালকোহলের কথায়। অনেকে মনে করেন যে আরব অধিবাসীদের ক্যান্সার কম হয় অ্যালকোহলের প্রভাব সেখানে কম বলে। ক্যান্সারে ভূমিকা রাখুক বা না রাখুক, যৌন জীবনে অ্যালকোহল চোখ বন্ধ করে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে। অ্যালকোহল পান করার ৩০ মিনিটের মধ্যেই টেস্টোস্টেরনের মাত্রা দ্রুত হ্রাস পেতে পারে। অ্যালকোহলের পাশাপাশি অন্যান্য বেশ কিছু মাদকেরও এই যৌন হরমোনটিকে বাজেভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রয়েছে। তাই এসব থেকে দূরে থাকার কোনো বিকল্প নেই।
শেষ কথা
এতক্ষণ বহু গবেষণাপত্রের সারমর্ম তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। টেস্টোস্টেরন পুরুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই একজন পুরুষ হিসেবে যৌন জীবনে সফলতা এবং স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটাতে হলে আপনাকে থাকতে হবে সচেতন। আজকের ব্লগপোস্টে যেসব কথাবার্তা হলো, সেগুলো পালন করার চেষ্টা করুন এবং প্রয়োজনে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো অবহেলা নয়। কারণ “স্বাস্থ্যই সম্পদ”।
তথ্যসূত্র–
- 8 Proven Ways to Increase Testosterone Levels Naturally
- Testosterone-Associated Dietary Pattern Predicts Low Testosterone Levels and Hypogonadism
- Manipulation of Dietary Intake on Changes in Circulating Testosterone Concentrations
- Low-carbohydrate diets and men’s cortisol and testosterone: Systematic review and meta-analysis
- What Medications Cause Low Testosterone
- What is Low Testosterone?
Leave a Reply