ওয়্যারউলফ সিনড্রোম: কল্প-বাস্তবতার অসুখ-বিসুখ

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

আষাঢ়ের রাত। বাইরে একনাগাড়ে বইছে তুমুল ঝড়ো হাওয়া। বাদল দিনের চিরায়ত রূপ, অঝোর বারিধারা। এসময় টানা বর্ষণে ভরা পূর্ণিমার গলগলে চাঁদটাও মাঝ আকাশে হেলে পড়েছে। পৃথিবীর পানে মেলে ধরেছে তার স্নিগ্ধ সৌন্দর্য। বৃষ্টির ঝাপটা আর ঝলমলে রূপোলী চাঁদের আলোয় রহস্যময় হয়ে উঠেছে এ জনপদের মেঠোপথ, রাস্তা-ঘাট আর ফসলের মাঠ। 

দূরের পূব আকাশে এখনো বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, একের পর এক। পরক্ষণেই গর্জে উঠছে সারি সারি ধূসর মেঘ। এসময় খাল-বিলের কৈ মাছগুলো আনন্দের আতিশয্যে উঠে বসছে ডাঙায়, ধানক্ষেতে। এদের শিকারে মৃদু টর্চ হাতে শান্ত পায়ে এগিয়ে আসে শিকারীরা। তাদের সবার ভেতরই চাপা উত্তেজনা। কে কার চেয়ে বেশি ধরবে, শুরু হয় প্রতিযোগিতা!

দুঃসাহসী এসব মানবের মাঝে ভয় নেই। নেই বর্ষার এমন নিশুতি রাতে বাজ পড়ার শঙ্কা। মাছ ধরার আনন্দে এসময় মগ্ন থাকে তারা। ভুলে যায় এসব কথা। তবে, এমন ভৌতিক অন্ধকারে এক অতিপ্রাকৃতিক আতঙ্ক তাড়া করে তাদের। কারা তারা? রাতের আঁধারে ঘুরে বেড়ানো রহস্যময় নেকড়ে মানব! যারা বর্ষার ঠাণ্ডা মৌসুমেও অন্তরে কাঁপন ধরায়। শীতল শিহরণ জাগায় হৃদয়-আত্মায়!

চাঁদের রূপোলী আলোয় মাছ শিকার; ছবি সূত্র: Village Fishing

কারা তারা?

১৮২৩ সাল। টেনেরিফ দ্বীপ, স্পেন।

অভিজাত কৃষক পরিবারে জন্ম নেয় শিশু পেট্রাস গনসালভাস। জন্মের কয়েকমাসের মাথায় যার শরীরের একাংশে দেখা দেয় ভিন্নতা, গজায় অসংখ্য লোম। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে এরা। বৃদ্ধি পেতে থাকে এদের ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। একসময় লোমের আবরণে ছেয়ে যায় তার পুরো দেহাবয়ব। যেন গভীর জঙ্গল থেকে উঠে এসেছে ভয়ংকর এক বন্য প্রাণী।

বয়স যখন দশ, তখন পেট্রাসকে নিয়ে আসা হয় ফ্রান্সের মনোরম শহর প্যারিসে। উপহারস্বরূপ প্রদান করা হয় রাজা হেনরি তৃতীয়কে। উদ্দেশ্য– রাজ সভাসদদের বিনোদন দেওয়া। মাতিয়ে রাখা আনন্দ-উল্লাসে। একদিন রাজাও পেট্রাসকে দেখে হন বেজায় খুশি। তার সঙ্গে হাসি-আনন্দে কাটাতে লাগলেন সময়। এসময় সে জনসম্মুখে পরিচিতি পায় ‘ক্যানারিয়ান ওয়্যারউলফ’ নামে।

কাটতে লাগলো সময়। একসময় কৈশোর থেকে যৌবনেও পদার্পণ করে পেট্রাস। আবদ্ধ হন বিয়েরও বন্ধনে। স্ব-ইচ্ছায় তাকে প্রণয়ের ডুরে বাঁধেন অভিজাত ঘরের মেয়ে লেডি ক্যাথরিন। একে একে তাদের কোল আলোকিত করে জন্ম নেয় সাত সন্তান। কিন্তু বিধাতার খেল বোঝা মুশকিল! কেননা, এদের চারজনই পেয়ে বসে পেট্রাসের গঠন। বিদঘুটে লোমে ছেয়ে যায় তাদেরও দেহ। ধারণা করা হয়, রূপকথার  ‘বিউটি এন্ড দ্য বিস্ট’ কাহিনীটি লেখা হয়েছিল এই পেট্রাস-ক্যাথরিন দম্পতির জীবনের করুণ বাস্তবতায়৷

পেট্রাস গনসালভাস ও লেডি ক্যাথরিন; ছবি সূত্র: livescience.com

পরবর্তী ঘটনা

সময়টা ১৮৬৫ সাল। ফ্রান্সের লাইওন শহরে লেখক স্যাবিন বারিং গোল্ডের মাথায় এবার উঁকি দিচ্ছে ভিন্ন চিন্তা। ভাবছেন– নেকড়ে মানবদের নিয়ে লিখে ফেলবেন নাকি এক অনন্য বই? যেখানে দেখানো যাবে তাদের বিচিত্র জীবনের সত্যিকার সুর-রস-ছন্দ। বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকা করুণ মূহুর্তগুলো। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। সে বছরের শেষ নাগাদ লিখে সম্পন্ন করেন বইটির কাজ। তুলে ধরেন তাদের জীবনের অন্তরালের বিবর্ণ যত উপাখ্যান। বইটির নাম– দ্য বুক অব ওয়্যারউলভস।

বইয়ের প্রচ্ছদে তিনি উপস্থাপন করেন এক নেকড়ে মানবীর লোমশ প্রতিচ্ছবি। সেখান থেকে অনুমেয়, বইটি তিনি লিখেছেন পেট্রাস দম্পতিরই কন্যা  অ্যান্টোনিয়েটা গনসালভাস-এর বাস্তবিক জীবনকে ঘিরে। উৎসর্গও করেছেন তাদেরই। কেননা, বাবার মতো সেও আক্রান্ত ছিল বিবর্ণ হাইপারট্রাইকোসিস সিনড্রোমে।

তারপর? তারপর চিত্তাকর্ষক এসব বই ও পৌরাণিক কাহিনীর সংস্পর্শে রোমাঞ্চকর মুভি-সিরিজেও ঢুকে পড়ে রোমহষর্ক নেকড়ে মানব চরিত্র। যেখানে তাদের দেখানো হয়– দিনের বেলা দিব্যি ভালো মানুষের মতো ঘুরে-ফিরে তারা। কিন্তু, পূর্ণিমার ঝলমলে রাত হলেই পাল্টে যায় তাদের চেহারা। বদলে যায় দেহাবরণ। হয়ে উঠে একেকজন দুর্ধর্ষ দানবীয় নেকড়ে মানব।

ভাবছেন কীভাবে হয় এমনটা? মুভি-সিরিজে ল্যাবরেটরী থেকে ছড়িয়ে পড়া মারাত্মক এক ভাইরাসের সংক্রমণে সুস্থ মানুষ পরিণত হয় নেকড়েতে। কিন্তু বাস্তবে এসবের পেছনে লুকিয়ে থাকে সত্যিকার রহস্য– জেনেটিক রোগ হাইপারট্রাইকোসিস। মারাত্মক এই রোগের কারণেই সুস্থ মানুষ পরিণত হয় হিংস্র নেকড়েতে।

বইয়ের প্রচ্ছদে অ্যান্টোনিয়েটা গনসালভাস; সূত্র: itunes.apple.com

কেন হয় এই রোগ?

প্রাগৈতিহাসিক কালে মানুষের পূর্ব পুরুষ আদি-মানবদের শরীরও ছিল ভয়ংকর লোমশ। পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের নিমিত্তেই হয়েছিল এমনটা। সময়ের কাল-প্রবাহে, বিবর্তনের ধারায় ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে তা। কমে এসেছে গাত্রবর্ণে লোমের পরিমাণ। অতিরিক্ত লোম বৃদ্ধির জন্য দায়ী এই জিন বিবর্তনের ফলশ্রুতিতে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হয়ে পড়ে নিস্ক্রিয়।

কিন্তু বিরল রোগ কনজেনিটাল হাইপারট্রাইকোসিস এর মূল কারণ– লোম বৃদ্ধির জন্য দায়ী এসব জিনের পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠা। অজানা কারণেই ছোট্ট ফিটাস গর্ভে থাকাবস্থায় লোম বৃদ্ধির জন্য দায়ী এসব জিন হয়ে উঠে সক্রিয়। সদ্য ভূমিষ্ট শিশুর শরীরজুড়ে গজায় অসংখ্য লোম। পরবর্তীতে এদের বৃদ্ধি এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। একসময় এই রোগটিই পরিচিতি পায় ওয়্যারউলফ সিনড্রোম নামে।

এ ধরনের রোগে মানব শরীরের বিভিন্ন অংশ– মুখমণ্ডল, ঘাড়, পিঠ, উড়ু লম্বা-ঘন লোমে ঢাকা পড়ে। আক্রান্ত পুরুষদের ক্ষেত্রে মুখমন্ডল এবং চোখের পাতা ছেয়ে যায় ঘন লোমে। আর নারীদের ক্ষেত্রে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গজিয়ে ওঠে গুচ্ছ গুচ্ছ লোম।

এখন অবধি বিশ্বব্যাপী বিরল এই রোগের মাত্র ১০০টি রেকর্ড শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এ থেকে সহজেই বোঝা যায়, কতটা দুর্লভ এই রোগের প্রাদুর্ভাব। ১৯৯৫ সালে ১১ বছর বয়সী এক থাই বালিকার নাম “দ্য ওয়ার্ল্ড’স হেয়ারিয়েস্ট চাইল্ড” হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ডে।

দ্যা ওয়ার্ল্ড’স হেয়ারিয়েস্ট চাইল্ড; ছবি সূত্র: livescience.com

গবেষণার ফলাফল

এখন অবধি বিরল এ সিনড্রোমের পেছনের অনুঘটক জিনটি পুরোপুরি আবিষ্কৃত হয় নি। যা নিয়ে গবেষণাও হচ্ছে খুবই অপ্রতুল। কেননা, বিদঘুটে এ সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যাও বেশ কম।

তবে সম্প্রতি হিউস্টনের বেলর কলেজ অফ মেডিসিনের মলিকিউলার জেনেটিসিস্ট প্রগ্না আই প্যাটেলের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক দলের সদস্যরা রিপোর্ট করেছেন বিখ্যাত নেচার জেনেটিক্স জার্নালে। সেখানে তারা লিঙ্গ-নির্ধারক X ক্রোমোজোমের ছোট একটি অঞ্চলে জিনটির অবস্থানকে খুঁজে পেয়েছেন। যা গবেষকদের মনে জাগিয়েছে আশার সঞ্চার। তবে, সুনির্দিষ্ট অবস্থান শনাক্তের জন্য তাদের অনুসন্ধান রয়েছে এখনো চলমান।

এছাড়াও, বংশগতির প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে তারা নির্ধারণ করতে সমর্থ হয়েছে যে, চুলের বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে একটি এক্স-লিঙ্কযুক্ত প্রভাবশালী বৈশিষ্ট্য। এর ফলে পুরুষরা জিনটি শুধুমাত্র কন্যাদের কাছে প্রেরণ করতে সক্ষম হলেও নারীরা এটি কন্যা এবং পুত্র উভয়ের কাছেই পৌঁছাতে পারে। 

চিকিৎসা পদ্ধতি

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বিবর্ণ এই রোগের বিপরীতে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয় নি। ধরা দেয় নি একে সমূলে উৎখাতের সত্যিকার রহস্য। জেনেটিক রোগ হওয়ায় উপযোগী প্রতিরোধ ব্যবস্থাও গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। তাহলে উপায়?

উপায় হিসেবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কিছু বিষয় যেমন– লোম বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পৃক্ত ওষুধ সেবন থেকে বিরত থাকা চাই। এছাড়াও কিছু কাজ যেমন– শেভিং, ওয়্যাক্সিং, হেয়ার ব্লিচিং-এর মাধ্যমেও কিছুটা হলেও পাওয়া যাবে স্বস্তি।

শেভিং-এর মাধ্যমে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়; ছবি সূত্র: greeklegends

পরিশেষে

শুধু পেট্রাস গনসালভাস পরিবারই নয়, বীভৎস এ রোগে মেক্সিকান সংগীতশিল্পী জুলিয়া পেস্ট্রানা, আমেরিকান ক্রাও ফারিনি এবং ভারতীয় যুবক লালিত পালিতদারও ছিলেন আক্রান্ত। তাদের দুর্বিষহ জীবন এখনো ভাবায় অনেককে।

হয়তো সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হবে জেনেটিক এ রোগের হিংস্রাত্মক প্রকোপ। আর সেদিন-ই বীভৎস নেকড়ে মানবের রোমহষর্ক ঘটনা বাস্তব জীবন থেকে হারিয়ে চিরদিনের জন্য ঠাঁই পাবে রহস্য ও রোমাঞ্চকর রূপকথার ভুবনে!~

তথ্যসূত্র:

লেখাটি 67-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading