মাংকিপক্সের আদ্যোপান্ত

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

গেল ক’বছর পূর্বেই বিশ্ব দরবারে প্রানহানি থাবা বসিয়েছিল মরণঘাতী করোনা ভাইরাস। সেকালের কোভিড ১৯ এর ক্ষয়ক্ষতি বর্তমান বিশ্বের আলোকে দেখলে আজও অপূরণীয়। করোনার পরে আরোও কিছু ভাইরাসের এই পৃথিবীতে আনাগোনা হলেও এতোটা বিভীষিকার জন্ম তেমন কোনোটাই দেয়নি। তবে সম্প্রতি এমপক্স (mpox) নামে ভাইরাস নিয়ে উত্তাল হয়ে আছে পৃথিবীবাসী। হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলো এই এমপক্স? এর লক্ষণ, প্রতিকার, টিকা সম্পর্কে কতটুকু তথ্য দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা? নিজের ব্যাক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং পরিবার, বন্ধুদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে নিবন্ধটি মনোযোগ দিয়ে পড়ার অনুরোধ রইলো।

এমপক্স/ মাংকিপক্স কী?

মাংকিপক্স বা সংক্ষেপে এমপক্স (mpox- monkey pox) ভাইরাস। এটা অর্থোপক্স গণের অন্তর্ভুক্ত দ্বিসুত্রক ডিএনএ ভাইরাস। বাইরের আবরণটা লিপিডে মোড়ানো। এরা গুটিবসন্ত এবং জলবসন্ত পরিবারেরই আরেক সদস্য। গুটিবসন্তের মতো এটাও তীব্র সংক্রামক এবং মূলত আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে, মধ্য আফ্রিকা এবং পশ্চিম আফ্রিকার ভেতরকার বিভিন্ন পশুপাখির মধ্যে ছড়ায়। এরা জুনোটিক ভাইরাস। জুনোটিক মানে ‘অন্য প্রাণী থেকে মানুষে’ বা ‘মানুষ থেকে অন্য প্রাণীতে’ যেতে পারে এমন ভাইরাস। অর্থাৎ পোষক পরিবর্তন করতে পারে। ইতঃপূর্বে বানর, ইঁদুর, কাঠবিড়ালির মতো প্রানীতে এই এমপক্সের সংক্রমণ দেখা গেলেও হঠাৎ করেই এর উপস্থিতি দেখা মেলে অসংখ্য মানুষের শরীরে!

মাংকিপক্স ভাইরাসের গঠন।

ফলস্বরূপ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরী অবস্থা জারি করে। গবেষকদের মতে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো এই ভাইরাস মধ্য আফ্রিকা ও পশ্চিম আফ্রিকায় ব্যাপকহারে ছড়িয়েছে এবং গত ১৫ই আগস্ট সুইডিশ হেলথ অফিশিয়াল জানিয়েছে- আফ্রিকার পর বিশ্বে প্রথমবারের মতো সুইডেনে হানা দিয়েছে এমপক্স। ২০২৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৩ই আগস্ট প্রায় সতেরো হাজারেরও বেশি কেস এসেছে আফ্রিকার রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার সংস্থা এসিডিপির কাছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে কেবল আফ্রিকার কঙ্গোতেই প্রায় ১৫,৬৬৪টি এম পক্সে আক্রান্ত রোগীর খবর এসেছে যার ভেতর ৫৩৭ জন মৃত্যুবরন করেন এবং এই সংখ্যাটি ২০২৩ সালের রেকর্ডও ভেঙে ফেলে। এছাড়াও প্রায় ১১টি আফ্রিকান দেশে এম পক্স ছড়িয়েছে। তবে এর মধ্যে কেন্যা, রোয়ান্ডা, বুরুন্ডি এবং উগান্ডায় আগে কখনো এম পক্স দেখাই দেয়নি!

এমপক্স কত ধরনের?

এ যাবত এমপক্সের দুটি ধরণ আবিষ্কৃত হয়েছে। ক্লেড ১, ক্লেড ২। এই দুই ক্লেডের ভেতর আবার সাব ইউনিট এ, বি আছে।

ক্লেড ১: এটা এমপক্সের সবথেকে ভয়াবহ জাত। অসুখ এবং মৃত্যুহার অত্যাধিক হারে বেড়ে যায় ক্লেড ১-এ। গবেষণায় উঠে এসেছে ,এমপক্স ক্লেড ১- এ আক্রান্তদের ভেতর প্রায় ১০% মানুষ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত। ক্লেড ১ এর সাব ইউনিট ক্লেড এলবি, বর্তমান ক্ষয়ক্ষতির অন্তরায়। তবে জোনাস আলবারনাজের মতে “ক্লেড ১ এর এই সাবইউনিট ক্লেড ১ এর থেকে বেশি ভয়াবহ কিনা তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।” সেন্ট্রাল আফ্রিকাতে এমপক্সের এই ধরনটি এন্ডেমিক।

ক্লেড ২: এটি ক্লেড ১ এর মতো এতোটা ক্ষতিকর নয়। এতে প্রাণ নাশের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ৯৯.৯% মানুষ এম পক্সের এই প্রকারভেদে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে যায়। ক্লেড-২ ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন ফেলেছিল এবং এটি পশ্চিম আফ্রিকার এন্ডেমিক।

কীভাবে এমপক্স নিশ্চিত হবেন?

এমপক্সের যেই ধরনেই আক্রান্ত হোন না কেন, শরীরে কিছু না কিছু লক্ষণ প্রকাশ পাবেই। সাধারণত এমপক্স শরীরে প্রবেশ করার এক সপ্তাহের মধ্যে এই লক্ষণগুলো দেখা দেয়। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক-

র‍্যাশ: সাধারণ পক্সের মতন এমপক্সেও শরীরের র‍্যাশ ওঠে। প্রথমদিকে শরীরে কালশিটে দাগ হলেও পরবর্তীতে সেই দাগ ফোস্কায় রুপ নেয় এবং ফোস্কাগুলো হয় অত্যান্ত যন্ত্রনাদায়ক। ফোস্কা গুলো বেশ চুলকায়, ব্যাথাও হতে পারে। প্রথমদিকে মুখেই অধিক হারে র‍্যাশ দেখা যায়। ভুক্তভোগীর কেউ কেউ বলেছেন, তারা যৌনাঙ্গ এবং পায়ুপথেও র‍্যাশের যন্ত্রণায় ভুগেছেন।

এছাড়া আরও কিছু লক্ষণ যেমন-

  • জ্বর
  • মাথাব্যাথা
  • মাংসপেশিতে ব্যাথা
  • কোমর ব্যাথা
  • লিম্ফনোড ফুলে যাওয়া
  • ক্লান্তি ভাব

মানুষ ভেদে লক্ষণগুলো কম-বেশি হতে পারে। কারও কারও আবার কোনো লক্ষণই প্রকাশ পায় না। আবার উপরের লক্ষণগুলো কারও থাকলেই যে এম পক্স হবে তা কিন্তু না। অন্য কোনো পক্সও হতে পারে। অনেকের আবার দেখা গেছে সব লক্ষণ প্রকাশ পায় না, কেবল র‍্যাশ দেখা দেয়। যাইহোক না কেন, উপরের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া মাত্রই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে রক্ত পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হওয়া উচিত।

এমপক্স ছড়ায় কি করে?

এমপক্সে আক্রান্ত হয়েছে এমন রোগীর খুব কাছাকাছি থেকে বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করলে সুস্থ যেকোনো ব্যাক্তি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। যেমন: এম পক্সে আক্রান্ত ব্যাক্তি যদি তার সুস্থ সঙ্গীকে চুমু দেন, সেক্ষেত্রে সঙ্গীও এম পক্সে আক্রান্ত হবেন। তাছাড়া আক্রান্ত ব্যাক্তির সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত থাকা, একই বিছানার চাদর ব্যবহার করা, ক্রমাগত স্পর্শ করা, একই বাসন ব্যবহার করা ইত্যাদি কার্য সম্পাদনের মাধ্যমেও এমপক্স ছড়াতে পারে। শিশুদের (বিশেষ করে ১৫ বছরের নিচে), গর্ভবতী নারীদের এবং যাদের শরীর কোনো কারণে রোধ প্রতিরোধ ক্ষমতায় পিছিয়ে তাদের এমপক্সে আক্রান্ত হওয়ার এবং কঠিন ভুক্তভোগী হওয়ার সম্ভাবনা অন্য সকলের থেকে বেশি। অন্যদিকে পশুপাখি থেকেও মানুষের দেহে এমপক্সের ভাইরাস ছড়াতে পারে। আক্রান্ত পশু পাখির কোনো সুস্থ মানুষকে আচড় দিলে, কামড় দিলে, তাদের রক্ত গায়ে লাগলে বা অন্য যেকোনো ধরনের সংস্পর্শে পশু থেকে এই ভাইরাস মানুষে ছড়াতে পারে।

এমপক্সের প্রতিরোধ ও প্রতিকার

এমপক্স সাধারণত নিজ থেকেই চলে যায়। বিপাকে পড়েন কেবল যাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল। যেহেতু মাংকিপক্সকে দূর করার মতো অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা এখনো বের হয়নি ,তাই চিকিৎসকেরা রোগীকে এ জাতীয় কোনো ঔষধ দেন না। তবে আক্রান্ত ব্যক্তি মাত্রাতিরিক্ত অসুস্থ হলে, অন্যান্য পক্সের (যেমন স্মল পক্স) অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ দেওয়া হয়।

তবে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে এমপক্স থেকে সহজেই রেহাই পাওয়া সম্ভব। যেমন-

  • এমপক্সে আক্রান্ত রোগীর নিকট সংস্পর্শ পরিহার করা।
  • আক্রান্ত ব্যাক্তির সাথে যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হওয়া যাবে না।
  • আক্রান্ত পশুপাখিকে আলাদা রাখতে হবে। তাদের বেশি কাছে যাওয়া যাবে না।
  • আক্রান্ত ব্যাক্তির সাথে একই বিছানার চাদর এবং অন্যান্য জিনিস ভাগাভাগি করা যাবে না।
  • আক্রান্ত ব্যাক্তির ব্যবহার করা জিনিস এমনকি ইনজেকশন ব্যবহার করা যাবে না।
  • এমপক্সের প্রকোপ বেশি যেসব এলাকা সেসব এলাকায় যাওয়া থেকে বিরত থাকা।
  • মাস্ক পরিধান করুন এবং এমপক্সে আক্রান্ত হলে অবশ্যই কোয়ারেন্টিনে থাকুন।
  • ফোস্কাগুলোতে বারবার স্পর্শ করা এবং চুলকানো থেকে বিরত থাকুন।

এমপক্সের টিকা

এমপক্সের টিকা আছে। এই টিকার দুটো ডোজই যথেষ্ট। এছাড়াও গবেষণায় প্রমানিত হয়েছে যে- স্মল পক্সের জন্য যেই ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয়, তাও এমপক্স সারাতে সক্ষম।
কিন্তু অন্যান্য ভাইরাসের মতো এমপক্স ভাইরাসও প্রতিনিয়ত নিজের জৈবিক পরিবর্তন করছে। তাই নতুন এমপক্সের ভ্যারিয়েন্টে পুর্ববর্তী টিকা কিংবা স্মল পক্সের টিকা শতভাগ কার্যকরী না-ও হতে পারে। আরও একটা ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে সেটা হচ্ছে- কেবল আক্রান্ত হবার পর আপনার অসুখের সীমা অতিক্রম হলেই কেবল টিকার আশ্রয় নিবেন। তাছাড়া এই পক্স নিজে থেকেই সেরে যাবে।

আজ এ পর্যন্তই। সম্পূর্ণ পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

তথ্যসূত্র-







বিজ্ঞান নিউজলেটার

যুক্ত হোন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান নিউজলেটারে!
আমরা সাপ্তাহিক ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। 
এ নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। থাকবে নতুন লেখার খবরও।


Loading

লেখাটি 81-বার পড়া হয়েছে।

ইউটিউব চ্যানেল থেকে

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য লেখা


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

বিজ্ঞান অভিসন্ধানী: পঞ্চাশ জন বিজ্ঞান লেখকের লেখা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই ই-বুকটি। আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে শুরু করে ডিএনএর রহস্য, গণিত, এমনকি মনোবিজ্ঞানের মতো বিশাল বিষয় ব্যাপ্তির পঞ্চাশটি নিবন্ধ রয়েছে দুই মলাটের ভেতরে।
বিজ্ঞান অভিসন্ধানী: আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে শুরু করে ডিএনএর রহস্য, গণিত, এমনকি মনোবিজ্ঞানের মতো বিশাল বিষয় ব্যাপ্তির পঞ্চাশটি নিবন্ধ রয়েছে দুই মলাটের ভেতরে। ।