বিজ্ঞানী না হয়েও দারুণ বিজ্ঞান ভাবনা

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

কে বলেছে যে বিজ্ঞানে অবদান রাখতে আপনাকে বিজ্ঞানী হতে হবে? আমাদের মানবসভ্যতায় কিছু উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এমন কিছু ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের কাছ থেকে এসেছে, যারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগের চেয়ে তাদের শৈল্পিক এবং সাহিত্যিক অবদানের জন্য বেশি পরিচিত। আজকের ব্লগপোস্টে আমরা এমনি ৩ জনের ব্যাপারে জানবো, যারা হয়ত জীবনে কোনো দিন কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ বা গবেষণা করেও দেখেননি, কিন্তু বিজ্ঞান ভাবনায় তারা ছিলেন যে কারও তুলনায় অগ্রগামী। তাঁরা একদিকে যেমন বিজ্ঞানকে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছিলেন, তেমনি বদলে দিয়েছেন আমাদের বিজ্ঞান ভাবনাও। চলুন, শুরু করা যাক!

জুল ভার্ন

আমাদের জীবনের প্রথম পড়া সায়েন্স ফিকশনগুলো ছিল কিংবদন্তি লেখক জুল ভার্নের লেখা। পড়েছি তার ঐসব গল্প, যেগুলো সযত্নে শামসুদ্দীন নওয়াব অনুবাদ করেছেন। যেমনঃ রহস্যের দ্বীপ, সাগর তলে ইত্যাদি। ভার্নের প্রভাব সাহিত্য এবং চলচ্চিত্রের বাইরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতেও ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে। আর এভাবে তিনি বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক এবং অনুসন্ধানকারী প্রজন্মকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। বৈজ্ঞানিক কল্পগল্পের জনক কে, সেটা নিয়ে অনেকের অনেক মন্তব্য থাকলেও জুল ভার্নকে এক প্রকার ‘সায়েন্স ফিকশনের বাপ’ বলাই যায়। 

জুল ভার্ন

জার্নি টু দ্য সেন্টার অফ দ্য আর্থ (১৮৬৪), ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন (১৮৬৫) এবং টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি (১৮৬৯-৭০) এর মতো বইগুলো যেকোনো পাঠককে বিজ্ঞান নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখাবে। এখানেই শেষ নয়। উনিশ শতকে বসে তিনি লেখেন ‘প্যারিস ইন দি টুয়েনটি সেঞ্চুরি’, আর পরবর্তী শতকেই বিশ্ববাসী ফ্রান্সের এই রাজধানী শহরে সেই বইয়ে করা ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যেতে দেখে। প্যারিসে আসে ফ্যাক্স মেশিন, উচ্চগতির ট্রেন, ইন্টারনেট ইত্যাদি। এগুলোর অনেক কিছুর ব্যাপারেই ঐ বইতে জোরালো ইঙ্গিত দেওয়া হয়। আর এসব প্রযুক্তিগত অগ্রগতি চাক্ষুস ঘটতেও দেখে পাঠকেরা। 

‘ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন’ বইটারও একটা বিশেষত্ব ছিল। এই বইতের জুল ভার্ন মহাকাশভ্রমণের ধারণা দেন, যা প্রায় ১০৪ বছর পর বাস্তবে রূপ নেয়। সেই যাত্রায় নভোচারীর সংখ্যা, স্পেন্সশিপের আকার ও নভোচারীদের ওজনহীনতার অনুভূতি নিয়ে তিনি যেসব তথ্য দিয়েছিলেন, তা প্রায় হুবহু মিলে যায়। একইভাবে তিনি বেশ কিছু উদ্ভাবন সম্পর্কে লিখেছিলেন; যেগুলো তার সময়ে কাল্পনিক ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে বিজ্ঞানের উসিলায় সেগুলো বাস্তবতার মুখ দেখেছিল। 

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি 

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির নাম শোনেননি, এমন পাঠক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! বেশিরভাগ মানুষ তাঁকে চিত্রশিল্পী হিসেবেই চিনে থাকলেও, তিনি একজন দারুণ স্বপ্নদ্রষ্টা ও চিন্তাবিদ ছিলেন। তিনি গ্লাইডার, প্যারাসুট, উড়োজাহাজ এবং হেলিকপ্টারের ছবি এঁকেছিলেন, যা এক দিন সভ্যতার মানুষজন চাক্ষুস দেখতে পায়। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, রসায়ন, ভূতত্ত্ব, জ্যামিতি, হাইড্রোডাইনামিক্স, যান্ত্রিক প্রকৌশল, আলোকবিদ্যা, পাইরোটেকনিক এবং প্রাণীবিদ্যায় ওনার অবদান ছিল। 

Leonardo da Vinci | Biography, Art, Paintings, Mona Lisa ...
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি

এমনকি ভিঞ্চি রোবটিক যোদ্ধার ছবিও এঁকেছিলেন বলে জানা যায়। তিনি চোখের সকেট, মানুষের পেশী এবং কঙ্কালের সিস্টেম সহ শরীরের বিভিন্ন অংশ আঁকতে ১৪৮৯ সালে মানুষের অঙ্গসংস্থান ও শারীরবিদ্যা নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। এই সিস্টেমগুলি সম্পর্কে জানার জন্য দ্য ভিঞ্চি প্রায় ৩০টি মৃতদেহ কাটাকুটি করেছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর মৃত্যুর পরে বিজ্ঞানীরা ওষুধের অগ্রগতি সাধনের জন্য তার অঙ্কনগুলো থেকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সক্ষম হন যে কীভাবে মানবদেহ কাজ করে।

সুইস ব্রিজ নির্মাতারা একটি সেতুর জন্য দ্য ভিঞ্চির নকশাগুলো ব্যবহার করেছিলেন। ভিঞ্চি গিয়ার এবং ক্র্যাঙ্ক সিস্টেম ডিজাইন করার কাজ করেছিলেন, যা পরে ঘড়ি থেকে ইঞ্জিন পর্যন্ত বিভিন্ন ডিভাইসে প্রয়োগ করা হয়েছিল। এমনকি তিনি ঘনীভূত সৌর শক্তি ব্যবহার এবং প্লেট টেকটোনিক্স নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দিয়েছিলেন। এতো বিশাল সব অবদান রাখার পরেও লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি তেমন কোন কৃতিত্ব বা সম্মাননা পাননি।

আইজ্যাক আসিমভ

আইজ্যাক আসিমভকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়, রোবোটিক্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে যার প্রভাব অপরিসীম। তাঁর যেই বইটার কথা না বললেই নয়, সেটি হলো ‘আই, রোবট’। ইংরেজী ভাষায় লেখা এই কল্পকাহিনীর সাথে রোবট তৈরির একটা সম্পর্ক আছে। কারণ বইতে তিনি ‘রোবটিক্সের নীতি’ নিয়ে যেই কথাগুলো বলেছিলেন, সেগুলোর উপর ভিত্তি করে রোবট তৈরি করা। 

আসিমভের ঐ বইতে ৩টি নীতি ছিল। প্রথমত, রোবট কখনো মানুষকে আঘাত করবে না বা মানুষের ক্ষতি করবে না। দ্বিতীয়ত, প্রথম নীতি মেনে রোবট অবশ্যই মানুষের আদেশগুলো মেনে চলবে। তৃতীয়ত, প্রথম আর দ্বিতীয় নীতি মেনে রোবট নিজেদেরকে যথাসম্ভব রক্ষা করবে। এই নৈতিক ব্যাপারগুলোকে গুরুত্ব দিয়েই বড় বড় জরুরি রোবটগুলো তৈরি করা হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করে থাকেন যে এই নীতিগুলো ঠিকমতো বাস্তবায়িত না হলেই মানবসভ্যতা প্রযুক্তির বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। 

Isaac Asimov | Biography & Facts | Britannica
আইজ্যাক আসিমভ

খেলা এখানেই শেষ নয়। আইজ্যাক আসিমভের ‘সাইকোহিস্ট্রি’ বিষয়ক ধারণারও অনেক গুরুত্ব রয়েছে আজকের রোবটিক্সের জগতে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, ইতিহাস, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদিন সমন্বয়ে গোষ্ঠীর ভবিষ্যত আচরণ সম্পর্কে সাধারণ ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারার ব্যাপারটাই হলো ‘সাইকোহিস্ট্রি’। জর্জিয়া টেক স্কুল অফ ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এর রোবট বিশেষজ্ঞ ম্যাগনাস এগারস্টেড বলেন যে এই ধারণা তাকে মুগ্ধ করেছে। সেই সাথে তার প্রতিষ্ঠানের সহকর্মী এবং শিক্ষার্থীরা রোবটিক্স নিয়ে নতুন কিছু করার অনুপ্রেরণাও পেয়েছে। 

আসিমভের প্রোগ্রামিং বিষয়ক বর্ণনা কোডার এবং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদেরকে বিভিন্ন নৈতিক প্রশ্নের ব্যাপারে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রথম সুস্পষ্টভাবে ‘রোবোটিক্স’ শব্দটি ব্যবহারেরর পাশাপাশি তিনি কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোলের উপর ‘দ্য কোলাপসিং ইউনিভার্স: দ্য স্টোরি অব ব্ল্যাক হোলস’ নামের একটি জনপ্রিয় বইও লিখেছিলেন, যেখানে বিভিন্ন মহাজাগতিক ব্যাপার-স্যাপার গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছিলেন। 

তুলির শেষ আঁচড়

এতক্ষণ যেই তিন জনের কথা বললাম, তাঁদের হয়ত খুব বড় কিছু আবিষ্কার করেননি, কিন্তু যেভাবে পথ দেখিয়েছেন বা শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে লেখক-গবেষকদেরকে ভাবিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। শুধু তাঁরাই নন, একইভাবে অ্যাডগার অ্যালান পো, বিয়াট্রিক্স পটার এবং জন স্টেইনবেকের মতো মানুষেরাও রেখেছেন ছোট-মাঝারি উল্লেখযোগ্য অবদান। বিজ্ঞানকে নতুন করে উপলব্ধি করতে এ ধরণের মানুষদের ভূমিকার কোনো তুলনা হয় না। 

আপনিও যদি এরকম কোনো স্বপ্নদ্রষ্টার নাম বা অবদান জেনে থাকেন, তাহলে কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু!  

তথ্যসূত্র

লেখাটি 97-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ২০% ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

নতুন লেখার খবরাখবর ছাড়াও বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে দুইটি ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে নতুন লেখার পাশাপাশি বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে।







Loading