সমুদ্র এমন একটা অদ্ভুত গবেষণাগার যেখানে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবর্তন থেকে বিশাল বড় পরিসরে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সাধারণ ভাষায় একে বলে স্কেল (scale)। সমুদ্রে মিলিমিটার বা সেন্টিমিটার স্কেলের ক্রিয়াপ্রক্রিয়া যেমন পরিলক্ষিত হয়, ঠিক তেমনি এখানে হাজার হাজার কিলোমিটার জুড়ে পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যায়। এই পরিবর্তন কে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ভ্যারিয়াবিলিটি (variability)। মজার ব্যপার হল, ডমিনো ইফেক্ট এর মতো করে এই ছোটো স্কেলের ঘটনাগুলোই আস্তে আস্তে বড় স্কেলের পরিবর্তন এর দিকে ধাবিত হয়।
উদাহরণস্বরূপ, নিচের ছবিতে (ছবি-১) আমরা বিভিন্ন স্কেলের একটা ম্যাপের মাধ্যমে বুঝানোর চেষ্টা করছি যে, ছোট ছোট ঘুর্ণনস্রোত (~১ মিটার) সমুদ্র মোহনার লবণ স্তরায়ন (~১০ মিটার) বা স্রোতের বিন্যাস প্রভাবিত করে, যা পরবর্তিতে সেই মোহনা বায়োলজিক্যাল সক্রিয়তা হেরফের করতে সক্ষম। যখন আমরা একটু বড় স্কেলের দিকে তাকাই, আমরা দেখবো ১০-৫০০ কিলোমিটার জুড়ে ঘূর্ণাবর্ত স্রোতের বিন্যাস (eddy) এক সমুদ্র থেকে আরেক সমুদ্রে পুষ্টি, লবণ, খনিজ, এবং শক্তি পরিবহন করে নিয়ে যায়। এছাড়াও ঐতিহাসিকভাবে নাবিকরা সবসময়ই প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি এই স্রোতের বিন্যাসের উপর নির্ভরশীল ছিল। উদাহরণ হলো, গালফ স্ট্রিম (Gulf stream) কারেন্ট, ফ্রাম প্রণালী (Fram Strait) কারেন্ট, ইত্যাদি। তবে এর চেয়ে বড় পরিসরেও সমুদ্রে পরিবর্তন ঘটে (~১০০০ কিলোমিটার থেকে ~১০,০০০ কিলোমিটার) যা শুধু একটা সীমিত এলাকাকেই যে প্রভাবিত করে তা নয়, বরং পুরো পৃথিবীর জলবায়ু, তাপমাত্রা, লবনাক্ততা, উৎপাদনশীলতা নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন উত্তর মেরুতে বছর জুড়ে বরফের আস্তরণের (sea ice extent) হেরফের সরাসরিভাবে আমেরিকা, ইউরোপ, এবং উত্তর এশিয়ার দেশগুলোর জলবায়ু এবং আবহাওয়াকে প্রভাবিত করে (Vihma 2014)।
সমুদ্রে বড় স্কেলের পরিবর্তনের জন্য অন্যতম দায়ী হলো তাপমাত্রা। এই কারণে ছোট একটা জায়গায় তাপমাত্রার পরিবর্তন কীভাবে ঘটে, এটা যদি আমরা ভালোভাবে বুঝতে পারি, তাহলে বড় স্কেলে সাগর-মহাসাগরে পরবর্তীতে কি ধরনের পরিবর্তন ঘটবে, সেটাও অনুমান করা সহজ হবে। একজন সমুদ্রবিজ্ঞানী হিসেবে আমার আগ্রহের বিষয় হলো সমুদ্রের মোহনায় তাপমাত্রা মাপার চ্যালেঞ্জগুলো নিরূপন করা এবং তাপমাত্রা পরিবর্তনের প্রভাবগুলো বোঝা। এই লেখাতে আমি আমার প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণার প্রেক্ষাপট তুলে ধরবো।
মোহনাঃ সভ্যতার দোলনা
একজন সমুদ্রবিজ্ঞানীর কাছে সমুদ্রের যে কয়টা বিষয় সবচেয়ে আকর্ষনীয় ভাবে ধরা দেয় তাঁর মাঝে মোহনা (Estuary) একদম প্রথম দিকেই থাকবে। সাধারণভাবে বলতে গেলে, একটি মোহনা হল যেখানে একটি নদী বা নদীশাখা সমূহ সমুদ্রের সাথে মিলিত হয়। সাধারণত মোহনায় স্বাদু এবং নোনা জল মিশ্রিত থাকে (যদিও সবসময় এটা সত্যি নয়!)। মোহনাসমূহ পৃথিবীর সবচেয়ে উৎপাদনশীল স্থানগুলির মধ্যে একটি, আরও পরিষ্কারভাবে বললে, প্রতি বছর প্রতি বর্গমিটার এলাকায় মোহনার থেকে বেশি পরিমাণে জৈব পদার্থ পৃথিবীর অন্য কোন জমিতে উৎপন্ন হয় না (Sun, Wang, and Ho 2012)।ঐতিহাসিকভাবেও মোহনাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল প্রাচীন সব সভ্যতা।যেমন, মিশরের সভ্যতা নীলনদের মোহনাকে ঘিরে, মেসপটেমিয়ান, সুমেরিয়, ব্যাবীলনিয়ান সভ্যতা ফুরাত নদীর মোহনায়, সিন্ধু সভ্যতা গঙ্গা-যমুনার উপবাহিকায় ইত্যাদি। এমনকি বর্তমান বিশ্বেও ৩২ টি বৃহত্তম শহরের মধ্যে ২২ টিই বিভিন্ন সমুদ্রের মোহনায় অবস্থিত। স্যাটেলাইট ছবি (ছবি-২) থেকে দেখা যায় যে পুরো বিশ্ব যখন অন্ধকারে ঢাকা, তখনো মোহনা কেন্দ্রিক শহর গুলো জেগে আছে। এছাড়া মোহনাবর্তী অঞ্চলে যে পরিমাণে জৈবিক কার্যক্রম , জীববৈচিত্র্য, উদ্ভিদ-প্রাণীজগতের সমাহার দেখা যায় তা পৃথিবীর অন্যত্র অপ্রতুল (Nichols et al. 1986)।
মোহনায় তাপমাত্রার প্রভাব
জলবায়ু, পরিবেশ সংরক্ষণ প্রচেষ্টা (conservation effort), কৃষি, পর্যটন, এমনকি রাজনৈতিক কারণেও তাই মোহনা নিয়ে প্রতিবছর প্রচুর গবেষণা হয়। আমার পিএইচডি গবেষণার একটি অন্যতম বিষয় হচ্ছে মোহনার তাপমাত্রার দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনের প্যাটার্নকে ব্যাখ্যা করা। গবেষণার বিষয়বস্তর শিরোনাম তাই – Sea surface temperature variability of estuary from remote sensing and in-situ measurement. অর্থাৎ, স্যাটেলাইট এবং অন-সাইট থেকে তাপমাত্রার তথ্য সংগ্রহ করার বৈজ্ঞানিক উপায় এবং পর্যবেক্ষন থেকে ভবিষ্যতের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া। প্রশ্ন হলো, যতগুলো পরিবেশগত সূচক আছে, যেমন, লবনাক্ততা, অস্বচ্ছতা, জোয়ার ভাটা, ক্লোরোফিল, পুষ্টি সেগুলো বাদে কেন তাপমাত্রার দিকে লক্ষ্য করবো আমরা?
এর উত্তর হিসেবে বলা যায় – সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা হল একটি মোহনার মধ্যে জৈব-রাসায়নিক এবং শারীরিক প্রক্রিয়াগুলির একটি প্রাথমিক সূচক (Benoit and Fox-Kemper 2021)। মোহনার তাপমাত্রা সামুদ্রিক জীবনের বিপাক এবং উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করে; ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বিশ্ব-স্কেল ইউট্রোফিকেশনে (euterophication) অবদান রাখে বলেও দাবী করা হয়। বিশেষ করে অগভীর মোহনায়, তাপমাত্রার ঋতুগত পরিবর্তন জলের রসায়ন, পুষ্টির পরিবহন এবং দূষকদের চলাচলকে নিয়ন্ত্রণ করে। সেকারণে মোহনার পানির তাপমাত্রার আকস্মিক পরিবর্তন জলজ প্রাণীর গুরুত্বপূর্ণ জীবনচক্রের ঘটনাগুলিকে (যেমন, লার্ভা বিকাশ, স্পনিং, প্ল্যাঙ্কটন ব্লুম) উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতি করতে পারে (Li, Wang, and Liu 2021)। তাপমাত্রার এই পরিবর্তনশীলতা বায়োলজিক্যাল ঘটনার পাশাপাশি স্থানীয়-বায়ুমণ্ডল এবং সমুদ্রের গতিকে প্রভাবিত করতে পারে। অতিরিক্ত গরমের কারণে বাষ্পীভবনের হার বেড়ে যায়, স্থানীয় আর্দ্রতা বাড়ে। একইসাথে তাপমাত্রার বড় কোন পরিবর্তন বৃষ্টিপাতের দিক ওলটপালট করার পাশাপাশি নিম্ন-স্তরের মেঘের (low-level cloud) জন্ম দিতে পারে।
তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ
প্রশ্ন হলো বৈজ্ঞানিকভাবে কিভাবে মোহনার দীর্ঘ মেয়াদী তাপমাত্রার প্যাটার্ন নিয়ে গবেষণা করবো? দীর্ঘ মেয়াদী বলতে আমরা অন্তত তিন থেকে চার যুগেরও বেশি সময় কে বুঝাই কারণ কোনো অঞ্চলের জলবায়ু সম্পর্কে ভালো ধারনা পেতে এবং জলবায়ুর প্যাটার্ন ভবিষ্যদ্বাণী করতে এই ডাটা খুব গুরত্বপূর্ণ। একটা পদ্ধতি হলো স্যাটেলাইট থেকে তাপমাত্রার ম্যাপ তৈরি করে সেখান থেকে অনেকটা স্লাইড-শো প্লে করার মতো করে তাপমাত্রার হ্রাসবৃদ্ধি পর্যবেক্ষন করা, যাকে বলা হয় টাইম সিরিজ এনালাইসিস। তবে স্যাটেলাইট ব্যবহার করে এই টাইম সিরিজ এনালাইসিস করতে গেলে তিনটা বড় সমস্যা সামনে চলে আসে।
প্রথমত, হাতে গোণা সামান্য কয়েকটা স্যাটেলাইট চার যুগের বেশি সময় ধরে তাপমাত্রা ধারণ করছে, বেশিরভাগ স্যাটেলাইটই আধুনিক এবং সাম্প্রতিক সময়ে লঞ্চ করা এবং অতীতের পর্যাপ্ত ডাটা যোগান দিতে সক্ষম নয়। দ্বিতীয়ত, খুব কম সংখ্যক স্যাটেলাইটই প্রতিদিন থার্মাল ম্যাপ এর ছবি নেয়। বরং দেখা যায় বেশির ভাগ স্যাটেলাইটই গড়ে প্রতি এক সপ্তাহে কোন একটি নির্দৃষ্ট অঞ্চলের একটি মাত্র ছবি তোলে। এই ব্যপারটাকে বলা হয় টেম্পোরাল রেজোলেশন (temporal resolution)। তৃতীয় সমস্যা হলো ছবির রেজোলেশন (image resolution), অর্থাৎ, স্যাটেলাইটের তোলা ছবিতে একটি পিক্সেলে কতখানি এলাকা কত ভালোভাবে ধারণ করা হয়।
বোঝার সুবিধার্থে আমরা এখানে নারাগানসেট উপসাগরের মোহনার (Narragansett Bay Estuary) একটি ছবি (ছবি-৩) ব্যবহার করছি। এই মোহনাটি আমেরিকার রোড আইল্যান্ড (Rhode Island, USA) এর দক্ষিণে অবস্থিত। এই সম্পূর্ণ মোহনাটি স্টান্ডার্ড কোন স্যাটেলাইট বা জলবায়ু মডেলের একটা সিঙ্গেল পিক্সেলের মাঝে পরবে। কিন্তু মোহনার বিশেষত্ব এই যে, খুব ছোট জায়গার মাঝেও অনেক গুরত্বপূর্ণভাবে তাপমাত্রার হেরফের ঘটে যা একটামাত্র পিক্সেলের তথ্য থেকে সম্পূর্ণভাবে ধরা পরে না। আরও সহজভাবে বলতে গেলে, ধরা যাক, এই মোহনার একদম দক্ষিণদিকের দ্বীপ, নিউপোর্ট (Newport) এর সমুদ্র সংক্রান্ত নীতি-প্রণয়ন কি একদম উত্তরের প্রভিডেন্স নদীর (Providence River) এর ডাটার ভিত্তিতে হবে? উত্তর হলো, অবশ্যই না। কারণ এই দুই জায়গার পানির ঘনত্ব, লবণাক্ততা, স্রোতের ধরন, স্বচ্ছতা, সামুদ্রিক চাপ সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেকারণে মোহনার তাপমাত্রা বিষয়ক ঘবেষণার জন্য টেম্পোরাল রেজোলেশন ভালো হওয়ার সাথে সাথে স্থানিক রেজোলেশন (spatial resolution) খুব ভালো হওয়াটাও খুব জরুরী।
আমার পিএইচডির যাত্রাপথে এই তিনটা বড় চ্যালেঞ্জ এর মোকাবেলা করাটা ছিল একটা বড় লক্ষ্য। আমি এই ব্লগে নারাগানসেট উপসাগর (Narragasnett Bay) নিয়ে কথা বলেছি তবে এই গবেষণার প্রক্রিয়াটা যেকোনো মোহনা বা উপসাগরের জন্য প্রযোজ্য। প্রথম এবং তৃতীয় সমস্যা দুটো মোকাবেলা করার জন্য ল্যান্ডস্যাট স্যাটেলাইট (Landsat Satellite) খুব কার্যকরী একটি নির্বাচন। নাসার (NASA) ল্যান্ডস্যাট প্রোগ্রাম ভূ-পৃষ্ঠের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন রেকর্ড অর্জন করেছে কারণ এটা ১৯৮৪ সাল থেকে প্রতিনিয়ত পৃথিবীকে প্রদিক্ষণ করছে এবং প্রতি প্রদিক্ষণে ৩০ থেকে ৬০ মিটার স্থানিক রেজোলেশনে থার্মাল ম্যাপের ছবি তুলেছে (Markham and Helder 2012)।
তবে দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটা মোকাবেলার জন্য ল্যান্ডস্যাট স্যাটেলাইট যথেষ্ট না কারণ এটা গড়ে প্রতি ১৫ দিনে কোন একটি নির্দৃষ্ট জায়গার একটি মাত্র ছবি তোলে। তাই এই ১৫ দিনের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ কোনো আবহাওয়াগত পরিবর্তন ঘটে গেলে তা এই স্যাটেলাইট ধরতে পারেনা। এই সমস্যা মোকাবেলার জন্য সাহায্য করে ইন-সিটু পর্যবেক্ষণ (in-situ observation)। এই ছবিতে হলুদ রং এর এই বৃত্তগুলো দেখা যাচ্ছে তা আসলে অন সাইটে (অর্থাত ওই স্থানে) ইন্সটল করা তাপমাত্রা গণনা করার যন্ত্র (buoy, অনেকটা থার্মোমিটার এর মতো)। এরা প্রতিনিয়ত তাপমাত্রা রেকর্ড করে যায়। যার ফলে কোন তথ্য বাদ পড়ার সুযোগ থাকেনা। তবে সতর্কতার ব্যপারটা হচ্ছে এই যন্ত্রগুলো কোন একটি নির্দিষ্ট জায়গার তাপমাত্রাই কেবল রেকর্ড করে (অনেকটা পয়েন্ট ডাটা এর মতো), তাই সমগ্র মোহনার তাপমাত্রার ম্যাপটা তৈরি করা সম্ভব না। তবে স্যাটেলাইট এবং এই অন সাইটের ডিভাইস দুটোকে একসাথে ক্যালিব্রেট করে আমরা এই সমস্যাও সমধান করি।
প্রাথমিকভাবে এই তিনটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পরে তাপমাত্রার ওঠানামা (temperature variability) নিয়ে গবেষণা করার পথটা অনেকখানি সহজ হয়ে যায়। শুধু একটা ব্যাপার মাথায় রাখা ভালো, তা হলো স্যাটেলাইট মহাকাশ থেকে যেই তাপমাত্রার ছবি ধারণ করে তা মূলত পানির পৃষ্ঠদেশের তাপমাত্রা (water skin temperaure)। অন্যদিকে অনসাইটের ডিভাইস গুলো পানির এক থেকে দেড় মিটার গভীরের তাপমাত্রা ধারণ করে। যার ফলে এনালাইসিস করার আগে এই দুই তাপমাত্রার মাঝে একটা সমতা নিয়ে আসা খুব জরুরী। এই সমতা করার পদ্ধতিকে বলে বায়াস কারেকশন (bias correction) যেখানে আমরা মূলত এই দুটি সোর্সের তাপমাত্রা ব্যবধানের উপর ভিত্তি করে একটা কমন গ্রাউন্ডে নিজেদের রেখে সম্পূর্ণ চার দশকের তাপমাত্রার ডাটা সেইভ করি (best fit curve)। নিচের ছবিতে (ছবি-৪) দেখা যাচ্ছে স্যাটেলাইট এবং অন্য সাইটের তাপমাত্রা এর মাঝে কিভাবে আমরা সামঞ্জস্য তৈরি করি।
মোহনার তাপমাত্রা ও মৎস্য সম্পদ
সম্পূর্ণ তাপমাত্রার রেকর্ড প্রস্তুত করার পরে আমরা এখন মোহনার তাপমাত্রার ওঠানামা (temprature variability) নিয়ে গবেষণার জন্য প্রস্তুত। গুরত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, কি ধরণের ফলাফল আমরা খুঁজবো এই ডাটাসেট থেকে? উত্তর হলো, সবার আগে দেখে নেওয়া উচিত তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা (temperature trend)। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এর কারণে মোহনাগুলোর গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। মোহনার গভীরতা বেশি না হওয়ার কারণে এই বৃদ্ধির হার সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধির হারের তুলনায় অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ, নারাগানসেট উপসাগরের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার প্রতি দশকে গড়ে প্রায় ০.৫৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস যা বৈশ্বিক সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হারের প্রায় চার গুণ।
এই ধরণের গবেষণার আরেকটি গুরত্ব হলো, আঞ্চলিক নীতিপ্রণয়নকারীদের জন্য এই তথ্য জানা খুবী জরুরী যে কোন কোন জায়গা হট-স্পট (Hot-spot) এ রূপ নিচ্ছে। সমগ্র পৃথিবী জুড়েই মোহনা কেন্দ্রিক মৎস্য চাষ খুব জনপ্রিয়। বিশেষ করে এই অঞ্চলে শেলফিশ (shell fish) জাতীয় মাছের চাহিদা খুব বেশি। উদাহরণস্বরূপ, আটলান্টিক মহাসাগরের লবস্টার, চিংড়ি, কাঁকড়া, স্ক্যালপ, অয়েস্টার, ক্ল্যাম, ইত্যাদি। তবে গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে যে নারাগানসেট উপসাগরে যেসব জায়গায় শেলফিশ প্রজাতির মাছের চাষ বেশি হয়, সেখানে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার বেড়ে গেলে খামারীরা ভবিষ্যতে অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হবে (ছবি-৫)। কারণ উচ্চ উষ্ণতার হারের কারণে এই জায়গার বাস্তুতন্ত্রগুলি বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। পূর্ববর্তী গবেষণা থেকে জানা যায় যে মোহনার তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে কার্বন ডাই অক্সাইড এর ঘনত্ব বেড়ে যায়, অক্সিজেন কমে আসে এবং পানির অ্যাসিডিফিকেশন পরিবর্ধিত হয় (Mackenzie et al. 2014)। এই সবগুলো পরিবর্তনই শেলফিশের উৎপাদন বহুগুণে কমিয়ে দেয়। নারাগানসেট উপসাগরের হটস্পট এবং শেলফিশ এলাকা গুলো কে নিচের মানচিত্রে দেখানো হলো –
মোহনার তাপমাত্রা এবং মানুষের কার্যকলাপ
নৃতাত্ত্বিক কার্যকলাপ (anthropogenic activity) সম্ভবত মোহনার তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী, বিশেষত সেসব মোহনা যেখানে মানুষের উপস্থিতি অনেক বেশি হওয়ার কারণে শিল্পায়ন গড়ে উঠেছে কারখানার বর্জ্য পদার্থ সাধারণত দুটি উপায়ে মোহনার ক্ষতিসাধন করে থাকে। প্রথমত, বর্জ্য পদার্থ (বিশেষত নাইট্রোজেন, ফসফরাস, এবং অন্যান্য জৈব যৌগ) মোহনার পানিতে মিশে গেলে ইউট্রোফিকেশন (Eutrofication) শুরু হয়। ইউট্রোফিকেশনের কারণে পানিতে পুষ্টির পরিমাণ অতিরিক্ত রকম বেড়ে যায়। আপাতত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এটা একটা সুবিধাজনক প্রক্রিয়া তবে বাস্তবতা এর বিপরীত। ইউট্রোফিকেশন এর ফলে প্রচুর পরিমাণে শেওলা, শৈবাল, কচুরিপানা, ইত্যাদি পানির উপড়ের স্তরে জমা হতে থাকে (ছবি-৬a)। ফলাফলস্বরূপ, সূর্যের আলোর প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে যায় এবং সূর্যের পর্যাপ্ত আলোর ওপর নির্ভরশীল প্রাথমিক স্তরের খাদকরা মারা যেতে থাকে, এবং ক্রমান্বয়ে তাদের ওপরে নির্ভরশীল থাকা অন্যান্য উপরের স্তরের খাদকরাও মারা যায়।
দ্বিতীয়ত, কারখানা থেকে নির্গত হওয়া গরম পানি বা রাসায়নিক পদার্থ (thermal waste) মোহনার পানির সাথে মিশে মোহনার পানির কেমিক্যাল কম্পোজিশন দীর্ঘমেয়াদিভাবে পরিবর্তন করে দিতে পারে। সাধারণত পানিতে ঠিক যে জায়গায় এসব বর্জ্য ফেলা হয় সেখান থেকে শুরু করে প্রায় কিছু কিলো অবধি প্রাণের বসবাসের অযোগ্য এলাকা তৈরি হয়ে যেতে পারে যাকে বলা হয় তাপীয় প্লুম (thermal plume)। এই প্লুম তার চারপাশের তাপমাত্রার থেকে প্রায় ৮-১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেশি গরম পানি তৈরি করতে পারে (ছবি-৬e)। বাস্তুসংস্থানের যে সকল প্রাণীর ডিম বা লার্ভা তাপমাত্রা পরিবর্তনের সাথে অতিরিক্ত রকম সংবেদনশীল তারা সাধারণত বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে ওই অঞ্চলের বাস্তুসংস্থান ভেঙ্গে পড়ে।
কৌতূহলোদ্দীপক ব্যপার হলো, ছবি-৫b থেকে আমরা দেখি পুরো নারাগানসেট উপসাগরে মাত্র একটি জায়গা থেকে তাপমাত্রা কমে যাওয়ার হার লক্ষণীয়। এটা কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে হচ্ছে না! ছবি-১ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে ব্রেটন পয়েন্ট পাওয়ার স্টেশন এর অবস্থানে তাপমাত্রা কমে গেছে। এটার কারণ হলো, এই পাওয়ার পয়েন্টটা ১৯৯০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত চলমান ছিল এবং মোহনার এই অঞ্চলের পানি কে মারাত্নকভাবে দূষিত করতো। ২০০৪ সালে জেরেমি ফিশার এবং জন মাস্টার্ড তাদের গবেষণাপত্র (Fisher and Mustard 2004) প্রকাশনা করার পরে স্থানীয় পরিবেশ প্রকল্পনাকারকদের টনক নড়ে উঠে এবং তারা সর্বোচ্চ আঈন প্রণয়ন করে দূষণকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার জন্য। ২০১১ সালে এই পাওয়ার স্টেশনকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং এর থেকে নির্গত হওয়া তাপীয় বর্জ্যও সম্পূর্ণভাবে কমে যায়। যার ফলে গত ৪০ বছরের গড় তাপমাত্রা প্রবণতা হিসাব করলে এই অবস্থানটা চারপাশ থেকে ঠান্ডা দেখায়। এই ঘটনা থেকে আমরা মোহনার তাপমাত্রা নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণা করার গুরত্ব বুঝতে পারি।
মোহনায় বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব এবং পরিশিষ্ট
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাস্তব। আমাদের যুগেই আমরা জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে, খাদ্যাভাব, খরা, জলোচ্ছ্বাস, পানিবাহিত রোগের প্রবণতা, এবং বিভিন্ন প্রাণীর জেনেটিক মিউটেশনের হার এর মাধ্যমে এর প্রমাণ পাচ্ছি। আগামী ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এই প্রবণতা আরও চূড়ান্ত রূপ ধারণ করবে। মারাত্মক বিপদগ্রস্ত হবে আমাদের ঠিক পরের প্রজন্ম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মোহনা অঞ্চলগুলো পারিপার্শ্বিক এলাকার তাপমাত্রা হ্রাস বৃদ্ধির ওপর অনেক বেশি সংবেদনশীল। এর প্রধান কারণ হলো সমুদ্র, এবং মহাসমুদ্রের গড় গভীরতা যেখানে ১ কিলোমিটার এবং ৩.৫ কিলোমিটার, সেখানে মোহনার পানির গড় গভীরতা মাত্র ৩ মিটার থেকে ১৫ মিটার। এই অগভীর পানিতে সূর্যালোক খুব সহজে প্রবেশ করতে পারে এবং সামগ্রিকভাবে সম্পূর্ণ মোহনার পানির তাপ ধারণ ক্ষমতাও স্বল্প। ক্রমবর্ধমাণ তাপমাত্রা মোহনার পানির লবণ পরিবহন চক্র এবং স্তরবিণ্যাসকেও (stratification) পরিবর্তন করে। যার ফলে শুধু গ্রীষ্মকালই না, বরং সমগ্র বছর জুড়েই মোহনাতে তামপাত্রা বৃদ্ধির হার বজায় থাকে। নিচের ছবি (ছবি-৭) থেকে যেটা আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পারছি।
জলবায়ুপরিবর্তনের প্রভাব সারা পৃথিবীর উপরেই পড়ছে। যখন আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের উষ্ণায়নের কথা ভাবি, তখন পৃথিবীর সকল মহাসাগরের কথাই মাথায় আসে। কিন্তু সেটা বৃহত্তর স্কেল। আমার এই লেখায় আমি চেষ্টা করছি, বৃহত্তর সমুদ্রের একটা ছোট অংশ মোহনা কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ। মোহনায় তাপমাত্রা পরিবর্তন কেন হচ্ছে, সেটা আমরা কিভাবে মাপবো, সেটার প্রভাব কিভাবে বোঝা যাবে এগুলো বোঝাটা জরুরী। কারণ ছোট স্কেলের পরিবর্তনই বড় পরিবর্তনের ঘূর্ণি তৈরি করে। এই বিষয় সম্পর্কে যদি আপনি আরো জানতে চান, তাহলে আমার গবেষণাপত্রটি পড়তে পারেন এখান থেকে-
Ahmed, Ashfaq and Fox-Kemper, Baylor and Watkins, Daniel M. and Wexler, Daniel and Wilhelmus, Monica Martinez, Estuarine Temperature Variability: Integrating Four Decades of Remote Sensing Observations and In-Situ Sea Surface Measurements. Available at SSRN: https://ssrn.com/abstract=4865122 or http://dx.doi.org/10.2139/ssrn.4865122
অন্যান্য তথ্যসূত্র
- Benoit, Jonathan, and Baylor Fox-Kemper. 2021. “Contextualizing Thermal Effluent Impacts in Narragansett Bay Using Landsat-Derived Surface Temperature.” Frontiers in Marine Science 8 (September):705204. https://doi.org/10.3389/fmars.2021.705204.
- Fisher, Jeremy I, and John F Mustard. 2004. “High Spatial Resolution Sea Surface Climatology from Landsat Thermal Infrared Data.” Remote Sensing of Environment 90 (3): 293–307.
- Li, Lei, Yujue Wang, and Dongyan Liu. 2021. “Phytoplankton Shifts in the Central Bohai Sea over the Last 250 Years Reflect Eutrophication and Input from the Yellow River.” Ecological Indicators 126:107676.
- Mackenzie, Clara L, Sharon A Lynch, Sarah C Culloty, and Shelagh K Malham. 2014. “Future Oceanic Warming and Acidification Alter Immune Response and Disease Status in a Commercial Shellfish Species, Mytilus Edulis L.” PLoS One 9 (6): e99712.
- Markham, Brian L, and Dennis L Helder. 2012. “Forty-Year Calibrated Record of Earth-Reflected Radiance from Landsat: A Review.” Remote Sensing of Environment 122:30–40.
- Nichols, Frederic H., James E. Cloern, Samuel N. Luoma, and David H. Peterson. 1986. “The Modification of an Estuary.” Science 231 (4738): 567–73. https://doi.org/10.1126/science.231.4738.567.
- Sun, Jinshui, Ming-Huang Wang, and Yuh-Shan Ho. 2012. “A Historical Review and Bibliometric Analysis of Research on Estuary Pollution.” Marine Pollution Bulletin 64 (1): 13–21. https://doi.org/10.1016/j.marpolbul.2011.10.034.Vihma, Timo. 2014. “Effects of Arctic Sea Ice Decline on Weather and Climate: A Review.” Surveys in Geophysics 35:1175–1214.
Leave a Reply