প্রকৃতিতে গণিতের সৌন্দর্য!

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

গণিত; প্রকৃতির রহস্য উদঘাটনের এক চমকপ্রদ উপহার। এর সাহচর্যে প্রসারিত হচ্ছে বিজ্ঞানের সীমানা। আবিষ্কৃত হচ্ছে নব-নব প্রযুক্তি, উন্মোচিত হচ্ছে দিগন্ত-বিস্তৃত সম্ভাবনা।

তবে, সুনিপুণ এই বিজ্ঞানের জগৎকেও অনেকেই ভয় পান। ভাবেন- গণিত মানেই জটিল-কঠিন সমীকরণের সমাহার আর নিকষকালো, প্রাণহীন, দুর্ভেদ্য সব অন্ধকার বিষয়। কিন্তু, এর অতল গহ্বরে ডুব দিয়েও যে এর মগজ-ধাঁধানো সৌন্দর্য প্রাণভরে উপভোগ করা যায়, সে সুযোগটুকুও তৈরি করে নিতে রীতিমতো অপারগ তারা।

তাদের এমন অপারগতার ফলাফল, মলাটবদ্ধ পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও যে গণিতের রয়েছে অবাধ বিচরণ, তা দু-চোখ ভরে কখনোই দেখা হয়ে ওঠে না। জানা হয় না বর্ষার অথৈ জলে হেলেদুলে ভাসমান শাপলার পাতায়, শামুকের খোলসে, মৌমাছির মৌচাকে, মাকড়সার জালে, কিংবা চোখের সামনে অকস্মাৎ ফাটল ধরা কোনো প্রাচীরে– এসবের মাঝেও প্রকৃতি লুকিয়ে রেখেছে গণিতের অবারিত সৌন্দর্য, আশির্বাদ। 

চলুন তবে আজ ঘুরে আসি প্রকৃতিতে বিরাজমান সেসব গাণিতিক সৌন্দর্যের ভুবন থেকে।

সূর্যমুখী ফুলে ফিবোনাক্কি ক্রম

গণিতের এক বিশেষ ধারা বা ক্রম হচ্ছে ফিবোনাক্কি নাম্বার। এই ধারাটির কোনো একটি পদ তার পূর্বের দুইটি পদের যোগফলের সমান।
যেমন: ০, ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪…(চলবে)।

এভাবে, ফিবোনাক্কি ধারাটি ১৩৭.৫ ডিগ্রী কোণ উৎপন্ন করে এগিয়ে চলে। এই ১৩৭.৫ ডিগ্রীকে বলা হয় গোল্ডেন অ্যাঙ্গেল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- এই গোল্ডেন অ্যাঙ্গেলের সঙ্গে সূর্যমুখী ফুলের সম্পর্ক কী?

সূর্যমুখীর বীজ এই ধারাপদের নিয়মকে আঁকড়ে ধরেই সুবিন্যস্ত থাকে। এমনকি, লক্ষ্য করলে দেখবেন, বীজগুলোর গঠনকাঠামোয় দুই ধরণের স্পাইরাল বিন্যাস বা সর্পিলাকৃতিও রয়েছে। একটি ঘড়ির কাঁটার দিকে, আর অন্যটি ঘড়ির কাঁটার ঠিক বিপরীত দিকে ঘুরছে মনে হবে। আর এভাবে সূর্যমুখীর বীজগুলোও একটি অপরটির সাথে উৎপন্ন করছে ১৩৭.৫ ডিগ্রী কোণ। এর ভেতরে নিজের অজান্তেই তৈরি করেছে রোমাঞ্চকর গোল্ডেন অ্যাঙ্গেল। দারুণ না?

সূর্যমুখী ও গোল্ডেন অ্যাঙ্গেল; ছবিসূত্র: gofiguremath.org

হয়তো ভাবছেন- সূর্যমুখী কেনই বা বীজগুলোকে ফিবোনাক্কি ধারায় সর্পিলাকৃতিতে সাজিয়ে রাখে? উত্তর হলো, এভাবে খুব কম শক্তি ব্যয় করেই সুন্দর ফুলটি বীজগুলোকে সাজিয়ে রাখতে পারে। কেননা, সরল-রৈখিক আকৃতিতে সাজিয়ে রাখতে প্রয়োজন হবে এর চেয়েও অধিক স্থান। দরকার হবে অধিক শক্তি।

শুধুই কী সূর্যমুখী ফুল এভাবে থাকে? না! ফাইলোট্যাক্সিস (Phyllotaxis) নামক একধরণের গৃহসজ্জার গাছ, রক্তবর্ণের বাঁধাকপি (Red Cabbage ) এবং আনারসেও রয়েছে বিভিন্ন ধরণের স্পাইরাল কন্ডিশন। তবে সব সূর্যমুখীতে অবশ্য গোল্ডেন অ্যাঙ্গেল পাওয়া যায় না।

ফাইলোট্যাক্সিস; ছবিসূত্র: gofiguremath.org

শামুকের খোলসে লগারিদম

ফিবোনাক্কি স্পাইরাল, লগারিদমিক স্পাইরাল বা গোল্ডেন স্পাইরাল–এই তিনটিরই আকৃতি মোটামুটি কাছাকাছি ধরণের। আর তাই অনেকেই শামুকের খোলসে গোল্ডেন স্পাইরাল রয়েছে ভেবে ভুল করে বসেন।

কিন্তু না, প্রকৃতিতে বিদ্যমান অল্পসংখ্যক শামুকে ফিবোনাক্কি স্পাইরাল থাকলেও বেশিরভাগ শামুকেই লগারিদমিক স্পাইরালের দেখা মেলে।

শামুকের খোলস; ছবিসূত্র: gomath.org

আচ্ছা, শামুকের মতো ছোট্ট একটি প্রাণী এই আকৃতি পেলো কীভাবে? এটি বেঁচে থাকার প্রয়োজন ও বিরূপ পরিবেশে অভিযোজনের নিমিত্তেই একপ্রকার প্রাকৃতিক নির্বাচন বলা যায়।

লগারিদমিক স্পাইরালে শামুকের ভারসাম্য ঠিক থাকে। প্রতিসাম্যতা আসে আকার-আকৃতিতে। এদের খোলসও হয় অন্য শামুকের চেয়ে অধিক মজবুত। বাঁচে বেশিদিন। জন্ম দেয় প্রজননক্ষম সন্তান। টিকে থাকে বংশপরম্পরা।শামুক ছাড়াও এমন আরও কতক যেমন- ক্রান্তীয় ঘুর্ণিঝড়, ছায়াপথের বাহু, কর্ণিয়ার স্নায়ু ইত্যাদিও লগারিদমিক স্পাইরালের চমকপ্রদ উদাহরণ।

লগারিদমিক স্পাইরাল, ছায়াপথের বাহু ও ক্রান্তীয় ঘুর্ণিঝড়; ছবিসূত্র: Wikipedia

রোমানেস্কো ব্রকলিতে ফ্র্যাক্টাল জ্যামিতি

ফ্র্যাক্টাল; জ্যামিতিক এই নকশাকে বিবেচনা করা হয় নিজেই নিজের প্রতিসম হিসেবে। প্রকৃতিতে এদের উদাহরণ অসংখ্য, অহরহ। রোমানেস্কো ব্রকলি এদের মধ্যে অন্যতম। 

নিচের ছবিটি খেয়াল করুন। সবুজ ফল বা সবজিটিতি একইরকম ছোট ছোট অনেকগুলো আকৃতি দেখতে পাচ্ছেন- তাই না? এদের প্রত্যেককে ডাকা হয় ফ্লোরেট নামে। প্রতিটি ফ্লোরেট দেখতে একইরকম। এরা আবার একই স্পাইরাল লগারিদম বিশিষ্টও।

রোমানেস্কো ব্রকলি; ছবিসূত্র: Wikipedia

ছুরি-চাকু দিয়ে আপনি যখন একটি ফ্লোরেট কাটবেন, তখন দেখবেন কাটা অংশটি যেন সদ্য গজানো আরেকটি রোমানেস্কো ব্রকলি

সূর্যমুখী ফুলের বীজের লগারিদমিক স্পাইরালের মতো এরাও ফিবোনক্কি ধারা মেনেই একটি সম্পূর্ণ ব্রকলি সৃষ্টি করে। প্রকৃতির মাঝে বিদ্যমান এমন আরও কিছু ফ্র্যাক্টাল আকৃতির দেখা মিলে ফার্ন গাছের পাতায়, আঞ্জেলিকা ফুলগাছের বিন্যাসে কিংবা তুষারকণায়।

ফ্র্যাক্টাল জ্যামিতিক নকশা; ছবিসূত্র: Wikipedia

মৌমাছির মৌচাকে ষড়ভুজ আকৃতি

মৌমাছি মৌমাছি
কোথা যাও নাচি নাচি
দাঁড়াও না একবার ভাই,
ঐ ফুল ফোটে বনে
যাই মধু আহরণে
দাঁড়াবার সময় তো নাই।

আসলেই তো, দাঁড়াবার সময় কোথায় তাদের? পাতা-ফুলে ঘুরে মধু আহরণ, মধু বহন, চাকে সংরক্ষণ– কত্ত কাজ! ও হে, সংগৃহীত মধু যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত বাসস্থান নির্মাণও তো প্রয়োজন, যেখান থেকে পড়বে না একফোঁটা মধুও।

তাই তো, পরিশ্রমী মৌমাছিরা বেছে নিয়েছে মৌচাক তৈরির অনন্য গঠন কৌশল। তৈরি করেছে অনিন্দ্য সুন্দর সংরক্ষণাগাড়। একটু মনযোগ দিয়ে দেখলে বুঝবেন, মৌচাকের প্রতিটি খোপের আকৃতি পুরোপুরি ষড়ভুজ। বৃত্তাকার, ত্রিভুজাকার, বর্গাকার, রম্বসাকার কিংবা পঞ্চভুজাকারও নয়। কিন্তু কেন? এখানেই লুকিয়ে আছে বুদ্ধিমান মৌমাছিদের আবাস নির্মাণের গাণিতিক রহস্য।

মৌচাক; ছবিসূত্র: gomath.org

নানাবিধ আকৃতির ভেতর একমাত্র ষড়ভুজই অধিকতর স্থিতিশীল। নির্ধারিত তলে তারা জায়গাও দখল করে খুবই অল্প। বিপরীতে হয় আটসাট, সামঞ্জস্যপূর্ণ। এদের অতিমাত্রায় স্থিতিশীলতার কারণে মৌমাছিরা সময় ও শক্তি কম খরচ করেও তৈরি করে নিতে পারে যুৎসই বাসস্থান। যেখানে সংরক্ষণ করা যায় অনেকখানি মধু। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবেন সহজেই–

মৌমাছিরা মৌচাকের প্রতিটি খোপের দেয়াল মধু-মোম দিয়ে তৈরি করে। এদের পুরুত্ব হয় গড়ে ০.০৫ মিলিমিটার। কিন্তু ছোট্ট এই খোপগুলো নিজেদের ওজনের প্রায় ২৫ গুণ মধু ধরে রাখতে পারে।

এছাড়াও, মোটামুটি ১০০-১৫০ গ্রাম ওজনের একটি মৌচাকে পাওয়া যায় ৪০০০-৬০০০ গ্রাম (৪-৬ কেজি) মধু। ভাবা যায়? এ থেকে সহজেই অনুমেয়, কত মজবুত এই গাণিতিক আকার, আর কতই না বুদ্ধিমান এই মৌমাছির দল।

মৌচাকের খোপ; ছবিসূত্র: gomath.org

মানব মুখমন্ডলে সোনালি অনুপাত

জানেন কী, মানব মুখাবয়বের সৌন্দর্য পরিমাপেও রয়েছে গাণিতিক মান? একে বলে গোল্ডেন রেশিও। এর মান ধরা হয় 1.618033989 বা 0.618033989। মুখমন্ডলের বিভিন্ন দূরত্বের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত নির্ণয় করে নির্ধারণ করা হয় এই মান।

অনেক হলিউড-বলিউড তারকাদের এই মাপের ছাঁচে ফেলে নির্ণয় করা হয়েছে তাদের চেহারার মাধুর্যতা। তেমনি কয়েকজন–

Brad Pitt- 9.67
Kate Upton- 7.46
Miley Cyrus- 7.36
Ryan Gosling- 7.30
Beyonce Knowles- 7.28
Angelina Jolie- 7.13
Lena Dunham- 6.82
George Clooney- 6.77
Ben Affleck- 6.55
John Mayer- 6.42
হলিউড অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি; ছবিসূত্র: pinokio.com

কিন্তু প্রশ্ন হতে পারে, আমরা যারা সাধারণ, তারা কী তাহলে কুৎসিত? বা যাদের চেহারায় সোনালি অনুপাত বা গোল্ডেন রেশিও নেই, তারা কী বিদঘুটে। কিন্তু, বিষয়টা মোটেও এমন নয়।

যাদের প্রেমে পড়ি আমরা, কল্পনায় দেখি, হৃদয়ের গভীরে যাদের চিত্র আকি, নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসি, বাঁচতে চাই আঁকড়ে ধরে– তাদের গোল্ডেন রেশিও মাপার প্রয়োজন পড়ে না। এমনিতেই ভালোবাসি আমরা। আর এভাবেই ভালোবেসে যাই।

ভিট্রুভিয়ান ম্যানের উদাহরণ

অনেকেই গোল্ডেন রেশিওর উদাহরণে ভিট্রুভিয়ান ম্যানকে টেনে আনেন। তাদের মতে, বিখ্যাত চিত্রকর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি তার রহস্যময় চিত্রকর্ম ‘ভিট্রুভিয়ান ম্যান’ গোল্ডেন রেশিও মেনে এঁকেছিলেন। কিন্তু এটি সত্য নয়, বরঞ্চ অযৌক্তিক এবং অসম্ভবও বটে।

কেননা, জানা যায়, প্রখ্যাত রোমান স্থপতি মারকাস ভিট্রুভিয়াসের অতিসাধারণ একটি অঙ্কন তত্ত্ব অনুসারে ভিঞ্চি এঁকেছিলেন এই ছবিটি। এমনকি ভিট্রুভিয়াস নিজেও তার অঙ্কন তত্ত্বে গোল্ডেন রেশিও নামে কোনো কিছুর উল্লেখ করেন নি।

এছাড়াও, ভিট্রুভিয়ান ম্যান চিত্রটির বিভিন্ন অংশের দৈর্ঘ্যের অনুপাত নির্ণয় করে পাওয়া যায়- 1:3, 1:4, 1:6, 1:8, 1:10 ইত্যাদি। এদের সাথেও একদমই মেলে না গোল্ডেন রেশিওর প্রকৃত অনুপাত। সুতরাং ভিট্রুভিয়ান ম্যান নিয়ে এমন ধারণা একদমই ধোপে টেকে না। কিন্তু, তাতে কী? তাই বলে কী ভিট্রুভিয়ান ম্যানের গুরুত্ব কমে যাবে? একটুও না!

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ভিট্রুভিয়ান ম্যান; ছবিসূত্র: www.Lucnix.be

পরিশেষে

গণিতের সৌন্দর্য মিশে আছে প্রকৃতির প্রতিটি রূপ-রস-গন্ধে ও প্রতিবিম্বে। জড়িয়ে আছে বিভিন্ন আঙ্গিকে, অনন্য আকার-আকৃতিতে, আষ্টেপৃষ্টে। এর বর্ণনা করে হয়তো কখনোই শেষ করা যাবে না।

তবে এটুকু বলা যায়, মায়াময় গণিত তার ভালোবাসার চাদরে এভাবেই আগলে রাখুক বিচিত্র প্রাণ ও প্রকৃতিকে।

গণিতের সুশীতল শুভেচ্ছা সবাইকে।

তথ্যসূত্র:

লেখাটি 139-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading