হাতের পাঁচ আঙুল ও বিবর্তন


লিখেছেন

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বর। বিখ্যাত নেচার জার্নালে প্রাচীন এক সরীসৃপ সম্পর্কে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়। নতুন আবিষ্কৃত সেই সরীসৃপের সামনের দুই বাহুতে ৭ টি করে আঙুল ছিল এবং পায়ের আঙুল সংখ্যা ছিল ৬ টি করে। শুনতে সাধারণ মনে হলেও, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার ছিল। এই আবিষ্কারের গুরুত্ব বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে এখন থেকে প্রায় ৩৬-৪২ কোটি বছর আগে। পৃথিবীতে তখন ডেভোনিয়ান পিরিয়ড বা ডেভোনিয়ান সময়কাল। ডেভোনিয়ান পিরিয়ডের প্রথমদিকে পুরো পৃথিবীতে রাজত্ব করত মাছ। ডাঙায় তখনো কোনো প্রাণীর উদ্ভব হয়নি। তবে ডেভোনিয়ান এর মাঝামাঝি সময়ে এক নতুন ধরণের মাছের উদ্ভব হয় যাদের শরীরে সরু রশ্মিযুক্ত পাখনা’র বদলে মাংসল পাখনা’র উদ্ভব হয়। এদের বলা হতো ‘লোব ফিনড ফিশ’ কিংবা মাংসল পাখনাযুক্ত মাছ। এদের ছাড়া বাকি মাছেদের বলা হয় ‘রে ফিনড ফিশ’। যাহোক, ডেভোনিয়ান পিরিয়ডের শেষদিকে এই মাংসল পাখনাযুক্ত মাছেরা নিজেদের পাখনা’য় ভর দিয়ে ডাঙায় উঠে আসে এবং এদের বংশধর থেকেই প্রাচীন চতুর্পদী প্রাণীর উদ্ভব হয়।

ডেভোনিয়ান সময়কালে মাছেরা ডাঙায় ওঠে আসতে শুরু করে

জীবাশ্ম রেকর্ড থেকে জানা যায় এসব প্রাচীন চতুর্পদী’দের হাত ও পা’য়ে পাঁচ, ছয় বা সাতটি করে আঙুল ছিল। তবে পরবর্তীতে যখন সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী এবং পাখির উদ্ভব হয় তখন আঙুলের সংখ্যা কমতে থাকে। সরীসৃপদের ক্ষেত্রে আঙুলের সংখ্যা কমে গিয়ে তিনটি (কোনো ক্ষেত্রে দুইটি) হয়ে যায়। তবে ২০০৩ সালের সেই গবেষণাপত্র সেই সংখ্যা’কে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।

এখন আঙুলের সংখ্যা’র তারতম্যের হিসাব করতে গিয়ে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে হাতের বিবর্তনের দিকে। এখন পৃথিবীতে যত হাত যুক্ত প্রাণী আছে তাদের হাতের বিবর্তন ঘটেছে প্রাচীন মাছের পাখনা থেকে। মাছেরা যখন ডাঙায় ওঠে আসে তখন তাদের মাংসল পাখনা ধীরে ধীরে হাত-পায়ে রূপান্তরিত হয়। সেই হাত-পায়ে সৃষ্টি হয় আঙুলের। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী পরিবেশের বিভিন্নতা অনুযায়ী প্রাণীদের মাঝে আঙুলের সংখ্যার ভিন্নতা দেখা দিয়েছিল। যখন চতুর্পদীরা ডাঙায় ওঠে আসে তখন কাছাকাছি সময়ে দুটি গণবিলুপ্তি হয়েছিল। সেসময় প্রায় ৫০ শতাংশ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং চতুর্পদী’রা ডাঙায় রাজত্ব করতে শুরু করে। তবে হঠাৎ করেই কিন্তু তাদের মাঝে হাতের উদ্ভব হয়নি; বরং ধীরে ধীরে মাংসল পাখনা থেকে হাত এবং আঙুলের উদ্ভব হয়। সেসময় বেশিরভাগ চতুর্পদীই চার হাত-পা’য়ে ভর দিয়ে ঘষটে ঘষটে হাঁটতো।

তাই, হাত ও পা’য়ে বেশি শক্তি থাকার প্রয়োজন ছিল। আর, এজন্য প্রাচীন চতুর্পদী’দের আঙুলের সংখ্যা বেশি ছিল (৭/৮ টি)। প্রাচীন চতুর্পদীদের মধ্যে ইকথিওস্টেগা এবং অ্যাকান্থোস্টেগার হাত ও পা’য়ে আঙুলের সংখ্যা বেশি থাকলেও যখন প্রাণীরা পুরোপুরি ডাঙায় ওঠে আসে এবং হাত ও পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে শুরু করে তখন আঙুলের সংখ্যা কমে আসে এবং সেই সংখ্যা সাধারণত ৫ এর বেশি বাড়েনি। এ নিয়ে ‘ডলোর আইন (Dollo’s Law)’ নামক একটি নিয়ম প্রচলিত আছে। এই ল’ অনুযায়ী প্রাণীদের একটি বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গেলে সেটা সাধারণত পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয় না। তিমির হাত কিংবা পাখির দাঁত এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। তবে শুরুতেই দেওয়া সেই আদিম প্রাণীর ক্ষেত্রে ‘অপসারী বিবর্তন’ এর মাধ্যমে আঙুলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে নিশ্চিত হয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

বেশিরভাগ স্তন্যপায়ীদের হাতে আঙুলের সংখ্যা পাঁচটি

বার্সেলোনার সেন্টার ফর জিনোমিক রেগ্যুলেশন-এর গবেষক জেমস শার্প বলেন-  

“প্রাণীর শরীরের সবকিছু খুব সুন্দরভাবে নির্দিষ্ট করা রয়েছে এবং অবশ্যই বিবর্তনের মাধ্যমে এসব ঘটেছে।…..সব কিছুর উর্ধ্বে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। আমি প্রায়ই বলি, যদি আমরা বুঝতে পারি কেন আঙুলের সংখ্যা ৫ টি, তাহলে সবকিছুই বোঝা সম্ভব।” 

তাঁর নেতৃত্বে একদল গবেষক ‘হাত ও পায়ের’ আঙুলের গঠনে তিনটি অণুর ভূমিকা আবিষ্কার করেছেন। এই তিনটি অণুর নাম দেওয়া হয়েছে যথাক্রমে ‘Sox9’, ‘Bmp’, ‘Wnt’। ভ্রূণ গঠনের বিভিন্ন সময়ে এই অণুগুলো সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় হওয়ার মাধ্যমে ভ্রূণের শরীরে আঙুলের গঠন নিশ্চিত করে। তবে এই অণুগুলোর একটি যখন সক্রিয় হয়, অপরটিকে সেটি নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, Bmp অণু Sox9 কে সক্রিয় করে এবং Wnt আবার Sox9 কে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। আজ থেকে প্রায় ৭২ বছর আগে গণিতবিদ ‘এলান টিউরিং’ প্রায় কাছাকাছি একটি গাণিতিক মডেল প্রকাশ করেছিলেন। সেই মডেল অনুযায়ী, দুইটি অণুর পারস্পরিক ক্রিয়া’র মাধ্যমে নতুন নতুন প্যাটার্ন তৈরি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে তৃতীয় একটি অণু আবার প্রথম অণুকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলবে। চিতার গায়ের দাগ কিংবা জেব্রামাছ এর গায়ের দাগ’ও একই প্যাটার্ন মেনে চলে। তাই এই তিনটি অণুকে ডাকা হয় ‘ট্রিনিটি’ নামে। 

তিন অণুর সমন্বয়ে হাতের আঙুলের গঠন সৃষ্টি হয়

জেমস শার্পের দল এই তিনটি অণু নিয়ে একটি সিম্যুলেশনও তৈরি করেছেন। সেখান থেকে দেখা যায়, ভ্রূণ গঠনের ষষ্ঠ সপ্তাহে যখন আঙুলের গঠন তৈরি হওয়া শুরু করে তখন এই তিনটি অণু মিলে পাঁচটি আঙুল তৈরি করে। সেই পরীক্ষা থেকে যখন একটি অণুকে সরিয়ে দেওয়া হয় তখন বাকি দুইটি অণুও কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ফলে আঙুলের গঠন সম্পূর্ণ হয় না। যেমনঃ Bmp অণু সরানো হলে Sox9 অণু কাজ করা বন্ধ করে দেয় এবং আঙুল বিহীন লম্বাকৃতি একটি হাতের গঠন তৈরি হয়। আবার যখন Wnt এবং Sox9 অণু সরিয়ে নেওয়া হয় তখন আঙুল গঠিত হলেও আঙুলগুলোর মাঝে কোনো ফাঁকা স্থান থাকে না ফলে আঙুলগুলো আলাদাও হয় না। একইভাবে Wnt এবং Bmp অণু সরিয়ে নিলে আঙুলের সংখ্যা নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে কমে যায়। ২০১৪ সালে সায়েন্স জার্নালে এ সম্পর্কে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন তারা।

মানুষের বিবর্তনের অন্যতম প্রভাবক ছিল হাতের ব্যবহার। হাতের পাঁচ আঙুল দিয়ে শক্তভাবে কোনো হাতিয়ার ধরতে পারার ফলেই শিকার করতে শুরু করে মানুষ এবং ধীরে ধীরে গাছ থেকে নেমে এসে সভ্যতার বিকাশ ঘটায়। মানুষের হাতের পাঁচ আঙুল এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। তেমনি অন্যান্য প্রাণীতেও হাতের আঙুলের পার্থক্য রয়েছে। এই আঙুলের পার্থক্য সম্পর্কেও আরেকটি সমীকরণ আবিষ্কার হয়েছে। একে বলা হয় লিম্ব ল (Limb law)- (N≈2π/k)।

হাতের আঙুলের সংখ্যা গণনার জন্য আবিষ্কার হয়েছে Limb Law

এই সমীকরণের মাধ্যমে আঙুলের দৈর্ঘ্যের ওপর ভিত্তি করে কোনো প্রাণীতে আঙুলের সংখ্যার হিসাব করা হয়। সেই হিসেবে মানুষের হাতে ১০টি আঙুল (৯.৪২ টি) থাকার কথা। তবে যেহেতু মানুষের হাতের সংখ্যা দুইটি; তাই সর্বশেষ হিসাব দাঁড়ায় ৪.৭৮ টি। হ্যাঁ, হাতের পাঁচ আঙুল!

হাতের আঙুল সম্পর্কে বিস্তারিত জানার মাধ্যমে ভবিষ্যতে জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে আমরা হয়তো হাতের শক্তিশালী গঠন তৈরি করতে পারবো এবং মানব কল্যাণে সেগুলো ব্যবহার করতে পারবো।

তথ্যসূত্র-

লেখাটি 71-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading