সমুদ্রপাড়ের বিচিত্র প্রাণ

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর বেশিরভাগ রহস্য হয়তো সমুদ্রেই লুকিয়ে আছে। রহস্যের ডেরা সমুদ্রের প্রানিকুলও যেন বিচিত্র সম্ভার। সমুদ্রের গভীরে ঠিক কত প্রজাতির প্রাণী আছে তার সঠিক তথ্য এখনো জানা যায়নি। ভবিষ্যতেও জানা যাবে কিনে সন্দেহ। যতদূর জানা গেছে সে সংখ্যাটাও নগণ্য। মনে করা হয়, সমুদ্রের এক শতাংশ প্রাণী সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। সমুদ্রের জীববৈচিত্র‍্য রক্ষাকারী এমনি কিছু প্রাণী নিয়ে আজকের পর্বটি সাজানো হয়েছে।

রাজ কাঁকড়া

অগভীর সমুদ্রে অথবা লোনা পানিযুক্ত মোহনার বালুকাময় তলদেশে বসবাসকারী এই প্রাণীটির ইংরেজি নাম হর্স শে ক্রাব (Horse shoe crab) অথবা কিং ক্রাব (King crab)। বাংলায় রাজ কাঁকড়া। এটি আর্থোপোডা (Arthropoda) পর্বের  লিমুলাস (Limulus) গণের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রাণী। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেই ট্রিয়াসিক যুগ থেকে এদের দৈহিক গঠনের তেমন পরিবর্তন হয়নি। তাই এদের জীবন্ত জীবাশ্ম বলে।   

ছবিঃ রাজ কাঁকড়া

বাংলাদেশের কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন সমুদ্র অঞ্চলে এদের বেশি দেখা যায় জেলেদের জালের সাথে অথবা খাদ্য শিকারে এরা সমুদ্রের পাড়ে চলে আসে। এদের গঠনেও বৈচিত্র্য দেখা যায়

লিমুলাস এর দেহ দুটি প্রধান অংশে বিভক্ত যথা শিরবক্ষ এবং উদর। শিরবক্ষ মস্তক অঞ্চল এবং ছয় জোড়া উপাঙ্গসহ বক্ষের সমন্বয়ে গঠিত। সমস্ত শিরবক্ষকে আবৃত করে রাখে অশ্বক্ষুরাকৃতির একটি শিরবর্ম।

এশিয়া অঞ্চলে এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। মৃত লিমুলাস মুরগি এবং শূকরের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত  হয়। মনে করা হয় এরুপ খাদ্য সরবরাহ করলে মুরগী বেশি ডিম দেয়। এ প্রাণী থেকে সরবরাহকৃত রং (Dye) ফিল্ম শিল্পে ব্যবহৃত হয়।

পাফার ফিশ(পটকা মাছ)

পটকা মাছ অস্টাইকথিস (Osteichthyes) শ্রেণির ডিওডনটেডি (Diodontidae) গণের  একটি সামুদ্রিক মাছ। এদের বেশিরভাগই সাধারণত অগভীর জলে, প্রায়শই প্রবাল প্রাচীরে , সামুদ্রিক ঘাসের ওপর এবং মোহনায়, দিনের আলোতে সাঁতার কাটার সময় দেখা যায়। গ্রীষ্মমন্ডলীয় আফ্রিকা এবং এশিয়ায় কয়েকটি স্বাদু পানির প্রজাতি দেখা যায় । বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপে এদের বেশি পরিমাণে দেখা যায়। কাঁটাযুক্ত শরীর এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আত্নরক্ষায় হঠাৎ করে প্রচুর পরিমাণে জল বা বাতাস গ্রহণের মাধ্যমে তার শরীরকে স্ফীত করে এই অবস্থায় মাছটিকে ফুটবলের মতো দেখায়। শরীরের বিষাক্ত কাটাগুলো দৃশ্যমান হয় ফলে শিকারি প্রাণীরা ভয়ে পালিয়ে যায় ।

ছবিঃ পটকা মাছ

এই অবস্থায় মাছটি সাঁতার কাটতে পারে না। সাধারণত এটা এদের আত্মরক্ষার কৌশল। বেশিরভাগ পাফার মাছের দেহে বিষাক্ত পদার্থ রয়েছে। বিশেষ করে লিভার, গোনাডস, ত্বক এবং অন্ত্রে। যেকারণে এদের মেলেছে সমুদ্রের সবচাইতে বিষাক্ত প্রাণীর তকমা। বিষাক্ত হওয়া সত্ত্বেও পর্যটকদের কাছে আছে এই মাছের চাহিদা। সমুদ্র থেকে ধরে শুকিয়ে বিক্রির জন্যে তৈয়ার করা হয় এই মাছ। এছাড়াও জাপানে এই মাছ দিয়ে তৈরি করা হয় সুস্বাদু খাবার ফুগু। তবে এমনভাবেই খাবারটি প্রস্তুত করা হয় যেন এর বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রভাবে কারো প্রাণনাশ না হয়। পটকা মাছ সম্পর্কে আরেকটি মজার তথ্য হচ্ছে প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পটকা মাছ স্ত্রী সদস্যদের আকৃষ্ট করতে সমুদ্রের তলদেশে নকশাঁ আঁকে। যা দেখে স্ত্রী সদস্যরা আকৃষ্ট হয় এবং প্রজননে আগ্রহী হয়।

শাপলা পাতা মাছ

ছবিঃ শাপলা পাতা মাছ

সমুদ্রের সৌন্দর্য বর্ধনকারী এই মাছটির  ইংরেজি নাম স্টিংরে (Stingray)। এটি কর্ডাটা পর্বের কনডিকথিস (Chondrichthyes) শ্রেণির ডেজিয়াটিডাই (Dasyatidae) পরিবারের মাছ। বৈজ্ঞানিক নাম মাইলিওবাটোয়েডই (Myliobatoidae)। নাতিশীতোষ্ণ সমুদ্রের অগভীর জলের মাছ এটি। মূলত মাংসাশী প্রাণী। এদের আয়ুষ্কাল ১৫-২৫ বছর।  উচ্চতায় সাড়ে ছ ফুট অবধি বাড়তে পারে এরা। একেকটা মাছের ওজন সর্বোচ্চ ৭৯০ পাউন্ড হতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর, ভারত মালয়েশিয়া ইত্যাদিতে এই মাছকে খাদ্য এবং অনান্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয়।ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) শাপলা পাতা মাছকে বিপন্ন প্রায় প্রজাতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় শাপলা পাতা মাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে শাপলা পাতা মাছ ধরা এবং বিক্রি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

তারামাছ

ইংরেজি নাম স্টার ফিশ(Star fish)৷ মেরুদণ্ডী প্রাণীদের থেকে তারামাছের বৈশিষ্ট্য অনেক আলাদা। তারামাছ অথবা সমুদ্রতারা হচ্ছে অ্যাস্টেরয়ডিয়া (Asteroidea) শ্রেণীর একাইনোডার্মাটা (Echinodermata) পর্বের অন্তর্ভুক্ত অ্যাসট্রোপেকটেন (Astropecten) গণের তারা আকৃতির মাছ। এদের মেরুদণ্ড থাকে না বলে প্রকৃতপক্ষে এদের মাছ বলা হয়না। চোখ থাকলেও এদের নেই কোনো মস্তিস্ক। এমনকি রক্তও নেই। কোনো কারণ বসত এদের হাত কেটে গেলে তা পুনরায় সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের চট্রগ্রাম, কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন দ্বীপে সাগরের লিটোরাল অঞ্চলে অগভীর পানির তলায় বালির উপর A.auranciacus প্রজাতিটিকে ব্যাপকভাবে বিচরণ করতে দেখা যায়। এরা ফটোপজিটিভ হওয়ায় এদের দিনের বেলাতেই বেশি দেখা যায়। চিন, ইন্দোনেশিয়ায় সহ কিছু দেশে এটি সামুদ্রিক খাবার হিসাবে প্রচলিত। প্রজাতি ভেদে তারামাছ ১০ থেকে ৩৪ বছর পর্যন্ত বাঁচে।

তারা মাছ। ছবি কৃতজ্ঞতা- আবিদ হাসান মুরাদ

প্রকৃতপক্ষে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য এত স্বল্প আলোচনায় ব্যাখ্যা করা একেবারেই অসম্ভব। সমুদ্রে এমন হাজার প্রজাতির জীব আছে যাদের সম্পর্কে মানুষ এখনো অবগত নয়। যেসকল জীব আমাদের দৃষ্টিগোচরে আসে আমরা শুধু সেগুলোকেই জানি। কিন্তু দৃষ্টির অগচরে থাকা জীবগুলো সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের অবশ্যই অধ্যায়ন এবং গবেষণা করতে হবে। সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে আমাদের সকলের সচেতন হওয়া উচিত। জেলেদের অজ্ঞতা, অসাধু ব্যবসায়ীদের অনৈতিকতা, সাধারণ মানুষের অসচেতনতা, পর্যটন শিল্পের অব্যস্থাপনা ইত্যাদি কারণে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পরে যাচ্ছে। তাই সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।

তথ্যসূত্র-







বিজ্ঞান নিউজলেটার

যুক্ত হোন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান নিউজলেটারে!
আমরা সাপ্তাহিক ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। 
এ নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। থাকবে নতুন লেখার খবরও।


Loading

লেখাটি 111-বার পড়া হয়েছে।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য লেখা

  • আইনস্টাইন জিগজ্যাগ

    আইনস্টাইন জিগজ্যাগ

  • ডাইনোসর বিলুপ্ত না হলে কেমন হতো পৃথিবীর ভবিষ্যৎ

    ডাইনোসর বিলুপ্ত না হলে কেমন হতো পৃথিবীর ভবিষ্যৎ

  • মুরগির মাংসে শনাক্ত ইশেরিশিয়া আলবার্টিঃ  অজান্তেই বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ঝুঁকি

    মুরগির মাংসে শনাক্ত ইশেরিশিয়া আলবার্টিঃ অজান্তেই বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ঝুঁকি

  • আদতেই কি ফিরে এসেছে ডায়ার নেকড়ে?

    আদতেই কি ফিরে এসেছে ডায়ার নেকড়ে?

  • ভুল নিদানে সন্তান হত্যার দায়ঃ একটি করুণ কেস স্টাডি

    ভুল নিদানে সন্তান হত্যার দায়ঃ একটি করুণ কেস স্টাডি

  • কমোডো ড্রাগন: উপকথার ড্রাগনদের পৃথিবীতে বিচরণ!

    কমোডো ড্রাগন: উপকথার ড্রাগনদের পৃথিবীতে বিচরণ!


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply