​​মস্তিষ্কে ওষুধ পৌঁছে দিবে বিড়ালের মলে থাকা পরজীবী

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

আমাদের রক্ত সংবহনতন্ত্র ও মস্তিষ্কের মধ্যে একটি বাঁধ আছে। একে ব্লাড-ব্রেইন ব্যারিয়ার (Blood-Brain Barrier) বলা হয়। এটি রক্ত থেকে অবাঞ্চিত কোনো কিছু মস্তিষ্কে প্রবেশ করা থেকে বাধা দেয়। যেমন রক্তে যদি কোন জীবাণু, বড় অণু কিংবা পানিআকর্ষী অণু ইত্যাদি থাকে, তাদেরকে আটকে দেয় এই ব্লাড-ব্রেইন ব্যারিযারটি। মস্তিষ্ক আমাদের অতি গুরুত্বপূর্ন অঙ্গ হওয়ায় তার সুরক্ষার জন্যই মূলত এই চেকপয়েন্টের ব্যবস্থা। ব্যারিয়ারটি মূলত কৈশিক জালিকার এন্ডোথেলিয়াল কোষ ও তাতে লেগে থাকা মস্তিষ্কের কিছু কোষ দিয়ে তৈরি। মস্তিষ্কের কোষের মধ্যে আছে এস্ট্রোসাইট (তারকার ন্যায় গ্লিয়াল কোষ) এর প্রান্ত এবং পেরিসাইট নামক বিশেষ কোষ। কৈশিক জালিকার এন্ডোথেলিয়াল কোষগুলো একে অন্যের পাশাপাশি টাইট জাংশনের (Tight Junction) মাধ্যমে যুক্ত থাকে।

(কৃত্রিমভাবে রঙ্গীনকৃত পরজীবী Toxoplasma gondii । উৎস: Eye of Science/Science Photo Library)

তবে, ব্যারিয়ারটি কিছু ক্ষেত্রে আমাদের জন্য মুশকিলের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, আমাদের মস্তিষ্কের যখন কোনো অসুখ বিসুখ হয়, সেইসবের প্রতিকারের জন্য মস্তিষ্কে কিছু ঔষুধ পাঠানোর প্রয়োজন পড়ে। তখন এই ব্যারিয়ার অনেক ক্ষেত্রেই সেইসব ওষুধ কে রক্ত থেকে মস্তিষ্কে প্রবেশে বাধা দেয়। সকল ওষুধের ক্ষেত্রেই যে বিষয়টি এমন হয় তা নয়। তবে অনেক অসুখই আছে যা প্রতিকারে বড় একটি বাধা হচ্ছে এই ব্যারিয়ার।

টক্সোপ্লাজমা গন্ডি: যে পরজীবী ব্লাড-ব্রেইন ব্যারিয়ার কে অতিক্রম করতে জানে

সম্প্রতি একদল বিজ্ঞানী এই সমস্যার একটি অভিনব ও চমৎকার সমাধানের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করেছেন। তাদের গবেষণার বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে নেচার মাইক্রোবায়োলজির জুলাই মাসের একটি গবেষণাপত্রে।

এখানে তারা টক্সোপ্লাজমা গন্ডি (Toxoplasma gondii) নামক একটি প্রোটোজোয়ান-পরজীবীকে ব্যাবহার করেছেন ডেলিভারিম্যান হিসেবে। বিজ্ঞানীরা আগে থেকেই জানতেন, এই পরজীবী সহজেই Blood-Brain Barrier অতিক্রম করতে পারে। যদিও মস্তিষ্কের কোন উল্লেখযোগ্য ক্ষতি সাধন করেনা। আরও মজার বিষয় হচ্ছে যে, এই পরজীবী পাওয়া যায় বিড়ালের মলে (Cat poop)।

যাইহোক, তো, বিজ্ঞানীরা এই পরজীবীর নিঃসরণ তন্ত্র (Secretion System) ব্যবহার করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। এই তন্ত্র মূলত কোষ থেকে বাইরে প্রোটিন নিঃসরণ করে যেমন Rhoptry ও Dense granule। এদের ভিন্নতা হলো, Rhoptry পোষক কোষে (মস্তিষ্কের কোষ নিউরন) প্রবেশ করার পূর্বেই প্রোটিন নিঃসরণ করে। অপরদিকে Dense granule কোষে প্রবেশ করার পর প্যারসাইটোফোরাস ভোকিউল (Parasitophorous Vacuole বা PV) নামক একটি আবরণ তৈরি করে। নিঃসরিত প্রোটিন প্রথমে PV ও পরবর্তীতে PV থেকে হোস্টের কোষরসে (Host Cytosol) প্রবেশ করে।

Toxoplasma gondii এর নিঃসরণ তন্ত্র সমূহ। উৎস: The Swaddle

রেট-সিন্ড্রোম এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং

পরবর্তী ধাপে যাওয়ার আগে একটি রোগের কথা বলে নেই, যার নাম রেট-সিন্ড্রোম (Rett Syndrome)। এটি একটি বিরল জেনেটিক নিউরোলজিকাল ডিসর্ডার। মানুষের X ক্রোমোজোমে অবস্থিত একটি জিন MECP2 (methyl-CpG binding protein 2) তে কোনো মিউটেশন হলে তা MeCP2 প্রোটিনটি তৈরী করতে ব্যার্থ হয়। ফলশ্রুতিতে রেট সিন্ড্রোমের আবির্ভাব ঘটে। জিনটি X ক্রোমোজমে থাকায় এই রোগ মেয়েদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। কারণ মেয়েদের দুটি ও ছেলেদের একটি X ক্রোমোজোম থাকে।

X ক্রোমজোমের MECP2 জিনের মিউটেশনে সৃষ্টি হয় রেট সিন্ড্রোমের। উৎস: Tom DiCesare

এবার আসি কিভাবে উক্ত পরজীবীকে ব্যাবহার করে MeCP2 নামক প্রোটিন কে মস্তিষ্কের কোষে পাঠিয়ে রেট সিন্ড্রোমের সারিয়ে তোলা যায়। তো বিজ্ঞানীরা করলেন কি, তারা টক্সোপ্লাজমা গন্ডির toxofilin ও GRA16 নামক দুটি প্রোটিনের সাথে MeCP2 নামক থেরাপিউটিক (যা রেট সিন্ড্রোমের ওষুধ হিসেবে কাজ করবে) প্রোটিন জুড়ে দিতে চালালেন ছুরি-কাঁচি। এখানে ছুরি-কাঁচি মানে রেস্ট্রিকশন এনজাইম (Restriction Enzyme)। মানে প্রোটিনকে জুড়ে দিতে হলে আগে প্রোটিনগুলোর জিনগুলোকে জোড়তে হবে। তার জন্য লাগবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। তারা জিনগুলোকে এমন ভাবে ইঞ্জিনিয়ার করলেন যাতে করে তা থেকে তৈরি হওয়া প্রোটিন দুটো সংযুক্ত অবস্থায় থাকে যাকে বলে কাইমেরা (Chimeric protein)। এই পদ্ধতিকে বলে ট্রান্সলেশনাল ফিউশন (Translational fusion)।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পর দুটো জিনের সংযোগের ডায়াগ্রাম। উৎস: Bracha et. al. 2024

এই প্রক্রিয়াটিতে সাধারণত টার্গেট জিনটিকে একটি ভেক্টরের (জিন বাহক) সাথে সংযুক্ত করা হয়। যেমন, এক্ষেত্রে একটি ইউক্যারিওটিক এক্সপ্রেশন ভেক্টর pGRA এর সাথে টার্গেট জিন যুক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। তার কারণ, টক্সোপ্লাজমা গন্ডি একটি এককোষী ইউক্যারিওট এবং শুধুমাত্র ইউক্যারিওটিক জিন পড়তে বা এক্সপ্রেস করতে  পারে। এক্সপ্রেশন ভেক্টর হলো একখন্ড ডিএনএ (যেমন প্লাজমিড)। এটি ক্রোমোজোমাল ডিএনএ থেকে স্বাধীনভাবে প্রোটিন সংশ্লেষন করতে পারে।

বিজ্ঞানীরা তাদের পরীক্ষায় দুটো জিনের মিশ্রণে তৈরি একটি এক্সপ্রেশন ভেক্টর পেতে একটি কৌশল ব্যবহার করেছেন। তা হলো, তারা প্রথমে toxofilin প্রোটিনের mRNA থেকে  রিভার্স ট্রান্সক্রিপশনের মাধ্যমে toxofilin cDNA তৈরি করেছেন। এই cDNA কে তারা ভেক্টরের ব্যাকবোন হিসাবে ব্যবহার করে তাতে MECP2 জিনটি সংযুক্ত করেছেন। এভাবে, toxofilin-MECP2 ফিউশন পাওয়ার পর তারা toxofilin promoter এবং কোডিং সিকোয়েন্স-কে প্রতিস্থাপন করেছেন GRA16 promoter এবং কোডিং সিকোয়েন্স দিয়ে, যাতে GRA16-MECP2 ফিউশন পাওয়া যায়।

এবার ভেক্টর এবং ভেক্টরের প্রোডাক্টকে গন্তব্যে পৌঁছানোর পালা

এবার তৈরীকৃত ভেক্টরটিকে পরজীবী (T. gondii) এর ভিতরে প্রবেশ করাতে হবে। আর এটি করা হবে  Transfection (ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে Transformation) নামক পদ্ধতির মাধ্যমে। প্রবেশ করানোর পর পরজীবীর কোষরসে থাকা রাইবোজোম সেই ভেক্টর থেকে হাইব্রিড প্রোটিন তৈরি করবে। কাজ কি শেষ? এখনো না!

এখন কাজ হচ্ছে, তৈরী হওয়া হাইব্রিড প্রোটিনটি নিঃসরণ তন্ত্র Rhoptry বা Dense granule এ ঠিকমতো পৌঁছে কিনা (Localisation) তা খতিয়ে দেখে নিশ্চিত করা। তৈরিকৃত হাইব্রিড প্রোটিন গুলোর GRA16 ও toxofilin অংশের কাজই হচ্ছে পথ চিনিয়ে জায়গামতো নিয়ে যাওয়া। যদি প্রোটিন গুলো ঠিকমতো না পৌছে, তাহলে নিঃসরণ তন্ত্র সেইসব প্রোটিনকে হোস্টের কোষে (যেমন, নিউরন) নিঃসৃত করতে পারবে না। তো, পৌঁছালো কিনা তা যাচাই করার জন্য রয়েছে ইমিউনোস্টেইনিং (Immunostaining) কিংবা Reporter Activation নামক পদ্ধতি।

তো বিজ্ঞানীরা দেখলেন, toxofilin-MeCP2 হাইব্রিড প্রোটিনটি ঠিকমতো Rhoptry তে পৌঁছাতে পারেনা। অর্থাৎ Localisation হয়না। অন্যদিকে, GRA16-MeCP2 হাইব্রিড প্রোটিনটি ঠিকমতো Dense granule এ পৌঁছাতে সক্ষম। পৌঁছানোর পর PV এবং হোস্টের কোষরসে নিঃসৃত হতে সক্ষম, এমনকি হোস্টের নিউক্লিয়াসেও প্রবেশ করতে সক্ষম, যেখানে সে তার কাজ করবে এবং MeCP2 এর অভাবে তৈরি হওয়া রোগ রেট সিন্ড্রোম দূর করবে। এক্ষেত্রে মস্তিষ্কের কোষে পরীক্ষা চালানোর জন্য ব্যবহার করা হয় ল্যাবে তৈরীকৃত কৃত্রিম ব্রেইন (Brain organoid)। ঐদিকে, toxofilin এর সাথে MeCP2 প্রোটিনটি যুক্ত অবস্থায় Rhoptry তে Localisation করতে না পারলেও অন্য কিছু প্রোটিন যেমন GDNF, PARK2 ও TFEB এর সাথে যুক্ত অবস্থায় Localisation করতে পারে।

Rett Syndrome একটি উদাহরণ মাত্র। এরকম আরোও অনেক জটিল ও বিরল রোগ থেকে রক্ষা পেতে সহায় হতে পরে সম্ভাবনাময় এই পরজীবী। তবে, Toxoplasma gondii-এর এইসব অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলিকে কাজে লাগাতে হলে অবশ্যই প্রয়োজন হবে  আধুনিক molecular techniques এবং একটি উন্নত কল্পনার জগৎ।

রেফারেন্স:

  • Bracha, S., Johnson, H. J., Pranckevicius, N. A., Catto, F., Economides, A. E., Litvinov, S., Hassi, K., Rigoli, M. T., Cheroni, C., Bonfanti, M., Valenti, A., Stucchi, S., Attreya, S., Ross, P. D., Walsh, D., Malachi, N., Livne, H., Eshel, R., Krupalnik, V., . . . Rechavi, O. (2024). Engineering Toxoplasma gondii secretion systems for intracellular delivery of multiple large therapeutic proteins to neurons. Nature Microbiology, 9(8), 2051–2072. https://doi.org/10.1038/s41564-024-01750-6
  • What is Rett syndrome? (www.rettsyndrome.org)

লেখাটি 370-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Responses

  1. Riad hossain Avatar
    Riad hossain

    ভালো লিখছিস অনেক বন্ধু।নতুন জানলাম এসব কিছু ভালোই লাগলো।
    চালাই যা এইভাবে আরো বেশি বেশি লিখিস। তোর লেখা কবিতা আমার অন্য বন্ধুদের শুনাইতাম।এখন বিজ্ঞানের লেখা গুলা নিজে পড়বো অন্যদের শুনাবো।

    1. মাজেদুল শিহাব Avatar
      মাজেদুল শিহাব

      ধন্যবাদ রিয়াদ।❤️

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading