অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে স্যামুয়েল হানিম্যান বলে এক জর্মন ডাক্তার নতুন এক চিকিৎসা-পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। এর নাম ‘হোমিওপ্যাথি’। সিনকোনা গাছের বাকল থেকে ম্যালেরিয়ার ওষুধ বানানো যায় এ-খবর অনেক কাল থেকেই মানুষের জানা ছিলো। হানিম্যান পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, সুস্থ মানুষকে সিনকোনা গাছের বাকল খাওয়ালে তার দেহে ম্যালেরিয়ার মতো লক্ষণ দেখা দেয়। এই ঘটনা থেকেই হানিম্যান হোমিওপ্যাথির মূলতত্ত্ব দাঁড় করিয়েছিলেন।
‘Extraordinary claims require extraordinary evidence’~Carl Sagan
হানিম্যানের তত্ত্বের দুটি প্রধান নীতি ছিলো। প্রথমত,যা খেলে কোনো রোগের লক্ষণ দেখা দেয়,সেটাই ভিন্ন ডোজে ওই রোগ সারাতে পারে দ্বিতীয়ত,ওষুধকে যত বেশি লঘু করা যাবে,ওষুধ তত বেশি শক্তিশালী হবে। এই নীতি অনুসারে, অনিদ্রা রোগের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা হতে পারে ক্যাফেইনের অতি লঘুকৃত কোনো দ্রবণ(!)
প্রবর্তনের পর তিনশো বছর ধরে বহু চিকিৎসক এবং ততোধিক রোগী হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় আগ্রহী হয়েছেন। তৈরি হয়েছে পুরোদস্তুর হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ, সরকারি হাসপাতালে রাখা হয়েছে হোমিওপ্যাথের পদ। এতদসত্ত্বেও দুনিয়াজুড়ে বহু স্বতন্ত্র গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে হোমিওপ্যাথির রোগ সারানোর কোনো প্রত্যক্ষ ক্ষমতা নেই। প্লাসিবো’র চেয়ে এর প্রভাব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কম। তাহলে এত চিকিৎসক, প্রতিষ্ঠান এবং মানুষ হোমিওপ্যাথি নিয়ে মাতামাতি করে কেন?
এর উত্তর: হোমিওপ্যাথি একটি স্যুডোসায়েন্স বা অপবিজ্ঞান। অপবিজ্ঞান বিভিন্ন মতবাদ, পদ্ধতি এবং অনুকল্পের এক সমাবেশ,যেগুলো ‘বৈজ্ঞানিক’ বলে শোনায়, কিন্তু আদতে তা নয়। বৈজ্ঞানিক শোনানো,আর আসলে বৈজ্ঞানিক হওয়া দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত জিনিস—যা বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ সহজে ধরতে পারেন না। অপবিজ্ঞান-চর্চাকারীরা এই আপাত দ্বিধার সুযোগ নেয়। তাদের নিয়ত যদি ভালো’ও ধরে নিই,তাহলেও বলতে হবে এহেন চর্চা মানুষকে তার প্রাপ্য সঠিক সেবা কিংবা সাহায্য থেকে বঞ্চিত করে।
তাহলে কীভাবে আপনি বুঝবেন, কোনটা বিজ্ঞান আর কোনটা অপবিজ্ঞান?
এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অতোটা সহজ নয়। প্রচলিত মত অনুযায়ী, কোনো কিছু বৈজ্ঞানিক হতে গেলে তাকে কঠোর পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। কিন্তু সত্যি হলো কিছু বৈজ্ঞানিক চর্চা প্রাথমিকভাবে তত্ত্বনির্ভর থাকে। আমরা এখন অনেক কিছুকে বৈজ্ঞানিক বলে মানি,যা একসময় পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা দুঃসাধ্য ছিলো,জ্ঞানের স্বল্পতা কিংবা প্রযুক্তির অনুন্নতার কারণে। আবার, বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা বিভিন্ন মানদণ্ড, বিভিন্ন লক্ষ্য ও পদ্ধতি মোতাবেক বাস্তব অভিজ্ঞতাকে পাঠ এবং বিশ্লেষণ করতে চায়।
বিংশ শতাব্দীর দার্শনিক কার্ল পপার বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ নির্দিষ্ট করেন: মিথ্যা-প্রতিপাদনযোগ্যতা(Falsifiabilty)। এই গুণ বিজ্ঞান বনাম অপবিজ্ঞান তর্ক ফয়সালার কাজ কিছুটা সহজ করে দেয়। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কিছু নির্দিষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করে যার ভিত্তিতে তাকে মিথ্যা প্রতিপাদন করা যাবে। যেমন কেউ একজন তত্ত্ব করলেন পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে (ধরা যাক এই জ্ঞান তখনো অজানা)। তাহলে তত্ত্বপ্রদানকারীর পক্ষে রাতের আকাশে দৃশ্যমান অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তুর গতি-স্থিতি নিয়েও সুস্পষ্ট অনুমান করা সম্ভব। অনুমানগুলো যদি বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে না মেলে, তবে তাকে বাতিল করা যেতে পারে। পপারের এই নীতি ব্যবহার করে জ্যোতিষশাস্ত্রের ভণ্ডামি প্রমাণ করা যায়। জ্যোতিষ এমনই ভাসাভাসা,সাধারণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত দেয় যা প্রায় যেকোনো পর্যবেক্ষণ/অভিজ্ঞতার সাথেই মেলানো যেতে পারে।
বিজ্ঞান এবং অপবিজ্ঞানের পার্থক্য বোঝার আরেকটি মজার দিক হলো যে কর্তৃপক্ষ কোনো তত্ত্ব প্রস্তাব করছে তারা কীভাবে সমালোচনাকে গ্রহণ করে। কোনো কিছু যদি সত্য বা যৌক্তিক হয়,তাহলে তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সজ্ঞান এবং প্রশিক্ষিত পণ্ডিতদের নানামুখী সংশয়ের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারবে। নতুন আবিষ্কৃত তথ্য কিংবা অভিজ্ঞতা প্রচলিত মত’কে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এবং বিরুদ্ধ-পক্ষে যথেষ্ঠ প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রচলিত তত্ত্বটি বাতিলও হতে পারে। এই ব্যাপারে বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীকে সর্বদাই উদার থাকতে হয়। কিন্তু অপবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে অনুমানের সাথে না মেলা তথ্যকে গোপন করে কিংবা অসৎ উপায়ে তাকে ব্যাখ্যা করতে তৎপর হয়। অপবিজ্ঞানের সমর্থন আসে কোনো একক উৎস বা একই স্বার্থে কাজ করা সমরূপ উৎস থেকে। এর মাধ্যমে অপবিজ্ঞান অপরাপর গঠনমূলক সমালোচনার দ্বার রুদ্ধ করে দেয়। অপবিজ্ঞান কোনোরকম স্বচ্ছ ‘পিয়ার রিভিউ’তেও অংশগ্রহণ করে না। যখন কোনো তত্ত্বকে এভাবে পরীক্ষণের চেয়ে সুরক্ষিত করে রাখার চেষ্টা বেশি করা হবে,তখন বুঝতে হবে এর মধ্যে গলদ রয়েছে।
বিজ্ঞানের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো সার্বিক সুসংগতি। কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব অন্য বিভিন্ন শাস্ত্রসিদ্ধ তত্ত্ব-তথ্য-সত্যের লঙ্ঘন করে না। অন্যভাবে বললে, বিজ্ঞান বস্তুজগতের একটি সামগ্রিক ছবি তৈরি করার চেষ্টা করে বিভিন্ন শাস্ত্রের গবেষণালব্ধ তথ্যের যৌথ নেটওয়ার্কের ভিত্তিতে। জীববিজ্ঞানের গবেষণায় এমন কোনো তথ্য আসতে পারে না,যা পদার্থবিজ্ঞান কিংবা রসায়নের পরীক্ষাসিদ্ধ তত্ত্বের সাথে সংগতিপূর্ণ হবে না। কিন্তু অপবিজ্ঞান এ ধরনের কোনো সংগতি রক্ষার ধার ধারে না। যেমন, সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা বলে থাকে জীবজগতে বিবর্তন হয়নি এবং পৃথিবীর বয়স বড়জোড় হাজার বিশেক। বিবর্তনের কথা যদি বাদও দিই, তারপরেও ভূতত্ত্ব-আবহাওয়াবিদ্যা এবং পদার্থবিদ্যার বিপুল তথ্য-প্রমাণ দিয়ে দেখানো যায় পৃথিবীর বয়স কয়েক বিলিয়ন বছরের কম নয়।
আবার, হোমিওপ্যাথির নীতি অনুসারে ওষুধের দ্রবণ যত পাতলা হবে, তত শক্তিশালী হবে। তেইশ পাওয়ারের ওষুধ বলতে বোঝায় সেখানে একভাগ ওষুধকে ১০২৩ ভাগ দ্রাবকে দ্রবীভূত করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ১০২৩টি দ্রাবক অণুর (দ্রাবক হিশেবে পানি নিলে এর ভর ৩ গ্রাম) বিপরীতে ওষুধ অণু আছে মাত্র একটি! হোমিওপ্যাথি অনুসারে এটা কোনো অসুবিধা নয়, কারণ ব্যবহৃত দ্রাবকের নাকি বিশেষ ‘স্মৃতিশক্তি’ আছে, যার বলে সেখানে একবার কোনো ওষুধ দিয়ে যতোই লঘু করা হোক না কেন, সেই স্মৃতি দ্রাবকে রয়ে যায়। ফলে এতো লঘু করার পর শিশিতে ওষুধের দানা থাকুক আর না থাকুক, দ্রাবকের গুণেই তা রোগ সারাতে পারবে। বলাই বাহুল্য, রসায়নশাস্ত্রে দ্রাবকের ‘স্মৃতিশক্তি’র কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
আমাদের বুঝতে হবে যদিও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিই বাস্তব দুনিয়ার বিভিন্ন সাধারণ-অসাধারণ অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপকরণ, মানবমনের গতিপ্রকৃতি সবসময় একে অনুসরণ করবে এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। বিশেষত, ধর্মীয়-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু আমাদের ভেদরেখাটা টানতে হবে এইজন্য যে বহু মানুষ স্বার্থ হাসিলের জন্য বিশ্বাসকে বিজ্ঞানের মোড়কে হাজির করতে চান; কখনো সুপ্রতিষ্ঠিত, যৌক্তিক বৈজ্ঞানিক মতকে খারিজ করেন।
অনেক অবৈজ্ঞানিক চর্চা ‘কোনো ক্ষতি তো হচ্ছে না’ বলে পার পেয়ে যায়, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না এভাবে অপবিজ্ঞানকে বৈধতা দেওয়া প্রকৃত বৈজ্ঞানিক বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি করে। আজকের অস্থির দুনিয়ায় যখন সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য করা বড়ো দায়, তখন আমাদের ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’কে শাণিত করা যারপরনাই জরুরি হয়ে উঠেছে।
সুতরাং এরপর যখনই কোনো অত্যাশ্চর্য দাবির মুখোমুখি হবেন,নিজেকে প্রশ্ন করুন: এই দাবির সত্যতা কি পরীক্ষা করে দেখা যাবে? দাবিকারী কর্তৃপক্ষ কি নতুন তথ্য-অনুসন্ধানের সাপেক্ষে তাদের তত্ত্বকে সংশোধন করছেন? এই দাবি কি দিন-দুনিয়া সম্বন্ধে আমাদের বৃহত্তর বৈজ্ঞানিক বোঝাপড়ার সাথে সংগতিপূর্ণ হচ্ছে?
তথ্যসূত্র-
Leave a Reply