বিবর্তন তত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণ করতে অনেকেরই তো অনেক প্রয়াস দেখলেন, আজকে আমরা জানব ‘ইয়ং আর্থ ক্রিয়েশানিজম’ নামে এক অদ্ভুত প্রস্তাবনা নিয়ে। বাংলায় বলা যায়, ‘নব্য পৃথিবী সৃষ্টিতত্ত্ববাদ’। পুরো লেখায় ইয়ং আর্থ ক্রিয়েশানিজম-ই ব্যবহৃত হবে। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের আশীর্বাদে আমরা জানতে পেরেছি যে আমাদের মহাবিশ্ব প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে মহা বিস্ফোরণের ফলে আবির্ভূত হয়েছে। আর এই মহাজাগতিক যাত্রায় পৃথিবীর যোগদান মোটামুটি সাড়ে চার শ কোটি বছর আগে। আমরা নানানভাবে এসবের স্বপক্ষে এতসব প্রমাণ পেয়েছি যে এখন আর এতকিছুকে মিথ্যে প্রমাণ করার অবকাশ নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, কিছু লোক প্রাচীন কিছু মিথোলজিকাল বইপত্র ঘেঁটে দেখলেন, পৃথিবীর বয়স দাঁড়ায় ৬ হাজার বছর।
তাই তারা চেষ্টা করলেন এমন এক অপবিজ্ঞান দাঁড় করাতে, যা দিয়ে তাদের এ বিশ্বাস ডিফেন্ড করা যায়। এখানেই আসল ‘ইয়ং আর্থ ক্রিয়েশানিজম’। তাদের মতে ৬ হাজার বছর আগে মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল। এরই মাঝে এই মহাবিশ্ব প্রায় ৯৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ ছড়িয়ে গেলো। হাজার কোটি গ্যালাক্সির জন্ম হলো। তাদের বিশ্বাস মানুষের উৎপত্তি-ও ৬ হাজার বছর আগে বিগ ব্যাং এর পরপরই। অর্থাৎ আজ অবধি যতো প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী এসেছে যদিও বিজ্ঞান মতে বিগ ব্যাং এর ৩ লক্ষ ৮০ হাজার পরও মহাবিশ্বের অবস্থা এতটাই অস্থিতিশীল ছিল যে হাইড্রোজেন ছাড়া আর কোনো মৌল তৈরিই হতে পারেনি [১]। অন্য সব জ্যোতিষ্ক এই দৃশ্যপটে আসতে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও কোটি কোটি বছর। সেই শিশু মহাবিশ্বে প্রথম নক্ষত্রের জন্ম হয়েছে বিগ ব্যাং এরও ১০০ মিলিয়ন বছর পর। আর আমাদের সৌরজতের জন্ম হয়েছে বিগ ব্যাং এর প্রায় ৯২০ কোটি বছর পর [২]! আমাদের মহাজাগতিক বিশলতা, মহাবিশ্বের এই গ্রান্ড স্কেল সেই ইয়ং আর্থ ক্রিয়েশানিস্টদের বোধগম্যের বাইরে।
তাদের ডিলিউশনাল বিশ্বাসের বাইরে যদি আসলে ইতিহাসের কথা বলি, তাহলে ৬ হাজার বছর আগে মানুষ মিশরে বসে মমিকরণের কৌশল শিখে ফেলেছে। কিছুদিনের মধ্যেই পিরামিডও বানিয়ে ফেলবে। না, তখন বিগ ব্যাং ঘটেনি। ৬ হাজার বছর আগে আয়ারল্যান্ডে বসে বসে মানুষ পাথর দিয়ে ‘নিউগ্র্যাঞ্জ’ মনোলিথিক মন্যুমেন্ট বানাচ্ছিলো। আর আমাদের উপমহাদেশে, পাকিস্তানের ইন্ডাস উপাত্যকায় সিন্দু সভ্যতা শুরু হতে যাচ্ছে। গুহায়, পাথরে ইচ্ছামতো ছবি এঁকেছে। তাই একবার ভাবুন, ইয়ং আর্থ ক্রিয়েশানিস্টদের এই প্রস্তাবনা কতটা হাস্যকর। এই ব্যাপারটার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অবশ্য বেশ বড়। সেই হাজার বছর আগেই আব্রাহাম বিন মীর ইবনে ইজরা নামক এক ইহুদী ভদ্রলোক বিশেষ একটি ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত নানান পৌরাণিক ঘটনার সময়কাল গুণে গুণে জানান যে এই পৃথিবীর সৃষ্টি হয় যীশুখ্রিস্ট আসার ৩৬১৬ বছর আগে। অর্থাৎ আমাদের এই মহাবিশ্ব যে অতটাও পুরোনো না, এমন বিশ্বাস মানুষের সুপ্রাচীনকাল আগে থেকেই। ইংরেজ নাট্যকার শেক্সপীয়রও একদা বিস্ময়ের সুরে লিখলেন,
“এই বেচারা পৃথিবী প্রায় ৬ হাজার বছর পুরোনো।”[৩]
তাঁদের দোষও দেয়া যায় না। সে সময়ের খোদ নিউটনকেও জিজ্ঞেস করলেও হয়ত এমনই উত্তর দিতেন। কারণ পৃথিবী তথা এই মহাবিশ্বের বয়স নিয়ে আমাদের হাতে তখনও প্রমাণাদি ছিল না তেমন। কিন্তু, আঠারো শতকের দিকে ঘটতে থাকে ‘এইজ অব এনলাইটেনমেন্ট’। তারপর বিজ্ঞানের উন্নতির ধারাবাহিকতায় আমরা মাটির শিলাস্তর, রেডিওএক্টিভ কার্বনের মাধ্যমে বয়স নির্ধারণ, ডপ্লার ইফেক্টের মাধ্যমে মহাবিশ্বের সম্প্রসারিত হওয়ার প্রমাণ ও ফলশ্রুতিতে মহাবিশ্বের বয়স—নানান দিকে বিজ্ঞানের নানান ক্ষেত্রে উন্নতির মাধ্যমে আমরা জানতে থাকলাম আমাদের আসল ইতিহাস। আমাদের, এই মহাজগতের ইতিহাস কোনো পৌরাণিক গ্রন্থে লেখা নেই, ছিল ও না। লেখা ছিল পাথরে, শিলাস্তরে, ফসিলে, নক্ষত্রের আলোতে—আমাদেরই চারপাশে, প্রকৃতিতে।
আকাশসম প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও গত শতকে, ১৯২৩ সালে ম্যাকক্রিডি প্রাইস নামক এক সেভেন্থ ডে এডভেন্টিস্ট খ্রিস্টান ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি এই ইয়ং আর্থ এর ভিত্তিহীন দাবী আবারো জোরদমে প্রচার শুরু করেন। ভদ্রলোক দশকের পর দশক বিজ্ঞানীমহল থেকে তার দাবির শত শত খন্ডন, যুক্তি-প্রমাণ পেয়েও এই অন্ধবিশ্বাস-ই কামড়ে ধরে রাখেন। তারপর ১৯৬১ সালে এসে হেনরি মরিস এবং জন হুইটকম্ব নামক দুই ধর্মপ্রাণ ভদ্রলোক জীববিজ্ঞান, পরিবেশবিজ্ঞান, অণুজীববিজ্ঞান, জিনবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ববিজ্ঞান, এনাটমি, জীবাশ্মবিজ্ঞান, মলিকিউলার বায়োলজি, জেনেটিক্স ইত্যাদির সাথে একপ্রকার যুদ্ধ ঘোষণা করে ম্যাকক্রিডি প্রাইসের ইয়ং আর্থ ক্রিয়েশানিজম আরও পাকাপোক্ত করার উদ্দেশ্যে ‘দ্য জেনেসিস ফ্লাড’ নামে একটা বই লিখেন। যে বইটা পরবর্তীতে আধুনিক যুগের ইয়ং আর্থ ক্রিয়েশানিস্টদের কাছে আসমানী কিতাবতুল্য হয়ে ওঠে। বইটায় লেখক দু’জন কল্পনার মাধুরী মিশিয়ে নানান চটকদার কথাবার্তা বলেছেন। যেমন, মরিস এবং হুইটকম্ব যুক্তি দিয়েছিলেন যে পৃথিবী ভূতাত্ত্বিকভাবে খুব নতুন এবং মহাপ্লাবন মাত্র একবছরেই, হ্যাঁ ঠিক শুনেছেন, মাত্র এক বছরের মধ্যেই বেশিরভাগ ভূতাত্ত্বিক স্তর সৃষ্টি করেছে [৪]
আমরা একেকটা শিলাস্তরে যেসব ফসিল খুঁজে পাই, সেগুলোকে কখনো সেই নির্দিষ্ট স্তর ব্যতিত আর কোথাও পাওয়া যায় না। অর্থাৎ, একটা স্তর যত নীচে আর যত পুরোনো, সেখানে পাওয়া ফসিলগুলোও ততটাই পুরোনো। এরমানে যে স্তরে ডাইনোসরের ফসিল পাওয়া গেছে, সে স্তরে কোনো প্রাইমেট (মানুষ সহ অন্যান্য গ্রেইট এপ) দের খুঁজে পাবেন না। কিন্তু অদ্ভুত কথা হলেও সত্যি যে, ইয়ং আর্থ ক্রিয়েশানিস্টরা বিশ্বাস করে মানুষ আর ডায়নোসোর একই সময়ে পৃথিবীতে ছিল। বিশাল উল্কার আঘাতে পৃথিবী লাখ লাখ বছর নরক হয়ে থাকলেও, কোটি কোটি প্রাণির বিলুপ্তি ঘটলেও তাদের মতে মানুষ আরাম আয়েশে টিকে থেকেছে। তারা তাদের এ উদ্ভট দাবীর স্বপক্ষে যতবার যত প্রমাণ দেখিয়েছে, সব পরবর্তীতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এবং হাসির খোরাক হয়েছে। এমন কিছু মানুষ ঢুকে পড়েছে আমাদের বাংলাদেশেও।
এ নিয়েই আমাদের পরবর্তী গল্পটা। এবার তাদের কিছু মিথ্যাচার এবং সেসবের খন্ডন করা যাক।
বঙ্গদেশের নিউ আর্থ ক্রিয়েশানিজম এবং তাদের নির্জলা মিথ্যাচার
এ অংশে কোনো ধর্মীয় সংগঠনকে বা কোনো লেখক, ব্যক্তিবর্গকে কটাক্ষ করার কোনো উদ্দেশ্য নেই। ২০২০ সালে বাংলাদেশের একজন ডাক্তার বেশ কাঠখড় পুড়িয়ে বিবর্তন তত্ত্বকে এক হাত দেখে নিয়ে একটা চমৎকার তথ্যসমৃদ্ধ বই লিখেন। ডাঃ রাফান আহমেদের বইটির নাম, “হোমো স্যাপিয়েন্সঃ রিটেলিং আওয়ার স্টোরি”। অর্থাৎ বইয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে, তিনি আমাদের গল্পটা নতুন করে বলতে চান। কতটা নতুন করে?
বইটির (১ম সংস্করণের) ১১৬ পৃষ্ঠায় ভদ্রলোক পূর্ণবিশ্বাসে লিখলেন,
“অনেক ফসিল,পাথরের তৈরি তৈজসপত্র ও হাতিয়ার পাওয়া গেছে যা বহু প্রাচীন, বিবর্তনের গল্পের সাথে মিলে না। তাই নানাভাবে বাদ দেয়া হয়েছে।”
এহেন বক্তব্যের সার হচ্ছে, বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী আধুনিক মানুষ এসেছে প্রায় এক লক্ষ বছর আগে। আর, ভাষা শেখা শুরু হয়েছে ৫০ হাজার বছর আগে। আসবাবপত্র পাবার কথা মাত্র ২০–৩০ বছর আগের। কিন্তু কয়েক কোটি বছর বা ১০/১২ লক্ষ বছর আগে এসব আসবাবপত্র পেয়ে গেছে মানুষ। অতএব, বিবর্তন তত্ত্ব ভুয়া। এ তত্ত্ব বাঁচাতে এসব প্রমাণাদি নাকি গোপন করা হচ্ছে। ব্যপারটা পুরোপুরি জানতে ভদ্রলোকের দেয়া রেফারেন্সগুলো ঘাটাঘাটি শুরু করলাম।
তারপর দেখা গেলো, ভদ্রলোকের বইয়ে উপরে উল্লেখ করা বক্তব্যটির নীচে সাইট করা আছে “মাইকেল ক্রেমো” নামে এক “আর্কিওলজিস্টকে”। ভাবলাম, দেখে আসা যাক এই মাইকেল ক্রেমো কে। কেনই বা তার মনে হল ইভোলিউশন কেবল ষড়যন্ত্রে ভরপুর!
খোঁজ নিয়ে দেখি তার আরেক নাম দ্রুতকর্ম দাস। সে পেশায় ফ্রী-ল্যান্সার। নিজেকে বৈদিক সৃষ্টিতত্ত্ববাদী(Vedic Creationist) আর অল্টারনেটিভ আর্কিওলজিস্ট দাবি করে। একই সাথে নিজেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস’(সংক্ষেপে ইস্কন)-এর একজন গর্বিত গবেষক হিসেবে পরিচয় দেন।
৭০ দশক থেকে শ্রী কৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত এই ইস্কন সদস্যের বিবর্তন নিয়ে বেশ অদ্ভুত চিন্তাভাবনা দেখতে পেলাম। তার মতে, ঈশ্বরের মৎস্য অবতার হচ্ছে আধুনিক রেপ্টাইল, ম্যামালদের পূর্বপুরুষ। আবার, তার ধারণা এপম্যানের কথা ডারউইনই আগে উল্লেখ করেন নি। হাজার বছর আগে “রামায়ণেও” লিপিবদ্ধ ছিলো। তিনি এও বিশ্বাস রাখেন, মানুষ কোটি বছর আগেই এসেছে। ভদ্রলোকের বক্তব্য,
“The idea of ape-men is not something that was invented by Darwinists of the nineteenth century. Long before that, the ancient Sanskrit writings were speaking of creatures with apelike bodies, humanlike intelligence, and a low level of material culture. For example, the Ramayana speaks of the Vanaras, a species of apelike men that existed millions of years ago. But alongside these ape-men existed humans of our type. The relationship was one of coexistence rather than evolution.”
এখন, ডাঃ রাফান আহমেদ কার ঘাড়ে পা রেখে মানুষের মধ্যে ফসিল নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন, তা একটু ভেবে দেখেছেন? বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত কোন তত্ত্বের বিরোধিতা করতে যেখানে প্রয়োজন সম পর্যায়ের গবেষণা, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ—সেখানে উনি নেমেছেন ইস্কনের ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গকে সাইট করতে। রাফান আহমেদ এর দেয়া লিংকে কি ছিল?
সে লিংকে ছিল ১ ঘণ্টার লম্বা ভিডিও। ভিডিওটা মাইকেল ক্রেমো বা দ্রুতকর্ম দাসের বৈদিক সৃষ্টিতত্ত্বের আলোকে লেখা “Forbidden Archaeology” নামের বই নিয়ে তারই বক্তব্য। সেখানে কিছু ফসিলের সময়কাল বিবর্তন তত্ত্বের সাথে যায় না বলে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে, এমন এক উদ্ভট বক্তব্য ছেড়ে দিলেন। আর এটাই আমাদের এই ডাক্তার সাহেবের কাছে গস্পেল ট্রুথ হয়ে ধরা দিল যে বইয়ে সাইট করতে হল। এগুলিকেই তিনি বিবর্তন তত্ত্বের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ভাবতে পছন্দ করেন সম্ভবত। দেখুন, বিজ্ঞান থাকবে বিজ্ঞানের জায়গায়। ধর্ম ধর্মের জায়গায়। যে ব্যক্তি আর্কিওলজি, বিবর্তন তত্ত্বকে ধর্মীয় মিথোলজির ছাঁচে ফেলে নিজের মতো ব্যখ্যা করেন, সে ব্যক্তি কিভাবে সাইটেবল হতে পারেন কোনো বইয়ে? ভিডিওটার হাই-লাইট দেখে নিতে পারেন পদটীকা ও তথ্যসূত্রে দেয়া লিংক থেকে [৫]।
এবার কথা হচ্ছে, দ্রুতকর্ম দাস কিন্তু এসব উদ্ভট আর্কিওলজির পায়োনিয়ার না। তার বইয়ে উল্লেখ করা ডায়নোসোর আমলের হাড়ি পাতিলের এসব উদ্ভট দাবি প্রথম তুলেছে পশ্চিমের ইয়ং আর্থ ক্রিয়েশানিস্টরাই। উনি কেবল ভুল গুগল সার্চের বলি হলেন।
এখন কথা হচ্ছে, এদের দাবি তোলা এসব ফসিল কি সত্যিই আছে, যেগুলি বিবর্তন তত্ত্বের সাথে যায় না?
উত্তর হচ্ছে, “না”। এগুলি কেবল কিছু ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গের প্রোপাগান্ডা। কিছু পুরোনো আসবাবপত্র পাওয়ার পর প্রাথমিকভাবে খুব প্রাচীন মনে হলেও পরবর্তীতে কার্বন ডেটিং আর ফ্লোরিন টেস্ট করে সঠিক বয়স নির্ধারণ করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে এগুলো আসলেই ততোটা প্রাচীন নয় এবং এর সঙ্গে বিবর্তন তত্ত্বের কোনো বিরোধিতা নেই। কিন্তু, এসব জিনিসের বয়স নিশ্চিত হওয়ার আগেই সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের প্রোপাগান্ডা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, এগুলোর ব্যাপারে দুইবার না ভেবে রাফান আহমেদরা বিবর্তন তত্ত্বের বিরুদ্ধে ‘শক্তিশালী প্রমাণ’ হিসেবে লুফে নেয়।
একটা উদাহরণ দেয়া যাক।
১৯৩৬ সালে টেক্সাসে পাওয়া যায় ফসিলাইজড একটা হ্যামার। এই সো কল্ড ফসিলাইজড হ্যামার কে বলা হয় “লন্ডন আর্টিফেক্ট”।
“এটা ডায়নোসর যুগের”— এমন দাবি প্রথম তোলে কার্ল বগ নামের এক ক্রিয়েশানিস্ট। যে নিজেকে বেশ কিছু (অনিবন্ধিত) প্রতিষ্ঠান থেকে ডক্টরেট নেয়া দাবি করতো। তার নিজের স্থাপিত “ক্রিয়েশান এভিডেন্স মিউজিয়াম” এ রেখে নিজেই দাবি করলো এটা ডায়নোসর যুগের। আরেকটা আইরোনি ব্যাপার কি জানেন? এই মিউজিয়ামের উদ্দেশ্য পৃথিবীকে মাত্র ৬ হাজার বছরের পুরোনো একটা গ্রহ হিসেবে তুলে ধরা। তার মতে ডায়নোসর ও মানুষেরা কয়েক হাজার বছর আগেও এক সাথে ছিলো।
এই কার্ল বগের দাবি সায়েন্টিফিক কমিউনিটিতে সিউডোসায়েন্স হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি, আরও আইরোনি ব্যাপার হচ্ছে, Answers in Genesis ও Answers in Creation নামের কিছু ধর্মীয় ক্রিয়েশানবাদী সংস্থাও এই কার্ল বগের প্রচারণাকে প্রতারণামূলক দাবি করে। যাইহোক, এই হ্যামারটাকে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এটা ১৯ শতকের কোনো মাইনারের হ্যামার হতে পারে।
এরকম আরও অনেক তথাকথিত ফসিল বা পুরোনো আসবাবপত্র পাওয়া গেছে, যেগুলি ব্যবহার করে বিবর্তন তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছে। রাফান আহমেদ এর বইয়ে দেয়া ৩-৫ কোটি বছর আগের ‘Mortar Pestle’ ও সেরকম এক প্রোপাগান্ডা। [৬]
এমন উদাহরণ আরও অনেক আছে ৷ যেমন, ‘ম্যালাকাইট ম্যান’দের ফসিল যারা ‘মোয়াব ম্যান’ নামেও খ্যাত । ১৯৭১ সালে অনেকগুলো ফসিল পাওয়া যায়। বিবর্তনবিরোধীরা বলেছিল এগুলো নাকি ১৪ কোটি বছর আগের। কিন্তু পরবর্তী পরীক্ষায় প্রমাণিত হয় এগুলো মাত্র ১০০-১৫০ বছর আগের নেটিভ আমেরিকান’দের! [৭] কিন্তু রাফান আহমেদ দের তো আর এত খবর নেয়ার সময় নেই। ভদ্রলোক এমন সব প্রমাণ টেনে বই ভরেছেন, যেসব প্রমাণের কোনো ভিত্তি নেই। খোঁজ নিতে গেলে হাস্যকর সব ক্রিয়েশানিস্ট ক্লাউন বেরিয়ে আসে। তাই পাঠকগণের প্রতি আমার প্রশ্ন, এসব বইকে বিবর্তন তত্ত্বের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের আগে একটু ভেবে নেবেন কিনা?
তথ্যসূত্রঃ
- [১] Larson, R. B., & Bromm, V. (2024, February 20). The First Stars in the Universe. Scientific American. https://www.scientificamerican.com/article/the-first-stars-in-the-un/
- [২] Sun: Facts – NASA Science. (n.d.). https://science.nasa.gov/sun/facts/
- [৩] Shakespeare’s (1599) line given to Rosalind addressing Orlando in As you like it (IV, 1:90).
- [৪] Whitcomb, JC (1960). The Genesis Flood: The Biblical Record and Its Scientific Implications. P&R Publishing. ISBN 978-0-87552-338-5
- [৫] Talks at Google. (2021, March 6). Highlights: Michael Cremo | Forbidden Archaeology | Talks at Google [Video]. YouTube. https://www.youtube.com/watch?v=C6UdLVXiYyI
- [৬] Reply to Steiger’s MOM Review. (n.d.). http://www.talkorigins.org/faqs/mom/mom-reply.html
- [৭] Moab Man and Malachite Man. (n.d.). http://paleo.cc/paluxy/moab-man.htm
Leave a Reply