ব্লিডিং ডিজঅর্ডার কী এবং কেন হয়?

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

শরীরে কোথাও ধারালো কিছুর আক্রমণে কেটে গেলে কতক্ষণ রক্ত পড়ে? দুই মিনিট? চার মিনিট? কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় যে রক্ত পড়া বন্ধই হচ্ছে না। কেন?

আমাদের শরীরের কোথাও কেটে গেলে সেখানে অণুচক্রিকা সক্রিয় হয়ে প্লাগ তৈরি করে। ফলে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। যদি ছোটোখাটো কাটা হয় তাহলে এভাবেই রক্তপড়া বন্ধ হয়। রক্তবাহিকা বেশি কেটে গেলে তখন রক্ত জমাট বাঁধতে থাকে। সুস্থ মানুষের রক্তক্ষরণ কাল (ব্লিডিং টাইম) ১-৬ মিনিট এবং রক্ত জমাট বাঁধার সময় (ক্লটিং টাইম) ৬-১০ মিনিট। এই সময়সীমা বিলম্বিত হলে বুঝতে হবে যে, কোনো না কোনো কারণে রক্ত ঠিকমতো জমাট বাঁধছে না ফলে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সব ধরনের অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণকে এক কথায় ব্লিডিং ডিজঅর্ডার বলা হয়।

ব্লিডিং ডিজঅর্ডার তিনভাবে হতে পারে, রক্তবাহিকার প্রাচীরে অস্বাভাবিকতা, অণুচক্রিকার সংখ্যাহ্রাস বা ঠিকমতো কাজ না করলে এবং রক্ত জমাট বাঁধার ফ্যাক্টরগুলো অকার্যকর হয়ে পড়লে। শেষেরটির কারণে সংঘটিত ব্লিডিং ডিজঅর্ডারকে কোয়াগুলেশন ডিজঅর্ডারও বলা হয়ে থাকে। 

রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া

রক্তবাহিকার কোথাও ক্ষত হলে যেভাবে রক্ত জমাট বাঁধে। ছবিসূত্র- Blood Clotting – Anatomy Ch. 10
  • অণুচক্রিকা থেকে থ্রম্বোপ্লাস্টিন নামের এনজাইম বের হয়, যা রক্তের প্লাজমা প্রোটিন প্রোথ্রম্বিনকে থ্রম্বিনে পরিণত করে। 
  • থ্রম্বিন এনজাইমের মতো কাজ করে আরেক প্লাজমা প্রোটিন ফাইব্রিনোজেনকে ফাইব্রিন মনোমারে পরিণত করে। 
  • ফাইব্রিন মনোমার থেকে ফাইব্রিন পলিমারের জালক তৈরি হয়। এটি ক্ষতস্থানে রক্তকণিকা ও প্রোটিনকে আটকে ফেলে ক্লট বা রক্তপিণ্ড তৈরি করে।

 এই কাজগুলো ঠিকমতো না হলেই কোয়াগুলেশন ডিজঅর্ডার দেখা দেয়।

কোন কোন টেস্ট করে ব্লিডিং ডিজঅর্ডার শনাক্ত করা যায়?

ব্লিডিং ডিজঅর্ডারগুলো শনাক্ত করার জন্য কিছু স্ক্রিনিং টেস্ট করা হয়ে থাকে। প্রত্যেকটির একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে যা দীর্ঘায়িত হলেই রোগ ধরা পড়ে। যেমন:

  • রক্তক্ষরণ কাল বা ব্লিডিং টাইম (BT) : ১-৬ মিনিট
  • রক্ত জমাট বাঁধার সময় বা ক্লটিং টাইম (CT) : ৬-১০ মিনিট
  • অ্যাক্টিভেটেড পার্শিয়াল থ্রম্বোপ্লাস্টিন টাইম (APTT) : ৩২-৪০ সেকেন্ড 
  • প্রোথ্রম্বিন টাইম (PT) : ১০-১২ সেকেন্ড 
  • থ্রম্বিন টাইম (TT) : মোটামুটি ১৪ সেকেন্ড 

ব্লিডিং ডিজঅর্ডারের মোটাদাগের কারণগুলো

রক্তবাহিকার অস্বাভাবিকতা

রক্তবাহিকার প্রাচীরে কোলাজেন প্রোটিন থাকে, যেটি প্রোকোলাজেন হিসেবে তৈরি হয়। প্রোকোলাজেনকে কোলাজেনে পরিণত করতে হলে চাই ভিটামিন সি। দেহে ভিটামিন সি এর অভাব হলে তখন যথেষ্ট কোলাজেন তৈরি হয় না, ফলে রক্তবাহিকার প্রাচীর ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। তখন ত্বক বা মিউকাস মেমব্রেন বা শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গের ছোট ছোট শিরা বা কৈশিক জালিকা ফেটে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে পারপুরা (purpura)। চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণের ফলে যে লাল বা বেগুনি বুটির মতো দেখা যায়, তাকে বলে ব্লচ। এই ব্লচ পারপুরার অন্যতম প্রধান লক্ষণ। এছাড়া দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তপড়া বা অস্থিসন্ধিতে ব্যথা হতে পারে।

অণুচক্রিকার সংখ্যা কমে গেলেও পারপুরা দেখা দিতে পারে। অনুচক্রিকার সংখ্যা কমে যাওয়াকে বলে থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া। পারপুরার ফলে চামড়ায় যে বিভিন্ন দাগ তৈরি হয়, গ্রামেগঞ্জে অনেকে একে শয়তান বা জ্বিনের আঁচড় মনে করে। তাই এ বিষয়ে সচেতনতা জরুরি। পারপুরার ক্ষেত্রে ব্লিডিং টাইম বেড়ে যায় কিন্তু ক্লটিং টাইম স্বাভাবিক থাকে।

অণুচক্রিকা কমে গেলে 

অস্থিমজ্জার রোগকে বলা হয় মায়েলোডিসপ্লাস্টিক ডিজঅর্ডার। এই রোগে সব ধরনের রক্তকণিকার সংখ্যা কমে যায়। স্বভাবতই তখন অণুচক্রিকাও কমে যায়। তবে অন্য কারনেও কমতে পারে। যেমন ডেঙ্গুজ্বরে, দেহে অণুচক্রিকার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হলে, প্লীহার রোগে অধিক অণুচক্রিকা ধ্বংস হলে এবং রক্তদান করলেও অণুচক্রিকা হ্রাস পায়। 

প্রতি ঘন মিলিমিটারে স্বাভাবিক প্লেটলেটের সংখ্যা দেড় থেকে চার লক্ষ। এই সংখ্যা ৫০ হাজারের নিচে নামলে তাকে বলে থ্রমবোসাইটোপেনিয়া। বলে রাখা ভালো যে অণুচক্রিকার আরেক নাম থ্রমবোসাইট। ৩০ হাজারের নিচে নামলে ব্লিডিং ডিজঅর্ডার এবং হেমারেজ বা শরীরের ভেতর রক্তক্ষরণ এর প্রবণতা দেখা যায়। সংখ্যাটা হাজার দশেকের নিচে নামলে তাকে প্রাণঘাতী বলে ধরে নেওয়া হয়।

অণুচক্রিকা প্রতিদিন দেহের অনেক ক্ষতস্থান পূরণ করে, যেগুলো আমরা প্রায় সময়ই টের পাই না। তারা আগে নিজেরা সক্রিয় হয়ে প্লেটলেট প্লাগ তৈরি করে। এরপরও রক্ত ক্ষরণ বন্ধ না হলে নানা ফ্যাক্টরকে সক্রিয় করে রক্ত জমাট বাঁধতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। এখন যদি প্লেটলেটই কমে যায়, তাহলে রক্ত কীভাবে জমাট বাঁধবে? আর রক্ত পড়া বন্ধ হবে কীভাবে? তাই প্লেটলেট কম থাকার কারণেও এক ধরনের পারপুরা দেখা যায়, যাকে বলে থ্রম্বোসাইটোপেনিক পারপুরা। 

রক্ত জমাট বাঁধার ফ্যাক্টরগুলো অকার্যকার হয়ে পড়লে 

রক্ত জমাট বাঁধায় থাকে প্লেটলেট থেকে কিছু ফ্যাক্টর এবং রক্ত প্লাজমায় থাকা কিছু ফ্যাক্টরের কারসাজি। এদের কার্যক্রম স্বাভাবিক না থাকলে দীর্ঘক্ষণ রক্ত পড়লেও জমাট বাঁধে না। তখন ব্লিডিং টাইম স্বাভাবিক থাকলেও ক্লটিং টাইম অনেক বেড়ে যায়। নানা কারণে এই ফ্যাক্টরগুলোর কাজ ব্যাহত হতে পারে। যেমন: 

ভিটামিন কে এর অভাব: ভিটামিন কে রক্ত জমাট বাঁধার ফ্যাক্টরগুলোর সক্রিয়তায় খুবই দরকার, বিশেষত ফ্যাক্টর ২, ৭, ৯, ১০। বলে রাখা দরকার যে, রক্ত জমাট বাঁধার ফ্যাক্টর আছে মোট ১৩টি। এদের ১ থেকে ১৩ এভাবে নাম্বারিং করা হয়। ভিটামিন কে চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন। সবুজ শাকসবজি যেমন পালংশাক, পার্সলে, লেটুস পাতা, বাঁধাকপি, ফুলকপি এবং প্রানিজ আমিষ যেমন মাছ, মাংস, ডিম,  কলিজায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন কে পাওয়া যায়। যেহেতু চর্বিতে দ্রবণীয়, তাই অন্ত্র থেকে শোষিত হতে এর যকৃতের সাহায্য লাগে। যখন হেপাটাইটিস, জন্ডিস, লিভার সিরোসিস এসব কারণে যকৃত ঠিকমতো কাজ করতে পারে না, তখন ভিটামিন কে এর শোষণ বাধাগ্রস্ত হয়, যা রক্ত জমাট বাধার সামগ্রিক প্রক্রিয়াকেই বাধাগ্রস্ত করে।

হিমোফিলিয়া: যদি ক্লটিং ফ্যাক্টরই না থাকে, তাহলে কাজ করবে কীভাবে? হ্যাঁ, হিমোফিলিয়া এমন একটি সেক্স ক্রোমোজোমাল ডিজিজ যেখানে ফ্যাক্টর ৮ আর ৯ ( অ্যান্টিহিমোফিলিক ফ্যাক্টর) এর ঘাটতি থাকে। একে সেক্স ক্রোমোজমাল ডিজিজ বলে কারণ এটি সেক্স ক্রোমোজমের মাধ্যমে বাহিত হয়। সেক্স ক্রোমোজোম দু’রকম হয়, X আর Y। এই রোগটি কেবল X ক্রোমোজোমের মিউটেশনের ফলেই হয়। তাই একে X লিংকড ডিজঅর্ডারও বলে। মিউটেশন হলো ক্রোমোজোমের কোনো জিনে পরিবর্তন। যেখানে X ক্রোমোজোম ত্রুটিপূর্ণ জিন বহন করে । পুরুষের একটিমাত্র X ক্রোমোজোমে মিউটেশন হলেই তারা এই রোগে আক্রান্ত হয়। কিন্তু নারীদের দুটি X ক্রোমোজোম থাকায় একটি আক্রান্ত হলেও অন্যটি সুস্থ থাকে, ফলে তারা আক্রান্ত না হয়ে বাহক হয়। বিরল ক্ষেত্রে দুটো ক্রোমোজোমে মিউটেশন হয়ে নারীরাও আক্রান্ত হতে পারে। হিমোফিলিয়ার জিন বাহক নারী ও আক্রান্ত পুরুষের মধ্যে বিয়ে হলে তাদের ছেলেশিশুরা ৫০% হিমোফিলিক হবে। আর মেয়েশিশুরা ৫০% হিমোফিলিক এবং ৫০% বাহক হবে।

হিমোফিলিয়া থাকলে সার্জারির পরে, দুর্ঘটনায় এমনকি দাঁত তোলার পরেও দীর্ঘসময় রক্তক্ষরণ হতে থাকে। রক্ত জমাট বাঁধার ফ্যাক্টর VIII বা IX পরীক্ষা করে হিমোফিলিয়া শনাক্ত করা হয়৷ ফ্যাক্টর ঘাটতি পূরণ করার জন্য ইনজেকশন দেওয়া হয়। 

আবার ভন উইলেব্র্যান্ড ফ্যাক্টর নামে প্রোটিনের অভাবে এক ধরনের ব্লিডিং ডিজঅর্ডার হয়, যাতে ফ্যাক্টর VIII ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। একে ভন উইলেব্র্যান্ড ডিজিজ বলা হয়। হিমোফিলিয়া আর ভন উইলিব্র‍্যান্ড ডিজিজকে একত্রে হেরেডিটারি বা বংশগতীয় ব্লিডিং ডিজঅর্ডার বলা হয়।

ডিসএমিনেটেড ইন্ট্রাভাস্কুলার কোয়াগুলেশন (DIC) : এই রোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন টিস্যুতে হুটহাট ক্লটিং ফ্যাক্টরগুলো সক্রিয় হয়ে যায়৷ তখন বিভিন্ন জায়গার রক্তবাহিকায় রক্ত জমাট বাঁধতে থাকে। ক্ষত হলে সেখানে রক্ত জমাট বাঁধানোর মতো ক্লটিং ফ্যাক্টর থাকে না। 

প্রতিকার ও প্রতিরোধ

বংশগত ছাড়া অন্যান্য ব্লিডিং ডিজওর্ডারগুলো নিরাময়যোগ্য। এক্ষেত্রে ভিটামিন-কে, ভিটামিন -সি ও কপার সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করলেই সমস্যাগুলো দূর হয়ে যায়। বংশগত রোগগুলো প্রতিরোধের জন্য, বিয়ের আগে বর-কনের রক্ত পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত এবং নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে না হওয়াই ভালো। 

আর যাদের ব্লিডিং ডিজঅর্ডার নিরাময়যোগ্য নয় (যেমন হিমোফিলিয়া বা ইডিওপ্যাথিক পারপুরা) তাদের যেকোনো কাটা ছেঁড়ার ক্ষত থেকে সাবধান থাকতে হবে।

ব্লিডিং ডিজঅর্ডার নিয়ে কিছু প্রশ্ন

হিমোফিলিয়া আর থ্যালাসেমিয়া কি এক?

না, হিমোফিলিয়াতে ক্লটিং ফ্যাক্টরের অভাবে রক্তক্ষরণ বেড়ে যায়, যেখানে থ্যালাসেমিয়াতে রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া দেখা যায়। থ্যালাসেমিয়া রোগে হিমোগ্লোবিনের গ্লোবিন প্রোটিনে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়।

হিমোফিলিয়া কি শুধুই বংশগত?

এখন ২৫% ক্ষেত্রে হিমোফিলিয়ার কারণ মিউটেশন। বংশগত বৈশিষ্ট্যের আকস্মিক ও স্থায়ী পরিবর্তনই হলো মিউটেশন। কেমোথেরাপি, অতিবেগুনি রশ্মি বা অন্য কোনো কারণে জিনের অস্বাভাবিকতা ঘটে হিমোফিলিয়া হতে পারে।

মেনোরেজিয়া কি ব্লিডিং ডিজঅর্ডার?

মেনোরেজিয়া বা মাসিকের সময় অত্যধিক রক্তপাতের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডিম্বাশয়ের সমস্যা ও হরমোন দায়ী। মাঝে মাঝে ভন উইলিব্র্যান্ড ফ্যাক্টরের সম্পৃক্ততা থাকলেও এটিকে ঠিক ব্লিডিং ডিজঅর্ডার বলা চলে না।

তথ্যসূত্র-

লেখাটি 26-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো, মাসে একবার। নিউজলেটারে সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে বিশ্লেষণ থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading