আমাদের চোখের সামনেই ঘটে চলা নানান বিবর্তনীয় ঘটনা নিয়ে আজকের আসরে বসার পূর্বে কিছু ব্যাপার পরিষ্কার করে রাখা উচিত বলে মনে করি। আমাদের এই প্রকৃতির কিছু বস্তুতা আছে, যা আমরা সরাসরি উপস্থিত হয়ে চাক্ষুষ অবলোকন করতে পারি না বা সম্ভবও না। যেমন পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহগুলির যেমন সূর্যেকে কেন্দ্র করে সৌরজগতে ঘূর্ণায়মান রয়েছে; যা সরাসরি উপস্থিতি থেকে চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর পক্ষে সম্ভব নয় একটি নক্ষত্র ব্ল্যাকহোলে পরিণত হচ্ছে, আর সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা হাতে নিয়ে দেখা। কিংবা একজন ভূতত্ত্ববিদের পক্ষে সম্ভব না পৃথিবীর কেন্দ্রের গঠন দেখা আসা। ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্টি হওয়া সিসমিক ওয়েভ থেকে আমরা জানতে পারি ভূঅভ্যন্তরের গঠন সম্পর্কে। নিজ চোখে আমরা কেউ কোনোদিন দেখতে পারিনি, এমনকী, কোনো যন্ত্রও পাঠানো সম্ভব হয়নি। টেলিস্কোপে ব্ল্যাক হোল স্বচক্ষে দেখার প্রায় ১০০ বছর আগেই মানুষ কেবল অংক কষেই ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছে।
অর্থাৎ, পৃথিবী তথা মহাবিশ্বের সব বাস্তবতা এক রকম নয়; কোনোটা চাক্ষুষ দেখা যায়, কোনোটা চাক্ষুষ দেখা যায় না। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণার জন্য বিভিন্ন মেথোডোলজি বা পদ্ধতি রয়েছে। বিজ্ঞানের তত্ত্ব গঠনের জন্য গবেষণা পদ্বতি কেবলমাত্র সরাসরি উপস্থিত উপস্থিত হয়ে বাস্তবতা পর্যবেক্ষণের’ ওপর নির্ভরশীল নয়। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণার জন্য বিভিন্ন পদ্বতি রয়েছে। কোথাও ডিডাক্টিভ পদ্বতি অনুসরণ করা হয়, কোথায় ইনডাক্টিভ পদ্বতি। বিজ্ঞানে কোনো অপ্রমাণিত অনুমান বা অনুকল্পকে পরীক্ষণ-বিশ্লেষণ ছাড়া মেনে নেওয়া হয় না। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবেও গ্রহন করা হয় না [১]। লক্ষ-কোটি বছর আগের বিবর্তন সামনে থেকে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করা যায়না বলেই বিবর্তন তত্ত্বের গবেষণায় মূলত ইন্ডাক্টিভ রিজনিং ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ, পূর্বের অসংখ্য প্রমাণ সংগ্র করে সবকিছু যেদিকে নির্দেশ করে, তার ওপর ভিত্তি করেই দাঁড় করানো হয় সিদ্ধান্ত।
তবুও, আমাদের নাকের ডগায়-ই এমন সব বিবর্তন ঘটে গেছে বা যাচ্ছে, যেগুলি প্রকৃতির এই অনিবার্য বাস্তবতাকে আমাদের সামনে আরও পরিস্কার করে দেয়। যেমন আছে মাইক্রো বিবর্তনের নজির, তেমনি আছে ম্যাক্রো বিবর্তনের নজির। ম্যাক্রো বিবর্তন সাধারণত দীর্ঘ সময় ব্যবধানে হয়ে থাকে। সেটা কয়েক হাজার থেকে শুরু করে কয়েক লাখ, এমনকী কয়েক কোটি বছর ধরে ঘটতে পারে। তাই মাইক্রো বিবর্তনকে জানতে, চিনতে এবং প্রমাণ জন্যে আমরা ফসিল রেকর্ড, জিনতত্ত্ব, এবং হোমোলোগাস প্রমাণের দ্বারস্থ হই। তবে, মাঝে মাঝে নানান প্রাকৃতিক পরিস্থিতির কারণে কখনো কখনো ম্যাক্রো বিবর্তন খুব দ্রুত গতিতে ঘটতে পারে, বিশেষ করে যদি কোনো সংকটময় বা পরিবেশগত চাপ থাকে। স্পিসিয়েশন তথা প্রজাতির বিবর্তনের ঐতিহাসিক প্রমাণ অসংখ্য। আজ অবধি ফসিল রেকর্ড, জেনেটিক্স, হোমোলজির ওপর ভিত্তি করে অসংখ্য প্রজাতির উদ্ভব নিয়ে জানা গেছে। এ নিয়ে লিখতে শুরু করলে কয়েকশো ভলিউমের এনসাইক্লোপিডিয়া হয়ে যাবে। বিখ্যাত ফসিল টিকটালিকের সহ-আবিস্কারক জীবাশ্মবিদ ড. নিল শুবিন তাঁর ২০০৮ সালে প্রকাশিত Your Inner Fish: A Journey into the 3.5-Billion-Year History of the Human Body বইয়ে লিখেছেন,
“The evidence for evolution is so strong that one could spend a lifetime studying it without exhausting the supply. Fossils, genes, embryos, and anatomy all reveal evolutionary change in painstaking detail.”
এ অংশে আমরা চারপাশে ঘটে চলা মাইক্রো এবং ম্যাক্রো বিবর্তনের নানান নজির; দিনদুপুরে আমাদের মধ্যেই ঘটে চলা ন্যাচারাল সিলেকশানের বেশ কিছু উদাহরণ পেশ করেছি। দেখাবো ল্যাবেও কীভাবে ঘটানো গেছে বিবর্তন। যদিও প্রজনন বিচ্ছিন্নতা ও জেনেটিক ড্রিফটের আলোচনায় আমরা সাম্প্রতিক কিছু বিবর্তনের আলোচনা করেছি, তাও এখানে এ আলোচনা আরও বিস্তারিত পরিসরে করা যাক। ম্যাক্রো তথা বৃহৎ বিবর্তনের উদাহরণে টানা হয়েছে কম সময়ে ঘটা বিবর্তনের উদাহরণগুলি।
দ্যা ব্যাটেল অব ম্যালেরিয়াঃ ডিক্লোরো-ডাইফিনাইল-ট্রাইক্লোরোইথেন বনাম মশা
এনোফিলিস নামক এক ধরণের মশার দেহে এক ধরণের প্রটোজোয়া পরজীবী বাস করে। সমস্যা হচ্ছে, এরা যখন আমাদের কামড় দেয়, আমরা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ি। আবার আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে কামড়ানো মশারা যখন সুস্থ মানুষের দেহে কামড় দেয়, তখন সে সুস্থ মানুষটাও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে প্রতি বছর ম্যালেরিয়ায় ৩০ থেকে ৫০ কোটি মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে ৭ থেকে ২৭ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে। তাহলে এই ম্যালেরিয়া থেকে মুক্তি পেতে সহজ উপায় কী হতে পারে? মশা নিধন, তাই তো?
কয়েক দশক আগে আমাদের উপমহাদেশ সহ পৃথিবীর অনেক দেশে তাই-ই করা হয়েছিলো। ডিক্লোরো-ডাইফিনাইল-ট্রাইক্লোরোইথেন বা সংক্ষেপে ডিডিটি (DDT) নামক কীটনাশকের মাধ্যমে ব্যাপক হারে মশা নিধন করা হয়েছিলো। মোটামুটি ৬০/৭০ এর দশকেই ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমিয়ে গড় আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ৭ কোটিতে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিলো। তাহলে এখন সে সংখ্যা ৩০-৫০ কোটি কেন? কীভাবে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ আবারও এতো বাজেভাবে বেড়ে গেলো?
এখানে এই ডিডিটি আর মশার যুদ্ধে মশা ন্যাচারাল সিলেকশনের লটারী জিতে গিয়েছিলো। এ গল্পটা আরও ভালো করে বুঝতে চলুন আমরা ভারতের উদাহরণ দেখি। গত শতকের ৪০ এর দশকে মশাদের প্রকোপ থেকে বাঁচতে ভারতে ডিডিটির প্রয়োগে প্রায় এক যুগ ধরে ম্যালেরিয়া রোগের আক্রান্তের সংখ্যা নেমে আসে তলানীতে। বিপত্তিটা ঘটে সেই এক যুগ পর। হঠাৎ করেই দেখা যায় ডিডিটিকে আর পাত্তা দিচ্ছেনা মশারা। চোখের পলকে আকাশ-বাতাস ছেয়ে যাচ্ছে মশা। ১৯৫৯ সালের দিকে বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, এই মশাদের থেকে একদল মশার আবির্ভাব ঘটেছে, যারা এই ডিডিটির প্রতি রেজিস্ট্যান্স। ব্যাপারটাকে একদম জিন পর্যায়ে কাটাকুটি করে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা।
দেখা গেছে, বেশ কিছু মিউটেশনের ফলে এদের দেহে বিষমুক্তকরণ এনজাইমের (Detoxification Enzyme) পরিমাণ বাড়ার সাথে মোটামুটিভাবে দুই জায়গায় জেনেটিক পরিবর্তন ঘটে।
- ডিডিটির কারণে এদের VGSC জিন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই জিনেই ঘটে যায় মিউটেশন। এই মিউটেশনের ফলে এদের লিউসিন নামক এমিনো এসিড, যেটি VGSC জিনের ১০১৪ তম পজিশনে(L1014F) থাকতো, সেটিকে phenylalanine নামক এমিনো এসিড প্রতিস্থাপন করে। এতে করে ডিডিটি-এর কার্যকারিতা কমে যায় একেবারেই [২]।
- Acetylcholinesterase-1 নামক জিনে আরেকটি মিউটেশন ঘটায় ACE-1 নামক এনজাইমের উৎপাদন বেড়ে যায় মশার দেহে। এই এনজাইমটি ডিডিটির প্রভাবকে ডিটক্সিফাই অর্থাৎ বিষমুক্ত করতে পারে [৩]।
দেখা গেছে যে, এলোমেলোভাবে মিউটেশনের ফলে যেসব মশার দেহে এই পরিবর্তন গুলি এসেছে, তারাই ডিডিটি যুক্ত পরিবেশে বেঁচে গেছে। একই সাথে মরতে থাকে স্বাভাবিক, অপরিবর্তিত মশাগুলি। মিউটেটেড মশাগুলি সে পরিবেশে বংশবৃদ্ধি করতে করতে একসময় তারাই হয়ে ওঠে মেজারোরিটি। এভাবে লম্বা সময় বাদে এমন মশা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেটার ডিডিটি রেজিস্ট্যান্স নেই। এখানে মশারা মিউটেশনের ফলে প্রাপ্ত পরিবর্তিত বৈশিষ্ট্য নিয়ে সে পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য যোগ্য হিসেবে নির্বাচিত হয় এবং টিকে যায়। জিন তত্ত্ব নিয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকা ডারউইন কেবল পর্যবেক্ষণ থেকে এই ন্যাচারাল সিলেকশানের ধারণা দিয়েছিলেন। যা আজ আমরা চোখের সামনে, হাতে কলমে, ল্যাবে ফেলে কাটা-ছেঁড়া করে প্রমাণ পাচ্ছি প্রতিনিয়ত। সামনে এগুতে এগুতে আমরা আরও উদাহরণ দেখবো চলুন।
দ্যা ব্যাটেল অব ম্যালেরিয়া-২ঃ এনিমিয়া বনাম ম্যালেরিয়া
সিকেল সেল এনিমিয়া (Sickle Cell Anemia) নামক একটি জেনেটিক রোগ আছে। এই রোগটি মূলত হয় রক্তে একপ্রকার বিকৃত হিমোগ্লোবিনের উপস্থিতির কারণে। সুস্থ হিমোগ্লোবিন আর সিকেল সেল হিমোগ্লোবিনে তফাত হচ্ছে এদের বেটা চেইনে কেবল মাত্র একটা এমিনো এসিডের অমিল থাকার কারণে। সুস্থ হিমোগ্লোবিন চাকতির মতো দেখতে হলেও এই সিকেল সেল হিমোগ্লোবিনগুলো দেখতে অনেকটা অর্ধচন্দ্রাকৃতির। এই বিকৃত হিমোগ্লোবিনগুলো অক্সিজেন বহন করতে পারে না এবং রক্তস্বল্পতারও কারণ হয়।
আমরা জানি যে আমাদের প্রতিটি জিনের দুটি কপি আছে। একটা আসে বাবার থেকে, আরেকটা আসে মায়ের থেকে। যারা বাবা ও মা দুজনের থেকেই সিকেল সেল হিমোগ্লোবিনের জিন পায়, সে পূর্ণাঙ্গ রোগী। তাঁর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে খুবই ক্ষীণ। কিন্তু, যে বাবা মায়ের কেবল একজনের থেকে এই জিন পায়, সে এই এনিমিয়ার বাহক। যদিওবা এদের ভারী কাজ করা কষ্টকর হয়, তাও এরা ভালোভাবেই বেঁচে থাকতে পারে। অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে, আফ্রিকায় প্রতি ১০০ জনে ৩০ জনই এই বিকৃত হিমোগ্লোবিন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এবং প্রতিনিয়তই এ সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। কথা হচ্ছে, কোনো পপুলেশনে একটা নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বেড়ে চললে বুঝতে হবে হবে সে জিনটি কোনো সুবিধা দিচ্ছে।
কী সেই সুবিধা?
এই এক কপি সিকেল সেল হিমোগ্লোবিন জিন তাদের ম্যালেরিয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখে। এই বিকৃত হিমোগ্লোবিনের জন্য ম্যালেরিয়ার পরজীবি টিকতে পারে না। আফ্রিকায় ম্যালেরিয়া এক আতংকের নাম। প্রতিবছর পৃথিবীতে ম্যালেরিয়ায় যতোজন মানুষ মারা যায়, তার ৭৫%-ই আফ্রিকান বাসিন্দা। লক্ষ্য করে দেখা গেছে, যেসব অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি, সেসব অঞ্চলেই আশ্চর্যজনকভাবে এই এনিমিয়ার রোগী দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। একটা বিকৃত সিকেল সেল হিমোগ্লোবিন জিন নিয়ে সেখানকার মানুষ টিকে থাকে ঠিকই, কিন্তু রক্ষা পেয়ে যায় মরণব্যাধি ম্যালেরিয়া থেকে। এখানেই তারা পেয়ে গেছে ন্যাচারাল সিলেকশানের লটারি। ধীরে ধীরে এনিমিয়ার রোগী সেসব অঞ্চলে বাড়ার কারণ হচ্ছে, সেসব অঞ্চলে স্বাভাবিক মানুষেরা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। কিন্তু, এক জিন বিশিষ্ট এনিমিয়ার রোগীরা বেঁচে যাচ্ছে। সেই পরিবেশে এনিমিয়ায় আক্রান্ত রোগীরাই প্রাকৃতিকভাবে নির্বাচিত এবং সে অঞ্চলের যোগ্যতম সদস্য। স্বাভাবিক মানুষেরা সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাই দিনকে দিন সেসব অঞ্চলে এনিমিয়ার রোগী বাড়ছে। এভাবে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ অব্যাহত থাকলে হাজার হাজার বছর পর হয়তো আফ্রিকার সেসব অঞ্চলে স্বাভাবিক আর কোনো মানুষ পাওয়া যাবে না। সবাই এনিমিয়া রোগ বহন করে বেড়াবে [৪]।
চিত্রঃ আফ্রিকার যেসব অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি, সেসব অঞ্চলেই আশ্চর্যজনকভাবে এই এনিমিয়ার রোগী দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। সবুজ দিয়ে ম্যালেরিয়ার বিস্তার এবং নীল রঙ দিয়ে সিকেল সেল এনিমিয়ার বিস্তার দেখানো হয়েছে। ছবি ঋণঃ ইভোলিউশান-বার্কলি-এডুকেশান
শিল্প বিপ্লব ও পেপারড মথ(Biston betularia)
পেপারড মথের গল্পটা বেশ ইন্টারেস্টিং। উনিশ শতক। আবিষ্কার হলো স্টিম ইঞ্জিন, শুরু হলো শিল্প বিপ্লপব। ইংরেজরা এই মানবজাতিকে এক লাফে কয়েকশো বছর এগিয়ে দিলো। বলা হতো, “ইংরেজ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যায় না”। ১৭৬০ সালে শিল্প বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়ে ১৮৪০ পর্যন্ত এক বিশাল সময়ে সভ্যতার মোড় ঘুরিয়ে দিলো ইংরেজরা। কিন্তু, এর ফলে শুধু সভ্যতারই মোড়ই ঘোরেনি, বিবর্তনের ছোট একটা গলিও ঘুরে গিয়েছিলো।
১৮১১ সালের আগে পৃথিবীর মানুষ পেপারড মথ নামক যে বিশেষ প্রকার মথ কে চিনতো, তারা দেখতে ছিল সাদা রঙের। মথ হচ্ছে প্রজাপতির মতোই দেখতে একপ্রকার পতঙ্গ। কেবল মাথায় ছোট এন্টেনা। প্রজাপতির বড় এন্টেনা থাকে। তো হলো কী, কখনো মানুষ কালো বা অন্যান্য রঙের পেপারড মথ দেখেনি। থাকলেও মাঝে মাঝে রেন্ডম মিউটেশনে টুকটাক কিছু হয়তো জন্মাতো, সেটাও খুবই রেয়ার। অস্বাভাবিকভাবে কালো রঙ নিয়ে জন্মানো মথরা নিজের মিউটেশনকে পরবর্তী প্রজন্মে তেমন আকারে পাস করতে পারতোনা। কারণ, সাধারণত শিল্প বিপ্লবের আগে সে অঞ্চলে অধিকাংশ গাছ গাছালির বাকলই ছিলো উজ্জ্বল বর্ণের। উদ্ভিদের কাণ্ড বা মূলের বাহিরের অংশকে বাকল বা গাছের ছাল বলা হয়। ফলে শিকারী পাখি বা প্রকৃতির অন্যান্য প্রিডেটরদের চোখে পড়ে যেতো উজ্জ্বল গাছে, পাতায় হেঁটে বেড়ানো কালো মথদের।
১৮৪৮ সালে পোকামাকড় নিয়ে গবেষণা করা RS Edleston নামক এক প্রকৃতিবিদ তাঁর জার্নালে লিখেন, “আজকে পুরোপুরি কালো বর্ণের একটা মথ ধরতে পারলাম মেনচেস্টারের কেন্দ্রে” [৫]। হঠাৎ এই কালো মথ দেখা অবধিও সমস্যা নেই। প্রায়ই আমরা পরিচিত প্রাণিদের বিরল রঙ নিয়ে জন্মাতে দেখি। তাই, টুকটাক কোনো মিউটেশনে কিছু কালো বর্ণের মথ দেখা অসম্ভব কিছু না। গল্পটা অন্যদিকে মোড় নিলো সে শতকের শেষদিকে। ১৮৮৫ সালের দিকে মানুষ দেখলো সামনে যতো মথ আসে, সব কালো বর্ণের। সাদা মথ আর কারোর চোখে পড়ে না। ব্যাপারটা নিয়ে গবেষকরা উঠে পড়ে লাগলো। এ ব্যাপারে ডারউইনের মৃত্যুর ১৪ বছর পর ১৮৮৬ সালে ব্রিটিশ কীটতত্ত্ববিদ জেমস উইলিয়াম টাট জানান যে, এ ব্যাপারটা ঘটেছে ন্যাচারাল সিলেকশান বা প্রাকৃতিক বিবর্তনের ফলে। কিন্তু এ ব্যাপারে বিস্তারিত গবেষণা আসে আরও পরে। এ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষাসহ প্রথম গবেষণা করেন জেনেটিসিস্ট বারনার্ড ক্যাটেলওয়েল। পরবর্তীতে এরচেয়েও বিস্তারিত গবেষণা করেন ক্যাম্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিসিস্ট মাইকেল ম্যাজেরাস। এই দীর্ঘ ৭ বছরের পূর্ণ গবেষণার ফলাফল নিয়ে ২০১২ সালে বিশ্ববিখ্যাত রয়েল সোসাইটির পিয়ার রিভিউড জারররনাল, বায়লোজি লেটার্সে প্রকাশিত হয় Selective bird predation on the peppered moth: the last experiment of Michael Majerus শিরোনামে গবেষণা প্রবন্ধ [৬]।
আমরা সংক্ষেপে জানার চেষ্টা করবো যে কেন ১৮৮৫ সালের পর সব পেপারড মথ পুরোপুরি কালো বর্ণের হওয়া শুরু করেছিল এবং কেনই বা সে যাত্রায় বিবর্তন তাদের বিলুপ্তি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। ম্যানচেস্টার ছিলো ইংল্যান্ডের সবচেয়ে শিল্পোন্নত শহরগুলোর একটা। শিল্পবিপ্লবের ফলে সারা বিশ্বে কয়লার ব্যাবহার বেড়ে যায়।এই কয়লার ব্যবহারের ফলে অতিরিক্ত কার্বন নিঃস্বরণ ঘটতে শুরু করে। এই কয়লা থেকে আসা কার্বনের ফলে গাছ-পালা আর বিভিন্ন স্থাপনার গায়ে ধোঁয়া, কার্বন লেগে তাদের রঙ অনুজ্জ্বল হয়ে গেলো। অনেক গাছের বাকলও কালচে বর্ণ ধারণ করতে থাকে। এতে সমস্যা হয়ে গেলো সে সময়ের সাদা বর্ণের পেপার্ড মথদের। এই কালচে বর্ণের উদ্ভিদে হেঁটে বেড়ানো পেপারড মথেরা সহজেই নজর কাড়তো শিকারী পাখিদের। তাই সে পরিবেশে রেন্ডম মিউটেশনের ফলে কালো পিগমেন্ট নিয়ে জন্মানো একটা-দুটো বিরল পেপারড মথই টিকে থাকার জন্য সুযোগ সুবিধা পেয়ে গেলো, যেটা আগে পেতো না। এভাবে এরা বাঁচতে পারছে, বংশবৃদ্ধি করতে পারছে, কিন্তু সাদারা শিকারীদের খপ্পড়ে পড়ছে। এভাবে সাদাদের সংখ্যা কমতে কমতে একসময় তলানীতে যায় এবং কালো বর্ণের পেপারড মথে চারপাশ ছেয়ে যায়। তারপর সে অঞ্চলে, সে শতকে সাদা মথদের আর দেখতে পাওয়া যায়নি। শিল্পোন্নয়নের কারণে কোনো প্রজাতিতে গাঢ় পিগমেন্টের আধিক্য হওয়ার এই ঘটনাকে বলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যালানিজম। এটা হয় ডারউইনের বাতলে যাওয়া সেই ন্যাচারাল সিলেকশনের কারণে।
চিত্রঃ ধোঁয়ার জন্য কালো হয়ে যাওয়া গাছের বাকলে কালো পেপারড মথেরা প্রায় মিশে গেছে। কিন্তু সাদারা সহজেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।
পপুলেশন জেনেটিক্সের অন্যতম প্রবক্তা সিওয়াল রাইট ১৯৭৮ সালে বলেন,
“এটা (মিরাকল অফ মথ) প্রথম ঘটনা, যেখানে বিবর্তন সুস্পষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে” [৭]।
আচ্ছা, এই ঘটনায় কোন ধরনের ফিনোটাইপটা সিলেক্টেড হয়েছে? শুধু গাঢ় ধরনের। মানে, একটা নির্দিষ্ট ফিনোটাইপ এর সংখ্যা ভীষণভাবে বেড়ে গিয়েছে। এই ধরনের ন্যাচারাল সিলেকশনকে আমরা বলি “ডায়রেকশনাল”।
বিজ্ঞানীরা এদের জিনোমে চিরুনী অভিযান চালিয়েছেন, দেখার জন্য যে, কেন তাদের এই ম্যালানাইজেশন ঘটে। এ গবেষণা ২০১৬ সালে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল, ন্যাচারে The industrial melanism mutation in British peppered moths is a transposable element শিরোনামে প্রকাশিত হয়। তাদের গবেষণায় উঠে আসে, মথদের এই কালো হয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী “carb-TE” নামক একটি ট্রান্সপোজেবল এলিমেন্ট। এটি তাঁরা খুঁজে পান কর্টেক্স জিনের কাছেই। এটি একটি ২১,৯২৫ বেস পেয়ার বিশিষ্ট অংশ। এটা এক প্রকারের ট্রান্সপোজেবল এলিমেন্ট কারণ এই “carb-TE” সেকশানটি জিনোমের মধ্যে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হতে পারে। দেখা গেছে, যখনই জিনোমের এ অংশটি সক্রিয় হয়, তখনই পেপারড মাথের কালো রঙের এক্সপ্রেশন ঘটে [৮]।
সাম্প্রতিক সময়ে দূষণ কমায় আবারও অল্প হলেও সাদা পেপারড মথ চোখে পড়তে শুরু করেছে। এই ঘটনাটা আমাদের দেখায় যে কীভাবে পরিবেশগত পরিবর্তন দ্রুত একটি পপুলেশনে অ্যালিলের ফ্রিকোয়েন্সিকে প্রভাবিত করতে পারে। প্রপরিবেশের পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুযায়ী একেকটা মিউটেশনের ফলাফল একেকভাবে কাজে লাগে। সে অনুযায়ী পাল্টে যায় সে প্রজাতির অ্যালিল ফ্রিকোয়েন্সি। ন্যাচারাল সিলেকশান হচ্ছে বিবর্তনের একেকটা বিল্ডিং ব্লক। এভাবে অনবরত কোনো প্রজাতি নানানভাবে ন্যাচারাল সিলেকশানের মাধ্যমে নানান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেলে একসময় পাল্টে যায় তাদের প্রজাতি। পৃথিবীর জীবনের এই বিরাট যাত্রার গল্পে স্পিসিয়েশনের অসংখ্য গল্প থাকলেও সামনে আমরা আরও সেরকম কিছু গল্প দেখাবো, যেগুলি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে হাতে-নাতে বিবর্তনকে দেখিয়েছে। এ পর্বটা শেষ করব আরেকটা উদাহরণ দিয়ে।
হেলিকোনিয়াস প্রজাপতির বিবর্তনের গল্প: সংকরায়ন জন্ম দেয় নতুন প্রজাতির
মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার কোস্টারিকার সবুজ সজীব বনাঞ্চল। এসব ট্রপিকাল বনাঞ্চলে জীবনের রঙ ছড়িয়ে পড়ে নানান রূপে। আমাদের অলক্ষেই সেখানে এক বিস্ময়কর বিবর্তনীয় ঘটনা ঘটে গেলো। সংকরায়ণ দ্বারা একটা নতুন হেলিকোনিয়াস প্রজাপতির নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটলো। আমাদের এ হেলিকোনিয়াস প্রজাপতির গল্পটা আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায় যে বিবর্তন সবসময় ধীরে ধীরে ঘটে না—এটা অনেক সময় সৃজনীর বিস্ফোরণে সংকরায়নের মাধ্যমে তৈরি করে ফেলে নতুন ধরণের জীবন। হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিস্ট নিল রসারের ভাষ্যে,
“হাইব্রিডাইজেশনকে একসময় বিরল বা গুরুত্বহীন বলে মনে করা হতো, তবে সাম্প্রতিক জিনোমিক গবেষণাগুলি দেখায় যে এটি প্রজাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে।” [৯]
তো যেখানে ছিলাম, এই বিবর্তনীয় পাঁচালীর মূল চরিত্র দুটি প্রজাতির প্রজাপতি—হেলিকোনিয়াস মেলপোমেনি(Heliconius melpomene) এবং হেলিকোনিয়াস সিডনো(Heliconius cydno)। হেলিকোনিয়াস মেলপোমেনির ডানা কালো, উজ্জ্বল লাল রেখায় সজ্জিত। আর হেলিকোনিয়াস সিডনোর ডানা হালকা রঙের, উজ্জ্বল সাদা চিহ্নযুক্ত। যদিও এরা আলাদা প্রজাতির, তাদের বসবাসের এলাকা একই জায়গায় হওয়ায় এদের মধ্যে প্রায়ই আন্তঃপ্রজনন করে হাইব্রিড সন্তান জন্ম দেয়। সধারণত ভিন্ন প্রজাতির মধ্যে সংকরায়ণ বন্ধ্যা বা বেঁচে থাকার অযোগ্য সন্তান জন্ম দেয়। কিন্তু হেলিকোনিয়াস প্রজাপতির ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে গেলো—এই হাইব্রিড প্রজাপতিরা শুধু উর্বরই হয়নি, বরং তারা তাদের পিতামাতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে মিশ্র ডানার নকশা পেয়ে গেলো।
এই সংকরায়িত নতুন প্রজাপতির ডানায় কালো-লাল এবং সাদা চিহ্ন দেখা যায়, যা তাদের একটি নতুন বিবর্তনীয় সুবিধা দেয়। দেখা গেলো এরা এই রঙ নিয়ে সেসব ট্রপিকাল জঙ্গলে তাদের প্যারেন্টদের থেকে আরও ভালোভাবে টিকে থাকতে পারছে। প্রথম নজরে এই রঙিন ডানাগুলির নকশা কেবল সজ্জা মনে হতে পারে, কিন্তু তাদের এই নতুন, মিশ্র ডানার নকশা সেই পরিবেশে শিকারীরা চিনতে পারে না। এতে করে ন্যাচারাল সিলেকশানের লটারি জিতে যায়। সময়ের সাথে সাথে এরা নিজেরা নিজেরা প্রজনন করা, প্যারেন্ট প্রজাতির সাথে প্রজননগতভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া, নিজেদের ভিন্ন নিচেস তৈরি—ইত্যাদি করার মাধ্যমে তাদের প্যারেন্টস প্রজাতি থেকে জেনেটিক্যালিও খুব কম সময়েই আলাদা হয়ে যায়। আবির্ভাব ঘটে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রজাতির, হেলিকোনিয়াস হিউরিপা (Heliconius heurippa) [১০]।
হেলিকোনিয়াস প্রজাপতির এই গল্পটা আপনাদের বললাম, কারণ এটা আমাদের বিবর্তন সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। কী সেটা বলি, ম্যাক্রোইভলিউশন—যার মাধ্যমে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে—অনেক সময় ভাবা হয় ধীরে ধীরে ঘটে, কিন্তু হেলিকোনিয়াস প্রজাপতিরা আমাদের অবাক করিয়ে দিয়ে দেখালো যে সংকরায়ণের মাধ্যমে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি খুব দ্রুতও হতে পারে। বিবর্তনীয় টাইম ফ্রেমে, খুব ক্ষুদ্র সময়ে এই হাইব্রিডরা প্রজননগত ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো, তাদের নিজস্ব ইউনিক ডানার নকশা ডেভেলপ করে ফেললো এবং তাদের নিজস্ব বাস্তুতান্ত্রিক নিচেস-য়েও বসবাস করা শুরু করে দিলো। ক্ষুদ্র সময়েই বিবর্তিত হয়ে গেলো নতুন প্রজাতিতে।
সামনের পর্বে আমরা আরও চমৎকার কিছু উদাহরণ দেখবো, সে পর্যন্ত সুস্থ থাকুন।
তথ্যসূত্রঃ
- [১] জীববিববতর্ন তত্ত্বঃ নানা জিজ্ঞাসা, অনন্ত বিজয় দাস, পৃষ্ঠাঃ ৪।
- [২] Silva, A.P.B., Santos, J.M.M. & Martins, A.J. Mutations in the voltage-gated sodium channel gene of anophelines and their association with resistance to pyrethroids – a review. Parasites Vectors 7, 450 (2014). https://doi.org/10.1186/1756-3305-7-450
- [৩] Abbasi E, Daliri S (2024) Knockdown resistance (kdr) associated organochlorine resistance in mosquito-borne diseases (Culex quinquefasciatus): Systematic study of reviews and meta-analysis. PLOS Neglected Tropical Diseases 18(8): e0011991. https://doi.org/10.1371/journal.pntd.0011991
- [৪] Luzzatto, L. (2012) “SICKLE CELL ANAEMIA AND MALARIA”, Mediterranean Journal of Hematology and Infectious Diseases, 4(1), p. e2012065. doi: 10.4084/mjhid.2012.065.
- [৫] Peppered Moths: natural selection. (n.d.). https://askabiologist.asu.edu/peppered-moths-game/natural-selection.html
- [৬] Cook, L. M., Grant, B. S., Saccheri, I. J., & Mallet, J. (2012). Selective bird predation on the peppered moth: the last experiment of Michael Majerus. Biology Letters, 8(4), 609–612. https://doi.org/10.1098/rsbl.2011.1136
- [৭] Rice, Stanley A. (2007). Encyclopedia of Evolution. New York: Facts on File. p. 308. ISBN 978-1-4381-1005-9
- [৮] Hof, A., Campagne, P., Rigden, D. et al. The industrial melanism mutation in British peppered moths is a transposable element. Nature 534, 102–105 (2016). https://doi.org/10.1038/nature17951
- [৯] Gazettebeckycoleman, & Gazettebeckycoleman. (2024, June 12). Amazon butterfly evolved from hybrids. Harvard Gazette. https://news.harvard.edu/gazette/story/2024/04/amazon-butterfly-evolved-from-hybrids-heliconius-species-evolution/
- [১০] C. A. Salazar, C. D. Jiggins, C. F. Arias, A. Tobler, E. Bermingham, M. Linares, Hybrid incompatibility is consistent with a hybrid origin of Heliconius heurippa Hewitson from its close relatives, Heliconius cydno Doubleday and Heliconius melpomene Linnaeus, Journal of Evolutionary Biology, Volume 18, Issue 2, 1 March 2005, Pages 247–256, https://doi.org/10.1111/j.1420-9101.2004.00839.x
Leave a Reply