ভিটামিন নিয়ে কয়েকটি প্রচলিত ধারণার অ্যানাটমি

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

ভিটামিন- আমাদের খাদ্যতালিকার অন্যতম অত্যাবশকীয় বা “এসেনশিয়াল” উপাদান। অত্যাবশকীয়, কারণ দুয়েকটা ছাড়া বেশিরভাগ ভিটামিন আমাদের দেহে তৈরি হয়না, খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণ করে চাহিদা পূরণ করতে হয়। ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি – এই তিনটি খাদ্য উপাদানকে “প্রোটেক্টিভ ফুড” বলা হয়। অর্থাৎ এই তিনধরনের খাদ্য উপাদান শরীরের নানারকম রোগ প্রতিরোধী ভূমিকা পালন করে। ভিটামিন দুইভাবে গ্রহণ করা যায়: খাদ্যের মাধ্যমে (প্রাকৃতিক ভাবে) এবং সাপ্লিমেন্ট হিসেবে (ট্যাবলেট বা সিরাপ হিসেবে)। যেভাবেই গ্রহণ করা হোক, দেহে ভিটামিনের গ্রহণযোগ্য পরিমাণ এবং কার্যক্ষমতা নির্দিষ্ট। অর্থাৎ ভিটামিন আমাদের দেহে খুবই অল্প পরিমাণে প্রয়োজন হয় এবং বিভিন্ন বিপাকীয় ক্রিয়ায় কো-এনজাইম হিসেবে কাজ করে সে শক্তি অবমুক্ত হতে বা কোনো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সাহায্য করে। 

ভিটামিন দুই ধরনের:

  • চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন : ভিটামিন এ, ডি, ই, কে। এরা পিত্তের সাহায্যে অন্ত্র থেকে শোষিত হয় এবং লিভারে জমা থাকতে পারে। অতিরিক্ত গ্রহণ করলে হাইপারভিটামিনোসিস (পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া) দেখা দিতে পারে।
  • পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন : ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ও ভিটামিন সি। এরা দেহে জমা থাকতে পারেনা (ভিটামিন বি-১২ ব্যতীত)। মূত্রের মাধ্যমে দেহ থেকে নিষ্কাশিত হয়।

ভিটামিন নিয়ে অনেকের অনেক সংশয় এবং ভ্রান্ত ধারণা বিদ্যমান। সে আলোকে কিছু প্রচলিত ধারণা তুলে ধরে তা কাটাছেঁড়া করা যাক। প্রত্যেক কাটাছেঁড়ার শেষে থাকছে একটা করে চমকপ্রদ তথ্য।

“ভিটামিন খেলে শক্তি হয়।”

জবাব : এই কথাটি সেসব বাচ্চাদেরকে খুব বলা হয়, যারা খুবই অল্প খাবার খায় বা প্রচুর বেছে খায়। দেখা যায়  মা-বাবা কীভাবে বাচ্চাকে খাবার খাওয়ানো যাবে তা নিয়ে না ভেবে মাল্টিভিটামিন নিয়ে বাচ্চাদের পেছনে দৌড়াচ্ছেন। তাদেরকে জানানো দরকার যে, ভিটামিন কখনোই শক্তি উৎপাদন করতে পারেনা, সে বড়জোর একটা এনজাইমের মতো কাজ করে। দেহে শক্তি উৎপাদনের কাজ শর্করা, আমিষ ও চর্বির। এই তিন ধরনের উপাদান জারিত হয়ে গঠন, ক্ষয়পূরণ ও শক্তি উৎপাদনের কাজ করে।  শিশুদের জন্য আমিষ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তারপর শর্করা। তাই ঠিকমতো খাবার না খেয়ে ভিটামিন নেওয়া কোনো সমাধান নয়। শিশুকে ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট দেওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া ভালো।

চমকপ্রদ তথ্য : লোহিত রক্তকণিকা তৈরির জন্য লৌহ ও প্রোটিনের পাশাপাশি ভিটামিন বি-১২ ও ভিটামিন বি-৯ (ফলিক এসিড) প্রয়োজন হয়। এ দুটো ভিটামিনের অভাবে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা হতে পারে।

“চোখের যাবতীয় সমস্যার কারণ ভিটামিন-এ’র ঘাটতি।”

জবাব: এর কাটাছেঁড়া করতে হলে চোখে ভিটামিন-এ’র কিছু কাজের ফিরিস্তি দেওয়া যাক। ভিটামিন এ ভিজুয়াল পিগমেন্ট তৈরির মাধ্যমে আমাদের চোখকে আবছা ও উজ্জ্বল আলোয় দেখতে সাহায্য করে।

রেটিনায় দুই ধরনের কোষ থাকে, রড ও কোন। রড কোষে রডোপ্সিন আর কোন কোষে পাইরিডপ্সিন, সায়ানোপ্সিন আর আয়োডোপ্সিন নামের ভিজুয়াল পিগমেন্ট থাকে। এগুলো তৈরিতে রেটিনল তথা ভিটামিন-এ এর ভূমিকা রয়েছে। ভিটামিন-এ এর অভাবে যখন রডপ্সিন তৈরি ব্যাহত হয়, তখন চোখ স্বল্প আলোয় দেখতে পায় না, যাকে রাতকানা বলে। আর কোনো কোষের পিগমেন্টগুলো তৈরি ব্যাহত হলে চোখ উজ্জ্বল আলোও সহ্য করতে পারেনা ; কর্নিয়ায় সাদা দাগ পড়ে (বিটট’স স্পট), কর্নিয়া ও কনজাঙ্কটিভা শুষ্ক হয়ে যায় এবং রোগী অন্ধও হয়ে যেতে পারে। এগুলোকে সামষ্টিকভাবে জেরোফথ্যালমিয়া বলে ডাকা হয়।

অর্থাৎ, ভিটামিন-এ’র অভাবে রাতকানা ও জেরোফথ্যালমিয়া হতে পারে। অন্যদিকে মায়োপিয়া (দূরের জিনিস কম দেখা), হাইপারমেট্রোপিয়া (কাছে কম দেখা), ছানি পড়া এসবের সাথে ভিটামিন এ’র সম্পর্ক গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত নয়। তাই মায়োপিয়ার রোগীকে দিনরাত ভিটামিন-এ খাওয়ালে তার চশমার পাওয়ার কমার সম্ভাবনা নেই। 

চমকপ্রদ তথ্য : ভিটামিন এ’র উচ্চ ডোজ ব্রণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। সর্দি কাশি হলে ভিটামিন-সি এর তুলনায় ভিটামিন-এ বেশি ভালো ফল দেয়।

ভিটামিন-ডি নিয়ে বিভ্রান্তি

জবাব: যে অল্প কয়েকটি ভিটামিন আমাদের দেহে তৈরি হয়, তার মধ্যে ভিটামিন-ডি অন্যতম। আমাদের দেহের জন্য প্রয়োজনীয় ৮০% ভিটামিন-ডি ত্বকের নিচের বিশেষ কোলেস্টেরল থেকে লিভার ও কিডনির ক্রিয়ায় তৈরি হয়ে থাকে। বাকি ২০% খাদ্য থেকে পাওয়া যায়। তবে তাও পরিমাণে খুব কম। মাছ-মাংস এমনকি দুধও ভিটামিন-ডি এর খুব ভালো উৎস নয়। তাই ভিটামিন ডি এর চাহিদা পূরণের জন্য সুর্যালোক ও খাদ্য দুটিই নিশ্চিত করতে হবে।

ভিটামিন-ডি নিয়ে এই বিভ্রান্তি বাংলাদেশ ও গোটা বিশ্বেই দেখা যায়। ফলাফল, ভিটামিন-ডি ডেফিসিয়েন্সি (অভাবের) উচ্চ হার। বাংলাদেশের প্রায় ৮৬% মানুষের ভিটামিন-ডি এর ঘাটতি রয়েছে। শহুরে লোকেরা ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ খাবার ও সাপ্লিমেন্ট পায় কিন্তু রোদে বের হয়না। গ্রামের লোকেরা এতো পুষ্টিকর খাদ্য ও সাপ্লিমেন্ট সহজে পেতে পারেনা, আবার চামড়ার রঙ গাঢ় হলে অত্যধিক মেলানিন ভিটামিন-ডি উৎপাদন ব্যাহত করে। তাই দুই গোষ্ঠীরই ভিটামিন-ডি এর অভাব পরিলক্ষিত হয়।

চমকপ্রদ তথ্য: ভিটামিন-ডি দেহে নিজেই নিজের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

“ভিটামিন-ই ক্যান্সার ও হার্টের রোগ নিরাময় করে।”

জবাব: কোনোটাই না, ভিটামিন-ই বরং এই রোগগুলো প্রতিরোধ করে। ভিটামিন-ই একটা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ভিটামিন। এটি লো ডেনসিটি লিপোপ্রোটিনকে (এক ধরনের কোলেস্টেরল) জারিত হয়ে পারঅক্সাইড তৈরি করতে বাধা দেয় এবং ফ্রি রেডিকেলগুলোকেও (মুক্ত ইলেকট্রন যুক্ত অতি-সক্রিয় যৌগ) অকার্যকর করে। অর্থাৎ রক্তনালিকায় চর্বি জমতে বাধা দেয় এবং টিস্যুর ক্ষয় রোধ করে। এটার আরেকটা গুণ হলো, এটা ত্বক, চোখের লেন্স ও প্রজননতন্ত্রের সুরক্ষায়ও কাজ করে।

চমকপ্রদ তথ্য : ভিটামিন-ই শরীরের পেশিগুলোতে থাকা ক্রিয়েটিন প্রোটিনের মাত্রা স্বাভাবিক রেখে পেশিগুলোকে সঠিক মাত্রায় কার্যক্ষম রাখে।

“ভিটামিন-সি বেশি খাওয়া ঠিক নয়।”

জবাব: কতটা বেশি হলে “বেশি”, তা জানা দরকার। দিনে ২০০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ভিটামিন-সি খাওয়া নিরাপদ। একটা সিভিট ট্যাবলেটে সাধারণত ২৫০ গ্রাম অ্যাসকরবিক অ্যাসিড বা ভিটামিন-সি থাকে, যা পুরুষ ও নারীদের দৈনিক চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট। তবে কেউ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে বেশি বেশি ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবার খেলে কোনো অসুবিধা নেই। এই ভিটামিন মাত্র ২৪ ঘণ্টা আমাদের দেহে থাকতে পারে, তারপর মূত্রের মাধ্যমে দেহ থেকে নিষ্কাশিত হয়। তাই কেউ স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি ভিটামিন-সি খেলেই তাকে ডায়রিয়ার ভয় দেখানো যৌক্তিক নয়।

চমকপ্রদ তথ্য : ভিটামিন-সি দেহে ভিটামিন-ই কে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে।

শেষকথা

মাছ, মাংস, ডাল, বাদাম, মৌসুমি ফল, শাকসবজি এসবকিছুতেই ভিটামিন পাওয়া যায়। নিয়মিত এসব খাবার যথেষ্ট পরিমাণে খেলেই ভিটামিনের ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা কম। কোনো কারণ ছাড়া অতিরিক্ত ভিটামিন বিশেষ করে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-ডি, ভিটামিন-কে, ভিটামিন বি-৬ গ্রহণ করে তা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ভিটামিন বেশি করে খেলেই যে বেশি উপকার পাওয়া যাবে, এ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। একইসাথে ভিটামিনের সহজলভ্য উৎস নিয়মিত খাদ্য তালিকায় রাখা উচিত। যেহেতু গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের ভিটামিন ঘাটতির সম্ভাবনা বেশি, তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তাদের সাপ্লিমেন্ট বা সিন্থেটিক ভিটামিন দেওয়া উচিত।

তথ্যসূত্র

লেখাটি 48-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো, মাসে একবার। নিউজলেটারে সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে বিশ্লেষণ থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading