ভেন্টিলেটর: কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের উদ্ভাবনের গপ্পো!

১৯৫২ সাল। শান্ত-স্নিগ্ধ শহর কোপেনহেগেন। ডেনমার্ক।

মাত্র বছর সাতেক পূর্বেই জার্মান সৈন্যবাহিনীর জাহান্নাম থেকে মুক্তি মিলেছিল শহরটার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীভৎস থাবার ক্ষত থেকে ধীরে ধীরে সেরে উঠছিল সবকিছু। বেরিয়ে আসছিল ভয়ংকর সব তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে। নতুন করে নিজেদের গুছিয়ে নিতে তাই আপন মনে ব্যতিব্যস্ত সবাই। এরইমাঝেই একদিন, শহরটিতে হুড়মুড়িয়ে হামলে পড়লো এক ভয়ংকর ছোঁয়াচে রোগ- বালবার পোলিও ভাইরাস।

বিশ্বযুদ্ধের বিবর্ণ সময়টায় নগরীর যেসব স্থানে বোমার আঘাতও হানা যায়নি, সেসব স্থানেও হানা দিয়েছে এই পোলিও। অকেজো করে দিচ্ছে শান্তিপ্রিয় মানুষদের মস্তিষ্কের মোটর নিউরন। ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে পড়ছে রোগীর শরীর। সেই সঙ্গে নড়ছে না মুখমণ্ডলও। কথা বলা বা ওষুধ-খাবার সেবনেও সৃষ্টি হচ্ছে জড়তা। দেখা দিচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা! আর সবকিছু তো চেষ্টা করে সমাধান করা যায় কিছুটা। কিন্তু, যে শ্বাস নিতে পারে না, তাকে বাঁচানোর উপায় কী?

প্রিয় পাঠক, আজকের এই গল্প কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যবস্থার জন্য বেঁচে যাওয়া লাখো মানুষদের। এই গল্প ইয়ন ইবসেনের। এই গল্প ফেরেস্তা হয়ে আগমন ঘটা আশির্বাদপুষ্ট ভেন্টিলেটরের। যার জাদুকরী ছোঁয়ায় প্রাণ ফিরে পেয়েছিল হাজারো মানুষ। চলুন আজ সেই মহতী আবিষ্কারের গল্পটা শুনে আসা যাক।  

পোলিওতে আক্রান্ত সদ্য ভূমিষ্ট বাবু; ছবিসূত্র: Aturty.com

শুরুটা যেভাবে

১৯০০ সাল। শতবছর পেছনের সে পৃথিবীতে রোগবালাই ছিলো যেন নিত্যসঙ্গী। মহামারী, কলেরা আর নানাবিধ রোগব্যাধির ত্রাসে জনজীবন ছিলো দিশেহারা। যদিও, এ সময়, শ্বাস-প্রশ্বাস সমস্যা তেমন একটা ছিল না। ছিল না ফুসফুসের হট্টগোলও। আর তাই ভেন্টিলেটরের মতো যন্ত্র আবিষ্কারের ধারণা তখনো হাঁটি হাঁটি পা। কেননা, চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগৎ তখন ততটাও উন্নত না। আজকে আমরা যাকে ভেন্টিলেটর হিসেবে চিনি তখন তা কেবল ধারণামাত্র।

১৯২৮ সাল। এসময় ভেন্টিলেটর ধারণা কিছুটা সফলতার মুখ দেখে। ফিলিপ ড্রিঙ্কার ও লুইস আগাসি শ’-র হাত ধরে আগত হয় এক কিম্ভূতকিমাকার যত্ন, বিশাল আয়রন লাং (iron lung)। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় লৌহ ফুসফুস। এর আরেক নাম ড্রিঙ্কার ট্যাংক। এর কাজ?

আসলে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে না এমন রোগীদের জন্য ছোট্ট একটি বিছানা পাতানো থাকতো ট্যাংকটির ভেতর। মারাত্মক পরিস্থিতিতে রোগীকে শুইয়ে দেওয়া হতো সেখানে। কেবল গলা ও মাথা বের হয়ে থাকতো বাইরে। তারপর ভালো করে বন্ধ করে দেওয়া হতো সেটি। রাবার দিয়ে পেঁচিয়ে সিল করে দেওয়া হতো গলার আশপাশ, যেন একফোঁটা বাতাসও বের হতে না পারে। অতঃপর মোটরের সাহায্যে চালানো হতো এই আয়রন ট্যাংক।

শক্তিশালী মোটরটি বের করে দিতো ট্যাংকের ভেতরের সকল বায়ুপ্রবাহ। এর মাঝে সৃষ্টি করতো কৃত্রিম ভ্যাকুয়াম। এভাবে রোগীর দেহের চারপাশে তৈরি করা হতো ঋণাত্মক চাপ। সংকুচিত হয়ে আসতো রোগীর ডায়াফ্রাম। ফলস্বরূপ, বাধ্য হয়ে ট্যাংকের বাহিরে থাকা নাক-মুখ টেনে নিতো শ্বাস-প্রশ্বাস! এভাবেই চলছিলো এই যান্ত্রিক কাজ। কিন্তু সে বছরের আগস্ট নাগাদ পোলিওর ধাক্কায় একেবারে ধ্বসে পড়লো সব!

আয়রন লাং: ছবিসূত্র: smithsonianmag.com

পোলিও-র তাণ্ডব

ব্লেগদাম হাসপাতাল। কোপেনহেগেন। ডেনমার্ক।

মহামারী পোলিও-র তাণ্ডবে প্রতিদিন দলবেঁধে আসতে লাগলো নিদারুণ যন্ত্রণায় ভোগা আক্রান্ত রোগীরা। হাসপাতালে সৃষ্টি হতে লাগলো প্রচন্ড চাপ, জায়গা সংকট। তার সঙ্গে শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্রেরও দেখা দিলো নিদারুণ অভাব। গড়ে প্রতিদিন ৫০ জন করে রোগী আসতে লাগলো হাসপাতালে।

কিন্তু, এত রোগীর একসঙ্গে চিকিৎসা হবে কীভাবে? পর্যাপ্ত আয়রন লাং-ই বা কোথায়? তার উপর এর যা দাম! উৎপাদনও তো অপ্রতুল! এছাড়াও, যাদের খাবার-ওষুধ খেতে সমস্যা হয়, তাদের সবকিছুই আটকে থাকে গলায়। আয়রন লাং-এর প্রচন্ড ঋণাত্মক চাপে সেসব চলে যায় ফুসফুসে। সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে বরঞ্চ অসুস্থ হতে থাকে রোগী।

সুতরাং, যা হওয়ার, তাই হলো। কয়েক সপ্তাহ পর দেখা গেলো, হসপিটালে আগত ৮৭% রোগীই মারা যাচ্ছে। আবার নতুন করে আরো অসংখ্য রোগীও আসছে। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি। এমন পরিস্থিতিতে হসপিটাল কর্তৃপক্ষ, ডাক্তার, নার্স- সবারই দিশেহারা অবস্থা। কী করবে তারা?

হাসপাতালের চিফ ফিজিশিয়ান আলেক্সান্ডার ল্যাসেন জরুরি মিটিং ডাকলেন। দ্রুততম সময়ে সমবেত হতে বললেন সবাইকে। শুরু করলেন আলোচনা। কী করা যায়, সেই ভাবনা! সকলের মতামত শেষে পেছন থাকা তরুণ ডাক্তার ইয়ন ইবসেন হাত উঠালেন। বলতে চান কিছু তিনি! কী বলবেন? ভেবেই পান না অভিজ্ঞ ডাক্তারেরা। যেখানে তারাই কুপোকাত, সেখানে কিছুদিন আগে বোস্টনের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হসপিটাল থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করা ইবসেন কী-ই বা বলবেন? তবুও, রীতিমতো জোর করেই, কী বলে শোনাই যাক না।

ইবসেন বর্ণনা করলেন চমকপ্রদ এক আইডিয়ার। দিলেন কার্যকরী ধারণা। সবকিছু শুনে রীতিমতো অবাক সকলে। কী বলেছিল ইবসেন? সেদিন, সেই মিটিং-এ? কোথায়ই বা পেয়েছিল এই প্রযুক্তির আইডিয়া?

পোলিও আক্রান্ত রোগীদের আয়রন লাং-এর সাহায্যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে; ছবিসূত্র: smithsonianmag.com

আইডিয়ার সূত্রপাত

এই ঘটনার প্রায় একযুগ পেছনের কথা। ১৯৪০ সাল। সদ্য মেডিক্যালের পাঠ চোকানো তরুণ ডাক্তার ইবসেনের গন্তব্য তখন ডেনমার্কের উত্তরে, বিচ্ছিন্ন এক উপদ্বীপে। উদ্দেশ্য, সেখানে গিয়ে সম্পন্ন করবেন তার ইন্টার্নশীপ, প্রশিক্ষণ। তার ভাষ্যমতে, ওখানে তখন মাত্র তিনজন মানুষ চিকিৎসা সেবা দিতো- একজন ডাক্তার, একজন ফার্মাসিস্ট ও একজন পাদ্রী! চতুর্থজন হিসেবে ইবসেন যোগ দিলো তাদের সঙ্গে। নতুন পরিবেশে চলতে লাগলো জীবন। হাতেকলমে আয়ত্ত করতে লাগলেন চিকিৎসাবিদ্যা।

১৯৪৯ সাল নাগাদ ইবসেন সপরিবারে অবস্থান করেছেন সেখানে। কাঁটাছেড়া, সার্জারি ও ডেলিভারি থেকে শুরু করে সবকিছুই করেছেন হাতেকলমে। শিখেছেন আরো অনেক কিছু। এবং ১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পরিবার নিয়ে চলে আসেন বোস্টনে। যোগ দেন ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালে, সার্জন হিসেবে। পাশাপাশি আয়ত্ত করেন অ্যানেস্থেশিওলজি।

এখানে এসেই ইবসেন চমৎকার এক ধারণার সাক্ষাৎ পান। ধারণাটির নাম ব্যাগিং! ব্যাগিং মানে, অ্যানেস্থেশিয়া দেয়া রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিকভাবে চালানোর জন্য রাবারের ব্যাগ ব্যবহার করা। অপারেশনের সময় রোগী যাতে ব্যথা অনুভব না করেন সেজন্য শরীরের নির্ধারিত অংশ অবশ করে ফেলা হয়। এই প্রক্রিয়াকেই মূলত বলা হয় অ্যানেস্থেশিয়া। আর অ্যানেস্থেশিয়ার সময় রোগীদের শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখতে ব্যবহৃত হতো ব্যাগিং পদ্ধতি।

ইয়ন ইবসেন; ছবিসূত্র: smithsonianmag.com

ছোট্ট ব্যাগের উপর আলতো করে চাপা হতো। তৈরি হতো বায়ুপ্রবাহ, ফুসফুসে। অনেকটা পজেটিভ প্রেশার ভেন্টিলেশন-এর মতো। সুবিশাল আয়রন লাং-এর সাহায্যে শরীরের চারপাশে ঋণাত্মক চাপ তৈরি করে শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোর পরিবর্তে বাইরে থেকে সরাসরি শরীরে বাতাস দেয়ার এ পদ্ধতিটিই তখন কার্যকর হয়ে উঠে।

সময়ের সাথে সাথে এটি পরিচিত হয়ে ওঠে চিকিৎসক মহলে। এই পদ্ধতিকে আরেকটু এগিয়েও নেন আলবার্ট বাওয়ার ও ভিভিয়ান রে বেনেট। তারা রবার ব্যাগের সঙ্গে যুক্ত করে দেন একটি নলাকার শ্বাসযন্ত্র। রোগীর ঘাড়ের পেছনে একটুখানি কেটে নলাকার ব্যাগটি জুড়ে দেন রোগীর ট্রাকিয়ায়। এবং কার্যকরভাবেই এটি ফুসফুসে বায়ুপ্রবাহে দারুণভাবে সহায়তা করে। জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধবিমানের পাইলটদের অক্সিজেন সরবরাহে ব্যবহৃত হতো এই পদ্ধতি।

১৯৫০ সাল। অভিজ্ঞ ডাক্তার ইবসেন ততদিনে ফিরে এসেছেন কোপেনহেগেনে। যোগ দিয়েছেন ব্লেগদাম হাসপাতালে। মনোযোগের সাথে প্রদান করছেন চিকিৎসাসেবা। এবং প্রায় ভুলতেই বসেছিলেন এই চমকপ্রদ প্রযুক্তির কথা যদি না বালবার পোলিং মহামারী আকার ধারণ করতো। কেননা, ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল থেকে এখানে আসার পর আর এই পদ্ধতির প্রয়োজন পড়েনি। কোথাও ব্যবহারও হয় নি সেভাবে। ফিলিপ ড্রিঙ্কার ও লুইস আগাসি শ’-এর আবিষ্কৃত আয়রন লাং দিয়েই কাজ চালিয়ে গেছেন চিকিৎসকরা। তবে, সেদিন ১৯৫২ সালের ২৫ আগস্টের মিটিং-এ ইবসেনের ঠিকই মনে পড়ে গেল সেই উদ্ভট পদ্ধতির কথা।

ব্যাগিং পদ্ধতিতে ভেন্টিলেটরের কার্যক্রম; ছবিসূত্র: Wikimedia Commons

মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন

সুযোগ পেয়ে জনসম্মুখে ইবসেন উত্থাপন করলেন তার পদ্ধতির কথা। খুলে বললেন বিস্তারিত। উপস্থিত সবার ভেতর শুরু হলো তর্ক-বিতর্ক। এবং একসময় চীফ ফিজিশিয়ান ল্যাসেন রাজি হলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, পরীক্ষা করে দেখাই যাক না কী হয়!

মিটিংয়ের পরেরদিন, ভিবি এবার্ট নামের ছোট্ট এক কিশোরী পোলিও নিয়ে ভর্তি হলো ব্লেগদামে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। প্রাণ যায় যায় অবস্থা মেয়েটির। মেয়েটি যখন শ্বাস নিতে না পেরে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিল, হারতে বসেছিল নিয়তির কাছে, ঠিক তখনই ইবসেন সিদ্ধান্ত নিলেন, এই পদ্ধতি ব্যবহার করেই তিনি মেয়েটিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন।

যেমন ভাবনা তেমন কাজ। পরেরদিন, ইবসেনের নির্দেশানুযায়ী একজন ডাক্তার শুরু করলো মেয়েটির অপারেশন। ঘাড়ের দিকে সতর্কতার সাথে একটুখানি কর্তন করে একটি নল (ট্রাকিওস্টোমি টিউব) প্রবেশ করানো হলো তার ফুসফুসে। ফলাফল? ফল হলো বিপরীত! অক্সিজেনের লেভেল কমে গিয়ে মরতে বসেছিল সে!

এ ঘটনায় মোটেই ঘাবড়ে গেলেন না ইবসেন। হাল ছাড়লেন না এতটুকুও। এবার টিউবের সঙ্গে একটি অক্সিজেন ভর্তি ব্যাগ জুড়ে দিলেন তিনি। যখনই ব্যাগে চাপ দেওয়া হয়, অক্সিজেন ভর্তি বাতাসে ভরে উঠে মেয়েটির ফুসফুস। কিন্তু বিধাতার খেল বোঝা মুশকিল। মেয়েটি কিছুতেই নিতে চাচ্ছে না এই অক্সিজেন। উপরন্তু, থুথু-লালায় ভরে উঠেছে তার মুখ, ভেসে যাচ্ছে চিবুক। রীতিমতো পাগলপ্রায় অবস্থা।

আশেপাশে জড়ো হওয়া ডাক্তারেরা নাক সিটকে বেরিয়ে পড়লেন সেখান থেকে। মনে মনে হয়তো ভাবলেন, এ দিয়ে আবার মানুষ বাঁচে নাকি? কিন্তু, শক্তমনা ইবসেন এবারও ধীরস্থির। সিডেটিভ সোডিয়াম থায়োপেন্টাল লাগালেন তার নাকে। ধীরে ধীরে মেয়েটি কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্রের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিল। সুদীর্ঘ প্রতিক্ষার পর আপন ফুসফুসে পুরে নিলো ব্যাগের অক্সিজেন। এসময় সজোরে নিঃশ্বাস নিলো সে। যেন ভিবি এবার্টের হয়ে নিঃশ্বাস নিলেন স্বয়ং ইয়ন ইবসেন। তৎক্ষণাৎ, একাকী রুমে বসে আনন্দে কেঁদে ফেললো সে। বিস্ময়কর খুশির ঝিলিক খেলে গেলো তার চোখেমুখে।

একসময় থায়োপেন্টালের ক্ষমতা কমে এলে আবারো খিঁচুনি উঠলো ভিবির। এসময় ইবসেন কেবল অক্সিজেন ব্যাগটাই চাপলেন। ততক্ষণে খাপ খাইয়ে নিয়েছে ভিবি। অভিযোজন করে ফেলেছে সদ্য আবিষ্কৃত কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্রের সঙ্গে। অক্সিজেন ব্যাগ চেপে নিঃশ্বাস চলমান রাখা হলো তার। আর এভাবেই বাওয়ার, বেনেট ও ইবসেনের কাঁধে ভর করে বেঁচে গেল ভিভি এবার্ট। আবিষ্কৃত হলো প্রাচীন ভেন্টিলেটর প্রযুক্তি। যা সময়ের ঘূর্ণাবর্তে সূচনা করেছে নব দিগন্তের।

ভিভি এবার্ট; ছবিসূত্র: smithsonianmag.com

চিকিৎসা কার্যক্রম

পরেরদিন, ঘটা করে শুরু হলো নবপ্রযুক্তির প্রয়োগ। পরের একসপ্তাহ টানা ব্যবহার করা হলো এই ব্যাগ। গড়ে প্রতিদিন ১০ লিটারের ২৫০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার শেষ হয়েছে। ছোট্ট হসপিটালটিতে ২৪ ঘন্টা একটানা চেপে চেপে ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে শ্বাস দিতে হয়েছে রোগীদের। তারপর?

একটানা আর কতদিন, কে-ই বা চাপবে এসব? চেপে চেপে হাতেও তো কষ্ট হচ্ছে খুব! ডাক্তার, নার্স, রোগীর স্বজন সবাই ক্লান্ত! এখন উপায়?

প্রতিকূল সে মুহূর্তে যেন দেবদূত হয়ে এগিয়ে এলো একঝাঁক মেডিক্যাল কলেজ ও ডেন্টাল পড়ুয়া শিক্ষার্থী। সংখ্যায় প্রায় হাজার দেড়েক তারা। হাত লাগালো স্বেচ্ছাসেবী কাজে। সেবাসুশ্রুষায় মাতিয়ে তুললো হাসপাতালের পরিবেশ। এই স্বেচ্ছাসেবীরা দিন-রাত এক করে পালাক্রমে প্রদান করেছে সেবা। চেপে গেছে অক্সিজেনের ব্যাগ, দিনরাত, সারাক্ষণ। ব্লেগদাম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের সবার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। তবে করতে পারে নি তাদেরকে পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান।

হয়তো ধরণী মা-ও বুঝেছিল সেদিন। মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত তাই তো সে-ও স্থাপন হয়েছিল। বিনা সুরক্ষা সামগ্রীতেই তারা প্রদান করেছে সেবা। এসময় শিক্ষার্থীর একজনও আক্রান্ত হয়নি ছোঁয়াচে বালবার পোলিওতে!

স্বেচ্ছাসেবী মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরা পোলিও আক্রান্ত রোগীদের ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে কৃত্রিম শ্বাস দিচ্ছেন; ছবিসূত্র: Medical Museion, University of Copenhagen

প্রাপ্ত ফলাফল

মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে মৃত্যুর হার ৮৭% থেকে সোজা ৫০% এ নেমে এলো। মাস দুয়েক না ঘুরতেই মৃত্যুর হার এসে ঠেকেছে ৩৬% এ। এর পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে মৃত্যুর হার নেমে গেলো সোজা ১১% এর ঘরে। কী দারুণ ফলাফল! তাই-না?

সেসময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জায়গা সংকুলানে পোলিও আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে আসেন একক স্থানে। অন্য রোগীদের জায়গা হয় ভিন্ন স্থানে। তাদের (পোলিও আক্রান্তদের) জন্য রাখা হয় এ রোগে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন স্পেশাল ডাক্তার নার্স। তৈরি করা হয় এক বিশেষ পরিবেশ।

ভাবেন তো, কী হয়েছিল তখন? হ্যা, এভাবেই সূচনা ঘটে বর্তমানে আমরা যাকে চিনি ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট (ICU) নামে। তারপরের গল্পটা সকলেরই জানা। ব্লেগদামকে অনুকরণ করে অন্য সকল হাসপাতালেও গড়ে তোলা হয় এই বিশেষ পরিবেশ। ব্যবহার করা হয় হাতে তৈরি ভেন্টিলেটর চাপন যন্ত্রের। পরবর্তী সময়ে এই ভেন্টিলেটরকে করা হয়েছে উন্নত। সময়ে-অসময়ে পেয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া।

এখনকার অধুনা ভেন্টিলেটর নিজেই বুঝতে পারে কখন রোগীর কতটুকু অক্সিজেন প্রয়োজন। সে সময় এসবের কিছুই ছিল না। ছিল না যান্ত্রিক সতর্কতাও। ফলস্বরূপ, নিপতিত হতে হয়েছে নানাবিধ তিক্ত অভিজ্ঞতায়।

আধুনিক ভেন্টিলেটর যন্ত্রের কার্যক্রম; ছবিসূত্র: Greech.net

পোলিং আক্রান্ত রোগীদের রাতের বেলায় ঘুমের বেশ প্রয়োজন ছিল। আর তাই রাত হলেই নিভিয়ে দেওয়া হতো রুমের সকল বাতি। অন্ধকার কক্ষেই চলতো সেবা-যত্ন।

অনেক সময় এমন হতো, রাতের বেলা রোগীর ঘাড় থেকে খুলে গেছে অক্সিজেন টিউব। স্বেচ্ছাসেবীরা তা টের পেয়েছেন সকাল হলে। দেখতে পেতেন, মরে ঠান্ডা হয়ে আছে একেকজন রোগী। কী হৃদয়বিদারক দৃশ্য, তাই-না?

এতসবের পরেও তারা অক্লান্ত সেবা দিয়ে গেছেন। আগলে রেখেছেন শয্যাশায়ী মানুষগুলোকে- নিজেদের উষ্ণ স্পর্শে, মায়াময় সেবা-সুশ্রুষায়!

তথ্যসূত্র: 

লেখাটি 72-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো, মাসে একবার। নিউজলেটারে সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে বিশ্লেষণ থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading