চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে বেশ বড়ো একটা জায়গা দখল করে রয়েছে সার্জারি বা শল্যচিকিৎসা। সুপ্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত চিকিৎসাশাস্ত্রে নিজের স্থান ধরে রেখেছে এই পদ্ধতি। সবচেয়ে পুরাতন সার্জারির প্রমাণ পাওয়া গেছে পাথর যুগে, একটি শিশুর পা-ব্যবচ্ছেদ। প্রাচীন মিশরীয়রা আনুমানিক ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার শুরু করে। এ সময়ে তাঁরা জখমের সেলাই ও হাড় ভাঙার চিকিৎসা করত। খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫০ সালে ‘দ্য কোড অব হাম্মুরাবি’ তে সার্জনদের অনুসৃত নীতিমালা পাওয়া যায়। খ্রিস্টাব্দ ৯৫০ সালের দিকে আরবরাও এক্ষেত্রে নৈপুণ্য প্রদর্শন করে। কাল পরিক্রমায় উনবিংশ শতাব্দীতে আধুনিক সার্জারি বিকাশ লাভ করে।
সার্জারির ক্ষেত্রে অপারেটিভ মটার্লিটি বলে একটা কথা আছে। কোনো এক ধরনের সার্জারি করার পর তাৎক্ষণিকভাবে বা সার্জারির ৩০ দিনের মধ্যে কত রোগীর মৃত্যু ঘটে, সেই মৃত্যুহারই হলো অপারেটিভ মর্টালিটি। একেক ধরনের সার্জারির মৃত্যুহার একেক দেশের জন্য একেক রকম হয়। তবে ইতিহাসে এমন একটা সার্জারির ঘটনা আছে, যেটির মৃত্যুহার ৩০০%। অর্থাৎ এক সার্জারিতে তিনজন মানুষের (রোগী এবং অন্য দুইজন) মৃত্যু ঘটেছিল।
যে ব্যক্তি এ ঘটনার জন্য দায়ী, তিনি হলেন ব্রিটিশ সার্জন রবার্ট লিস্টন। ১৭৯৪ সালের ২৮ অক্টোবর জন্ম তাঁর। ডাক্তারি পড়া শেষ করেন ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরার মেডিক্যাল স্কুল থেকে। কাজ করতেন অ্যানাটমিস্ট জন বার্ক্লের সহকারী হিসেবে। ১৮১৮ সালে এডিনবারা রয়্যাল ইনফার্মারি তে হাউজ সার্জন হিসেবে নিযুক্ত হন। শুরুতে কর্তৃপক্ষের সাথে বনিবনা না হওয়ায় তাঁকে সেখান থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তবে বছর পাঁচেক পর তাঁকে সেখানে ফেরানো হয়। ১৮২৮ সালে তাঁর পদোন্নতি ঘটে অপারেটিং সার্জন হিসেবে। ১৮৩৪ সালে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের সদ্যপ্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে তিনি সার্জন হিসেবে নির্বাচিত হন।
যেসময় লিস্টন প্র্যাক্টিস করতেন,তখন অ্যানাসথেসিয়া ছিল না। সার্জারির ব্যথা যাতে রোগী অনুভব না করতে পারেন, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করাই হলো ক্লিনিক্যাল অ্যানাসথেসিয়া বা অ্যানাসথেসিয়া। ১৮৪৮ সালে উইলিয়াম মর্টন নামের এক আমেরিকান ডেন্টিস্ট এক রোগীর দেহে সালফিউরিক ইথার নামক অ্যানাস্থেটিক প্রয়োগ করেন এবং অপারেশন করেন সার্জন জন ওয়ারেন। ইথারের বাষ্প প্রশ্বাসের সাথে শরীরে প্রবেশ করার পর রোগী আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং ব্যথাহীন একটি সার্জারি সম্পন্ন হয়। এটাকেই অ্যানাস্থেসিয়া ব্যবহার করে ইতিহাসের প্রথম সফল সার্জারি বলা হয়।
তবে এর আগে সার্জারি সফল করতে (রোগীকে বাঁচাতে) সার্জনকে যথাসম্ভব দ্রুত হাত চালাতে হতো। যেহেতু সার্জারির সময় প্রচুর রক্তপাত হতো, তাই রোগীর টিস্যুগুলোতে রক্ত সরবরাহ কমে যেত, কমে যেত রক্তচাপ । ফলশ্রুতিতে দেখা দিত শক। ব্যথার কারণে বেড়ে যেত অ্যাডরেনালিন হরমোন, যার কারণে হার্ট ফেইলিউর হতো। দ্রুত সার্জারি করতে গিয়ে প্রায়সময় পরিচ্ছন্নতার দিকে খেয়াল রাখা হতো না। যে টেবিলে মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করা হতো দেখা যেত সেই টেবিলেই অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে। টেবিল ঘিরে সার্জনের আশেপাশে থাকত শিক্ষার্থী ও উৎসুক জনতা।
আবার সার্জনরা কালো লম্বা পোশাক পরতেন, যেটা ছিল তাদের পরিচিতিসূচক। ওই পোশাকে লেগে থাকত রোগীর রক্ত ও ধুলাবালি। কখনও পরিষ্কার করা হতো না ওই পোশাক। ধরে নেওয়া হত যার পোশাক যত নোংরা ও ধুলিমলিন, তিনিই সবচেয়ে অভিজ্ঞ বা ওস্তাদ সার্জন। এসব কিছুর ফলে সংক্রমণের হার ছিল অনেক বেশি। পোস্ট-অপারেটিভ ইনফেকশনের কারণে গ্যাংগ্রিন হয়ে বেশিরভাগ রোগী মারা যেত। মানুষ ধারণা করতো যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকের চেয়ে অপারেশনের রোগীর মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
নিজের কাজে লিস্টন ছিলেন একজন ওস্তাদ পর্যায়ের লোক। তাঁর দ্রুততা তৎকালীন অনেক চিকিৎসককে ঈর্ষান্বিত করতো। বেশিরভাগ সার্জনের সার্জারির ধীরগতির কারণে ১০০ জন রোগীর মধ্যে ২৫ জনই মারা যেত,যেখানে লিস্টনের জন্য সংখ্যাটা ছিল মাত্র ১০। লিস্টন নিজের সময়ের তুলনায় বেশ সচেতন সার্জন ছিলেন। জীবাণু সম্পর্কে ধারণা না থাকা সত্ত্বেও তিনি পরিচ্ছন্ন বেশে পরিষ্কার হাতে সার্জারি করতেন।
ব্রিটিশ সার্জন ও লেখক রিচার্ড গর্ডন উল্লেখ করেন,লিস্টন রোগীর পা ব্যবচ্ছেদ করতে সময় নিতেন মাত্র আড়াই মিনিট।এমনকি একবার ২৮ সেকেন্ডেও কাজটি করে দেখিয়েছিলেন! তাকে গর্ডন আখ্যা দিয়েছিলেন ‘ ফাস্টেস্ট নাইফ অন দ্য ওয়েস্ট ইন্ড’। নিজের হাতের দ্রুতগতির ব্যাপারে তিনি এতটাই নিশ্চিত থাকতেন যে, সার্জারি শুরু করবার আগে তিনি আশেপাশের মানুষকে বলতেন ঘড়ি ধরতে। তাঁর অপারেশন দেখতে রোগীর স্বজন ও ছাত্ররা তো বটেই,আশেপাশের অনেক মানুষও আসতো। একবার লিস্টন সার্জারি শুরু করলে তার ছুরির ঝলক বলে দিতো, দ্রুত সার্জারি করা এবং নিজের সময়ের রেকর্ড নিজেই ভাঙা তার কাছে কেমন নেশার মতো হয়ে উঠেছিল।
তবে একদিন ঘটে যায় দুর্ঘটনা। লিস্টন এক রোগীর পা ব্যবচ্ছেদ করছিলেন। যথারীতি “টাইম মি জেন্টলম্যান” বলে অপারেশন শুরু করলেন। দ্রুত ছুরি চালাতে গিয়ে বেখেয়ালে রোগীর পায়ের সাথে নিজের সহকারীর আঙ্গুলও কেটে ফেললেন। তিনি ছুরি ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে তা এক দর্শকের কোটের প্রান্তের কিছুটা কেটে ফেললো। দর্শক অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়লেন। যাদেরকে সেদিন লিস্টনের ছুরি স্পর্শ করেছিলো,তাঁরা কেউই বাঁচলেন না আর। রোগী আর ডাক্তারের সহকারীর ক্ষতে পচন ধরার কারণে তারা মারা গেলেন। আর যে লোকটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলো,সে আর কোনোদিন ওঠেনি। শকের কারণে মৃত্যু হলো তার। এভাবেই লিস্টনের এক সার্জারিতে মৃত্যু ঘটলো তিনজনের। তবে লিস্টনের ছুরির অবাধ্যতা এখানেই শেষ নয়। কথিত আছে,তিনি একবার রোগীর পায়ের সাথে তার অন্ডকোষও কেটে ফেলেন।
তবে এসব কিছুই লিস্টনের খ্যাতির পক্ষে বাধা হতে পারেনি। সর্বদা বটল গ্রিন কোট আর ওয়েলিংটন বুট পরিহিত ডাক্তার কিছুটা রুক্ষ প্রকৃতির হলেও রোগীদের প্রতি ছিলেন সদয় এবং সহানুভূতিশীল। রোগীর সাথে কোনো অসভ্য আচরণ করা হয়েছে সন্দেহ হলে কাউকে ছাড়তেন না, সহকর্মী বা ছাত্র যেই হোক না কেন। ইউরোপিয়ানদের মধ্যে তিনিই প্রথম অ্যানাস্থেসিয়া ব্যবহার করে অপারেশন করেন এবং এর প্রভূত প্রশংসা করেছিলেন। তিনি ইউনিভার্সিটি কলেজ হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল সার্জারির প্রথম অধ্যাপক হয়েছিলেন।লিখেছিলেন এলিমেন্টস অব সার্জারি (১৮৩১-১৮৩২) এবং প্র্যাক্টিকাল সার্জারি (১৮৩৭)। সার্জারি বিষয়ে তাঁর জ্ঞান জোসেফ লিস্টারের ( অ্যান্টিসেপটিক সার্জারির পথিকৃৎ) মতো বিজ্ঞানীকে অনুপ্রাণিত করেছিলো। ১৮৪১ সালে তিনি রয়াল সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৮৪৭ সালে অ্যাওর্টিক অ্যানিউরিজমে মৃত্যু ঘটে তার।
হয়তো দুর্ঘটনা ঘটতো, কিন্তু অবেদন বিহীন ওই যুগে দ্রুতগতির সার্জারি ছাড়া রোগীর জীবন বাঁচানো হতো কঠিন। তাই, লিস্টনকে স্বীকৃতি দিয়েছে ইতিহাস, তার নামে রয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ এবং পদক।
তথ্যসূত্র-
Leave a Reply