নরখাদক কিংবা প্রকৃতির এক বিশৃঙ্খলা

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

সাল ১৯৯০
গ্রান ডোলিনা গুহা, স্পেন।

গ্রান ডোলিনা গুহার খননকাজ প্রায় শেষের দিকে। এমন সময় কিছু একটা দেখে আৎকে উঠলেন তৎকালীন নৃতত্ত্ববিদরা। এই কিছুক্ষন আগে ৮ লাখ বছর পুরোনো যেই প্রাগৈতিহাসিক মানব দেহাবশেষটি পাওয়া গেলো, তার হাড়ে উঁকি দিচ্ছে অস্বাভাবিক কাটা কাটা দাগ। কিছু জায়গা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এই দেহের যিনি অধিকারী ছিলেন, তার হাড় থেকে জোর পূর্বক মাংস ছাড়ানো হয়েছে। বিষয়টি উপলব্ধি করা মাত্র যারপরনাই শিহরন বয়ে যায় উপস্থিত সকলের শরীরে। একজন তো বলেই উঠলেন, “সে কালেও তবে ক্যানিবালিসম ছিল! মানুষ হয়ে ওরা মানুষেরই মাংস খেতো!”

প্রিয় পাঠক, বিশ্বাস করুন আর না করুন উপরের ঘটনাটি কিন্তু একদম সত্যি। স্পেনের অ্যাটাপুয়েরকা পর্বতের গ্রান ডোলিনা গুহা বরাবরই প্রত্নতাত্ত্বিক এবং নৃতত্ত্ববিদদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। কেননা এখান থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে ৮ লাখ বছর পুরোনো মানুষের দেহাবশেষ। ১৯৯০-এর দশকের খননকাজে গ্রান ডোলিনা গুহা থেকে ৮ লাখ বছর পুরনো হাড়ের টুকরো উদ্ধার করা হয়। এবং গবেষকরা এই হাড়ের উপর কাটার দাগ এবং মাংস ছাড়ানোর লক্ষণ দেখতে পান, যা ইঙ্গিত করে যে এখানে ক্যানিবালিজম ঘটেছিল। বিষয়টির গভীরতা বুঝতে পারছেন কি? ৮ লাখ বছর কিন্তু!

প্রিয় পাঠক, চলুন আরেক “অভিশপ্ত হাসির” এক সত্য গল্প শোনা যাক। গল্পটি পাপুয়া নিউ গিনির সবুজ পাহাড়ঘেরা ফরেতে সম্প্রদায়ের গ্রামগুলোর প্রেক্ষাপট নিয়ে। একসময় সেখানে অদ্ভুত এক রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রথমে কেউই জানত না এর কারণ। এটি শুরু হতো সাধারণ মাথাব্যথা, গাঁটে ব্যথা আর হাত-পায়ের হালকা কম্পনের মাধ্যমে। তারপর দিন যত গড়াত, রোগীরা নিজেদের শরীরের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করত। তাদের হাঁটা-চলা অস্থির হয়ে পড়ত। এক পর্যায়ে অহেতুক হাসতো। এবং হাসতে হাসতেই তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো।

ফরেত সম্প্রদায়ের মানুষের বিকৃত বিশ্বাস তাদের ব্যাপক ভুল পথে ধাবিত করেছিল দিনের পর দিন। তারা চাইতো তাদের মৃত আত্মীয়-স্বজন যেন সবসময় তাদের পাশে থাকুক। আর এরই প্রেক্ষিতে তারা তাদের মৃত আত্মীয়দের মাংস বিশেষ করে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে মস্তিস্ক খাওয়া শুরু করে। একটা সময় দেখা গেল, গ্রামবাসীরা অহেতুক কারনে হাসাহাসি করতো। অর্থাৎ তারা জানে না তারা ঠিক কী কারণে হাসছে। তাদের এই হাসির রোগের কথা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়লে বিজ্ঞানীরা বিষয়টি ঘাটার জন্য সোজা ফরেতে চলে যায়। প্রথমে তারাও কিছু ধরতে পারছিলেন না। কিন্তু পরবর্তীতে গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলে জানতে পারেন এখানে মৃত দেহ খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। বিজ্ঞানীরা মৃতদেহ সংগ্রহ করে এর উপর গবেষনা চালালে জানতে পারেন এই রোগটি ছড়াচ্ছেই মৃতদেহ সরাসরি ভক্ষণের কারণে।প্রিয়ন নামের এক বিকৃত প্রোটিন এই রোগের জন্য দায়ী। এই প্রোটিন মানুষের মস্তিষ্কে জমা হয়ে স্নায়ুবিক ক্ষতি করে। যারই ফলাফল এই হাসির রোগ- কুরু। প্রিয়ন আবিষ্কৃত হয় ১৯৫০ সালে। এটি আবিষ্কারের পরই সরকার থেকে মৃতদেহ ভক্ষণের রীতি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ ইঙ্কিউবেশনের কারণে ২০০৯ সালে এসে সর্বশেষ রোগাক্রান্ত রোগীটি মারা যান।

কেন নরমাংস ভক্ষণ করাকে ক্যানিবালিজম বলে?

ক্যানিবাল শব্দটির উৎপত্তি হয় ক্রিস্টোফার কলম্বাসের ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ভ্রমণের সময়। গুয়াডেলুপে দ্বীপে পৌঁছে তিনি স্থানীয় অধিবাসীদের সম্পর্কে বন্ধুসুলভ মন্তব্য করেন। তবে তিনি এমন একটি গোষ্ঠীর গল্প শোনেন, যাদের বলা হয় “ক্যারিব,” যারা নাকি ভয়ঙ্কর আক্রমণ চালিয়ে তাদের শত্রুদের হত্যা করে তাদের মাংস খেত।
এমন খবরে স্পেনের রানী ইসাবেলা ক্যানিবালিজম প্র্যাকটিসকারীদের দাসত্বে নিয়ে আসার অনুমতি দেন। এরপরে কলম্বাস এসব প্রতিরোধকারী মানুষদের “ক্যারিব” নামে অভিহিত করেন, যা পরবর্তীতে “কানিবে” এবং শেষ পর্যন্ত “ক্যানিবাল” নামে পরিচিত হয়। ঔপনিবেশিকরা এই শব্দটি আদিবাসীদের অমানবিক প্রমাণ করতে ব্যবহার করেছিল।

আন্দিজের কান্না

খুব বেশি দিন হয়নি এমন এক ক্যানিবালিসমের একটি ঘটনা না বললেই নয়। আন্দিজ পর্বতে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা আমরা সকলেই কম বেশি জানি। এই পর্বতের উপর হয়েছিল এক রহস্যজনক দূর্ঘটনা যার কূলকিনারা অনেক কাল অব্দি আন্দাজ করা যায়নি। বরফে আচ্ছাদিত এই পর্বতে প্লেন ক্র‍্যাশের মতো দুর্ঘটনা সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। একটা জলজ্যান্ত প্লেন, উড়ছিল নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কোথায় গিয়ে পড়লো জানা গেলো না। কোনো ধরনের সংকেত কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে নিজের পরিণতির কথা কাউকে জানাতে পারেনি। বিশ্বাস না হলেও সত্য যে, প্ল্যান ক্র‍্যাশের পর পর যখন এটিকে তালাশ করা হচ্ছিলো, তখনোও কোনো উদ্ধারকর্মী প্লেনটির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায়নি। অবশ্যই ক্ষয়ক্ষতি অনেক হয়েছে, নিহতের মিছিলও ছিল অনেক। তবে এতটুকুই কি আন্দিজের “ঘটনা” বলে বিখ্যাত?

বরফে ঢাকা যেই পর্বতটি গুড়িয়ে যাওয়া প্লেনটির ধ্বংসপ্রাপ্ত দেহাবশেষটিকে আশ্রয় দিয়েছিল, সেই পর্বত থেকেই অনেক সময় পর উদ্ধার করা হয় জীবিত মানুষ! যারা ভাগ্যক্রমে বিমান ধ্বসে বেঁচে গেলেও খাবারের অভাবে টিকে থাকার কথা ছিল না। বিষয়টি খঁতিয়ে দেখার পর গবেষকরা জানান, জীবিতরা এতগুলো দিন তাদের মৃত সহযাত্রীর মাংস খেয়ে বেঁচে ছিল!

নির্মম ঠেকলেও কেবল বেঁচে থাকার তাগিদে এই কাজটি করেছে তারা। করেছে বললেও কথা ভুল শোনায়। বলা উচিত করতে বাধ্য হয়েছে।

তাহলে প্রিয় পাঠক, ক্যানিবালিসমের এই বিষয়টি আপনারা কীভাবে দেখেন? ইতিবাচক না-কি নেতিবাচক?

কোন পরিস্থিতিতে ক্যানিবালিসম ঘটছে বা ঘটেছে তার প্রেক্ষিতে একে সংজ্ঞায়িত করা উচিৎ। কেননা এটি এতটাই নাজুক একটি বিষয় যে আপনি একে ইতিবাচক তো বলতে পারবেনই বা বরং ক্ষেত্রবিশেষে নেতিবাচকও বলা যাবে না। নিশ্চয়ই ভাবছেন কেন নেতিবাচক বলা যাবে না? এই যে, আন্দিজ পর্বত আপনার সামনে উত্তর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

দেখুন, প্রাচীন ইউরোপে মানুষের মমি থেকে একধরনের গুড়ো তৈরী করা হতো যার নাম মুমিয়া। এটি পনেরো শতকের কথা বলছি। তখন মুমিয়া বেশ জনপ্রিয় ছিল। কেননা এর মাধ্যমে বমি, ক্ষত, মৃগী ও রক্তপাতের মতো সমস্যাগুলোর সমাধান করা হতো। একেও বেঁচে থাকার তাগিদে ক্যানিবালিসম চর্চার ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়, ঠিক আন্দিজের দূর্ঘটনার মতো।

অন্যদিকে যখন নর মাংস খাওয়ার ব্যাপারটা ধর্মীয় চর্চা, সংস্কৃতি, সামাজিক রীতি-রীতি-নীতি কিংবা ঐতিহ্যের মধ্যে পরে- তখন সেটি হয়ে যায় ক্যানিবালিসমের নেতিবাচক অংশ। তবে ক্যানিবালিসমের উদ্দেশ্য ভালো মন্দ যাই হোক না কেন, এটি কখনোই কাম্য নয়। একে যেমন সমাজ সম্মতি দেয় না ঠিক একই ভাবে বিজ্ঞানও একে সম্মতি দেয় না। আজ এ পর্যন্তই। পরবর্তী লেখা পড়ার আমন্ত্রণ রইলো। ধন্যবাদ।

লেখাটি 17-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো, মাসে একবার। নিউজলেটারে সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে বিশ্লেষণ থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading