আরবান হিট আইল্যান্ড


লিখেছেন

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

আরবান হিট আইল্যান্ড শব্দটা আমাদের অনেকের কাছেই পরিচিত, আবার অনেকের কাছেই অপরিচিত, কিন্তু নিয়মিত তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং এর কারণে জনজীবনের অস্বস্তির বিষয়টা কারোরই দৃষ্টিগোচর নয়। কিন্তু আমরা ‘আরবান হিট আইল্যান্ড’ পরিভাষাই কেন ব্যবহার করি? কেন ‘রুরাল হিট আইল্যান্ড’ বলি না? কীভাবে আরবান হিট আইল্যান্ড রূপায়িত হয়? কীভাবে আমরা এর পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা পেতে পারি? এই সব বিষয় নিয়েই আজ বিস্তৃতভাবে আলোচনা করব।

আরবান হিট আইল্যান্ড কী?

আরবান হিট আইল্যান্ড বা নগর তাপদ্বীপ হল এমন একটা ধারণা, যেখানে শহরাঞ্চলের তাপমাত্রা আশেপাশের গ্রামাঞ্চলের তুলনায় বেশি থাকে। এ ক্ষেত্রে তাপমাত্রা গ্রামের তুলনায় প্রায় ৩-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেশি হতে পারে। এতে শহুরে জনজীবন বিষিয়ে ওঠে।

কীভাবে সৃষ্টি হয় আরবান হিট আইল্যান্ড?

আরবান হিট আইল্যান্ড বা ইউএইচআই প্রভাব একটি প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট প্রক্রিয়া। শহরের গঠন, উপাদান, এবং মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপই এর পেছনে দায়ী। ইউএইচআই এর পেছনের কারণগুলো হলো-

শহুরে স্থাপনায় ব্যবহৃত নানা উপকরণের তাপীয় বৈশিষ্ট্য

শহরের স্থাপনায় ব্যবহৃত উপকরণ যেমন কংক্রিট, অ্যাসফল্ট, ও ইট সূর্যের তাপ অতি সহজে শোষণ করে এবং তা দীর্ঘ সময় ধরে রাখে। এই উপকরণগুলোর প্রতিফলন ক্ষমতা কম। ফলে দিনেরবেলা এরা প্রচুর তাপ শোষণ করে এবং এই শোষিত তাপ রাত্রিবেলা ধীরে ধীরে ছেড়ে দেয়। এর ফলে রাতেও শহরের তাপমাত্রা কমে না।

গাছপালা কমে যাওয়া এবং বাষ্পীভবন হ্রাস

শহরে গাছপালা ও খোলা জমির পরিমাণ কম থাকায় বাষ্পীভবন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। গাছপালা বাতাসকে আর্দ্র রাখে, যা তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু গাছপালা কম থাকায় এই শীতলীকরণ প্রক্রিয়াও দুর্বল হয়ে পড়ে।

উদাহরণস্বরূপ, ফাও (FAO) এর রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশের মোট বনভূমির পরিমাণ ১৫-১৬ শতাংশ। শহরে এর অনুপাত এক শতাংশেরও কম, কোথাও কোথাও ০.৩% বা তারও নিচে। অর্থাৎ শহরগুলোতে বনভূমির পরিমাণ গ্রাম বা প্রাকৃতিক এলাকার তুলনায় প্রায় ১৫ গুণ বা তারও কম।

মানবসৃষ্ট কারণসমূহ

যানবাহন, কলকারখানা, এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র থেকে প্রচুর তাপ তৈরি হয় যা আশপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাপমাত্রা বাড়ায়।

শহরের স্থাপত্য ও তাপ নির্গমনে বাধা

উঁচু দালান ও ঘনবসতির কারণে শহরের রাস্তাঘাট খুবই সরু হয়, যা বাতাস চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে গরম বায়ু শীতল বায়ু দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় না। এমনকি তাপ বিকিরণের ফলে রাতের বেলায়ও বাতাস ঠান্ডা হতে পারে না।

বায়ুদূষণ ও গ্রিনহাউস প্রভাব

শহরের বাতাসে ধূলিকণাসহ নানারকম ভারী ধাতু ভেসে বেড়ায়। এরা বাতাসে নির্গত তাপীয় বিকিরণ আটকে রাখে। যেমন পিএম (পার্টিকুলেট ম্যাটার, স্মগ ইত্যাদি)। ফলে চারপাশের পরিবেশ আরও বেশি গরম হয়ে যায়।

অনার্দ্র পৃষ্ঠ এবং পানিচক্র এর প্রভাব

শহরের পাকা রাস্তা ও দালানগুলোর কারণে বৃষ্টির জল মাটিতে প্রবেশ করতে পারে না, ফলে মাটির আর্দ্রতা কমে যায়। এর ফলে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক শীতলীকরণ ব্যাহত এবং শহরের তাপমাত্রা আরও বেড়ে যায়।

এই উপাদানগুলো একত্রে শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে এবং আরবান হিট আইল্যান্ড প্রভাবকে আরও প্রবল করে তোলে।

নগর তাপদ্বীপের স্বাস্থ্যঝুঁকি কি কি?

আরবান হিট আইল্যান্ডের কারণে তাপপ্রবাহ হয়ে থাকে, যার ফলে হিট স্ট্রোক হয়। এছাড়াও পানিশূন্যতা সহ নানা ধরনের তাপ ঘটিত সমস্যার সৃষ্টি হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর শিকার মূলত শিশু ও বৃদ্ধরাই হয়ে থাকে। আরবান হিট আইল্যান্ডের কারণে ওজোন স্তরের গঠন ব্যাহত হয়, যা বায়ুদূষণের জন্য দায়ী। এর ফলে শ্বাসতন্ত্রের রোগ যেমন হাঁপানি, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD), ফুসফুসের ক্যানসার ইত্যাদি রোগ হতে পারে।

আমরা কীভাবে আরবান হিট আইল্যান্ড প্রভাব কমাতে পারি?

  • বাসাবাড়ির ছাদে বাগান করা, বিভিন্ন ধরনের ইনডোর গাছ যেমন স্নেক প্লান্ট, মানি প্লান্ট, কয়েন প্লান্ট ইত্যাদি ঘরে রাখা যায়। এরা প্রাকৃতিকভাবে বায়ুতে উপস্থিত দূষিত পদার্থ কমিয়ে বাতাসকে বিশুদ্ধ করে এবং ঘরের ভেতরের তাপমাত্রাও কমাতে সাহায্য করে।
  • অযথা যানবাহনের ব্যবহার না করে, তার পরিবর্তে অল্প দূরত্বের পথে হেঁটে যাওয়া অথবা সাইকেল ব্যবহার করা।
  • শিল্পাঞ্চলে বায়ু বিশুদ্ধকরণ গাছ লাগানো।
  • রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় পরিকল্পিতভাবে গাছ রোপণ করা।
  • সোলার প্যানেলের ব্যবহার বাড়ানো।
  • অকারণে জলাশয় ভরাট না করা, নদী সংরক্ষণ করা, সূর্যের আলো প্রতিফলনের ব্যবস্থা করা।
  • অঞ্চলবিভাজন নীতি মেনে চলা 

আরবান হিট আইল্যান্ড প্রভাব প্রশমনে সফল দেশের উদাহরণ

শহুরে তাপদ্বীপ প্রভাব মোকাবেলায় বিশ্বের অগ্রগণ্য দেশগুলোর মধ্যে একটি হলো সিঙ্গাপুর। এই দেশটি উল্লেখযোগ্য ভাবে তাপ নিয়ন্ত্রণ করেছে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে। সরকার ‘সিটি ইন অ্যা গার্ডেন’ কর্মসূচির মাধ্যমে শহরের ফাঁকা স্থানগুলোতে বৃক্ষরোপণ করে যা শহরের তাপ কমাতে এবং বায়ু দূষণ কমাতে সহায়ক ভূমিকা পপাল  করে। গবেষণা বলে, এই সবুজায়ন প্রচেষ্টা তাপমাত্রা হ্রাসে কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

এছাড়া, সিঙ্গাপুরের বিল্ডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন অথরিটি, বিসিএ ‘গ্রিন মার্ক শেম’ চালু করেছে, যা টেকসই ভবন ডিজাইনের জন্য প্রণোদনা দেয়। এই ধরনের ভবন দ্রুত তাপ নির্গমনসহ তাপ শোষণ কমায়, যা আশেপাশের পরিবেশেরও তাপ কমাতে সাহায্য করে। সিঙ্গাপুরের আরবান রিডেভেলপমেন্ট অথরিটি নগর পরিকল্পনা, সংরক্ষণ, উন্নয়নসহ বিভিন্ন কার্যকলাপ প্রণয়নের মাধ্যমে তাপপ্রবাহ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।

তথ্যসূত্র-

লেখাটি 147-বার পড়া হয়েছে।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য লেখা

  • মুরগির মাংসে শনাক্ত ইশেরিশিয়া আলবার্টিঃ  অজান্তেই বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ঝুঁকি

    মুরগির মাংসে শনাক্ত ইশেরিশিয়া আলবার্টিঃ অজান্তেই বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ঝুঁকি

  • আদতেই কি ফিরে এসেছে ডায়ার নেকড়ে?

    আদতেই কি ফিরে এসেছে ডায়ার নেকড়ে?

  • ভুল নিদানে সন্তান হত্যার দায়ঃ একটি করুণ কেস স্টাডি

    ভুল নিদানে সন্তান হত্যার দায়ঃ একটি করুণ কেস স্টাডি

  • কমোডো ড্রাগন: উপকথার ড্রাগনদের পৃথিবীতে বিচরণ!

    কমোডো ড্রাগন: উপকথার ড্রাগনদের পৃথিবীতে বিচরণ!

  • মহাবিশ্বের জ্যামিতি ও অন্তিম পরিণতি

    মহাবিশ্বের জ্যামিতি ও অন্তিম পরিণতি

  • খাদ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি: কতটা ভয়ংকর?

    খাদ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি: কতটা ভয়ংকর?


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো, মাসে একবার। নিউজলেটারে সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে বিশ্লেষণ থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading