রাতের আকাশে অগণিত তারা দেখা যায়। কেবলমাত্র আমাদের সূর্যই একমাত্র তারা নয় যাকে কেন্দ্র করে গ্রহরা ঘুরে বেড়ায়। আমাদের সৌরজগতের বাইরে অন্য নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরে বেড়ায় এমন গ্রহকে বলা হয় এক্সোপ্ল্যানেট। ১৯৯৫ সালে আমাদের সূর্যের মতোই দেখতে একটি নক্ষত্রকে পর্যবেক্ষণ করার সময় প্রথম এক্সোপ্ল্যানেটের সন্ধান পান বিজ্ঞানী মাইকেল মায়োর ও দিদিয়ের কুইলোজ। তাদের এ আবিষ্কারের জন্য ২০১৯ সালে তারা নোবেল পুরষ্কারও লাভ করেন। প্রযুক্তির উৎকর্ষের কল্যাণে প্রতিনিয়তই এমন নতুন এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কার হচ্ছে। এই আর্টিকেলটি লেখার সময় অবধি মোট আবিষ্কৃত এক্সোপ্ল্যানেটের সংখ্যা ৫,৮৮৯টি।
কিন্তু এসব এক্সোপ্ল্যানেটেও কি মানুষের মতো জীব আছে? এর উত্তর আমরা এখনও জানি না। আবিষ্কৃত গ্রহের অধিকাংশই নক্ষত্রই গোল্ডিলক’স জোনে অবস্থান করে না। অর্থাৎ এই গ্রহগুলো হয় নক্ষত্র থেকে খুবই কাছে অবস্থান করে অথবা খুবই দূরে অবস্থা করে। নক্ষত্রের খুবই কাছে অবস্থান করলে প্রচণ্ড উষ্ণতায় গ্রহে প্রাণধারণ সম্ভব নয়। আবার নক্ষত্র থেকে খুবই দূরে অবস্থান করলে প্রচণ্ড হিমশীতল গ্রহেও প্রাণধারণ সম্ভব নয়। তবে সব গ্রহই কিন্তু এমন নয়। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত এক্সোপ্ল্যানেটের মধ্যে ৩৬১টি গ্রহ প্রাণধারণের উপযোগী। এর মধ্যে কে২-২৮বি নামক গ্রহটি প্রাণধারণের জন্য খুবই সম্ভাবনাময়।

সুপার আর্থ বনাম সাব নেপচুন
২০০৯ সালে কেপলার স্পেস টেলিস্কোপ নামে একটি টেলিস্কোপ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়। এ টেলিস্কোপের মূল কাজ আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মধ্যে থাকা পৃথিবীর প্রায় সমান আকারের এক্সোপ্ল্যানেটগুলো খুঁজে বের করা। ২০১৫ সালে কেপলার টেলিস্কোপের কে২ নামক মিশনে এই গ্রহটি আবিষ্কার করা হয়। পৃথিবী থেকে আমরা যদি আলোর বেগেও এর দিকে ছুটে চলি তবে এ গ্রহে পৌছাতে আমাদের সময় লাগবে প্রায় ১২৪ বছর। এই গ্রহটি যে নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরে (কে২-১৮) সে নক্ষত্রটি আমাদের সূর্যের থেকে আকারে ছোট ও তুলনামূলক কম উষ্ণ। এই গ্রহটি তার নক্ষত্রকে মাত্র ৩৩ দিনে একবার প্রদক্ষিণ করে আসতে পারে যেখানে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে আসতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন।
গ্রহটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৮.৫ গুণ ভরবিশিষ্ট তবে এর ব্যাসার্ধ পৃথিবীর তুলনায় মাত্র ২.৫ গুণ। ফলে এর গড় ঘনত্ব পৃথিবীর তুলনায় বেশি। এই গ্রহটির ভর ও ব্যাসার্ধ বিবেচনায় এটি অবশ্য পৃথিবী থেকে বড় কিন্তু নেপচুন থেকে ছোট। ফলে বোঝা মুশকিল, এই গ্রহটিতে পৃথিবীর মতো কঠিন পৃষ্ঠ রয়েছে না কি এর পৃষ্ঠ নেপচুনের মতো গ্যাসীয়। এখনও বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ বিষয়টি নিয়ে সংশয় কাটেনি।
হাইসিয়ান গ্রহ
যদি কে২-১৮বি একটি পৃথিবীর মতো পাথুরে পৃষ্ঠের গ্রহ হয়ে থাকে তবে এর বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি পাওয়া কথা। আর এটি যদি নেপচুনের মতো গ্যাসীয় দানব হয় তবে এর বায়ুমণ্ডলে অ্যামোনিয়া ও মিথেনের পরিমাণ বেশি পাওয়ার কথার। কে২-১৮বি আসলে কী তার সমাধান করার জন্য মাঠে নামেন দুইদল বিজ্ঞানী। ২০১৯ সালে মহাকাশে প্রেরণ করা জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে কে২-১৮বি কে পুনরায় পর্যবেক্ষণ করার কাজ হাতে নেন বিজ্ঞানী নিক্কু মধুসূদনের তত্ত্বাবধানে থাকা একটি দল ও বিজ্ঞানী রেনইউ হু-এর তত্ত্বাবধানে কাজ করা আরেকটি দল।
মূলত কে২-১৮বি গ্রহটি আমাদের থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে। এর বায়ুমণ্ডল উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টেলিস্কোপ দিয়েও সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায় না। যে নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে গ্রহটি ঘুরছে, প্রথমে সে নক্ষত্রের আলোক বর্ণালি বিশ্লেষণ করে ঐ নক্ষত্রে কী কী অনু-পরমাণু আছে তা বের করা যায়। এরপর যখন ঘুরতে ঘুরতে গ্রহটি নক্ষত্রের সামনে চলে আসে তখন গ্রহের কারণে ঐ নক্ষত্রের কিছু পরিমাণ আলো বাধাপ্রাপ্ত হয়। বাকি আলো গ্রহের বায়ুমণ্ডলের ভেদ করে আমাদের চোখে আসে। বায়ুমণ্ডল ভেদকারী এ আলোর বর্ণালি বিশ্লেষণ করে ঐ বায়ুমণ্ডলে কী কী অনু-পরমাণু আছে তা বের করা যায়।
কে২-১৮বি গ্রহের বায়ুমণ্ডলে আসলে কী কী আছে তা বোঝার জন্য তাই ঐ গ্রহের বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে গমনকারী আলোক বর্ণালি বিশ্লেষণ করতে হবে। এ কাজটিই করেন বিজ্ঞানী মধুসূদন ও তার দল। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মধ্যে থাকা দুটি ইন্সট্রুমেন্ট NIRSpec (Near-Infrared Spectrograph) এবং NIRI (Near-Infrared Imager and Spectrograph) এর সাহায্যে ২০২৩ সালে মধুসূদন ও তার টিম কে২-১৮বি এর বর্ণালি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেন।
বিশ্লেষণের ফলাফলে দেখা যায় কে২-১৮ বি গ্রহে প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোজেন ও পানির অণুর অস্তিত্ব আছে। হাইড্রোজেন ও পানির সাগর বিশিষ্ট গ্রহকে হাইসিয়ান গ্রহ নামে ডাকা হয়। এই আবিষ্কারটি বেশ চাঞ্চল্যকর ছিল। এর কারণ কে২-১৮বি প্রথম আবিষ্কৃত গ্রহ যা প্রাণধারণের জন্য উপযোগী এলাকা ‘গোল্ডিলকস জোন’-এ অবস্থিত এবং এতে পানির সাগরও বিদ্যমান রয়েছে। বিজ্ঞানী মধুসূদনের আরেকটি দাবীও ‘কে২-১৮বি এর বায়ুমণ্ডলে ডাইমিথাইল সালফাইডের উপস্থিতি’-ও বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি। তবে তার এ দাবী বিজ্ঞানীদের সমালোচনার সম্মুখীন হয়।
মনে রাখতে হবে, কোনো বিজ্ঞানী কিছু একটা দাবী করে তার পক্ষে প্রমাণ দিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেই তা প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান হয়ে যায় না, বিশেষ করে সে দাবী যদি বৈপ্লবিক কোনো দাবী হয়। তার সে দাবীর পক্ষে প্রদত্ত প্রমাণসমূহ বৈজ্ঞানিক মহলে গ্রহণযোগ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা তার কাজের সমালোচনা করবেন ও তার কাজের ত্রুটি বের করার চেষ্টা করবেন। দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেও যদি তার প্রমাণে ত্রুটি খুঁজে না পান কেবলমাত্র তবেই তা বৈজ্ঞানিক মহলে গ্রহণযোগ্য হবে ও তা বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
ডাই মিথাইল সালফাইড রহস্য
ডাই মিথাইল সালফাইড একটি বায়োসিগনেচার বা জৈবসংকেত। পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবে এই অণুটি কেবলমাত্র জীবরাই (ফাইটোপ্ল্যাংকটন) তৈরি করতে পারে। তাই এই অণুকে একটি বায়োসিগনেচার বলা হয়। অর্থাৎ অন্য কোনো গ্রহের বায়ুমণ্ডলে যদি এই গ্যাসটি পাওয়া যায় তাহলে ধরে নেওয়া যায় ঐ গ্রহেও এমন কোনো জীব আছে যারা এই ডাই মিথাইল সালফাইড তৈরি করছে।

সমস্যা হলো বিজ্ঞানী মধুসূদন ও তার টিম যে দুটি যন্ত্র দিয়ে বর্ণালি বিশ্লেষণ করেছেন তা আলোর যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যে ডাই মিথাইল সালফাইডের প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন, বর্ণালির সে অংশে ডাই মিথাইল সালফাইড ছাড়া মিথেন অণুর কারণেও শোষণ ঘটে। ফলে তারা যে ডাই মিথাইল সালফাইড খুঁজে পাওয়ার দাবী করেছেন সেটি ডাই মিথাইল সালফাইড না হয়ে বরং মিথেনও হতে পারে। বরং তা মিথেন হওয়াই স্বাভাবিক, হাইসিয়ান গ্রহে প্রচুর পরিমাণে মিথেন অণুর উপস্থিতি থাকা স্বাভাবিক একটি ঘটনা।

ডাই মিথাইল সালফাইডের উপস্থিতি ঐ গ্রহে আসলেই আছে কি না তা নিশ্চিত হতে বর্ণালির এমন অঞ্চলে ঐ গ্রহের বায়ুমণ্ডল পর্যবেক্ষণ করতে হবে যে অঞ্চলে কেবলমাত্র ডাই মিথাইল সালফাইডই তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ করে, অন্য কোনো অণু সে অঞ্চলে শোষণ করে না। এমন অঞ্চলে পর্যবেক্ষণক্ষম ইন্সট্রুমেন্ট হলো জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের এমআইআরআই বা MIRI (Mid-Infrared Instrument)।
এ বছরের শুরুতে বিজ্ঞানী মধুসূদন ও তার দল জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের এমআইআরআই যন্ত্র দিয়ে কে২-১৮বি এর বায়ুমণ্ডল পুনরায় পর্যবেক্ষণ করেন। তাদের পর্যবেক্ষণে তারা পুনরায় ডাই মিথাইল সালফাইডের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার দাবী করেন। শুধু তাই নয় বরং এর সাথে ডাই মিথাইল ডাই সালফাইড, যেটি কি না আরেকটি বায়োসিগনেচার অণু সেটির উপস্থিতি খুঁজে পাওয়ার দাবী করেন। তবে তাদের এ দাবীতে একটি কিন্তু আছে।
তারা যে দাবীটি করেছেন তা খুবই বৈপ্লবিক একটি দাবী, এটি সত্য হলে মহাবিশ্ব নিয়ে আমাদের জানাশোনা পরিবর্তন হয়ে যাবে। তাই তাদের এ দাবীর পক্ষে যে প্রমাণ দেওয়া হবে তা যথেষ্ট শক্তিশালী প্রমাণ হতে হবে। কিন্তু পরিসংখ্যানগত দিক থেকে তাদের দাবীর পক্ষে আনা প্রমাণ অতোটা শক্তিশালী নয়। তাদের প্রমাণ প্রায় ৩ সিগমা শক্তিশালী। পরিসংখ্যানে ৩ সিগমা শক্তিশালী প্রমাণ বলতে বুঝায় প্রায় ০.২৭% সম্ভাবনা আছে যে তাদের দেখানো এ প্রমাণ আসলে সঠিক নয়। এধরণের বৈপ্লবিক দাবীর জন্য বিজ্ঞানীরা সাধারণত ৫ সিগমা পরিমান শক্তিশালী প্রমাণ খুঁজেন যা বিজ্ঞানী মধুসূদন ও তার দল দিতে পারেন নি।
তাছাড়াও জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের এমআইআরআই যন্ত্র দিয়ে কে২-১৮বি এর বায়ুমণ্ডল পর্যবেক্ষণ করা এই ডাটাই পুনরায় পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানী টেইলর দেখিয়েছে, আসলে এটি ডাই মিথাইল সালফাইড নয় বরং এটি সিগন্যালের মধ্যে থাকা নয়েজ মাত্র। এ নিয়ে এখনও বিজ্ঞানমহলে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বিজ্ঞান এভাবেই কাজ করে – আত্মসমালোচনা ও নিজেদের ভুল শুধরে নেওয়ার মাধ্যমে।
তথ্যসূত্র
- কে২-১৮বি হাইসিয়ান গ্রহের পক্ষে প্রমাণ Madhusudhan, N., Sarkar, S., Constantinou, S., Holmberg, M., Piette, A. A., & Moses, J. I. (2023). Carbon-bearing molecules in a possible Hycean atmosphere. The Astrophysical Journal Letters, 956(1), L13.
- বায়োসিগনেচারের ব্যাপারে জানতে Seager, S., Bains, W., & Hu, R. (2013). Biosignature gases in H2-dominated atmospheres on rocky exoplanets. The Astrophysical Journal, 777(2), 95.
- মিরি ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে করা পর্যবেক্ষণে ডাই মিথাইল সালফাইডের অস্তিত্ব নিয়ে জানতে Madhusudhan, N., Constantinou, S., Holmberg, M., Sarkar, S., Piette, A. A., & Moses, J. I. (2025). New Constraints on DMS and DMDS in the Atmosphere of K2-18 b from JWST MIRI. The Astrophysical Journal Letters, 983(2), L40.
- ৫ সিগমা এর ব্যাপারে জানতে Lyons, L. (2013). Discovering the Significance of 5 sigma. arXiv preprint arXiv:1310.1284.
- মিরি ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে করা পর্যবেক্ষণে ডাই মিথাইল সালফাইডের অস্তিত্ব নেই এর প্রমাণে Taylor, Jake. “Are there Spectral Features in the MIRI/LRS Transmission Spectrum of K2-18b?.” arXiv preprint arXiv:2504.15916 (2025).
Leave a Reply