সম্প্রতি জাপানে মুরগির মাংস খেয়ে শতাধিক মানুষ ফুড পয়জনিং, ডায়রিয়া এবং কিডনির জটিলতার মতো গুরুতর উপসর্গে আক্রান্ত হয়েছেন। পরে পরীক্ষাগারে জানা যায়, এসব রোগের মূল কারণ একটি নতুন ব্যাকটেরিয়া ইশেরিশিয়া আলবার্টি (Escherichia albertii)। এটি ই. কোলি ব্যাকটেরিয়ার রূপান্তরিত প্রজাতি, যা মানুষের পরিপাকতন্ত্রে প্রবেশ করে গুরুতর সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো- এই জীবাণুটি অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী, এবং এটি ‘জুনোটিক’, অর্থাৎ অন্যান্য প্রাণী থেকে মানবদেহে ছড়াতে পারে।
ইশেরিশিয়া আলবার্টি একটি গ্রাম-নেগেটিভ, আণুবীক্ষণিক জীবাণু, যা Escherichia গণের অন্তর্ভুক্ত। এটি মূলত মানুষের ও অন্যান্য প্রাণীর অন্ত্রে বসবাসকারী জীবাণুদের মধ্যে একটি। এই জীবাণুটি নতুনভাবে শনাক্ত হওয়া একটি প্যাথোজেনিক (রোগ সৃষ্টিকারী) জীবাণু হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, বিশেষ করে ডায়রিয়া ও আন্ত্রিক রোগের সঙ্গে এর সংযোগ আছে বলে গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে। Escherichia albertii প্রথম শনাক্ত হয় ২০০৩ সালে। এটি মূলত নিউমোনিয়ার জন্য পরীক্ষা করার সময় একটি শিশুর নমুনা থেকে শনাক্ত করা হয়েছিল, তবে পরে দেখা যায় এটি মূলত গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্টে সংক্রমণ ঘটায়। এই প্রজাতির নাম রাখা হয়েছে বিখ্যাত অণুজীববিদ Michael J. Albert-এর নামে।
ই. আলবার্টি সাধারণত সোরবিটল গাঁজন করে না। এটিই ই. কোলি থেকে পার্থক্য করার অন্যতম উপায়। এটি শিগা টক্সিন (Shiga toxin) বা সাইটোলিথাল ডিস্ট্যান্ডিং টক্সিন (CDT- cytolethal distending toxin) উৎপন্ন করতে পারে, যা অন্ত্রের কোষকে ক্ষতি করে।)
এই সংক্রমণের খবর আন্তর্জাতিক মহলে আলোড়ন তুললেও বাংলাদেশের জন্য তা আরও ভয়ানক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জায়েদুল হাসান, জাপানি গবেষকদের সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগির ওপর গবেষণা পরিচালনা করেন।
গবেষণায় দেশের চারটি জেলা থেকে সংগ্রহ করা ১৭টি ব্রয়লার মুরগির নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ফলাফল ছিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক- সবগুলো নমুনাতেই ই. আলবার্টি ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। শুধু তা-ই নয়, এই ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমিত নমুনাগুলোর মধ্যে অধিকাংশই অন্তত একটি বা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।
গবেষণা আরো জানা যায়, শুধুমাত্র মুরগির মাংস নয় বরং ব্যবহৃত ছুরি, ব্লিডিং কোন (রক্ত ঝরানোর যন্ত্র), এবং কর্মীদের হাত থেকেও ই. আলবার্টি ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। অর্থাৎ রান্নার আগেই জীবাণুর সংস্পর্শে আসছে ক্রেতা, বিক্রেতা এবং আশপাশের পরিবেশ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও জীবাণুমুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের অবহেলা যে কতটা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে, এই গবেষণা তার-ই জোরালো প্রমাণ।
কেন ভয়ঙ্কর এই জীবাণু?
ই. আলবার্টি অন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়। এর ফলে দেখা দিতে পারে-
- ডায়রিয়া (মাঝেমধ্যে রক্তাক্ত),
- পেটব্যথা ও বমিভাব,
- জ্বর এবং দুর্বলতা,
- শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে কিডনির জটিলতা।
তবে সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো এই জীবাণুর সংক্রমণে শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জিন তৈরি হয়। আইজেএফএম- এ প্রকাশিত গবেষণা বলছে, ৯৪% ক্ষেত্রে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর হয় না এবং ৫০% স্ট্রেইন মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট। যদি এই জিন শরীরের ডিএনএ-তে প্রবেশ করে, তবে তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যেও সঞ্চারিত হতে পারে। অর্থাৎ আপনার সন্তানের জন্ম হতে পারে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জিন নিয়ে- যা চিকিৎসার জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান হুমকি
ই. আলবার্টি নিয়ে এখনো তুলনামূলকভাবে কম গবেষণা হলেও, এটি ইতোমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানিসহ বহু দেশে রিপোর্ট হয়েছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের খুচরা দোকানে বিক্রি হওয়া মুরগির মাংসের ৬৩.৯% নমুনায় ই. আলবার্টি পাওয়া গেছে।
২০১৯ সালে ইউএস সিডিসি জানায়, “ই. আলবার্টি একটি ইমার্জিং জুনোটিক জীবাণু। শিগগিরই এটি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিতে পরিণত হবে।”
একইভাবে ২০২৩ সালে লেন্সেট মাইক্রোব- এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “যদি ই. আলবার্টি- এর মতন জুনোটিক প্যাথোজেনগুলোর বিস্তার অব্যাহত থাকে এবং তা নিয়ন্ত্রণহীন হয়, তবে বৈশ্বিক অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স শুধু নীরব মহামারিই হবে না, বরং তা বংশানুক্রমে ছড়াতে থাকবে।”
সমাধান ও করণীয়
তবে চাইলেই আমরা ই. আলবার্টি-র সংক্রমণ ঠেকাতে পারব। সেজন্যে আমাদের করণীয় হলো-
- কাঁচা মুরগির মাংস ব্যবহারে ভালোভাবে ধোয়া, আলাদা কাটার ছুরি ও বোর্ড ব্যবহার, হাত ধোয়া এবং সঠিক তাপমাত্রায় রান্না নিশ্চিত করতে হবে।
- খোলা বাজারে পশু ও মাংস বিক্রির পরিবেশ, সরঞ্জাম, কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা জরুরি।
- পশু খামারে অ্যান্টিবায়োটিকের অপরিকল্পিত ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, তা না হলে এ ধরনের সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে পড়বে।
এবার একটা প্রশ্ন সবার মাথায় হয়ত ঘুরছে, যদি মুরগির মাংসে ই. আলবার্টি থাকে, তাহলে সেটা খাওয়া নিরাপদ কি না?
সহজ উত্তর হচ্ছে, সঠিকভাবে প্রক্রিয়াকরণ (ধোয়া, রান্না ইত্যাদি) না করলে খাওয়া বিপজ্জনক। তবে যথাযথভাবে রান্না করলে এই জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়, এবং খাওয়া অনেকাংশেই নিরাপদ হয়ে পড়ে। কাঁচা মুরগির জন্য আলাদা ছুরি, কাটিং বোর্ড ব্যবহার করুন। এই সরঞ্জামগুলিকে পরে গরম পানি ও সাবান দিয়ে ভালোভাবে ধুতে হবে। মাংস স্পর্শ করার পরে ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। ঠান্ডা পানি দিয়ে ধোয়া যেতে পারে, কিন্তু এতে জীবাণু পুরোপুরি ধ্বংস হয় না, বরং এটা শুধু প্রাথমিক ধাপ। কমপক্ষে ৭৪°সে. (১৬৫°ফা.) তাপমাত্রায় রান্না করুন। ফ্রাই, গ্রিল বা কারি যেভাবেই রান্না করেন না কেন, যেন ভিতরের অংশও সেদ্ধ হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। হাড়ের কাছে যদি গোলাপি রং থাকে, বুঝতে হবে মাংস পুরোটা সেদ্ধ হয়নি এবং এটা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। ফ্রিজে সংরক্ষণের সময় কাঁচা মাংস অন্য খাবার থেকে আলাদা রাখুন।
সর্বোপরি, খাবার শুধু পেট ভরানোর জন্য নয়- এটি স্বাস্থ্য, রোগ প্রতিরোধ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থতার অন্যতম স্তম্ভ। ই. আলবার্টির মতো ব্যাকটেরিয়া আমাদের কেবল তাৎক্ষণিক নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সংকটের মুখে ফেলতে পারে। এই বিপদ থেকে মুক্তি পেতে হলে চাই বিজ্ঞাননির্ভর সচেতনতা, নীতিনির্ধারকদের কার্যকর পদক্ষেপ এবং ভোক্তাদের নিজস্ব সতর্কতা। এখনই সময়, আমাদের সচেতন হবার।
তথ্যসূত্র-
- International Journal of Food Microbiology | Vol 431, 2 March 2025 | ScienceDirect.com by Elsevier
- CDC, USA: https://www.cdc.gov
- The antimicrobial resistance cube: a framework for identifying policy gaps and driving action – The Lancet
- Report signals increasing resistance to antibiotics in bacterial infections in humans and need for better data
- FAO/WHO Joint Expert Meeting on Microbial Risk Assessment, 2021
- Occurrence and cross contamination of Escherichia albertii in retail chicken outlets in Bangladesh”, International Journal of Food Microbiology, 2025 (https://bioengineer.org/surge-in-antibiotic-resistant-e-albertii-found-in-bangladeshi-poultry-retail-outlets/?utm_)
Leave a Reply